আন্দোলন ক্ষেত্রগুলিতে যৌন হেনস্থা ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার দাবি


  • May 9, 2021
  • (0 Comments)
  • 1408 Views

প্রগতিশীল সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলিতে যৌন হেনস্থার ঘটনা সাধারণভাবে বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়। একটি গোটা আন্দোলনকে নিন্দিত না করে, কীভাবে আমরা, কর্মী ও সমর্থকরা, যৌন নির্যাতন ও হিংসার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবো এই আন্দোলনগুলির ভিতরে? কেমনভাবে তৈরি হবে আন্দোলনের মধ্যে মহিলা কর্মী ও সমর্থকদের জন্য নিরাপত্তার বাতাবরণ?

 

আমরা ২৬ বছর বয়সী এপিডিআর, শ্রীরামপুর শাখার এক তরুণী কর্মীর অকালমৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর মৃত্যু হয় ৩০ এপ্রিল, হরিয়ানার বাহাদুরগড়ের একটি হাসপাতালে। পাঞ্জাব-হরিয়ানায় চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, তিনি কিষাণ সোশ্যাল আর্মি নামের একটি সংগঠনের সাথে গিয়েছিলেন টিক্রি বর্ডারে – সংহতি জানাতে। কিষাণ সোশ্যাল আর্মির কর্মীদের সাথে তাঁর কলকাতাতেই আলাপ, যখন দোসরা থেকে দশই এপ্রিল তাঁরা কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে এসেছিলেন। আমরা একাধারে তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত, অন্যদিকে, তাঁর জীবনের অন্তিম দিনগুলির কিছু ঘটনাবলী আমাদের গভীরভাবে বিচলিত করেছে।

 

তাঁর মা-বাবা ও বন্ধুদের বয়ান থেকে আমরা জানতে পারি যে, অনিল মালিক নামে কিষান সোশ্যাল আর্মির জনৈক কর্মী কলকাতা থেকে দিল্লি তথা টিক্রির দিকে যাওয়ার পথেই এই তরুণী মানবাধিকার কর্মীকে যৌন হেনস্থা করতে থাকে। যেহেতু, টিক্রি বর্ডারে ওঁর পরিচিত আর কেউ ছিলেন না, তাই এপ্রিল ১১ থেকে ১৬ পর্যন্ত উনি কিষাণ সোশ্যাল আর্মির তাঁবুতেই থাকতে বাধ্য হন। এবং সেসময় বারবার তাঁকে এই ব্যক্তির হাতে যৌন হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। ১৬ এপ্রিল আমাদের এই তরুণী-কর্মী বন্ধুটি কিছু কিছু মানুষকে এই ঘটনাবলীর কথা জানাতে শুরু করেন। তাঁরা ওঁকে অন্য একটি তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন, যেখানে অন্যান্য মহিলা কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

 

২১ এপ্রিল তাঁর অল্প অল্প জ্বর আসে ও তাঁকে টিক্রির মেডিকেল ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে, এবং তাঁর মা-বাবা ৯-সদস্য সম্বলিত কিষাণ সংযুক্ত মোর্চার কমিটির সাথে যোগাযোগ করলে, একটি গাড়িতে করে তাঁকে বাড়ি পাঠানোর অছিলায় অনিল মালিক ও অনুপ সিং চিনাউত তাঁর যাত্রাসঙ্গী হয় বলে জানা যায়। লোকেশন চিহ্নিত করে দেখা যায় যে, গাড়িটি পশ্চিমবঙ্গের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে রওনা হয়েছে হরিয়ানার হান্সির দিকে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে তাঁকে ফিরিয়ে এনে রাখা হয় ভগৎ সিংহ লাইব্রেরি ক্যাম্পে। সেখানে তাঁর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বাহাদুরগড়ের একটি হাসপাতালে, যেখানে কোভিডের প্রকোপে তাঁর মৃত্যু হয় ৩০ এপ্রিল।

 

গতকাল, ৮ মে সন্ধ্যেবেলা, মৃতার বাবা, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার সহায়তায় একটি এফ.আই.আর. দাখিল করেছেন অনিল মালিক ও অনুপ সিং চিনাউতের বিরুদ্ধে – যৌন হয়রানি ও অপহরণের অভিযোগে। স্থানীয় এস.ডি.এম.-এর কাছে প্রথমে অভিযোগ দাখিল করা হলে, তাঁর নির্দেশে এই এফ.আই.আর. করা হয়। এফ.আই.আর.টি গ্রহণ করেন বাহাদুরগড় থানার এসএইচও।

 

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এই গোটা সময়টি জুড়ে মৃতার পরিবার ও বন্ধুবর্গের সহায়তা করেছে। গত ৫ মে মোর্চার মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, কিষান সোশ্যাল আর্মির থেকে তাঁরা আলাদা হয়ে গেছেন। কিষাণ সোশ্যাল আর্মি আর প্রথাগতভাবে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার অন্তর্গত নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতেও কিষাণ সোশ্যাল আর্মি আর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার প্রতিনিধি নয়। টিক্রি বর্ডার থেকেও তাদের তাঁবুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

 

দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, এটি আন্দোলনের ভিতরে যৌন হয়রানির প্রথম ঘটনা নয়। এর আগে, ট্রলি টাইমস, এসএফএস এবং স্বরাজ অভিযান জাতীয় সংগঠনের ভিতরেও এই জাতীয় ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। একদিকে আমরা যেরকম আশা করছি, এফ.আই.আর. দাখিল করার মধ্য দিয়ে এই বিশেষ ঘটনাটির ক্ষেত্রে কোনো না কোনোরকমের ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে, তেমনি আমরা এও বিশ্বাস করি যে, আন্দোলনগুলির মধ্যে যৌন হেনস্থার ঘটনাগুলিকে সমাধান করতে পারার প্রক্রিয়া থাকা অত্যন্ত জরুরি। এযাবৎকাল আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সাধারণভাবে আন্দোলনের ভিতরকার যৌন হেনস্থার ঘটনাগুলিকে দেখা হয় একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে। কাজেই, বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হলেও সাধারণভাবে বিষয়টি নিয়ে কোনো রাজনৈতিক প্রচার বা চর্চা, আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলিতে তৈরি হয় না।

 

এই যৌন হেনস্থার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের ও কৃষক আন্দোলনের সমর্থনকারী হিসেবে আমরা দাবি তুলছি যে, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পক্ষ থেকে এই ঘটনাগুলির প্রতি এখনই পুরোপুরি মনোযোগ দিতে হবে। সাথে সাথে আন্দোলনের মধ্যে যৌন হেনস্থা, যৌন হিংসা ও পিতৃতন্ত্রজাত সমস্ত ধরনের বৈষম্যের বিরূদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। একদিকে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে আমরা যেমন নিঃশর্ত ভাবে দাঁড়িয়েছি, তেমনি আমাদের দাবি এই সমস্ত তরুণীদের পাশে সংযুক্ত কিষান মোর্চাকেও দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে, এই ক্ষেত্রে, মৃতার পরিবার ও বন্ধুদের পাশে থেকে সক্রিয়ভাবে আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সঠিক বিচার পাওয়া যায়।

 

কৃষক আন্দোলনে মহিলারা প্রথম থেকেই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, মিডিয়ার অপপ্রচার ও পিতৃতন্ত্রের নিগড় ভেঙে মহিলারা লড়াইয়ের সামনের সারিতে এসেছেন, হয়ে উঠেছেন লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাঁদের কণ্ঠস্বর ও অংশগ্রহণ বাদ দিয়ে এই তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লড়াই আজ অর্থহীন হয়ে উঠবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলিকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। আজ আমরা এই তরুণী কর্মীর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ। সাথে সাথে এও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তাঁর শেষ কয়েকদিনের যে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা, তার দায় আমাদের সকলের। তাই, নারীবাদী হিসেবে, একদিকে আমরা যেমন তাঁর দুর্দম জেদ, কৃষক আন্দোলনের প্রতি তাঁর নিঃশর্ত সমর্থন ও আদর্শবাদিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তেমনই,

 

১. আমরা সংযুক্ত কিষান মোর্চাকে আহ্বান জানাই, আন্দোলনের ক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে একটি সর্বজনীন বক্তব্য ও প্রতিবেদন হাজির করতে;

 

২.আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলিতে একটি চব্বিশ ঘন্টা হেল্পলাইনের ব্যবস্থা রাখতে, যেখানে অভিযোগকারিণীরা সমর্থন, সহায়তা ও অবলম্বন পেতে পারেন। একই সাথে, এই বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে একটি কমিটি গঠনও আশু প্রয়োজন;

 

৩. তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবির সাথে সাথে আন্দোলনের ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্র ও সার্বিক ভাবে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে, যে কাজে সহায়তা করবেন ট্রেড ইউনিয়ন, কিষাণ সংগঠন ও অন্যান্য গণ সংগঠনগুলিও।

 

ক্রোধে ও সংহতিতে ঐক্যবদ্ধ:

১. ফেমিনিস্টস ইন রেসিস্টেন্স, কলকাতা
২. হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের যৌন নির্যাতনের শিকার কয়েকজন
৩. উইমেন এগেইনস্ট সেক্সচুয়াল ভায়োলেন্স (ডাবলুএসএস)
৪. ফোরাম এগেইনস্ট অপরেশন অফ উইমেন, মুম্বাই
৫. পিঞ্জরাতোড়
৬. সহেলী, নিউ দিল্লি
৭. শ্রমজীবী মহিলা সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ
৮. বেকুফ আজাদী
৯. সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (আইপোয়া)
১০. সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি
১১. ওয়াজুদ, পাঞ্জাব
১২. বেবাক কালেকটিভ
১৩. জন সংঘর্ষ মঞ্চ, হরিয়ানা
১৪. পশ্চিম বঙ্গ ক্ষেতমজুর সমিতি
১৫. প্রগতিশীল মহিলা একতা কেন্দ্র
১৬. মজদুর অধিকার সংগঠন, হরিয়ানা
১৭. স্ত্রী অধিকার সংগঠন, উত্তর প্রদেশ
১৮. ফ্রি স্পীচ কালেক্টিভ
১৯. আওয়াজ-এ-নিসোয়ান, মুম্বাই
২০. বেশ্যা অন্যায় মুক্তি পরিষদ, মহারাষ্ট্র
২১. ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অফ সেক্স-ওয়র্কার্স
২২. বিদ্রোহী মহিলা মঞ্চ, মহারাষ্ট্র
২৩. মধ্য প্রদেশ মহিলা মঞ্চ
২৪. স্ত্রীমুক্তি সংগঠন, মহারাষ্ট্র

২৫. নারী চেতনা

 

 

ইমেইল – againstsexualviolence@gmail.com

দূরভাষ – ৯৪৩৩৭৩১২০৬, ৯৮১০২০১৩৬৯

 

To read the English version of the statement see

Strengthening our Struggles through Zero Tolerance to Patriarchal Violence

Share this
Leave a Comment