‘রাম নাম সত্য হ্যায়!’


  • April 22, 2021
  • (0 Comments)
  • 2379 Views

সঙ্কট যত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর বাগাড়ম্বর তত মাত্রা ছাড়ায়। তাঁর শূন্যগর্ভ ভাষণে না থাকে সঙ্কট নিরাময়ের কোনও দিকনির্দেশ, না থাকে দুঃখে-শোকে-সন্তাপে দয়ার প্রলেপ। কী প্রচণ্ড সঙ্কট হলে দিল্লি হাইকোর্টকে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে বলতে হয়, “ভিক্ষা করুন, ধার করুন, চুরি করুন কিন্তু অক্সিজেন জোগাড় করতেই হবে।” লিখছেন দেবাশিস আইচ

 

৫৬ ইঞ্চি খাঁচাটি যে হিংসা, দ্বেষ আর বণিকের বর্বর লোভে ভরা লোহার সিন্দুক — এ কথা স্পষ্ট করে বলাটা, বার বার বলাটা, নানা মাত্রায়, নানা ভাষায় বলাটা জরুরি। ওই খাঁচাটির অধীশ্বর এক সিংহহৃদয় বিক্রমপুরুষ — এমনই এক চূড়ান্ত মিথ্যা বহুকাল ধরেই নির্মাণ করা হয়েছে। বার বার তা ভেঙে পড়েছে, বার বার তার পুনর্নির্মাণে আদাজল খেয়ে নেমেছে কর্পোরেট-রাষ্ট্রের ধামাধরা প্রচারকরা। চা-ওয়ালা থেকে ভারতগুরু — এ এক সচেতন নির্মাণ। এক প্রচণ্ড প্রতারণা। দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে, স্বাস্থ্য সঙ্কটকে কীভাবে বেচে খেতে হয়, কীভাবে উপচে তুলতে হয় মুনাফার সিন্দুক, বলের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে হয় সব প্রতিবাদ — তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণগুলি সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ কথা আমরা বার বার বলে চলেছি। এই পাঁচদিন আগেও আমরা বলেছি, “… আবারও এসেছে সঙ্কটকালের সেই সুবর্ণ সুযোগ। নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ভাবছেন এই সঙ্কটকে সুযোগে বদলে দেওয়ার।… বিপর্যয়-ধনতন্ত্র এই সুযোগ আঁকড়ে ধরবেই। মোদী-ফান্ডের টাকায় বেশি দামে ভ্যাকসিন কিনে বেচেছে দেশ-বিদেশে। আর বিগত তিনমাসে টিকাকরণ হয়েছে মাত্র দেশের সাত শতাংশ অর্থাৎ ১৩৬ কোটির দেশের ১২ কোটি মানুষের। এ নাকি ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি! দুর্নীতি নয়, স্ক্যাম নয়, সিন্ডিকেটবাজি নয়!” (আত্মঘাতী বাঙালি, গ্রাউন্ডজিরো, ১৮ এপ্রিল ২০২০।

 

সঙ্কট যত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর বাগাড়ম্বর তত মাত্রা ছাড়ায়। তাঁর শূন্যগর্ভ ভাষণে না থাকে সঙ্কট নিরাময়ের কোনও দিকনির্দেশ, না থাকে দুঃখে-শোকে-সন্তাপে দয়ার প্রলেপ। থাকবেই বা কী করে! ওই খাঁচায় যে রক্তমাংসের মানুষের অস্তিত্বই নেই। হাজারো মানুষ, মানুষের তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদ হিংসার আগুনে নিঃশেষ হওয়ার পরও যাঁরা পেশাদার ঘাতকের মতো অবিচলিত, তাঁদের কাছে মনুষ্যত্ব আশা করাই বৃথা। সঙ্কট কোথায় পৌঁছলে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আদালতে ছুটে যেতে হয়! বলতে হয়, সরকারের দুয়ারে দুয়ারে মাথা কুটে মরছি, অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে, রোগীদের বাঁচান। কী প্রচণ্ড সঙ্কট হলে দিল্লি হাইকোর্টকে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে বলতে হয়, “ভিক্ষা করুন, ধার করুন, চুরি করুন কিন্তু অক্সিজেন জোগাড় করতেই হবে।” কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী কোথায়? তিনি কি বাংলার শেষ দুই পর্বের নির্বাচনী ভাষণের চূড়ান্ত রূপ দিতে ব্যস্ত? কোথায় দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? তিনি আজ বৃহস্পতিবার এই মুহুর্তে রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে বিভাজনের রাজনীতির বিষ ছড়াচ্ছেন। তবে, তাঁর তিনটি সভার মধ্যে একটি সভাই করেছেন অমিত শাহ। তাঁর দক্ষিণ দিনাজপুর সভার মাঝেই রাজ্যে কোভিড পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে, নির্বাচন কমিশনকে দায়ী থাকতে হবে বলে কলকাতা হাইকোর্টের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বাকি দুটি সভা বাতিল করা হয় বলেই মনে করা হচ্ছে। শেষ বিকেলে জানা গিয়েছে রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর ২৩ এপ্রিলের চারটি সভাই বাতিল করা হয়েছে। দিল্লি ও কলকাতা হাইকোর্টের তীব্র র্ভৎসনায় বোধহয় সংবিৎ ফিরেছে কেন্দ্রের।

 

কিন্তু, কেন নেই অক্সিজেন, কেন দুর্মূল্য রেমডেসিভিয়ার ইঞ্জেকশন, কেন সাধারণকে কিনতে হবে প্রতিষেধক টিকা? এই তো সেদিন, বিহার নির্বাচনের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে, আদর্শ নির্বাচন বিধি শিকেয় তুলে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, জিতলে সমস্ত বিহারবাসীকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হবে। কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? মানুষ যখন দমবন্ধ হয়ে মরছে, ওষুধ বিকোচ্ছে আগুন মূল্যে, খুলে দেওয়া হয়েছে টিকার বাণিজ্যিক বাজার, তখন জানা গেল — গত বছর জানুয়ারি মাসে ভারত যেখানে ৩৫২ মেট্রিক টন অক্সিজেন রপ্তানি করেছিল, চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা বেড়েছে ৭৩৪ শতাংশ। শুধু ডিসেম্বরেই কেন্দ্র ২হাজার ১৯৩ মেট্রিক টন অক্সিজেন রপ্তানি করেছে। গত বারের তুলনায় যা ৩০০ শতাংশ বেশি। এ সরকারি হিসেব। সাধারণ ভাবে বছরে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন অক্সিজেন রপ্তানি করা হয়। এই করোনা সঙ্কটের কালে, ২০২০-২১ সালে রপ্তানি হয়েছে ৯৩০০ মেট্রিক টন। কংগ্রেসের অভিযোগ, বিগত কয়েক মাসে ভারত ৬.৫ কোটি ডোজ প্রতিষেধক টিকা, ১১ লক্ষ রেমডেসিভিয়ার ইঞ্জেকশন, ২কোটি টেস্টিং কিট রপ্তানি করেছে। কী ভয়ংকর মুনাফা লোলুপতা! কী বর্বর লোভ! এই যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করে, তিন কৃষি আইন বাতিল করার জন্য আন্দোলনরত কৃষকেরা মোদী সরকারকে ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-রাজ বলে অভিযুক্ত করে — তা যে নিছকই মিথ্যা নয়, তা এই সময়, এই দেশের বাণিজ্যিক নীতি থেকেই স্পষ্ট। আজ ভ্যাকসিন আমদানি করতে হচ্ছে। অক্সিজেন আমদানির জন্য দরপত্র খুলতে হয়েছে। এই সরকারকে, সরকারের নীতি নির্ধারকদের কেউ যদি পাষণ্ড বলে, তবেও বুঝি কম বলা হবে।

 

অথচ, বছরের শুরুতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের আভাস মিলছিল। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতেই ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের ডেটা বেস ইঙ্গিত করছিল মিউট্যান্ট স্ট্রেনে (SARS-CoV-2) আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্য রোগীর শয্যা, অক্সিজেনের অপ্রতুলতার বিপদ সংকেত পাঠাতে শুরু করে কেন্দ্রকে। কে শোনে কার কথা! সেপ্টেম্বর থেকেই তো আমরা ‘করোনা জয়ী’, ‘করোনা জয়ী’ বলে উদ্বাহু নেত্য শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মাথায় তখন আসন্ন নির্বাচন। বিহার-সহ পাঁচ রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে দখলের মরিয়া স্বপ্নে মশগুল বিজেপি। একটি বছর সময় পেলেও হাসপাতালে হাসপাতালে গড়ে তোলা হয়নি ঘোষিত অক্সিজেন প্ল্যান্ট।

 

বিহার জয় হয়েছে। তিন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভোট পর্ব শেষ হয়েছে ৬ এপ্রিল। এই কলম যখন লিখছি, তখন ২২ এপ্রিল ষষ্ঠ দফার ভোট চলছে এই রাজ্যে। আরও দু’দফা বাকি। ২১ এপ্রিলের স্বাস্থ্য দপ্তরের বুলেটিন বলছে, রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। সংক্রমণের হার ২১.৫৬ শতাংশ। কলকাতায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ২,৫৬৮ জন। এর পরেই উত্তর ২৪ পরগনা, সংক্রামিত হয়েছেন ২,১৪৯ জন। এই দুই জেলা-সহ মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূমের ৭১টি আসনের জন্য ভোট হবে ২৬ ও ২৯ এপ্রিল। বিদায়ী শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের তিন দফা ভোট একদিনে বা দু’দফা একদিনে করার আবেদন ফিরিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বিজেপি ও সংযুক্ত মোর্চার কাছেও এই আবেদন যৌক্তিক মনে হয়নি। ইতিমধ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে রাজ্যে অক্সিজেনের চাহিদা দ্বিগুণ হয়েছে বলে খবর। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোভিড টেস্ট, হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে হয়রানির অভিযোগ। নির্বাচন শেষে রাজ্যের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভেবে এখনই শিহরিত চিকিৎসক মহল।

 

এমনই ছবি দেখা গিয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দেশে যখন করোনা সংক্রমণ বাড়ছে প্রধানমন্ত্রী তখন ব্যস্ত গুজরাতে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠান নিয়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যস্ত মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সরকারের বিধায়ক ভাঙিয়ে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। শেষ পর্যন্ত একধাক্কায় দেশকে লকডাউনে বন্দি করে কোটি কোটি মানুষকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল অন্ধকূপে। আজ দ্বিতীয় ঢেউ ঢের বেশি সংহারক হয়ে দেখা দিয়েছে। পূর্ণ লকডাউন দূরে থাক, আধা-লকডাউনও দেশের অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিতে পারে। অথচ আরও বেশি সংহারক ‘ট্রিপল মিউট্যান্ট’-এর হদিশ মিলতে শুরু করেছে। এ এমনই এক সময় যখন দেশের রাজধানী, বাণিজ্যিক রাজধানী, ধনী শহরগুলিতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে। ‘জয় শ্রীরাম’ রণহুঙ্কার ছাপিয়ে গিয়েছে শববাহকদের ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ হাহাকারে।

 

অথচ, চোখের পাতাটি পড়ে না। বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ পীড়া দেয় না। একের পর এক ভোটসভায় অনুতাপহীন বাগাড়ম্বরের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন মোদী-শাহ-যোগী বাহিনী। আর সেই পুরো সময়টি ধরে গুজরাত থেকে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকে ছত্তিশগড়ে ছড়িয়েছে প্রবল সংক্রমণ। কী নির্দয় এই শাসককুল! কী ভয়ংকর তাদের কর্তৃত্ববাদ। ক্ষমতা লিপ্সার এই মদমত্ততা, এই সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপনার লালসাকেই তো ফ্যাসিজম বলে।

 

Share this
Leave a Comment