একুশের ভোট, জনতা জনার্দন, ফ্যাসিবাদ ও বামেরা কী করিতেছেন?


  • April 16, 2021
  • (0 Comments)
  • 1454 Views

যে যে পরিমাণে বামপন্থীরা হীনবল ও পথভ্রষ্ট হয়েছেন, সেই সেই পরিমাণে পুঁজিতন্ত্র সমাজের সর্বস্তরে শিকড় গেড়েছে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভূগোল ছাড়িয়ে ঢুকে এসেছে মানুষের চৈতন্যের সূক্ষ্মতম প্রকোষ্ঠে। পুঁজিতন্ত্রের তৈরি করা দর্শন, শাসকদের মতাদর্শ বা আইডিওলজি ক্রমে সমাজগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে, বামপন্থার দর্শন এবং সেই দর্শনপ্রসূত প্রয়োগ পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। লিখেছেন সৌমিত্র ঘোষ। 

 

 

মোদীজি উবাচ

মাথায় গোর্খা টুপি লাগিয়ে মোদীজি শিলিগুড়ির কাছে কাওয়াখালিতে নির্বাচনী বক্তৃতা করছিলেন। উপগ্রহ, টেলিভিশন ও ফোন মারফত সেই বক্তৃতারত, গোর্খাটুপি শুভ্রশ্রশ্রু, শুভ্রকেশ সন্তযথা মোদীজির ছবি লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছিল। মোদীজি কী বলছেন ভোটপ্রচারে তা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ততটাই তাঁর সাংখ্য অর্থাৎ ডিজিটাল অবতার: কথা-শব্দ, অঙ্গভঙ্গি, সুর, রঙ, ছবি। সব মিলিয়ে প্যাকেজটি অব্যর্থ, যে দেখে সে-ই মজে, হর হর মোদী মোদী নামগান করতে করতে পদ্মবোতাম টেপে। মোদীজি কামাল কি পারফর্মার। এবারের একুশে ভোটে তিনি কী কায়দায় ‘দিদি-ই-ই’ বলছেন তা নিয়ে গবেষণা চলছে, এবিপি ডিজিটাল হিসেব করে দেখেছে দু’দিনের বক্তৃতায় মোদীজি মোট ১২৬ বার দিদি বলেছেন। মোদীজি আরো বক্তৃতা দেবেন, গোর্খাটুপি বদলে পাগড়ি গামছা বা অন্য কিছু হবে, আরো ছবি কুলুকুলু রবে টিভি ও ফোন-পর্দায় আছড়াবে।

 

জনতা জনার্দন

এ লেখাটা যারা পড়ছেন, পড়বেন, এসব জানেন। মোদী যা বলছিলেন তার ভিতরে একটি কথা কানে (কান মানেই মরম) লাগল। জনতা জনার্দন। মোদী এবং তদচ্যালারা নিয়ম করে বলে থাকেন, নতুন কিছু নয়। তবে সেদিনের পরিপ্রেক্ষিত কিছু আলাদা ছিল। সবে সকালবেলা কেন্দ্রীয় সিপাইরা শীতলকুচিতে জনাচারেককে গুলি করে মেরে ফেলে দিয়েছে, আরো কয়েকজন আহত। মোদী বলছিলেন, সব দিদির চক্রান্ত, যে জওয়ানরা আমাদের জানমাল অহোরাত্ৰ নিজেদের জীবন বাজি রেখে বাঁচাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দিদি লোক খ্যাপাচ্ছেন। এসবের জবাব হবে, মোদী বললেন। কে জবাব দেবে? জনতা জনার্দন। মানে কী? জনতাই জনার্দন, মানে ঈশ্বর। দিদির চক্রান্ত জনতারূপী ঈশ্বর ঠান্ডা করে দেবেন। দেবেন কি দেবেন না? লোক অর্থাৎ জনতা জনার্দন বলল হ্যাঁ। জোরসে বলিয়ে! আরো জোরে হ্যাঁ এবং জয় শ্রী রাম। প্যাকেজ শেষ করে মোদিজীর ছবি সংখ্যাব্রহ্মে লীন হয়ে গেল। পরের বক্তৃতায় পরের ছবি জন্মাবে ও আরো জনার্দন জনতা।

 

এই খেলা (বা লীলা) থেকে গুটিকতক শিক্ষণীয় আছে। এক, মোদীজি, তদচ্যালাবর্গ ও তদীয় সঙ্ঘ যা করেন সব জনতা ঈশ্বরের নামে। জনার্দনকৃপা না থাকলে তারা হুদো হুদো ভোট পেয়ে জিততে পারেন না। আর জিতে যখন গেছেনই, তাঁদের দল, সরকার এবং দল ও সরকারচালিত রাষ্ট্র যা করবে, সবটাই জনার্দনেচ্ছা, সেসব নিয়ে কথা হবে না। খামোখা কিছু গরিব মানুষকে কোতল করা হলো, জনার্দন। কোমরের ওপরে বুকে পেটে গুলি করা হলো, জনার্দন। রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী শীতলকুচি যেতে চাইলেন, নির্বাচন কমিশন তাঁর কোচবিহার জেলায় ঢোকা বারণ করে দিল। কিছু বলা যাবে না, জনার্দন। জনার্দনকৃপায় মোদীজি ও তাঁর লোকজন যা ইচ্ছে করতে পারেন, শীতলকুচি-কাণ্ডের অব্যবহিত পরের দিনই দিলীপ ঘোষ মশাই জানালেন, দুষ্টুমি বরদাস্ত করা হবে না, দুষ্টু লোক দেখলেই গুলি চলবে। এর আগেপরে ওদের দলের আর একজন মাতব্বর, সায়ন্তন বসু কেন্দ্রীয় সিপাইদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, পায়ে নয়, গুলি করতে হবে বুকে, এবং এখন চার মরেছে, পরে ষোলো মরবে। রাহুল সিনহা বললেন, সিপাই ব্যাটারা বজ্জাত, চার কেন আটটাকে ফেলা দরকার ছিল। একুশের ভোট যত এগুচ্ছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসছে, কেন্দ্রীয় সিপাইরা সংখ্যালঘু ভোটারদের ভয় দেখাচ্ছে, ভোট দিতে বাধা দিচ্ছে। সব চলতেই থাকবে, জনার্দনেচ্ছা। জনতা জনার্দন। যারা মোদীর সভায় ভিড় করেন, অমিত শাহের ‘রোড-শো’ য় হর হর মহাদেও ধ্বনি তোলেন, প্রার্থীর মাথায় বাঁশের বাড়ি মারেন এবং ভিন্নধর্মীয় ভোটারদের পাকিস্তানি বলে গাল দেন, সেই জনতা, সুতরাং অতএব, জনার্দন। যা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছায়।

 

আসলে কী হচ্ছে? জনার্দনতত্ত্বের অমোঘ প্রয়োগ মারফত সংসদীয় গণতন্ত্রের পুরো প্রক্রিয়াটিকে বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুরা আধিপত্যবিস্তার ও সাম্রাজ্যবিজয়ের মূল কাজের অধীন করে ফেলছে। আপনার, আপনার দলের সঙ্গে জনতা আছে, যে জনার্দন এবং যে বোতামে আঙুল ফেলে আপনাকে পাঁচ দশ পনেরো বছরের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাবে। না জিতলেও পরোয়া নেই, অন্য দল ভাঙিয়ে লোক জোগাড় হবে, সরকার বানানো হবে ঠিক, আসমুদ্রহিমাচল তালি ও থালিবাদ্যে স্বাগত জানাবে, যাবতীয় বিরোধীস্বর নিশ্চিহ্ন করে, নানান কিসিমের লুটতরাজ চালিয়ে, আপনি জনার্দনেচ্ছা পালন করতে থাকবেন।

 

ভোটধর্ম

ভোট বিষয়টাকে যে বিজেপি-আর এস এস ধর্মীয় আনুগত্যে পালন-লালন করে, তা এমনি নয়। বিজেপি-আর এস এস-এর সমর্থক ও সম্ভাব্য ভোটারদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হচ্ছে, ওহে, পদ্মে ছাপ দাও, মোদীকে ভোট দাও, কেননা সেটি ধর্ম। উল্টোদিকে যে বা যারা, সাক্ষাৎ অধর্ম। শিলিগুড়ির যে বক্তৃতার কথা বলছিলাম, সেখানে অনেকক্ষণ ধরে মোদী ধর্ম-অধর্ম বোঝালেন। সরল ভাষ্য: মোদীর দল জনতা জনার্দনকে মানে। জনতা জনার্দন ভোট দিয়ে মোদীর দলকে ক্ষমতায় এনেছে। সুতরাং মোদীর দল যা বলে ও করে তা ধর্ম। তার বিরোধিতা করা অধর্ম। সুতরাং হে সমবেত ভোটারকুল, যারা ছাউনির তলায় ও ডিজিটালবিশ্বে এই ভাষণ শুনিতেছ, সত্বর অধর্ম বিধর্মকে ছুঁড়িয়া ফেলো, ভোট দাও, ধর্ম পালন করো। তুমি ভোটার, সুতরাং তুমি ঈশ্বর, তোমার ইচ্ছাই সব, আমি মোদি নিমিত্তমাত্র।

 

মোদীর ভাষণ ও শাহের রোড-শো, দিলীপ ঘোষ ইত্যাদির অনর্গল কুকথা, শুধু এইটুকু দিয়ে গণতন্ত্রধর্ম তৈরি হচ্ছে, তা নয়। ভোটারমাত্রই যদি জনতা জনার্দন হন, তাহলে খুব মুশকিল, তৃণমূলকে বা অন্যদের যাঁরা ভোট দিচ্ছেন, তাঁরাও তাহলে ঈশ্বর, এবং তাঁদের আদেশ পালনীয়। এটি কোন হালতে অ্যালাউ করা যায় না, সুতরাং এমন একটি অবস্থা তৈরি হোক, যেখানে অসলি জনতা জনার্দনের রমরমা, উল্টোদিকে ভোটারমাত্র নেই। ২০১৯-এর ভোটে রাজ্যে রাজ্যে বুথে বুথে এমন হয়েছিল, সবাই হাঁ করে দেখেছেন। উনিশ একুশ নয় এবং এবার রাজ্যের ভোট, সে গোলমেলে গল্প সিটে সিটে বদলায়। ফলে অন্তত এমন করা হোক, যাতে উল্টোদিকের ভোটার সংখ্যা কমে আসে। সংখ্যালঘু ভোট বিজেপিতে যাবে না। তাদের ভোটবুথে আসা কম করার চেষ্টা করা হোক, ভয় দেখিয়ে, সন্ত্রাস চালিয়ে। রাষ্ট্রশক্তিকে চূড়ান্তভাবে ব্যবহার করা হোক।

 

পারসেপশান কি চমৎকার!

যদি তাতেও কাজ না হয়, ‘পারসেপশানে’র খেলা চলুক। সেটি কিরকম? সাংখ্যবিশ্বে যে মিডিয়া চরে বেড়ায়, বিস্তর টাকা ছড়িয়ে, প্রয়োজন মতো ভয় দেখিয়ে তাদের গলায় ঘন্টি বাঁধা হোক, অধর্মপথে গেলেই টিং করে বাজবে। একুশে বাংলায় যারা বঙ্গমিডিয়া দেখছেন, সবাই জানেন, হাতেগোনা দু-একটি চ্যানেল বাদ দিলে, বাকি সবকটি টিভি চ্যানেল কী অপূর্ব ও সমসত্ব কায়দায় জনতা জনার্দন নির্মাণে ব্যস্ত। ভোটপ্রচার দেখানো হচ্ছে চার বেলা। পর্দা দুই, তিন, চার ভাগ। একটা টুকরোয় তৃণমূল নেত্রী বা তাঁর ভাইপো (অন্য কাউকে দেখানো হয় না, অন্য দল তো দূরস্থান) কিছু বলছেন, বা মুখ নাড়ছেন, কথা শোনা যাচ্ছে না। অন্য টুকরোগুলোয় মোদীর বক্তৃতা কিম্বা শাহের/নাড্ডার রোড-শো। প্রথম টুকরোয় শুধু বক্তাকে দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় টুকরোয় রাস্তাভর্তি ও সভাস্থলভর্তি লোক, মাথা গোনা যায় না। ক্যামেরা আগুপিছু করছে, ডাইনে বাঁয়ে ঘুরছে, আরো লোক, আরো গেরুয়া, আরো হর হর মহাদেও ও জয়শ্রীরাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা এইসব দেখানো হচ্ছে, একজন মোদী একজন শা মুহূর্তে লক্ষ কোটি স্মার্টফোন ও টিভি মারফত জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিরাজমান, তৎসহ অমিত মালব্য এবং তাঁর আইটি সেল, লক্ষ লক্ষ ভাগওয়া ভিডিও ধূপের গন্ধের মতো দিকবিদিকে উড়ে যাচ্ছে, যার মোদ্দা কথা, আসছে আসছে বিজেপি আসছে, আসছে মানে আসছেই, না এলে দেশ পাকিস্তান। বিজেপি-আরএসএস-এর ছক অনুযায়ী, প্রচার যত তীব্র ও সর্বত্রগামী, জনতা জনার্দন তত সক্রিয়। সেই সক্রিয়তার মানে এই নয়, সবাই পদ্মছাপ মারবেন। ছাপ মারা তো ভোটের দিন। তার আগেই এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে কারুর মনে কণামাত্র সংশয় না থাকে যে ভোটে বিজেপি জিতছেই। মোদি-শাহ বলতে থাকবেন, লোগোনে মন বনা লিয়া, ভোট শেষ হবার আগেই বলে দেওয়া হবে ঠিক কত আসনে বিজেপি জিতছে, এবং এই যা যা বলা হবে তা মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া মারফত বর্ধিত বিবর্ধিত হতেই থাকবে। এতদ্বারা যা তৈরি হবে তা ‘পারসেপশন’, বহু মানুষ, অর্থে ভোটার, একসঙ্গে বিশ্বাস করতে থাকবেন, হচ্ছে হচ্ছে পরিবর্তন হচ্ছেই। পারসেপশনের এই খেলাটি বেড়ে চমৎকার। দিনরাত আপনি নানান কায়দায় জনতা জনার্দন করে যাচ্ছেন, ফুৎকারে বিরোধীপক্ষ ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। আসলে হচ্ছে না, তারাও রাস্তায় নেমে চেল্লামেল্লি করছে, ভিড়ও জোটাচ্ছে, হয়তো ভোটের বাক্সে তারা আদৌ পদ্মবোতাম টিপবে না, কিন্তু তাতে কি যায় আসে? তারা মিডিয়ায় নেই, সুতরাং তারা পারসেপশনেও নেই, অর্থাৎ কার্যত নেইইই।

 

জনতা জনার্দনের কালে, সাংখ্য প্রযুক্তির অবিরল প্রয়োগ মারফত, ‘আসল’ তা, যা খুব জোরে, অনেকে মিলে চিৎকার করে বলা হতে থাকে। যা বলা হয় না, বা হলেও শোনা যায় না, তা আসল নয়। ইতিপূর্বে গ্রাউন্ডজিরোয় একটি লেখায় বলেছি, এই খেলাটি বস্তুত ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের, নির্জলা মিথ্যাকে স্রেফ গলার জোরে, সঙ্ঘশক্তি, পুঁজি ও প্রযুক্তির সাহায্যে বহু বহু গুণ বাড়িয়ে, ফ্যাসিবাদ নয়াসত্য নির্মাণ করে। বিজেপি-আর এস এস এই সময়ের ফ্যাসিস্ত, তারা তাদের মতো খুচরো ও পাইকারি সত্য তৈরি করবে, এটা ধরে নেওয়া যায়। ফ্যাসিস্তদের হাতে অপরিমিত পুঁজিশক্তি থাকবে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা উদ্যোগী ও দক্ষ হবে, এটিও নতুন কথা নয়। যা নতুন তা হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের পাশ্চাত্য ধারণা ও ধাঁচাকে সঙ্ঘ কায়দার হিন্দুত্ব জারকে চুবিয়ে নেওয়া, ভোটার,  ইভিএম, মিডিয়া ও ভোটপ্রচার ইত্যাদি নেহাতই কেজো মেঠো বিষয়গুলোকে দু-চারটি গীতার বাণী আউড়ে ধর্ম-অধর্মের দ্বিত্বের খোপে ঢুকিয়ে দেওয়া। প্রথমাবধি, বিজেপি-০২তে, অর্থাৎ মোদী-শাহ জমানায়, এই ‘গণতান্ত্রিক’ ধর্মের ধারণাকে সামনে রাখা হয়েছে। মোদী যে ২০১৪-য় সংসদ ভবনে ঢুকতে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন, তার কারণও এই। সঙ্ঘ হিন্দুত্বের একটা মেরু যদি রামমন্দির হয়, দ্বিতীয়টি সংসদমন্দির। অধুনা দাড়িচুল লম্বা করে মোদীজি সেই মন্দিরের প্রধান সন্ত/মহন্ত, আপত্তি করলে গর্দান যায়।

 

জনতা জনার্দন ও ফ্যাসিবাদ

সংসদমন্দিরের প্রধান সন্ত হিসেবে মোদী যে জনতা জনার্দনকেপূজা করবেন, এতে গড়বড় নেই। জনার্দনার্শিবাদ না থাকলে ভোটে জেতা যায় না, ভোটে না জিতলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা যায় না। রাষ্ট্ৰ ক্ষমতায় না এলে পুঁজিতন্ত্রের সাঙাতগিরি করে মিডিয়া ও ডিজিটালবিশ্বের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা যায় না, না করলে দিকে দিকে ডাবল ইঞ্জিনের বিরোধীশূন্য সরকার হয় না, এবং জনতা জনার্দন বস্তুত হাপিস হয়ে যায়। এ সময়ের ফ্যাসিবাদে গণতন্ত্র, অর্থাৎ সর্বশক্তিময় জনতা জনার্দনের ধারণা (এবং ছবি), কেন্দ্রীয় ভূমিকায়, ট্রাম্প-বলসানেরো-এর্দোগান আদির কাজকর্ম দেখলে তা দিব্য মালুম হয়, সঙ্ঘমার্কা ফ্যাসিবাদে অন্য কিছু হবার কথা নয়। জনতা, প্রবল-প্রচণ্ড-রাস্তায়-ভিড়-করে-থাকা-জনতা জনার্দনরূপে এই ফ্যাসিবাদ সম্ভব করে তোলে। গণতন্ত্র, অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে আজকের ফ্যাসিবাদ দাপিয়ে বেড়ায় না। উল্টে তা গণতন্ত্রের আঁশে, রোঁয়ায়, রক্তমাংসে ওতপ্রোত, গণতন্ত্র না থাকলে ফ্যাসিবাদ জন্মায় না, বাঁচেও না। এ কথাটাও আগে বলার চেষ্টা করেছি, আবারও করা দরকার বিবেচনায় এত কথা বলা।

 

ওপরে এতক্ষণ যা বলা হলো, চুম্বকাকারে নিম্নরূপ দাঁড়ায়:

 

১) সঙ্ঘমার্কা দিশি ফ্যাসিবাদ এ সময়ের ফ্যাসিবাদ এবং ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের অনুসারী, তা বিভিন্ন মিথ্যাকে চূড়ান্তভাবে বিবর্ধন করে ‘একটিই’ সত্য নির্মাণ করে।

 

২) একুশে ভোটে বাংলা দখলে দিশি ফ্যাসিস্তরা মরিয়া। অপরিমিত পুঁজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে, স্থানীয় বৈদ্যুতিন মিডিয়ার প্রায় পুরোটা দখল করে ফ্যাসিস্তরা এক সাধারণ ধারণা বা ‘পারসেপশান’ নির্মাণ করছে, যেখানে বিরোধীপক্ষের কোনও জায়গা নেই।

 

৩) এই ‘পারসেপশানের’, অর্থাৎ ফ্যাসিস্ত নির্মিত একটিই ‘সত্যের’ নির্যাস: বাংলার জনতা মনস্থির করে ফেলেছেন, ভোটে বিজেপিকে জেতাবেন। জনতাই যেহেতু ঈশ্বর, এই সত্যের যে বিরোধিতা করে সে অধর্মের পোষণ করে।

 

৪) যেহেতু জনতা জনার্দন রায় দিয়ে ফেলেছেন, এবং ভোটযুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ, যে কোনও উপায়ে হোক, এই যুদ্ধ জিততে ফ্যাসিস্তরা বদ্ধপরিকর। প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রশক্তির বলগাহীন ব্যবহার করতে হবে, কেন্দ্রীয় বাহিনী সম্ভাব্য বিরোধী ভোটারদের সন্ত্রস্ত করবে, দরকার হলে গুলি চালাবে। রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত স্তরে, যাবতীয় প্রচলিত রীতিনীতি লঙ্ঘন করে, নির্বাচন কমিশন মারফত কেন্দ্রীয় শাসন চালু করা হবে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি প্রকাশ্য সভায় বুক ফুলিয়ে বলবেন, দরকারমতো শীতলকুচি-কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। বিজেপির যাবতীয় নেতারা সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলতেই থাকবেন।

 

৫) ১-৪এ যা বলা হলো, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল ধারণার বিরোধী নয়। বরং, আজকের ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের প্রচলিত ধারণাকে বিস্তৃততর করে ও গণতন্ত্র থেকে পুষ্ট হয়। ‘জনতা’-কে কেন্দ্রে রেখে, ‘জনতা’-র নামে ও নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, আধিপত্যবিস্তার করে।

 

ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্র

যা বলা হলো এতক্ষণ, তার সবটা না হলেও অনেকটাই আগে বলা। ধরে নেওয়া যায়, এই লেখার পাঠকেরা ফ্যাসিপন্থী হবেন না, সুতরাং ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে তাঁরা কমবেশি ওয়াকিবহাল। ফ্যাসিবাদ কী ও কেন, তাঁদের নতুন করে বলার দরকার নেই। তবু বলতেই হলো। কারণ, গণতন্ত্র অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে ফ্যাসিবাদকে আলাদা করে দেখার একটা ঝোঁক চিরকাল ছিল, আজও আছে। যেন সংসদীয় গণতন্ত্র বিষয়টি পবিত্র ও সত্য, ফ্যাসিবাদ বিজাতীয় দস্যু বা বর্গী হানাদার, তা থাকা মানে গণতন্ত্র গেল। বিজেপি সরকার ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত যা যা করেছে, তার সবকটায় গণতন্ত্র বিপন্ন বলে পরিত্রাহী রব উঠেছে। অথচ, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, বিজেপির সরকারি কাজের মধ্যে কোনটা গণতন্ত্রবিরোধী? যা যা করা হয়েছে, সব সংসদের অধিবেশন ডেকে। সে অধিবেশনের ধরণধারণ আপনার পছন্দ না হতে পারে। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় কী, সংসদের দুই কক্ষেই এখন বিজেপির হইহই বোলবোলা, ধ্বনিভোটে কৃষি আইন ও শ্রমকোড পাশ হয় তার কারণ সংসদে বিজেপির প্রশ্নাতীত সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কোন আইন সংবিধানবিরোধী, কোনটা নয়, কে ঠিক করে? সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানও বদলে দেওয়া যায়, মনে রাখতে হবে। সংবিধানের পিতৃকূলের কী ইচ্ছা ছিল, সংবিধানের ‘পবিত্রতা’ই বা কী, এসব অতি গোলমেলে প্রশ্ন। ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ধাঁচ তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আদলে, পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রভাবনায় ভারতের সংবিধান জারিত। সেটাকে অপরিবর্তনীয় ধর্ম ভেবে নেওয়ার কারণ কী? আর ধর্ম ভাবলে বিজেপি-আরএসএস-এর সঙ্গে ঝগড়া কোথায় ও কেন?

 

বামপন্থীরা কী করছেন?

লেখাটার পরের অংশে এবার ঢোকা যাক। এবারের ভোটকে কেন্দ্র করে বাংলায় একাধিক ফ্যাসিবিরোধী নাগরিক উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। বাংলার বড় বাম সিপিএম গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে লাল পতাকা নিয়ে মিছিল রোড শো ইত্যাদি করছে। ফ্যাসিবাদ ঠেকাতে একমাত্র বামপন্থীরাই পারে, চাদ্দিকে এ কথা শোনা যাচ্ছে। এই লেখক মনে করে না কথাটা ভুল। ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মাটি কামড়ে সবচেয়ে কঠিন লড়াইটা চালিয়েছিলেন ইউরোপের বামপন্থীরা, বিশেষত কমিউনিস্টরা। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে পারেন একমাত্র বামপন্থীরাই, একথাটাও সত্যি। একই সঙ্গে আরো কিছু কথা/প্রশ্ন/খটকা চলে আসে, এড়ানো যায় না বলে। প্রথমটা হলো, বামপন্থী বলতে আজকের সময়ে আমরা ঠিক কী বোঝাতে চাইছি? দুই, বামপন্থী বলে যদি কিছু বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠী/সমূহ বা ধারাকে চিহ্নিত করাও যায়, তাঁরা গণতন্ত্র বলতে ঠিক কী বোঝেন? প্রশ্নগুলো করতেই হয়।

 

১৮৪৮-এ কমিউনিস্ট ইস্তেহার প্রকাশ, ইউরোপ জুড়ে ব্যর্থ বিপ্লব প্রচেষ্টার পর থেকে প্রায় দু’শো বছর কাটতে চলল। ১৮৭২-এর পারি কমিউনের পর দেড়শো বছর। রুশ বিপ্লব এবং জার্মান বিপ্লবের অপমৃত্যুর পর একশো বছর। রুশ ও চীন বিপ্লব ঠিক কবে মরে গিয়ে প্রতিবিপ্লব হয়ে গেল, বলা মুশকিল। পৃথিবী এতটাই বদলেছে যে পুরোনো শব্দর পুরোনো মানেগুলো আর নেই। একসময় বামপন্থা বলতে বোঝাতো যে রাজনৈতিক স্রোতকে, সেখানে বহু ধারা এসে মিশতো। মার্ক্সপন্থী কমিউনিষ্টদের সঙ্গে সেখানে অ্যানার্কিপন্থীরাও ছিলেন, ছিলেন অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিস্টরা ও সোস্যালিস্ট রেভল্যুশনারি বা এসআর-রা। প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ ছিল না, কীভাবে তা করা হবে এবং নতুন সমাজের চেহারা কী হবে তর্ক ছিল তা নিয়ে। দু’শো বছরে সে তর্ক মীমাংসিত হয়নি। বিপরীতে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার অন্তর্লীন বৈষম্যের মূল কারণ যা, সেই পুঁজিতন্ত্র ক্রমাগত বিস্তৃত, সংহত ও শক্তিশালী হয়েছে। যে যে পরিমাণে বামপন্থীরা হীনবল ও পথভ্রষ্ট হয়েছেন, সেই সেই পরিমাণে পুঁজিতন্ত্র সমাজের সর্বস্তরে শিকড় গেড়েছে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভূগোল ছাড়িয়ে ঢুকে এসেছে মানুষের চৈতন্যের সূক্ষ্মতম প্রকোষ্ঠে। পুঁজিতন্ত্রের তৈরি করা দর্শন, শাসকদের মতাদর্শ বা আইডিওলজি ক্রমে সমাজগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে, বামপন্থার দর্শন এবং সেই দর্শনপ্রসূত প্রয়োগ পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।

 

বামপন্থার এই ব্যর্থতা থেকে ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদ শক্তিসঞ্চয় করেছে; পুঁজিতন্ত্রের ফলস্বরূপ যে বৈষম্য ও শোষণ সমাজে ছড়ায়, তার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের ক্রোধকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদ সামাজিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, সফল বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বামপন্থা যে মুহূর্তে শাসকের দর্শন হয়ে উঠল, পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শাসনস্থাপত্য (যথা আমলাতন্ত্র) হয়ে উঠল সমাজবদলের অভিজ্ঞান ও উপায়, বামপন্থা স্বধর্মচ্যুত হলো। শতাব্দীকাল বা তার বেশি সময় ধরে মার্ক্সপন্থীদের এক বৃহদাংশ ও অ্যানারকিপন্থীদের প্রায় সবাই এই কথা বলে আসছেন, আজকের সময়ে সে কথা স্মরণ করার প্রয়োজন আছে।

 

বামপন্থা ও সমাজবদল: সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি ও সিপিআইএম

বামপন্থার ব্যর্থতার দ্বিতীয় কারণও বহুচর্চিত, বিশেষত বাংলার বামপন্থী মহলে এ চর্চা ঘোরাফেরা করছে বহুদিন। চর্চার কেন্দ্রে যে প্রশ্ন— স্থিতাবস্থাকে মেনে নিয়ে কি সমাজবদল সম্ভব? সংসদীয় গণতন্ত্রের মায়াজালে আটকে থাকব না অন্য গণতন্ত্রসন্ধানে মন দেব, এই প্রশ্নে বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন খণ্ডবিখণ্ড হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র মারফত সমাজবদল করা যায়, উনিশ শতকীয় এই তত্ত্ব, যা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি নামে পরিচিত হয়, তা বামপন্থার দুনিয়াজোড়া অনুশীলনে বরাবর একটি প্রভাবশালী ধারা হিসেবে বর্তমান থেকেছে। অ্যানারকিপন্থীদের বাদ দিলে, আজকের পৃথিবীর বামপন্থীদের বেশিরভাগটাই সংসদীয় গণতন্ত্রে পরমবিশ্বাসী, তাঁরা মনেই করেন না, সমাজবদলের অন্য কোনও উপায় আছে। বিশেষত বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রীয় বামপন্থার প্রয়োগ যে সময়ে স্পষ্টত ব্যর্থ, পুঁজিতন্ত্রের বিকল্প বলে কিছু হতে পারে, এটাও তাঁরা মনে করেন না।

 

বাংলার বড় বাম, সিপিআইএম-এর রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অনুশীলন বলতে আপাতত ভোটে দাঁড়ানো ও জেতা (অবশ্য এখন জেতাটা ‘হারা’ হয়ে গেছে), জিতে রাষ্ট্র ক্ষমতার শরিক হওয়া। ৩৪ বছর তাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, আরো দশ বছর অতিক্রান্ত। সমাজে পুঁজিতন্ত্রের যে আগ্রাসন যথেচ্ছ জমি লুঠ, প্রকৃতিধ্বংস, শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক অধিকারহনন ও বেলাগাম দুর্নীতির মাধ্যমে পরিস্ফুট, তাঁর বিরুদ্ধে তাঁরা রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়তে তো পারেনইনি, উল্টে তাঁদের প্রকাশ্য মদতে নিওলিব বাজারি পুঁজিতন্ত্র রাজ্যে ঢুকেছে। তাঁদের দলের অধীন শ্রমিক সংগঠনের বহু নেতারা পুঁজিমালিকদের সঙ্গে সাঁট করে একের পর এক কারখানা-চা বাগান বন্ধ করিয়েছেন। শ্রমিকরা কর্মহীন, তাঁদের যাবতীয় বকেয়া চুরি করে এবং কারখানার যন্ত্রপাতি এমনকি ছাউনি ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে মালিকরা পগার পার, কারখানার জমিতে মল-আবাসন উন্নয়ন হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম দশ বছরে পঞ্চায়েত ও বর্গারেকর্ড মারফত যে সামাজিক সংস্কারের সূচনা হয়েছিল, তা কিছুদিন পরেই মুখ থুবড়ে পড়েছে, পঞ্চায়েত করে পার্টি নেতারা বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান হয়েছেন। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষার জায়গায় বামপন্থীরা সামাজিক স্থিতাবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।

 

সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ও অন্যত্র বাম সরকার যখন জমি দখল করতে চাইছিলেন, তাঁরা ব্যবহার করছিলেন ১৮৯৪ সালের ঔপনিবেশিক জমি অধিগ্রহণ আইন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় এই আইনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল। ২০১৩-য় যখন নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন তৈরি হয়, দেশের সমস্ত ভূমি-আন্দোলন একযোগে তার সমালোচনা করে। জমি নিয়ে কী করা হবে, তার চাইতেও বড় প্রশ্ন হয়ে উঠে আসছিল, জমি কার? জাতীয় নিরাপত্তা বা শিল্পায়ন বা উন্নয়ন ইত্যাদি অজুহাতে কৃষিজমি, অরণ্য, চারণক্ষেত্র এসব রাষ্ট্র দখল করতে পারে কি? এবং, দখল করে পুঁজিমালিকের হাতে তুলে দিতে? একুশের ভোট নিয়ে সিপিআইএম দল যে ইস্তেহার বার করেছে এবং তৎসহ দিন বদলের ডাক নামে আর একটি দলিল, এর কোনটাতেই এই পুরোনো প্রশ্নগুলোর নতুন উত্তর নেই।

 

ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পস্থাপন বামপন্থীদের কাজ নয়, হতে পারে না। তার একটা প্রধান কারণ, পুঁজি কোথা থেকে কোথায় যাবে, কীভাবে কতটা লগ্নি হয়, তা বামপন্থীরা নিয়ন্ত্রণ করেন না। ভারতবর্ষে এবং গোটা বিশ্বের সর্বত্র পুরোনো ধাঁচের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে লগ্নি ও লাভ দুটোই গত প্রায় দুই দশক ধরে কমছে। নতুন কাজ যা  তৈরি হচ্ছে তা মূলত নিরাপত্তাহীন মর্যাদাহীন, অ্যালগরিদম-নিয়ন্ত্রিত ঠিকা কাজ, আবাসনের/মলের নিরাপত্তারক্ষী, আমাজন বা জোমাটোর ‘ডেলিভারিবয়’, অ্যাপক্যাবের ড্রাইভার ইত্যাদি, যাঁদের সাধারণত গিগ-ওয়ার্কার বলা হয়। সিপিআইএম দল দেশের অন্যত্র, যেখানে তাঁরা ক্ষমতায় নেই বা আসবেন না, শ্রম ও শ্রমিকের ওপর নিওলিব আক্রমণ নিয়ে সরব। বাংলার ক্ষেত্রে তাঁরা যে শুধু শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ভাঙা ঘণ্টা বাজাচ্ছেন তাই নয়, নিওলিব পুঁজিতন্ত্রকে একটা রাজ্যের ভোটে জিতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই অত্যন্ত ক্ষতিকর মিথ্যাটাও প্রচার করছেন।

 

সিপিআইএমের কাজকর্মে অবাক বা আশাহত হবার মতো কিছু নেই। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা পৃথিবীর সর্বত্র পুঁজিতন্ত্রের পক্ষ নিয়েছেন বারবার, বিপ্লব ও বিপ্লব সম্ভাবনার বিপক্ষে কাজ করেছেন। ব্রিটেনের লেবার পার্টি বড় উদাহরণ, সেই সঙ্গে ইউরোপের প্রায় যাবতীয় বড় কমিউনিস্ট/বাম পার্টি, ইতালিতে, স্পেনে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে। আধুনিকতর উদাহরণ চাইলে ল্যাটিন আমেরিকার সরকারে যাওয়া বামপন্থীরা: ব্রাজিল, চিলি, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, মেক্সিকো। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির গর্ভে উপ্ত উগ্র দক্ষিণপন্থা ও ফ্যাসিবাদের বীজ, যে সামাজিক ক্রোধ স্থিতাবস্থা ভেঙে বিপ্লব সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, তা সংসদীয় গণতন্ত্র মারফত ডানপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানে সহায়ক, এমনকি প্রধান ভূমিকাও নেয়। বাংলায় এই প্রক্রিয়া এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি।

 

সিপিআইএম-এর রাজনীতি?

সিপিআইএম দলের উদ্ভট সব রাজনৈতিক তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ আছে। ২০১৪-য় লোকসভা ভোটে বিজেপি একগাদা ভোট পেল, বামেরা ছত্রভঙ্গ হলেন, ২০১৯-এর ভোটে পুরো উধাও হয়ে গেলেন। তাঁরা বলছেন, এক, বিজেপি তৃণমূলের হাত ধরে বাংলায় এসেছে, দুই, তৃণমূল বিজেপি এক। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে (শুধু ভোটের রাজনীতি নয়) বিজেপির উত্থান যে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা, বাংলায় বিজেপি দলের শক্তিবৃদ্ধির পিছনে যে বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের দীর্ঘ ছায়াপাত আছে, সেটা কি সিপিআইএম দলের নেতারা বোঝেন না, না বুঝতে চান না? ভারতীয় রাজনীতিতে আরএসএএস-এর পুনঃপ্রবেশ ১৯৭৪-৭৭-এ, স্বয়ং জয়প্রকাশ নারায়ণের হাত ধরে। কংগ্রেসবিরোধী যে রাজনীতি ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তার অন্যতম অংশীদার সিপিআইএম। ১৯৮৯ পর্যন্ত এই অবস্থা চলে, ভিপি সিংহের জনতা দল সরকারকে বিজেপি ও সিপিআইএম যুগ্মভাবে সমর্থন করেছিল। সে অর্থে ১৯৮৯ থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-আরএসএস যুগের সূচনা, তারপর থেকে যা ঘটেছে, ঘটছে, পুরোটাই সেই সিলসিলায়। তৃণমূল এখানে নিতান্তই ছোট বা কুচি খিলাড়িমাত্র, ইংরেজিতে যাকে বলে বিট প্লেয়ার। ১৯৯৯-এ নতুন তৈরি হওয়া তৃণমূল দল বিজেপি/এনডিএ সরকারে যোগ দেয় বটে, কিন্তু ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার থেকে বেরিয়ে আসেন। না বেরোলেও পারতেন। পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি পশ্চিমবঙ্গে অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠেন। সেটা বিজেপির লেজুড়বৃত্তি করে ঘটেনি। ২০০৬-এর রাজ্য ভোটে শোচনীয় পরাজয়ের পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এই জায়গায় যেতে পেরেছিলেন, তার একমাত্র কারণ, ২০০৬ থেকে মমতা বাংলায় বামপন্থী রাজনীতির মুখ্য বিন্দুগুলির সঙ্গে সচেতনভাবে নিজের দলের কাজকর্মকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।

 

 

বামপন্থী ভোট-রাজনীতি ও তৃণমূল

বিশদ আলোচনায় ঢোকা যাবে না, দু একটা উদাহরণ দিই। ১৯৭৭-এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে সংসদীয় বামদলগুলি ভোটে লড়তেন শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের ইস্যু নিয়ে। গ্রামের ভূমিহীন ক্ষেতমজুর বর্গাদার বামপন্থীদের সঙ্গে থাকতেন কেননা তাঁদের প্রাত্যহিক অস্তিত্বের লড়াইতে বামপন্থীরা তাঁদের সঙ্গ দিতেন। শিল্পাঞ্চলের, চা-বাগানের, শ্রমিকরা থাকতেন, কেননা পুঁজিমালিকদের শোষণের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা তাঁদের হয়ে লড়তেন। সরকারি কর্মচারী, শিক্ষকেরা থাকতেন কেননা বামপন্থীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁদের বেতনবৃদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদার লড়াইতে সামিল হতেন। ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা বামপন্থীদের বন্ধু বলে চিনতেন, কেননা বামপন্থীরা তাঁদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতেন। শহুরে বেকাররা বামপন্থীদের মিছিলে ভিড় করতেন কেননা বামপন্থীরা নতুন চাকরি এবং বেকার ভাতার কথা বলতেন। বিভিন্ন শ্রেণির অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার বাইরেও, রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষ ভাবতেন, বামপন্থীরা একটা নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছেন, যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যগুলো থাকবে না। এই যে বহু মানুষ একসঙ্গে এটা ভাবতেন, ভাবছিলেন, তার পিছনে বহু বামকর্মীর বহুদিনের সাংগঠনিক কাজ ছিল, বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন ছিল। একসঙ্গে অনেক মানুষ নতুন সমাজ, বদলে যাওয়া সমাজের কথা ভাবছিলেন। অর্থাৎ বামপন্থীদের যে মূল রাজনৈতিক কাজ —  সমাজে নতুন রাজনৈতিক চৈতন্য নির্মাণ করা, যে চৈতন্যকে বলা হতো শ্রেণি চৈতন্য — তা অনেকটাই করা গিয়েছিল। কমিউনিস্টদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী অর্ন্তকলহ এবং রাষ্ট্রের চূড়ান্ত নিপীড়ন সত্বেও এই কাজ থেমে থাকেনি। শ্রেণি চৈতন্য থেকে শ্রেণি ভিত্তি। সমাজের বিশেষ কিছু অংশ বামপন্থীদের নিজেদের ঘরের লোক, আপনজন ভাবতেন, ফলত তাঁদের ভোট বামপন্থীদের সঙ্গেই থাকতো। ১৯৭৭ থেকে ২০১১-র মধ্যে শ্রেণি চৈতন্য নির্মাণ ও শক্তিশালী করবার রাজনৈতিক কাজটা সরকারে থাকা বামদের কর্মসূচি ও ভাবনা থেকে যুগপৎ উবে গেল। ফলে তাঁদের ভোটের শ্রেণি ভিত্তিও টিকে থাকল না। ২০০৬-২০০৭-এ যখন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম হচ্ছে, মমতা বামপন্থীদের না-থাকা, দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া শ্রেণি ভিত্তিকে আশ্রয় করতে চাইলেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও কর্পোরেট জমিলুটের বিরুদ্ধে তিনি চাষি-ক্ষেতমজুর এবং আদিবাসীদের পক্ষ নিলেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে অসংখ্য সংস্কারমূলক কাজ করেছে, সামাজিক সুরক্ষা বহুলাংশে বাড়িয়েছে, সেটাও বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম দিকের কাজের অনুসরণে। মহিলাদের সামাজিক ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে তৃণমূল সরকার গত দশ বছরে যে কাজ করেছে, তার তুল্যমূল্য কিছু বাম সরকারের আমলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 

অর্থাৎ মমতা বামপন্থীদের শ্রেণি ভিত্তি আত্মসাৎ করছিলেন, তা নির্ভর করে ভোটে জিততে চাইছিলেন। হয়তো এখনো চাইছেন। তাঁর দলের নির্দিষ্ট রাজনীতি নেই, এবং দলটি প্রধানত লুম্পেনপুষ্ট, অথবা তিনি মুসলমান মৌলবাদীদের সঙ্গে অকাতরে হাত মেলান, এতদ্বারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের উত্থান ও সামাজিক ভিত্তির মূল রাজনৈতিক বিষয়টিকে অস্বীকার করা যায় না। অথচ সিপিআইএম সে প্রসঙ্গে যায় না। কোনও রাজনৈতিক প্রসঙ্গেই যে বঙ্গীয় সিপিআইএম দলের আগ্রহ আছে সেটা বোঝার উপায় নেই। তৃণমূল ও মমতাকে তারা প্রধান শত্রু মনে করে, যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে তাদের নেতারা মমতাকে আক্রমণ করেন, তার সঙ্গে বিজেপি নেতাদের ভাষা-ভঙ্গির বিশেষ ফারাক নেই। নিছক ভোটে জেতার জন্য কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোটে না জিততে দেবার জন্য তারা চিহ্নিত মুসলিম মৌলবাদী ও কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করে, এবং তাদের নেতাকর্মীরা লাল জামা লাল বেলুন (ও লাল ঝান্ডা)-সহ রাস্তায় রাস্তায় রোড-শো করেন, সেখানে ‘জনপ্রিয়’ টুম্পা গান বাজে, মমতা এবং তাঁর দলকে এন্তার গাল দেওয়া হয় এবং সেই তামাম ছবি, শব্দ হুবহু বিজেপি আইটিসেল কায়দায় সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে সাংখ্যবিশ্বে ছড়াতে থাকে। যে কায়দায় মোদী-শাহ বলেন, বঙ্গালকি লোগো নে মন বনা লিয়া, সিপিআইএম নেতারাও বলেন, বাংলার মানুষ মনস্থির করে ফেলেছেন, একুশের ভোটে বদল আসন্ন, মমতা আউট, সংযুক্ত মোর্চা ইন। পুরো ভোট প্রচারের কোথাও বামপন্থা বা বামপন্থী রাজনীতির নামগন্ধ নেই, এক পুরোনো সেই কমিউনিস্ট নাম ও লাল রঙ ছাড়া।

 

বাম ভোটের এখন তখন

 

১। সিপিআইএম

ষাট-সত্তরের দশকে বামপন্থীদের ভোটপ্রচার এবং ভোটে অংশগ্রহণের মধ্যে ভোটের বাইরের প্রতিদিনের রাজনীতির, জীবনের লড়াইয়ের ছায়া পড়ত। বামপন্থীরা সেই রাজনীতি দীর্ঘসময় ধরে সংগঠিত করেছিলেন। সেই রাজনৈতিক সংগঠন পচে যাওয়া, ঘুণে ধরা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজকে বদলাতে চাইছিল। সেই চাওয়াটা যখন আর থাকল না, রাজনীতি বা সংগঠন কিছুই থাকল না। রাজনীতির জায়গা নিলো স্থিতাবস্থার পক্ষে নির্লজ্জ ওকালতি, পুঁজিতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে সওয়াল। সংগঠন হয়ে দাঁড়াল নতুন মাতব্বরি এবং আধিপত্য বিস্তারের জায়গা, ফলত বিভিন্ন কিসিমের দুর্নীতিরও। সিপিআইএম ও বামফ্রন্ট এক দশক ধরে ক্ষমতায় নেই, কিন্তু এই অবস্থাটা তাতে করে বদলায়নি। ‘বাংলা বদল চায়’ এটা বলে এবং লাল জামাজুতো, বেলুন ও টুম্পা গান পথে এবং পথের চেয়েও বেশি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় উড়িয়ে বামপন্থী রাজনীতি হয় না, নষ্ট হয়ে যাওয়া শ্রেণির রাজনীতি ফিরে আসে না। বিধানসভার ভোটে অসংখ্য প্রাত্যহিকের বিষয় থাকে, থাকে স্থানীয় বাস্তবতাও, যা ব্লকে ব্লকে পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে এমনকি গ্রামে গ্রামেও বদলে যায়। একদা এই বহুবিধ অবস্থা এবং বাস্তবতাকে ধারণ করার ক্ষমতা বামপন্থী রাজনীতির ছিল। সমাজবাস্তব থেকে বামপন্থীরা বিযুক্ত হয়েছেন বহুকাল, নীচের তলার যে সংগঠন তাঁদের গর্ব ও শক্তি ছিল, তার জায়গা নিয়েছে ওপর থেকে বলা অন্তঃসারশূন্য বুলি, বিজেপি ও দক্ষিণপন্থীদের অনুকরণে ডিজিটাল ছবিবাজি। এই বামপন্থা কদাচ, কার্যত, বামপন্থা নয়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধতায় চাবুক ওঠানোর সামর্থ্য তার নেই।

 

২। যারা সিপিআইএম নন

সিপিআইএমের কথা থাক। অ-সিপিআইএম বামেরা একুশের ভোটে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নেবার চেষ্টা করেছেন। ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ স্লোগানকে সামনে রেখে তাঁরা যথাশক্তি প্রচারে নেমেছেন। এই লেখকও সেই প্রচারে অংশ নিয়েছে, ফ্যাসিবিরোধী যে নাগরিক উদ্যোগগুলি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে, তার বেশ কয়েকটির সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ফলে যে দু-একটি কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা যতটা সমালোচনা, আত্মসমালোচনাও বটে।

 

প্রথমেই বলা দরকার, অ-সিপিএম বামদের যে প্রচার গত তিন মাস ধরে চলছে, তাতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দলভুক্ত এবং দল-বহির্ভুত নাগরিকরা সাড়া দিয়েছেন, তার চাইতেও বড় কথা, যে বিভিন্ন দল ও দলখণ্ডগুলি সচরাচর যৌথ কাজ না করে এ-ওকে সোশ্যাল মিডিয়ায় গাল পাড়েন, তাঁরা একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছেন। ভোটের ফল বেরোবার পরে এই অবস্থা থাকবে কিনা, জানা নেই। সে বিষয়ে বেশি বলা এই মুহূর্তে অ-সমীচিন হবে। যে প্রশ্নটা নিজেদের করা দরকার, বিজেপিকে ভোট নয় বলে যে প্রচার চলছে, তা ভোটারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কী পদ্ধতিতে এবং আদৌ পৌঁছনো যাচ্ছে কিনা? এই লেখকের অভিজ্ঞতা, সিপিআইএম-এর প্রচারের মতো, এই প্রচারও হচ্ছে মূলত ওপর থেকে। নেতৃত্বস্থানীয়রা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বক্তৃতা করছেন, যেখানে স্থানীয় সংগঠন উপস্থিত, কিছু ভিড় হচ্ছে, যেখানে সংগঠন দুর্বল বা নেই, লোক কম হচ্ছে। রাজ্যজুড়ে বিজেপিকে ভোট নয় পোস্টার পড়েছে, এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার ভিডিওপ্রচার চলছে। সবটা মিলিয়ে প্রচারের এক ধরণের দৃশ্যমানতা তৈরি হয়েছে, বড় মিডিয়ার নজরে ও গোচরে এসেছে, বিজেপির লোকজন কিছু জায়গায় বাধা দিয়েছে, অন্যদের মধ্যে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং সিপিআইএম বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় চারবেলা গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। এসবের ফলে একটা ধারণা (বা পারসেপশান) তৈরি হচ্ছে, বিজেপিকে ভোট নয় এই মুহূর্তে প্রভাবশালী গণ-আন্দোলন, বাংলার জনগণ পণ করেছেন, বিজেপিকে তাঁরা ভোট দেবেন না।

 

৩। বিজেপির ‘জনতা জনার্দন’ ও বাম ‘জনগণ’

এইখানে দুটি প্রশ্ন। বিজেপি জনতা জনার্দনে বিশ্বাস করে, যেহেতু জনার্দন বানিয়ে ফেলার মতো উপযুক্ত অর্থবল ও মিডিয়াবল তাদের আছে। থালাবাটি, ঢাকঢোল বাজিয়ে, বেলুন-ঝান্ডা-আবির উড়িয়ে, সরু রাস্তায় কয়েক হাজার লোক চেপেচুপে ভরে, ফুলের পাপড়ি ছড়াতে ছড়াতে রোড-শো তাদের করতেই হয়, যেহেতু বিজেপির কাছে প্রতিটি সভা/রোড-শো একাধারে ইভেন্ট ও স্পেকট্যাকল বা দৃশ্য, যা প্যাকেজ, ছবি হয়ে বিবর্ধিত হবে, হতে থাকবে। ২০১৪ থেকে ভোটখেলার এই নতুন নিয়ম বিজেপি-আরএস এস তৈরি করেছে, ফলে অন্য দলগুলোকেও বাধ্য হয়ে একই কাজ করতে হচ্ছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ মশাই একটি টিভি-শোতে বলছিলেন, ভোটের ভাষণে কি ইস্যু টিস্যু থাকে? লোকে ইস্যু শুনতে চায় না। ইস্যু ইস্যুর জায়গায়, ভোট ভোটের। পাক্কা। বিজেপিকে যারা ভোট দিচ্ছেন, তাঁরা ইস্যু নিয়ে বিচলিত নন, তেলের গ্যাসের দাম আকাশ ছোঁক আর বেকারি বাড়তে থাকুক, মুসলমান ঠান্ডা করা এবং মোদীপূজা করা সবচাইতে দরকারি কাজ, তাঁরা বোঝেন এবং বিশ্বাস করেন। এই বোধ ও বিশ্বাস টিভি ও হোয়াটসঅ্যাপে অবিরল নিরন্তর ছবিবাজি করে উৎপন্ন হয়েছে, অন্তত বাংলায় তো বটেই। বিশ্বাস শেষ কথা। ট্রাম্পের সমর্থকরা ট্রাম্পকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। বলসানেরোর সমর্থকরা তাঁর সমর্থনে দাঙ্গা করেছেন। মোদীর সমর্থকদের জাতগোত্র আলাদা নয়, তাঁরা বিশ্বাস করেন মোদীজি ভগবান। ওদিকে মোদীজিও বলে যাচ্ছেন, জয় জনতা জনার্দন। সবই বিশ্বাস।

 

কথাটা/প্রশ্নটা হলো, বামপন্থীরাও কি জনতা জনার্দনে বিশ্বাস করা শুরু করেছেন? সিপিআইএম-এর কথা আর তুলছি না, তাঁরা যে রাজনীতি করেন তা শাসকের, পুঁজির ও ক্ষমতার, সেখানে বামপন্থা নেই। বিজেপিকে ভোট নয় বলে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে বামপন্থীরা প্রচার করছেন, তাঁরা কি সত্যিই মনে করেন, কিছু পথসভা করে, পোস্টার লাগিয়ে এবং ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল করে বিজেপির সম্ভাব্য ভোটারদের বোঝানো সম্ভব হবে যে বিজেপিকে ভোট দিলে বাংলা রসাতলে যাবে? এই প্রচার করা দরকার তা নিয়ে তর্ক নেই। কথাটা হচ্ছে ভোটের বাজারে প্রচারের নিট ফল কী দাঁড়াচ্ছে?

 

লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এবং খানিক পথেঘাটে ঘুরে এই লেখকের মনে হয়েছে, একুশের ভোটটা বহুলাংশে স্থানীয় বাস্তবতা এবং প্রাত্যহিকের ইস্যু দিয়ে নির্ধারিত হবে। বিভিন্ন স্থানীয় বাস্তবের ওপর বিজেপি তার রাষ্ট্রীয় জনতা জনার্দন ও পারসেপশান জবরদস্তি চাপিয়ে দিচ্ছে। সেটার মোকাবিলা একমাত্র স্থানীয়, তৃণমূল স্তরেই করা সম্ভব। ‘বাংলার জনগণ বিজেপিকে চাইছেন না’ জাতীয় গোলা কথা প্রচারে বলা যেতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করা উচিত কি?

 

আসলে বামপন্থীদের সমস্যা হচ্ছে, সমাজবাস্তব থেকে তাঁরাও বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন বিযুক্ত, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে তাঁদের অধিকাংশ সময় যায়, বাকিটা ইভেন্ট তৈরি করে। শ্রেণি-রাজনীতি সংগঠনের যে বুনিয়াদি কাজ সিপিআইএম ছেড়ে দিয়েছে, সে কাজ অন্য বামরাও তো করেন না। না করলে তাঁরা যা বলবেন সেটা ওপর থেকে ছাড়া ভাষণ ও বাণী হবে, অথচ তাঁদের পুঁজি ও মিডিয়ার জোর নেই, ফলে তাঁদের কথা মুহূর্তে মিলিয়ে যাবে। যে কথা দীর্ঘমেয়াদি কথোপকথন, সংগঠন ও রাজনীতি তৈরি করে সেই কথা তাঁরা বলে উঠতে পারবেন না। যে কাজটা তাঁরা মন দিয়ে সময় শক্তি ব্যয় করে নিজেদের বিপদাপন্ন করে করছেন, সেটা নিয়ে তলিয়ে খুঁচিয়ে না ভেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লাস চলবে। ফলে, জনতা জনার্দনের কৃপায় এবং ইচ্ছায় বিজেপি যদি ভোটে জিতে বাংলায় ক্ষমতায় আসে, আসবে। সামাজিক সুরক্ষার সরকারি প্রকল্পে ভর করে ও ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি বিজেপিকে আটকে দিতে পারবেন, আটকাবেন। বামপন্থীদের কি ভূমিকা হবে তা ইতিহাস (ও বামপন্থীরা) স্থির করবে, আশার বাণী শোনানোর মতো ক্ষমতা এই লেখকের অন্তত নেই।

 

(লেখক বামপন্থী ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী।)

 

পড়ে দেখুনফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র ও বামপন্থা: ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন কোন পথে?

 

Share this
Leave a Comment