বিজেপিকে ভোট নয় — বাংলার ডাকের সঙ্গে গলা মিলল আন্দোলনকারী কৃষকদের


  • March 11, 2021
  • (1 Comments)
  • 989 Views

নাগরিক সমাজের ডাক গণমানসের চিন্তা-চেতনায়, রাজনৈতিক সমাজের কল্পনাশক্তির সঙ্গে মিলে গেলে এমনটি হওয়ারই কথা। বদলে যাওয়ার কথা চাপিয়ে দেওয়া বয়ানের, শুরু হওয়ার কথা নতুন কথোপকথন। নতুন আন্দোলনের। লিখছেন দেবাশিস আইচ

 

‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ লেখা পথজোড়া ব্যানার হাতে হাঁটছেন মনজিৎ সিং ধানের, রামিন্দর সিং, অভিমন্যু কোহাররা। এঁরা পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানের কৃষক নেতা। দিল্লি সীমান্তের কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের অন্যতম প্রতিনিধি। অভূতপূর্ব দৃশ্য বটে। দিল্লি সীমান্তের ১০০ দিন ব্যাপী আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ হিসেবে নির্বাচনমুখী পাঁচ রাজ্যে বিজেপি বিরোধী ভোটবার্তা নিয়ে সফরের পরিকল্পনা আগেই ঘোষণা করেছিল কৃষক নেতৃত্ব। ১২ মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গে সেই অভিযানের শুরু। তার আগে ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি বিরোধী বাংলা’ মঞ্চের আমন্ত্রণে ১০ মার্চ ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ মিছিল ও সমাবেশও হয়ে উঠল কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ। যেন ১২ থেকে ১৪ মার্চের অভিযানের এক উপক্রম নাটিকা।

 

সভার প্রাথমিক বক্তা ছিলেন তাঁরাই। কখনও তাঁরা বললেন, কৃষকরা যে লড়াই শুরু করেছে তা বিজেপির হাত থেকে ‘গ্রাম বাঁচানোর লড়াই, খেত বাঁচানোর লড়াই, দেশ বাঁচানোর লড়াই। আর তার জন্যই আমরা বাংলায় এসেছি।” বাংলার মানুষের কাছে তাঁদের আবেদন, “দিল্লির সীমান্তে যে স্ফুলিঙ্গ, যে আগুন জ্বালিয়েছি সেটা ছিল প্রথম চ্যালেঞ্জ। সে আগুন ঠান্ডা হতে দেবেন না।” তিন কৃষি আইন যে বাংলার কৃষকদের উপর, বাংলার চাষবাসের উপরও প্রভাব ফেলবে বার বার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন রামিন্দর সিংরা। তাঁদের আন্দোলন যে স্রেফ কৃষি আন্দোলন নয়, তা গণতন্ত্রের লড়াই, সংবিধানের বাঁচানোর লড়াই। কৃষক নেতা তরুণ অভিমন্যু কোহার তীব্র আবেগে জানিয়ে দিলেন, “রক্ত দিয়ে যে ইতিহাস লেখা হয়েছে/ কালি দিয়ে তা মুছে ফেলতে দেব না।/ রেল কারখানা বেচে দিতে পারবে/ কৃষককে বেচতে দেব না।” বললেন, “কাকে ভোট দিতে হবে সে কথা বলতে আসিনি। একটা দলকেই বাতিল করুন, যে দল কৃষকদের বিরুদ্ধে, দেশের সম্প্রীতির বিরুদ্ধে।” আন্দোলনরত কৃষকদের মান-সম্মান রক্ষা করার আবেদনও জানান তিনি।

 

বক্তাদের ভাষণে স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা ও পঞ্জাবের সম্পর্কের স্মৃতি ছুঁয়ে গিয়েছে। গদর পার্টি, রাসবিহারী বসু, ভগৎ সিংয়ের নাম উচ্চারিত হয়েছে। উচ্চারিত হতে পারত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কথা, দেশজুড়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের নিঃস্তব্ধতার মধ্যে, বেশির ভাগ ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ কাগজে বৃটিশ সরকারের ‘প্রশংসা’র মধ্যে, দেশবাসীর যন্ত্রণা নিয়ে ‘মশকরা’র মধ্যে ‘ন্যূনতম’ যেটুকু তিনি করেছিলেন তার কথাও, “…the very least that I can do for my country is to take all consequences upon myself in giving voice to the protest of millions of million of my countrymen, surprised into a dumb anguish of terror. … and for my part, wish to stand, shorn, of all my special distinctions, by the side of those of my countrymen who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings.”

 

দিল্লি সীমান্ত থেকে আসা কৃষক নেতৃত্বের পাশাপাশি মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রাজ্যের নাগরিক ও সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিনিধি ও মঞ্চের আহ্বায়ক  সুজাত ভদ্র, কুশল দেবনাথরা। না, ছিলেন না কোনও সেলিব্রেটি কিংবা বিদ্বৎজ্জন। এ জাতীয় মিছিলে যা রেওয়াজ। তাঁদের পিছনে রাস্তার দখল নিয়েছিল প্রধানত ছাত্র-ছাত্রী ও যুব সম্প্রদায়। বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদ কিংবা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষি ও শ্রমজীবী নারী-পুরুষ এবং কলকাতা ও বিধাননগরের বস্তিবাসীদেরও ছিল সবাক উপস্থিতি।

 

মিছিলে উড়ছিল বিদ্যাসাগর থেকে তরুণ রবীন্দ্রনাথ,  ক্ষুদিরাম থেকে ভগৎ সিং, প্রীতিলতা থেকে বাবা সাহেব আম্বেদকরের ছবি আঁকা পতাকা, ব্যানার। নাগরিক সমাজের ডাক গণমানসের চিন্তা-চেতনায়, রাজনৈতিক সমাজের কল্পনাশক্তির সঙ্গে মিলে গেলে এমনটি হওয়ারই কথা। বদলে যাওয়ার কথা চাপিয়ে দেওয়া বয়ানের, শুরু হওয়ার কথা নতুন কথোপকথন। নতুন আন্দোলনের। এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন থেকেই মিছিলের চিত্ররূপ বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে শ্লোগানের ভাষা, বদলে যাচ্ছে বহু রঙ্গের বৈচিত্র্যময়তায়। তার এক রঙিনতম দৃশ্যাবলীর জন্ম দিল ১০ মার্চের মিছিল।

 

বীরভূম থেকে আসা প্রত্যন্ত গ্রামীণ অংশের কৃষক পরিবারের তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওঁরা বলছিলেন, পেট্রোল-ডিজেল-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কথা; বলছিলেন এনআরসি-সিএএর আতঙ্কের কথা; কৃষি আইন নিয়ে উদ্বেগের কথা। আর পাশাপাশি হতাশার সুরে বলছিলেন, সাধারণের বিশ্বাসকে কোনও মূল্য না দিয়ে রাজনৈতিক ডিগবাজির কথাও। তরুণ সমাজকর্মী মহম্মদ রিপন বলছিলেন, “ভোট এসে গেল প্রকৃত উন্নয়নের কথা হচ্ছে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের কথা বাদ দিয়ে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে।” তবে তাঁর বিশ্বাস বীরভূমের ‘সম্প্রীতির মাটিতে’ এই সুড়সুড়ি কাজে দেবে না।

 

আগামী ১২ থেকে ১৪ মার্চ সংযুক্ত কৃষাণ মোর্চার বাংলা সফরের শুরু। কলকাতা, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, আসানসোল সফর করবেন তাঁরা। ডাক দেওয়া হয়েছে কৃষক মহাপঞ্চায়েতের। বাংলার কৃষক প্রতিনিধিদের হাতে তাঁরা তুলে দেবেন বিজেপিকে হারানোর আবেদনপত্র। তিন কৃষি আইন অবশ্যই রাজ্যের কৃষিজীবী মানুষের এক বড় অংশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যু। আগামীতে তার তীব্রতা বাড়বে বলেই মনে হয়।

 

Share this
Tags :
Recent Comments
1
  • comments
    By: Raj Kumar Gupta on March 12, 2021

    আরো একটু বিস্তৃত রিপোর্ট আশা করে ছিলাম।

Leave a Comment