টিকরি সীমান্তে আর্ন্তজাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস উদ্‌যাপনে মহিলাদের বিপুল জমায়েত


  • March 9, 2021
  • (0 Comments)
  • 966 Views

 

৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস উদ্‌যাপনে দিল্লির টিকরি সীমান্তে অবস্থানরত প্রতিবাদী কৃষকদের মধ্যে মহিলা কৃষক ও আন্দোলনকারীদের দৃপ্ত উপস্থিতি বুঝিয়ে দিল এ লড়াই হারার জন্য ময়দানে নামেননি তাঁরা। নিছক পুরুষ কৃষকদের সঙ্গী হিসাবে বা অবস্থানে খাবার তৈরির জন্য তাঁরা ১০০ দিন পেরিয়ে সরকারের কৃষক-বিরোধী তিনটি কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে বাড়িঘর ছেড়ে পড়ে নেই। কৃষক হিসাবে, এ দেশের নাগরিক হিসাবে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে, নিজেদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তাঁরা স্বাধীনভাবে এই আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, ‘শ্রমজীবী নারী’ হিসাবেই এবং তাঁদের এই আন্দোলনে ‘রাখা’ হয়নি বা ইচ্ছে মতো তাঁদের আন্দোলন থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যায় না। সরকারের শোষনমূলক নীতির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ তাঁদের সম্পূর্ণ নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও নিজেদের হক তাঁরা বুঝেই নেবেন।

 

এদিনের হাজার হাজার উদ্দীপিত মহিলাদের তেজী শ্লোগানে, সংকল্পবদ্ধ উপস্থিতিতে স্পষ্ট হয়ে যায় জোটবদ্ধ শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মহিলারা তাঁদের দাবি আদায় করেই থামবেন। কৃষক আন্দোলনের অন্যতম শরিক বি.কে.ইউ উগ্রাহানের মহিলা শাখার নেত্রী হরিন্দর বিন্দু এদিনের মহিলা সম্মেলনের শেষে যে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন তার বাংলায় তর্জমা করা হল পাঠকদের জন্য –

 

দিল্লি কিষান মোর্চা মহিলাদের বিরুদ্ধে যে বৈষম্য ও অসমানতা চলে তা বন্ধ করার লক্ষ্যে লড়াইয়ের ডাক দেয়। চলমান কিষান মোর্চার মধ্যেই বি.কে.ইউ উগ্রাহান নারীদিবস উপলক্ষ্যে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দিলে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে হাজার হাজার মহিলা চরম উৎসাহ-উদ্দীপনায় তাতে যোগ দেন। মহিলাদের এই জনসমুদ্র যখন টিকরি সীমান্তের পকোরা চকের কাছে গাদরি গুলাব কউর নগরে পৌঁছায় তখন তা মোর্চায় যেন বা এক অন্য মাত্রার প্রাণশক্তি যোগায়। এই সম্মেলনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছেন মহিলারা এবং জমায়েতে বক্তব্যও রাখেন শুধুমাত্র মহিলা বক্তারা। সম্মেলন শুরু হয় জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনে শহীদ হওয়া নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দু’মিনিটের নীরবতা পালনের মাধ্যমে। বি.কে.ইউ উগ্রাহানের মহিলা শাখার নেত্রী হরিন্দর বিন্দু ও পরমজিৎ কউর জমায়েতের উদ্দেশে বলেন, বর্তমান আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা দৃষ্টান্তস্বরূপ, তারা ইতিমধ্যেই কৃষির দুর্দশার মধ্যে দিয়ে চলেছেন এবং তারা কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটের আক্রমণও চিহ্নিত করে ফেলেছেন। আন্দোলনে এই অংশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, যাদের সমাজের যে কোনও অংশের থেকে জীবনের কঠোর, রুক্ষ চেহারার মোকাবিলা করার অনেক বেশি ক্ষমতা আছে এবং তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা বলেন গত এক দশকে কৃষক ও শ্রমিকদের আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণের ফলে নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রগতির ভিত্তিটিও প্রস্তুত হয়ে গেছে। মহিলা কৃষক নেত্রী হরপ্রীত কউর জেঠুকে ও পরমজিৎ কউর কোটাডা অতীতের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, কৃষি বিল বাতিলের আন্দোলনে জয় না পাওয়া পর্যন্ত তারা তাদের অবস্থানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে অনড় থাকবেন।

 

সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী ও প্রয়াত নাট্যকার গুরশরণ সিং-এর কন্যা আমাদের দেশের ইতিহাসে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে মহিলাদের ভূমিকা আলোচনা করেন। তিনি বলেন বর্তমান ফ্যাসিস্ত সরকার মহিলাদের অধিকারের উপরে নির্মমতম আঘাত হানছে। সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল এই সরকারের ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গড়ার শ্লোগান মহিলাদের মধ্যযুগে ঠেলে দেওয়ার একটি হাতিয়ার এবং সমাজের অন্যান্য সব বিভাগের উচিত দলিত, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে মিলে এই ফ্যাসিস্ত আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত লড়াই গড়ে তোলা।

 

প্রাক্তন ছাত্র নেতা ও বিপ্লবী আন্দোলনকর্মী শিরিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, বর্তমানে কৃষকেরা যে বহুজাতিক কোম্পানি ও কর্পোরেট দুনিয়ার বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইতে নেমেছেন, সেই কোম্পানিগুলির মহিলাদের প্রতি আচরণও অত্যন্ত নেতীবাচক। একদিকে তাদের শোষিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে এই বহুজাতিক কোম্পানিগুলি মহিলাদের শ্রম-ক্ষমতাকে শোষন করে, অন্যদিকে তাদের পণ্য বিক্রির জন্য মহিলাদের নিছক শো-পিস হিসাবে ব্যবহার করে। পুঁজিবাদী ব্যবসা মহিলাদের বাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করেছে। সুতরাং কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে লড়াই নারীমুক্তি আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেন নারীমুক্তি আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের একটি অংশ এবং সামন্ততান্ত্রিক শোষনের বিরুদ্ধে লড়াই, মহিলাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার লড়াইও বটে। এভাবেই মহিলাদের অধিকারের আন্দোলন গণ আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

পাঞ্জাব ক্ষেত মজদুর ইউনিয়নের কৃষ্ণা দেবী বলেন, দলিত মহিলারা আমাদের সমাজে ত্রি-স্তরীয় শোষনের শিকার। তারা যেমন তথাকথিত উচ্চ-বর্ণের দমন-পীড়নের লক্ষ্য, তেমনি পিতৃতন্ত্রের দমননীতির শিকার ও শাসক শ্রেণীর দমনের লক্ষ্যও তারা। তিনি বলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত কৃষি-শ্রমিক মহিলারা।

 

এই জমায়েতে দিল্লি থেকে আসা মহিলাদের এক বিরাট প্রতিনিধি দলও যোগদান করে। এই প্রতিনিধি দলের মধ্যে থেকে শবনম হাসমি এই জমায়েতে বক্তব্য রাখেন  ও কৃষক আন্দোলনের প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। বিখ্যাত শিল্পী মায়া রাও তাঁর একটি পারফর্ম্যান্সের মধ্যে দিয়ে নিজের সমর্থন প্রকাশ করেন। এগুলি ছাড়া হরিয়ানার শ্বেতা ও পুনম রাণী ও পাঞ্জাবের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী হরপ্রীত কউর-ও জমায়েতে বক্তব্য রাখেন। মহিলা কৃষক নেত্রী কুলদীপ কউর কুস্যা দু’টি প্রধান দাবিপত্র পেশ করেন। প্রথম দাবিপত্রে দাবি তোলা হয়, অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে সমস্ত গণতান্ত্রিক মহিলা আন্দোলনকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির। দ্বিতীয় দাবিপত্রে সেইসব সাহসী মহিলা সাংবাদিকদের কুর্নিশ জানানো হয় যাঁরা নিরলসভাবে ফ্যাসিস্ট মোদি সরকারের পর্দাফাঁস করছেন। সুচেতক রঙ্গমঞ্চ মোহালি ‘যে হু ভি না বোলে’ নামের একটি নাটক পরিবেশন করে। মহিলাদের অংশগ্রহণ এত বিশাল ছিল যে সমস্ত আয়োজনই যেন মনে হচ্ছিল কম পড়ে যাচ্ছে।

 

শেষে রাজ্য সভাপতি যোগীন্দর সিং উগ্রাহান সমস্ত মহিলা যাঁরা এই জমায়েতে অংশগ্রহণ করেন তাঁদের ধন্যবাদ দেন। তিনি বলেন কোনও আন্দোলন, লড়াই-ই মহিলাদের অংশগ্রহণ ছাড়া সফল হতে পারে না। তিনি বলেন, এই অংশ যাঁরা সমাজের অর্ধেক, শুধু আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্যই তাঁদের প্রয়োজন আছে তা নয়, আমাদের সমাজে মহিলাদের জন্য সমতা তৈরি করার জন্যও তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, তাঁদের সংগঠন সব সময়েই মহিলাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে এবং ভবিষ্যতেও তা একই পথে চলবে।

 

Share this
Tags :
Leave a Comment