উদ্বাস্তু জনপদে ‘নাগরিকত্ব সুরক্ষা যাত্রা’: একটি রিপোর্ট


  • March 5, 2021
  • (0 Comments)
  • 662 Views

এনআরসি-এনপিআর বাতিল ও উদ্বাস্তু বিরোধী ২০০৩ ও ২০১৯ বাতিল এবং শর্তহীন জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে নাগরিকপঞ্জী বিরোধী যুক্তমঞ্চ বা জয়েন্ট ফোরাম এগেইন্সট এনআরসি  ‘নাগরিকত্ব সুরক্ষা যাত্রা’ শুরু করে ২৬ ফেব্রুয়ারি, নদিয়ার বেতাই থেকে। এই যাত্রা শেষ হবে ৫ মার্চ, ২০২১ নাগেরবাজার থেকে দমদম স্টেশন অবধি পদযাত্রার মাধ্যমে। প্রতীপ নাগ-এর প্রতিবেদন।

 

২০১৯-এ সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট বা সিএএ সংসদে পাশ হওয়ার পূর্বে ও তার পরবর্তী সময়ে  গোটা দেশ এক উত্তাল আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছিল। কিন্তু করোনা অতিমারি ও লকডাউনের ফলে এই আন্দোলনে ভাটা পড়ে। যদিও এই আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল শহরাঞ্চল। স্বাভাবিকভাবে বামমনস্ক ও লিবারেলরা ছিল এই আইনের বিরোধী। লক্ষণীয় বিষয়, বিপুল সংখ্যায় মুসলিম নারীদের এই আন্দোলনে যোগদান। দেশের সর্বত্রই তা পরিলক্ষিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়।

 

কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। দেশভাগের ফলে বিপুল সংখ্যায় ওপার বাংলার মানুষ। যার এক বড় অংশ নমঃশূদ্র, মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। আর  এই সম্প্রদায়ের এক বড় অংশের মধ্যে বর্তমানে বিজেপি-র সামাজিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে। যদিও এই উদ্বাস্তু মানুষদের জীবন- জীবিকা নিয়ে লড়াই সংগ্রাম শুরু করেছিল বামপন্থীরা।

 

গোলমালের শুরু ২০০৩ সালের সিএএ আইন প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে।আসলে বিশেষত মতুয়া,নমঃশূদ্র সহ পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা বিজেপি-র চোখে ‘ঘুষপেটিয়া’।তাই, বিজেপি-র নেতা, মন্ত্রীদের দাবি সারা দেশে ২ কোটি আর পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি ‘ অনুপ্রবেশকারী ‘ আছে।  এই বোঝাপড়া থেকেই ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী এনে সকল উদ্বাস্তুদের ‘ইল্লিগাল মাইগ্রেন্ট’ বানায়। ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইন এবং রুলেই দেশজোড়া এনপিআর তৈরি করে, তারপরে ‘ ডাউটফুল সিটিজেন ‘ দের বাদ দিয়ে এনআরসি-র করার কথা বলা হয়েছে।এই ২০০৩ সালের আইন বাতিলের দাবি নিয়ে ঠাকুরনগর থেকেই ২০০৩/২০০৪ সালে আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মতুয়া সমাজের নেতৃত্বের এক অংশ বিজেপির সাথে সমঝোতা করে ২০০৩ সালের আইনকে মেনে নেয়।

 

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে ঠাকুরনগরে বলেছিলেন, নতুন আইন পাশ করিয়ে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দিতে তারা প্রতিশ্রুত। সেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ সংসদে পাশ হয় ২০১৯ এর ১১ ডিসেম্বর।

 

আসলে কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ ২০১৯-এর মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে  তা আসলে এক ভাঁওতা। কারণ, ২০১৯-এর এই আইন নিঃশর্ত নয়। এই আইনের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ‘ অনুপ্রবেশকারী’ তকমা থেকে মুক্ত হতেই বেশ কিছু শর্ত পালন করতে হবে। শুধু শর্ত পূরণ করলেই হবে না, তারা কেবলমাত্র ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করবেন। তাই, দলিত উদ্বাস্তুদের  শর্তহীন নাগরিকত্ব দেওয়া কখনই  সম্ভব নয় সিএএ-২০১৯ আইনের আওতায়।

 

ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, তফসিলি জাতি- উপজাতি- ওবিসি সার্টিফিকেট, প্যান কার্ড, পাসপোর্টের মতন সরকার প্রদত্ত অন্ততপক্ষে একটি হলেও পরিচয়পত্র আছে।সুতরাং, নাগরিকত্ব নির্ণয় বা প্রমাণের জন্য আলাদা করে এনপিআর-এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করার কোনও যুক্তি নেই।

 

তাই, এনআরসি-এনপিআর বাতিল ও উদ্বাস্তু বিরোধী ২০০৩ ও ২০১৯ বাতিল এবং শর্তহীন জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে নাগরিকপঞ্জী বিরোধী যুক্তমঞ্চ বা জয়েন্ট ফোরাম এগেইন্সট এনআরসি  ‘নাগরিকত্ব সুরক্ষা যাত্রা’ শুরু করে ২৬ ফেব্রুয়ারি, নদিয়ার বেতাই থেকে।

 

নদিয়ার তেহট্ট, কৃষ্ণনগর, বাদকুল্লা, রানাঘাট, কুপার্স ক্যাম্প, বগুলা, ট্যাংরাখাল, দত্তফুলিয়া হয়ে এই যাত্রা উত্তর ২৪ পরগনায় ঢোকে ১ মার্চ। সিন্ধ্রানি, হেলেঞ্চা, বনগাঁ, গাইঘাটা, মছলন্দপুর, বাদুরিয়া,  বারাসাত, বাদু, হাতিয়ারা, বাগুইআটি ইত্যাদি অঞ্চলে প্রচার চালানো হয়।

 

এই যাত্রা পথে ইতিমধ্যেই ছোট-বড় মিলিয়ে ২৫টি পথসভা হয়েছে উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চলে, বিলি হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি একটি তথ্যসমৃদ্ধ লিফলেট।

 

উদ্বাস্তু মানুষজন ব্যাপকভাবে এই প্রচারে সাড়া দিয়েছেন, যুক্তমঞ্চের দাবিগুলিকে সমর্থন জানিয়েছেন। এই যাত্রার সক্রিয় সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন মতুয়া সমাজের নেতৃত্বের একাংশও। কিছু জায়গাতে বিজেপি-র সদস্য-সমর্থকরা যুক্তমঞ্চের প্রচারকদের সাথে রাস্তার মধ্যেই বচসায় জড়িয়ে পড়েন, যদিও কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আসলে এনআরসি-সিএএ-র সমর্থকরা মোদী সরকারের কার্যকলাপের পক্ষে কোন যুক্তিই আর দিতে পারছে না। এই যাত্রায় এপিডিআর- এর কৃষ্ণনগর ও বাগুইআটি শাখা, হরিচাঁদ- গুরুচাঁদ- আম্বেদকার চেতনা মঞ্চ, নাগরিক সুরক্ষা মঞ্চ প্রমুখ।

 

এই যাত্রা শেষ হবে ৫ মার্চ, ২০২১ নাগেরবাজার থেকে দমদম স্টেশন অবধি পদযাত্রার মাধ্যমে।

Share this
Leave a Comment