বিচারব্যবস্থায় পিতৃতন্ত্রের নিকষ কালো ছায়া


  • March 3, 2021
  • (0 Comments)
  • 701 Views

সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি যখন একটি ধর্ষনের ঘটনা  প্রসঙ্গে অভিযুক্তের আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন – অভিযুক্ত ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে রাজি কি না – তখন  সত্যিই অস্বস্তি তৈরি হয় এই ভেবে – পুরুষতান্ত্রিকতার শিকড়টি এতটাই গভীরে প্রোথিত যে  দেশের প্রধান বিচারপতিও নিরপেক্ষ, সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারেন না। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদে একটি ধর্ষনের ঘটনায় রায়ের প্রসঙ্গে অভিযুক্তের আইনজীবীকে প্রশ্ন করেছেন – অভিযুক্ত ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে রাজি কি না? যদি এই বিয়ে সম্ভব হত, তাহলে এক নাবালিকাকে দিনের পর দিন ধর্ষনের ঘটনার যে ভয়াবহতা তা কমে যেত বলে ধরে নেওয়া যায়। অন্তত মাননীয় প্রধান বিচারপতি হয়তো তেমনটাই মনে করেছিলেন। আর তা ভেবে নিতে যে তাঁর কোনওই সমস্যা হয়নি, তার কারণ তিনি সেই সমাজেরই ফসল যেখানে নাবালিকা বিবাহ, ধর্ষন এখনও খাতায়-কলমে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও তা হরবখত ঘটে চলেছে। আইনব্যবস্থাকে সমাজবিচ্ছিন্ন বলে গন্য করার কোনও কারণ থাকতে পারে না। একজন ব্যক্তি দেশের আইনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান পদে আসীন হয়েছেন মানেই তিনি শতকের পর শতক চলে আসা পিতৃতন্ত্রের শিকড় নিজের ভেতর থেকে উপড়ে ফেলতে পেরেছেন এমনটা আশা করাও ভুল বলে মনে হয়।

 

আসলে, একেকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ শিরোনাম তৈরি হলেই কেবলমাত্র তা নিয়ে হুলুস্থুলু তৈরি করাটা এখন আমাদের প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ কোন ঘটনাক্রমে এ ধরনের রায়, বক্তব্য উঠে আসে, কোন মানসিকতার প্রকাশ ঘটে তা নিয়ে নিয়মিত চর্চা আর আলোচনার জায়গাটি ক্রমেই যেন কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার তত্ত্বকথার চাপান-উতোরে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ যেখানে দাঁড়িয়ে দেশের প্রধান বিচারপতিকেও প্রশ্ন করা যায়, তাঁর বক্তব্যেরও কৈফিয়ৎ চাওয়া যেতে পারে, দেশের বিচারব্যবস্থার কোনওরকম অবমাননা না ঘটিয়েও যেখানে একজন নাগরিক হিসাবে, একজন মহিলা হিসাবে এহেন অসংবেদনশীল ও অসাংবিধানবিক মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়, উচিত ছিল সেই পরিসরটিকে আরও বেশি অর্ন্তভুক্তিমূলক করা, তথাকথিত শিক্ষিত, শহুরে তাত্ত্বিক নারীবাদের আওতার থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে তাকে এ দেশের মাঠ-বন্দর-খনি-জঙ্গলের মহিলাদের কথা বলার নেতৃত্বে নিয়ে আসা। অবশ্য বাস্তবে নিজেদের মতো করে লড়াইটা তাঁরা লড়েই নেন। শুধু মাঝেমধ্যে এ ধরনের মন্তব্য মনে করিয়ে দেয় সমস্ত আন্দোলনের আগে আমাদের বোধহয় নিজেদের বেড়ে ওঠা, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার পরিসরের মধ্যেই সারাক্ষণ প্রশ্ন জাগিয়ে রাখাটা সবচেয়ে জরুরি। ব্যক্তিগত পরিসরে আমরা যারা স্বীকার করে নিই আমাদের সামান্যতম ক্ষমতায়নও ঘটেছে, কেবল নিজের জন্য নয়, আমার সহ নাগরিক মেয়েটি, মহিলাটির জন্যও বিনা ভয়ে, বিনা অস্বস্তিতে প্রশ্ন করে যাওয়ার পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বটুকু নিতেই হবে।

 

এই কথাটুকু ভুলে গেলে কী করে হবে যে, প্রধান বিচারপতি যখন একজন অভিযুক্ত ধর্ষককে জিজ্ঞেস করেন একজন নাবালিকাকে দিনের পর দিন ধর্ষনের পর, ঘটনা সামনে আসার পরে শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে ধর্ষিতা মেয়েটি এখন যখন সাবালিকা হয়ে গেছেন তখন তিনি বিয়ে করবেন কি না – তখন আর কেবলমাত্র দেশের প্রধান বিচারপতি হিসাবে নয়, একজন ব্যক্তিমানুষ হিসাবে, যিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি সামাজিক জীবন কাটান, তাঁর সম্পূর্ণতা নিয়েই প্রশ্ন জাগে। ব্যক্তি হিসাবে, পুরুষ হিসাবে সামগ্রিকভাবে নারীর সামাজিক অবস্থান নিয়ে তাঁর এরকম চিন্তা সামনে উঠে এলে তখন সত্যিই অস্বস্তি তৈরি হয় এই ভেবে – পুরুষতান্ত্রিকতার শিকড়টি এতটাই গভীরে প্রোথিত যে এমনকি দেশের প্রধান বিচারপতিও নিরপেক্ষ, সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারেন না। তিনিই অপর একটি মামলার ক্ষেত্রে মন্তব্য করেছিলেন যে দু’জন নারী-পুরুষ যখন স্বামী-স্ত্রী হিসাবে একে অপরে সঙ্গে থাকেন তখন পুরুষটি স্বভাবগতভাবে খানিক নিষ্ঠুর হলেও আইনিভাবে বিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীর মধ্যে যৌন মিলনকে কি ধর্ষন বলা যায়? যৌনতার দিক থেকে নারী অবস্থানকে অকার্যকর করে দেওয়ার এর থেকে স্পষ্ট উদাহরণ এই দু’টির থেকে আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। দু’টি ক্ষেত্রেই যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষদের অবস্থানকে সর্বোচ্চ ও প্রশ্নহীন করে তোলা হচ্ছে। এবং বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটিকে মহিলাদের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হচ্ছে অলঙ্ঘনীয় হিসাবে। আইনিভাবে পরোক্ষে হলেও যখন এহেন শীলমোহর পাওয়া যায় তখন সামাজিকভাবে বিয়ের দোহাই দিয়ে মেয়েদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জীবন-জীবিকার মতো মৌলিক অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া আরও সহজ হয়ে যায়।

 

শব্দের ব্যবহার নিয়েও যে অস্বচ্ছতা (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) তা আবারও প্রশ্ন তুলতে বলে। প্রধান বিচারতপতি অভিযুক্তকে বলেছেন যে একজন নাবালিকাকে ‘সিডিউস’ বা প্রলুব্ধ করা ও ধর্ষন করার মতো ঘটনার যা ফলাফল হতে পারে সে বিষয়ে তার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এ কথা বোধহয় এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (যে কোনও লিঙ্গ পরিচিতির। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ) যখন উভয়ের সম্মতিক্রমে যৌন সম্পর্কে প্রবেশ করছেন তখন ‘সিডিউস’ বা প্রলুব্ধ করা সেই যৌনতার অংশ হয়ে ওঠে ও তা উভয়ের সম্মতিতে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতায় মহিলাদের এ বিষয়ে অংশগ্রহনকে প্রধান বিচারপতি সম্ভবত মানতে পারবেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে ধর্ষন ঘটেছে একজন নাবালিকার, সম্মতির কোনও প্রশ্নই নেই, সুতরাং ‘সিডিউস’ বা প্রলুব্ধ করার বিষয়টিও গ্রাহ্য হচ্ছে না।

 

এই দু’টি উদাহরণ প্রসঙ্গেই দেখা যাচ্ছে পুরুষেরা যেকোনও রকম যৌন সম্পর্কেই যে বলপ্রয়োগ করতে পারেন, নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারেন প্রধান বিচারপতি যেন সেই বিষয়টিকেই সহজ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাইছেন। আলোচ্য ঘটনায় শুধু ধর্ষন নয়, মেয়েটিকে শারীরিকভাবে চূড়ান্ত অত্যাচার করার পাশাপাশি ঘটনার কথা কাওকে বললে জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া বা অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়া, তার ভাইকে মেরে ফেলার মতো নৃশংসতম ভয়ও দেখানো হয়েছিল। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি মেয়েটির সাঙ্ঘাতিক মানসিক ট্রমার বিষয়টিও সমানভাবে বিচার্য। অথচ কী অবলীলায় অভিযুক্ত বলছেন যে ঘটনায় তার শাস্তি হলে তার সরকারি চাকরি চলে যেতে পারে এবং বিচারব্যবস্থা চেষ্টা চালিয়ে যায় তাকে সাহয্য করার। এধরনের মন্তব্য, রায়ের ফলে যার সঙ্গে ঘটনাটি ঘটছে সেই মেয়েটির বা মহিলাটির আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধও এক বিরাট ধাক্কা খায়। কারণ এক্ষেত্রে মেয়েটি/মহিলাটির মতামত জানার বা তাকে প্রশ্ন করার প্রয়োজনও বোধ করা হয় না। যেন ধর্ষিত হওয়ার দায় ও পরে অভিযুক্তকে বাঁচিয়ে দেওয়ার দায়ও এক ও একমাত্র তাঁরই। নিজেদের নিছক বিবাহযোগ্য পন্য মনে করা এবং চরমতম হেনস্থাকারীর সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ফরমান পাওয়ার পর চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর দায় ক্রমশ পিতৃতন্ত্রের প্রতিভূ হয়ে উঠতে থাকা এ দেশের বিচারব্যবস্থা নেবে কি? নেবেন কি দেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি?

 

এই একটি ঘটনা নয়। মেয়েটি আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে ও মা দেখতে পেয়ে যাওয়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাচ্ছে। মেয়েটির পরিবার ভয় না পেয়ে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে এটুকুই আশার আলো। সামাজিকভাবে হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কা পেরিয়েও নিজের ন্যায় পাওয়ার অধিকার ও সম্মানের দাবিতে বিচারব্যবস্থার কাছে পৌঁছানোটা যেকোনও পরিস্থিতিতে জরুরি। দেশের নাগরিক হিসাবে আইনি সাহায্য পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। যত বেশি এধরনের ঘটনা বিচারব্যবস্থার আওতায় আসবে ততই হয়তো আইনের ফাঁকফোকরগুলি নজরে আসবে, স্পষ্ট হবে তাঁর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের পিতৃতান্ত্রিক চেহারা। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যে অন্তঃসারহীন চরিত্র সেগুলি আরো পরিস্কার হবে। দেশ জুড়ে প্রতিবাদের স্বর হবে আরও উঁচু তারে বাঁধা। এই যে ধর্ষিতা মেয়েটির মা, পরিবার আদালতে গেছেন ন্যায়ের দাবি নিয়ে, হাথরাসে হেনস্থাকারীর হাতে বাবা খুন হয়ে যাওয়ার পরেও যে মেয়েটি ভয় পেয়ে মুখ লুকোননি, অসহনীয় যন্ত্রণা আর রাগ উগরে দিয়েছেন খুনী সমাজের বিরুদ্ধে তারা নিজের লড়াইটা নিজেরাই লড়ছেন। দরকার শুধু পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত করে পরস্পরের হাতটুকু ধরার।

 

Share this
Leave a Comment