ভাষা দিবস, ভাষার সমাজ-রাজনীতি, ভাষার লড়াই


  • February 20, 2021
  • (0 Comments)
  • 1769 Views

হিন্দুত্বের ভাষা হিসাবে সংস্কৃত-ঘেঁষা হিন্দির আধিপত্য গোটা দেশে কায়েম করার পিছনে সরকার-প্রশাসনের মদত খোলাখুলি কাজ করছে। ২০১১ সালের সরকারি আদমশুমারির প্রতিবেদনে উত্তর ও মধ্য ভারতের ২৬টি ভাষাকে পৃথক ভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে হিন্দির অংশ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। লিখেছেন বিপ্লব নায়ক

 

 

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি বাংলাভাষীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে ১৯৫২ সালে এইদিনে যাঁরা ভাষাশহীদ হয়েছিলেন কেবলমাত্র তাঁদের স্মরণ করার দিন বা বাংলা ভাষার অধিকার উদযাপনের দিনই নয়, ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই দিনটি বিশ্বের সমস্ত মাতৃভাষার অধিকারের দিন হিসাবে আজ চিহ্নিত হয়েছে। উদযাপনের থেকেও উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন বেশি এই দিনে, কারণ গোটা বিশ্ব জুড়ে মাতৃভাষাগুলি আজ বিপন্ন। ভাষাতাত্ত্বিকদের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে ৭০০০ থেকে ১০০০০ ভাষা আছে, তাদের মধ্যে বড় সংখ্যক বাচক রয়েছেন, এমন গুটিকয় ভাষা বাদে বাকি সবারই আজ শিরে সংক্রান্তি অবস্থা; তার কারণ –

 

১) এই ভাষাগুলির বাচকসংখ্যা ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের মুখে এই ভাষা ক্রমশ আরো কম সঞ্চারিত হচ্ছে;

 

২) বিভিন্ন সামাজিক-ব্যবহারিক ক্ষেত্রে (যেমন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ব্যবহার, শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার, সরকারি-প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার, ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহার ইত্যাদি) এই ভাষাগুলির জায়গা দখল করে নিচ্ছে অন্য কোনো আধিপত্যকারী ভাষা;

 

৩) এভাবে কোণঠাসা হতে হতে কিছু কিছু ভাষা তার শেষ বাচকটিকেও হারিয়ে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এবং এই ভাষামৃত্যুর হার বেশ তীব্র (প্রতি দুই সপ্তাহে একটি, ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী);

 

৪) গুটিকয় অতিকায় ভাষা (তার মধ্যে বাংলাও পড়ে) ঘাতক ভাষা হিসাবে অন্য ভাষাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে সামাজিক-ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য জারি করছে, সবচেয়ে দোর্দণ্ড ঘাতক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে ইংরেজি।

 

আমাদের পশ্চিমবাংলায়, বাংলা ভাষা (মান্য/প্রমিত বাংলা ভাষা) অন্য সমস্ত ভাষা, যেমন সাঁওতালি, কুরমালি, কামতাপুরী, সাদরি, টোটো, তামাঙ, লেপচা ইত্যাদির থেকে সামাজিক-ব্যবহারিক ক্ষেত্র দখল করে নেওয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া চালিয়ে আধিপত্য করছে, আবার অন্যদিকে সে নিজে ইংরেজি ভাষার কাছে ক্রমশ সামাজিক-ব্যবহারিক ক্ষেত্র খুইয়ে চলেছে।

 

আবার গোটা ভারত জুড়ে চলেছে হিন্দি-হিন্দু সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দৌরাত্ম্য। এই হিন্দি-হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিন্দু সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে চাগিয়ে তুলে হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসী অভিজানের মধ্য দিয়ে ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-পরম্পরার সমস্ত বয়ানকে নিজেদের কেটে দেওয়া গণ্ডিতে বাঁধতে চাইছে। অপর সমস্ত বয়ানকে প্রপ্তিপন্ন করতে চাইছে বিদেশী বা দেশবিরোধী হিসেবে। হিন্দুত্বের ভাষা হিসাবে সংস্কৃত-ঘেঁষা হিন্দির আধিপত্য গোটা দেশে কায়েম করার পিছনে সরকার-প্রশাসনের মদত খোলাখুলি কাজ করছে। এমনকি ২০১১ সালের সরকারি আদমশুমারির প্রতিবেদনে (এটিই এযাবত সর্বশেষ ভাষাসমীক্ষা) উত্তর ও মধ্য ভারতের ২৬টি ভাষাকে (ভোজপুরি, রাজস্থানি, মাগধি, ছত্তিসগড়ি, হরিয়ানভি, মালভি, মেওয়ারি, গাড়ওয়ালি, সাদরি ইত্যাদি) পৃথক ভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে হিন্দির অংশ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

এইভাবে ভাষার জগতে ঘাতক ভাষাদের আধিপত্যের ফলে ভাষার মড়ক সমাজ-ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে যে শঙ্কা তৈরি করেছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে চিহ্নিত করে ভাষিক অধিকার রক্ষা ও ভাষাবৈচিত্র্য রক্ষার আহ্বান সামনে আনার মধ্য দিয়ে।

 

এখন প্রশ্ন হল, সমাজ-ভাষাতাত্ত্বিকদের এই শঙ্কা ও উদ্যোগকে কি আমরা তাঁদের পেশাদারী বিশিষ্টতা বলে নিজেদের ভাবনাচিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখব, না কি আমাদেরও ভাবিত হওয়ার মতো কিছু আছে?

 

বহু ছোট ছোট (বাচক সংখ্যার নিরিখে) ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে গুটিকয় অতিকায় ভাষা যদি থানা গেড়ে বসে তো ক্ষতি কী? তা কি গোটা বিশ্বের মানুষদের মধ্যে যোগাযোগের, মতবিনিময়ের সুবিধাই করে দেবে না? বহু ভাষা কি অসুবিধার বস্তু নয়? প্রথমেই এইসব প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু ভাষা তো কেবল যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, ভাষা তো এমন একটি আধার যার মধ্যে একটি জনগোষ্ঠীর প্রজন্মবাহিত জ্ঞান আধারিত হয়। একটি ভাষার অকালমৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া, অর্থাৎ সামাজিক-ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ক্রমশ জায়গা হারানো এই বিশেষ প্রজন্মবাহিত জ্ঞান-সংস্কৃতি বোধকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়। যোগাযোগের বা ভাববিনিময়ের প্রয়োজনে মানুষ নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাও রপ্ত করেছে, বহুভাষী হয়েছে, তাতে তো কোনো অসুবিধা হয়নি! সেজন্য কোনো ভাষাকে অবলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়ে মানুবসভ্যতার জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সংকুচিত করা কি প্রয়োজনীয়, নাকি বাঞ্ছনীয়?

 

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যে জ্ঞান-সংস্কৃতি-বোধ এমনিতেই লোপের সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে, তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করার আদৌ কোনো অর্থ হয় কি? সভ্যতার অগ্রগতির ধারায় যা ঝরে পড়ার, তাকে ঝরে পড়তে দেওয়াই উচিত নয় কি? প্রশ্নটি জটিল। কারণ, সভ্যতার অগ্রগতি বলতে কী বুঝব, তা মোটেই তর্কনিরপেক্ষ নয়। পশ্চিম ইউরোপে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশলাভ ঔপনিবেশিকতার মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বে তার আধিপত্য বিস্তার, লগ্নি পুঁজির অর্থনৈতিক শৃঙ্খলরচনার মধ্য দিয়ে আধিপত্যের সুদৃঢ়করণ ও অধুনা পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতা ও আধিপত্যকে আরো কেন্দ্রীভূত করার প্রক্রিয়া ‘সভ্যতার অগ্রগতি’ সম্পর্কে এমন এক মতবাদিক ধারণা নির্মাণ করেছে যার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক স্তরে সমস্ত কিছুর পণ্যায়ন, সাংস্কৃতিক স্তরে পণ্যসংস্কৃতি, ভোগবাদ ও গোটা পৃথিবীর ইউরোপীয়-আমেরিকীকরণ, ও তার সঙ্গে যুক্তভাবে ভাষিক স্তরে পুঁজিবাদী কেন্দ্রের ভাষা ইংরেজিকে সর্বত্র সর্বপ্রধান ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করাকেই সভ্যতার অগ্রগতির একরৈখিক গতি হিসাবে হাজির করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রস্তাবিত ‘অগ্রগতি’ ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদকে পণ্যায়িত ভোগ্যসামগ্রীতে রূপান্তরিত করতে গিয়ে গোটা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের সংকট ঘনিয়ে তুলেছে, বহু জীব-প্রজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে, মানবসমাজকে প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন করে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের বিষে পঙ্গু করে তুলেছে, আধিপত্যশৃঙ্খলের ঝনঝনায় আত্মঘাতী পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা নিরন্তর ফেনিয়ে তুলছে। এই প্রশ্ন আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না যে, এই পথ কি সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথ, নাকি অগস্ত্যযাত্রার পথ? তাই, দুনিয়া জুড়ে পণ্যায়ন, পুঁজিবাদী সংস্কৃতি ও ইংরেজির আধিপত্যপ্রতিষ্ঠার আক্রমণের মুখে দুনিয়া জুড়ে যে বহু ভিন্নতর সংস্কৃতি ও ভাষা আজ বিলুপ্তির মুখে, তাদের পরিত্যাজ্য বলে কালবৈশাখীর হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া আর সম্ভব নয়। ভাষা-সংস্কৃতি ও মানবজ্ঞানের জগতে বহুবিচিত্র অর্জনকে ‘সভ্যতার অগ্রগামিতার দম্ভে’ পদপিষ্ট করে একক একটি আধিপত্যকারী বয়ান তৈরি নয়, বরং বহু বিচিত্রের মধ্যে নিবিষ্ট বহু মানব-অভিজ্ঞতা ও মানবজ্ঞানের স্ফূর্তি ও বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে মানবসভ্যতার এমন এক প্রান্তরই আমাদের গড়ে তুলতে হবে একরৈখিক পথের নেশা ছেড়ে। সেইজন্যই পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা দরকার, প্রতিটি ভাষা-সংস্কৃতির অন্তর্গত প্রজন্মবাহিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-বোধের মর্যাদাপূর্ণ চর্চাকে প্রসারিত হতে দেওয়ার পরিসর রচনা দরকার। এমত শতফুল বিকাশের মধ্য দিয়েই সম্ভবত প্রাকৃতিক ও ভাষিক বাস্তুতন্ত্রের বর্তমান মড়কগ্রস্ত দুরদশার অবসান ঘটিয়ে মানবসমাজ ও তার ধাত্রী এই গ্রহের ভবিষ্যতকে কিছুটা শঙ্কামুক্ত করা সম্ভব হতে পারে।

 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভাষিক অধিকার ও ভাষাবৈচিত্র্য রক্ষার আহ্বান তাই কেবল মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো কিছু ভাষার পুনরুজ্জীবনের জন্য সংগ্রামের আহ্বান নয়, তা মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো মানবসভ্যতা ও তার ধাত্রী গ্রহেরও পুনরুজ্জীবনেরও সংগ্রাম। স্বভাবতই এই সংগ্রাম কেবল একদিনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়ার নয়, বরং প্রতি পল-অণুপলে নতুন জীবনচর্চা ও সমাজচর্চা গড়ে তোলার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম মরশুমি অনুষ্ঠানমঞ্চ বা সভাগৃহের সংগ্রাম নয়, অবহেলিত জনপদে জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতির প্রবাহ বাহিত রাখা ও ভাষিক সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার মজবুত করার সাধনায় তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মেলানোর সংগ্রাম। ২১ ফেব্রুয়ারি বছরের একটি দিন মাত্র, কিন্তু এ সংগ্রাম প্রতিদিনের।

 

ভারতে ভাষা-আন্দোলনের ঐতিহ্য বেশ লম্বা। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে হিন্দি-আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্য বর্তমান। অসমের বরাক উপত্যকায় অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে বাংলাভাষীদের আন্দোলনও স্মরণীয় হয়ে আছে। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গেও সাঁওতালি, কামতাপুরী, সাদরি, কুরমালি-ভাষীরা নিজ ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে নানা মাপের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কিন্তু সেখানে একটা সীমাবদ্ধতার কথা না বললেই নয়। ভাষা নিয়ে এই আন্দোলনগুলো মূলত সরকারি তফশিল তালিকায় স্থান পাওয়ার দাবি, ভাষা-আকাদেমি বা কিছু একটা ভাষা-স্কুল খোলার দাবি এবং সরকারি কিছু স্বীকৃতি-সহায়তা আদায়ের দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। কিন্তু ভাষা-স্কুল বা ভাষা-আকাদেমি সরকারি সহায়তায় চালু হলেও সেই ভাষা-ভাষী সাধারণ মানুষদের প্রাত্যহিক স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ ও অংশগ্রহণের অভাবে প্রাণহীন হয়ে থাকছে, কোনো না কোনো সংকীর্ণ স্বার্থের ঘুঘুর বাসায় পরিণত হচ্ছে, আর ভাষার দুর্ভোগ ও মৃত্যুপথযাত্রা বহাল থাকছে। সরকার-কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র পরিসরের বাইরে কীভাবে এই আন্দোলন বেরোতে পারে, কীভাবে তা জনসমাজের বৃহৎ পরিসরে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অংশগ্রহণের প্রাণশক্তি নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে, সেটাই এখন ভাবার মূল বিষয়।

 

  • লেখক একজন সামাজিক  কর্মী 

 

Share this
Leave a Comment