অতিমারির শিক্ষা


  • January 6, 2021
  • (0 Comments)
  • 799 Views

এটা কোনও আশঙ্কার কথা নয়। কোনও ষড়যন্ত্র-তত্ত্বও নয়। কোভিড-কালে আমরা যদি নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্তের বক্তব্য মন দিয়ে পড়ি আমাদের বোধহয় আর কোনও সংশয় থাকে না যে ‘বিপর্যয়ের সুবর্ণসুযোগ’ গ্রহণে ধনতন্ত্র কতটা মরিয়া হয়ে ওঠতে পারে। লিখছেন দেবাশিস আইচ

 

ভয়াবহ বিপর্যয়ের একটি বছর পার হল। বিপর্যয়ের রেশ অবশ্য রয়ে গিয়েছে। বিশ্বজোড়া একটি স্বাস্থ্য-বিপর্যয় শুধু হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়নি আরও বহু বহু সংখ্যক মানুষের সামাজিক, আর্থিক জীবন তছনছ করে দিয়েছে। সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষের জীবনে যার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ এমনকি লক্ষ লক্ষ স্বচ্ছল মানুষ তাঁদের রুজিরোজগার হারিয়েছেন। আবার এই অতিমারির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। আমাদের দেশে এসবই ঘটতে পারল কেন্দ্রীয় সরকারের চরম নীতিহীনতার কারণেই। বা এভাবেও বলা যায় মানুষ-বিরোধী নীতির তাড়নায়। এই সময়ের সবচেয়ে বড় শিক্ষা বোধহয় এই যে, একটি দেশকে, একটি দেশের ১৩০ কোটি মানুষকে স্রেফ খানদুই নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও খানকয়েক দণ্ডবিধির সাহায্যে ঘরবন্দি করে ফেলা যায়। এবং তার জন্য কোনও সংসদের, কোনও মন্ত্রিসভার বা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং হাতে গোনা কয়েকজন নীতিনির্ধারক অনায়াসে একটি দেশকে টেলিভিশন বার্তার মধ্য দিয়ে চারঘণ্টার মধ্যে স্তব্ধ করে দিতে পারে। এমনভাবে তো দেশে জাতীয় জরুরি অবস্থাও জারি করা যায় না। ঔপনিবেশিক এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট, ১৮৯৭ ও ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৫ এমই দুটি নিয়ন্ত্রণমূলক আইন। এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারা ১৮৮ ও ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ধারা ১৪৪ হল দুটি দণ্ডবিধি।

 

জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করতে হলে, সে যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ যে কারণেই হোক না কেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদন প্রয়োজন, অনুমোদন প্রয়োজন সংসদের উভয়কক্ষের। আমরা দেখলাম, স্রেফ প্রধানমন্ত্রী একটি ভাষণের মধ্য দিয়েই সারা দেশের নীতিনির্ধারণের দায় কেন্দ্রীয় নির্বাহিকদের হাতে তুলে দিলেন। তার আগেই অবশ্য কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজ্যগুলিকে পরামর্শ দিয়েছিল মহামারি আইন প্রয়োগ করতে। আর ২৪ মার্চ মধ্যরাতে জারি হয়ে গেল বিপর্যয় মোকাবিলা আইন। দেশ স্তব্ধ হল। স্বাস্থ্যবিধির দোহাই দিয়ে, বিশেষ করে নিন্মআদালতগুলি বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় পঙ্গু হয়ে গেল হাইকোর্টগুলি ও সুপ্রিম কোর্ট। বিধি মানানোর দায়িত্ব পড়ল পুলিশ-প্রশাসনের উপর এবং সে কাজে তারা ফের যথাচ্ছাচারের নজির রেখে নাগরিকদের পিটিয়ে মারল পর্যন্ত। প্রথম তিনমাসে রাজ্য সরকারগুলির ব্যর্থতার খবর করার অপরাধে ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। গ্রেপ্তার হতে হয় কয়েকজনকে। হাসপাতালে হাসপাতালে করোনা-আক্রান্ত ছাড়া অন্যান্য জরুরি, মায় হৃদরোগ কিংবা ক্যানসার আক্রান্তের চিকিৎসাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। বন্ধ হয়ে গেল টিকাকরণ থেকে মিড ডে মিল। লাটে উঠল শিক্ষাব্যবস্থা। যা আজও স্বাভাবিক হয়নি। এ সবই হল কেন্দ্রীয় আমলাদের নির্দেশ মাফিক। দেশ চলে গেল তাদের নিয়ন্ত্রণে। ঠিক জরুরি অবস্থাতে যা ঘটে থাকে। শুধু কি তাই? জরুরি অবস্থাকালীন যেসব বিষয় সাংবিধানিকভাবে রাজ্যের অধীন, সে বিষয়েও নিয়ন্ত্রণ নিল কেন্দ্র। রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্রীয় আমলাদের রাজ্য পরিদর্শন তার একটি ছোট উদাহরণ। সবচেয়ে মারাত্মক উদাহরণ অধ্যাদেশ জারি করে কৃষি আইন বলবৎ করা। কৃষি বিষয়ক বিধিপ্রণয়নের মূল ক্ষমতা তো রাজ্যের অধীন। ছ’মাস পর সংসদের অধিবেশন বসল বটে, কিন্তু তা হল সাংসদদের আলাপ-আলোচনা, প্রশ্ন করার মূল অধিকারকে চূড়ান্ত ভাবে খর্ব করে। পরিশেষে গা-জোয়ারি করে পাশ হয়ে গেল কৃষি আইন। বকলমে এ যদি জাতীয় জরুরি অবস্থা না হয় তবে জাতীয় জরুরি অবস্থা কী। এ হল স্বৈরাচারী ও সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্রের এক নির্লজ্জ নমুনা।

 

১ মে ২০২০, শ্রমজীবী বার্তায় প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ‘বিপর্যয়ের সুবর্ণ সুযোগ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মী নাওমি ক্লাইনের একটি বহু আলোচিত এবং বিতর্কিত বইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। বইটি হল, দ্য শক ডকট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম। যেখানে নাওমির তাত্ত্বিক ভাবনাকে তিনি ব্যাখ্যাও করেন। নাওমির মতে, অনির্বাণের ভাষায়, “নিয়ো লিবারাল ধনতন্ত্র পরিকল্পনা করেই বিপর্যয় সৃষ্টি করে; কারণ বড় রকমের সঙ্কটকালে এই তন্ত্রের ধারক ও বাহকদের পক্ষে অনুকূল এমন অনেক নীতি এবং কার্যক্রম চালু করে দেওয়া যায়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যা বলবৎ করা তুলনায় কঠিন।” “বিপর্যয় কেবল মুনাফা বাড়ায় না, রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে সমাজে নিয়ো লিবারাল অর্থনীতির চালকদের আধিপত্য আরও জোরদার করতে সাহায্য করে।”

 

নাওমি ক্লাইনের বইটি আমেরিকার উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষিতে লেখা। কিন্তু, কোভিড-১৯ বিপর্যয় যে পরিকল্পনা করে সৃষ্টি করা হয়েছে এ কথা অবশ্য অনির্বাণ মনে করেন না। সে কথা বললে এই ‘বিপর্যয়-ধনতন্ত্রের লীলা’-র যে ‘সরলীকরণ’ হবে তা তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে এ কথাও স্পষ্ট করেছেন, “…এই দুর্যোগের সৃষ্টি, প্রসার এবং ফলাফলের গোটা প্রক্রিয়াটিতে ধনতন্ত্রের যে বিরাট ভূমিকা, সেটা লক্ষ্য না করলে যে অপরাধ হয় সেটা অতিসরলীকরণের চেয়ে গর্হিত।” তিনি যে জায়গাটার উপর জোর দিতে চেয়েছেন তা হল, সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে আধিপত্য কায়েম রাখা এবং বজায় রাখার ধারাবাহিক প্রচেষ্টাকে।

 

এটা কোনও আশঙ্কার কথা নয়। কোনও ষড়যন্ত্র-তত্ত্বও নয়। কোভিড-কালে আমরা যদি নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্তের বক্তব্য মন দিয়ে পড়ি আমাদের বোধহয় আর কোনও সংশয় থাকে না যে ‘বিপর্যয়ের সুবর্ণসুযোগ’ গ্রহণে ধনতন্ত্র কতটা মরিয়া হয়ে ওঠতে পারে। ১১ মে ২০২০ টাইমস অব ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে অমিতাভ কান্ত এক নিবন্ধে সেই মরিয়াভাবটিকেই যেন অক্ষরে অক্ষরে পরিস্ফুট করে তুলেছেন। তাঁর নিবন্ধের শিরোনামটি এরকম, ইটস নাউ অর নেভার: স্টেটস আর ড্রাইভিং বোল্ড রিফর্মস। উই উইল নেভার গেট দিজ অপরচুনিটি এগেইন, সিজ ইট।’ কখন তিনি বলছেন এ কথা? যখন মজুরি, ছাদ হারিয়ে, আধপেটা খেয়ে কোনওরকমে বেঁচেবর্তে থাকা লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ট্রেনে-বাসে, যে যেমনভাবে পারছেন গ্রামে ফিরে চলেছেন। দুর্ঘটনায়, পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে, অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার খবর মিলছে দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে।

 

এমন একটা সময় নীতি আয়োগের বড় কর্তা লিখছেন, সাহসী সংস্কারের এমন সুযোগ আর মিলবে না। লিখছেন, ১৯৯১ সালের সংস্কার শুরুর পর উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ গুজরাত সাহসীতম, নির্ভীকতম এবং শ্রমবাজারের আমূল সংস্কারের সূচনা করেছে। কীভাবে? সিইও জানাচ্ছেন, একগুচ্ছ শ্রমআইনকে ঠান্ডা ঘরে পাঠানোর মাধ্যমে উৎপাদনশিল্পকে নমনীয়তা প্রদান করে।

 

তিনি লিখছেন, লালফিতের ফাঁস, ইন্সপেক্টর রাজ আর যা কিছু মান্ধাতা আমলের শ্রমআইন রয়েছে তা বাতিল করে দিতে কোভিড-১৯ ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটকের কাজ করবে। তখনও শ্রমআইন বিরোধীহীন সংসদে পাশ হতে প্রায় পাঁচ মাস বাকি। এই রাজ্যগুলি এই অতিমারি-কালে অধ্যাদেশ জারি করে শ্রমিকদের তাবড় অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। যে কথাটা তিনি বলেননি যে, আইন-আদালত, সংসদের মতো মান্ধাতার আমলের ব্যবস্থাটিও এর সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেওয়া গেল। বাতিল করে দেওয়া গেল, বাকস্বাধীনতা ও তর্কবিতর্কের স্বাধীনতাকেও। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও প্রগতির যা পূর্বশর্ত। যে বিড়ালটিকে তিনি শেষ পর্যন্ত ঝুলি থেকে বার করলেন, দক্ষিণপন্থী এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়। বলবেন, আর্থিক সংস্কারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা, “উই আর টু মাচ অফ এ ডেমোক্র‍্যাসি’। কৃষকদের আন্দোলনে বিরক্ত হয়েই তো তাঁর এই অভিমত। কেননা গা-জোয়ারি করে সংসদে পাশ হয়ে যাওয়ার পর উচ্ছ্বসিত অমিতাভ বলেছিলেন, “নব্বইয়ের আর্থিক সংস্কার এতদিনে কৃষিতে এসে পৌঁছল।”

 

তিনি তাঁর প্রবন্ধটি শেষ করছেন এভাবে, “প্রতিটি সঙ্কটকাল একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। একটি বিশাল সাহসী কাঠামোগত সংস্কার (স্ট্রাকচারাল রিফর্ম) সূচনা করতে ভারতরাষ্ট্রকে এই সুযোগকে আঁকড়ে ধরতেই হবে। আমরা আর কখনও এই সুযোগ পাব না।” আর ঠিক একমাস বাদে ১১ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, উদার অর্থনীতির ঝাণ্ডাওয়ালাকে বলতে শুনব একই কথা। এই জুনেই কেন্দ্র কৃষি-অধ্যাদেশ জারি করেছে। কলকাতার ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের ৭৫তম প্লেনারি সেশনে সেদিন মোদী শোনাবেন তার কাহিনি। বলবেন, কেন্দ্র কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে বহুকালের ‘দাসত্ব’ থেকে মুক্তি দিয়েছে। বলবেন, আত্মনির্ভর ভারতকে গড়ে তুলতে সঙ্কটকে সুযোগে বদলে দিতে হবে। এখন নিশ্চয়ই বলতে অসুবিধা নেই যে, এ আসলে বিপর্যয়-ধনতন্ত্রের তুর্যনিনাদ।

 

বছর শেষে মোদীতন্ত্রকে সাহসী ও নির্ভীক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন দেশের কৃষক সম্প্রদায়। প্রবল শীতে রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থান করে চলেছেন তাঁরা। ইতিমধ্যেই শীতের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৪০ জন কৃষকের। কিন্তু, ‘বিপর্যয়-ধনতন্ত্রের লীলা’ সাঙ্গ করতে এ ছাড়া আর যে কোনও পথই খোলা রাখেনি এই ফ্যাসিস্ত সরকার।

 

 

লেখক স্বাধিন সাংবাদিক।

 

Share this
Leave a Comment