মহামারীর পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী অধিকারের লড়াইয়ের নতুন অভিমুখ


  • December 3, 2020
  • (1 Comments)
  • 1608 Views

অধ্যাপক, মানবাধিকার কর্মী ও বর্তমানে ৯৯% প্রতিবন্ধী জি.এন. সাইবাবা দেশদ্রোহীতার অপরাধে বিনা শুনানীতে নাগপুর জেলে আন্ডা সেল-এ বছরের পর বছর বন্দী হয়ে পড়ে থাকেন। পারকিনসনস আক্রান্ত অশীতিপর সামাজিক কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীও একই কারণে একইভাবে আটক হয়ে থাকেন। তাঁর প্রয়োজনীয় স্ট্র ও সিপারের দাবিটুকুও দিনের পর দিন উপেক্ষিত হতে থাকে। রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা যখন এভাবে প্রতিবন্ধী অধিকার তথা নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করতে থাকে, তখন তাদের কাছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণা মেনে প্রতিবন্ধী নাগরিদের অধিকার ও তাদের জন্য অর্ন্তভুক্তিমূলক পরিকাঠামো আশা করাটাই বৃথা। আজ ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।

 

 

৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতি বছরই এই দিনটি উদযাপিত হয় প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার, তাদের সামাজিক অবস্থান, তাদের সাফল্য, সমস্যা সবটুকু নিয়ে আলোচনার পরিসরটিকে আরও একটি ব্যাপ্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। এই বছর, ২০২০ সালের শেষ পর্যায়ে যখন এসে পৌঁছেছি আমরা, তখন এই দিনটির একটা অন্যরকম গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। প্রত্যেক বছরের থেকে এই বছরটা নিঃসন্দেহে আলাদা এবং সেই প্রেক্ষাপটেই প্রতিবন্ধী মানুষদের অবস্থান, তাদের বক্তব্য এগুলি নিয়ে আলোচনারও একটা আলাদা গুরুত্ব তৈরি হয়ে গেছে। কোভিড ১৯ সংক্রমণ, বিশ্ব জুড়ে মহামারী পরিস্থিতি তৈরি হওয়া এবং জরুরী অবস্থাকালীন সময়ে সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষদের স্বাস্থ্য-জীবিকা কেন্দ্রীক সমস্যাগুলি চলে এসেছে সামনের সারিতে। এবং এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষেরা রয়েছেন শুরুতেই। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে তাঁদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে কম।

 

রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণা অনুযায়ী এ বছরের বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের মূল বিষয়বস্তু: “নতুনভাবে গড়ে তোলা: প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা, জন্য ও সহ তৈরি একটি অর্ন্তভুক্তিমূলক, সুগম্য ও দীর্ঘমেয়াদী কোভিড-১৯ উত্তর পৃথিবী”। অর্থাৎ সহজভাবে বললে কোভিড ১৯ সংক্রমণ পরবর্তী পৃথিবীকে আরও বেশি করে প্রতিবন্ধী মানুষদের বসবাসযোগ্য করে তোলা। এই ঘোষণা কি তবে প্রমাণ করে যে বর্তমান পৃথবী তা নয়? প্রশ্নটা রয়েই যায়। বিশেষত এখন যে মহামারী পরিস্থিতি চলছে সেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের অবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতটা প্রান্তিক যে নিশ্চিতভাবেই নতুন করে আলোচনা শুরু হওয়া দরকার। অবশ্যই আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন আবারও এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়াল।

 

কোভিড সংক্রমণে যখন গোটা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের দেশেরও বিপর্যস্ত অবস্থা, তখন দেশের সরকার তথা আমাদের রাজ্য সহ অধিকাংশ রাজ্য সরকার প্রতিবন্ধীদের যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে রয়েছেন সম্পূর্ণ উদাসীন। বারবার বিভিন্ন ব্যক্তি মানুষ, প্রতিবন্ধী সংগঠনের তরফ থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। এ রাজ্যের শহর, শহরতলী, গ্রামাঞ্চল থেকে বারেবারেই খবর এসেছে লকডাউনকালীন সময়ে প্রতিবন্ধী মানুষেরা, তাদের পরিবার খাদ্যহীন, ওষুধহীন অবস্থায় পড়ে কী মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রশাসন নয়, সেখানে অধিকার আন্দোলনের কর্মী বা সংগঠনগুলিই উদ্যোগ নিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই ঘটনাগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় প্রতিবন্ধী মানুষদের স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন জীবনযাপনের বিষয়গুলি নিয়ে সরকার ও প্রশাসনের জরুরী অবস্থাকালীন সময়ে যতটা তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটা তাঁরা আদপেই হননি। বিশেষত কোভিড চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের যে বিশেষ বা আলাদা ধরনের চিকিৎসা পরিকাঠামোর প্রয়োজন হতে পারে, সে বিষয়ে কেন্দ্র, রাজ্য কেউই নজর দেয়নি। এখনও পর্যন্ত তা গড়েও তোলা হয়নি। মনে রাখতে হবে এ দেশের আইন অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতা রাজ্যের বিষয়।

 

কোভিড পরবর্তী পৃথিবী আমাদের জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করছে, তা হয়তো আমরা নিজেরাও জানি না। সেখানে যে ক্ষেত্রের মানুষেরা স্বাস্থ্য, জীবিকা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ মনোনিবেশ দাবি করেন প্রশাসন সব রকমভাবেই তাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। কথা হচ্ছিল শিক্ষক ও প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী অনির্বাণ মুখার্জীর সঙ্গে। তিনি বললেন, “স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে দেখবেন তা মূলত প্রাইভেটাইজড। এবং সেই পরিষেবা থেকে সমাজের যে বিরাট অংশ বঞ্চিত থাকেন, প্রতিবন্ধী মানুষদের একটা বিরাট অংশ তার মধ্যেই পড়ে। সরকার যে কোভিড গাইডলাইন তৈরি করেছে তাও কিন্তু প্রতিবন্ধীদের অর্ন্তভুক্তিমূলক নয়। তাছাড়া শিক্ষা, কাজের বাজার সবেতেই এবার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে প্রভাবিত হতে চলেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কোভিডের যে অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়তে চলেছে, তা তো অস্বীকার করা যাবে না, আর সেখানে প্রচুর সংখ্যক প্রতিবন্ধী শ্রমিকও রয়েছেন। ফলে তাদের সঙ্গে যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ ঘটতে চলেছে বা ঘটে গেছে তারও আলাদা উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে অনেক সামাজিক আন্দোলনও গড়ে উঠেছে। সেগুলিতে প্রতিবন্ধী মানুষেরা অংশগ্রহণও করছেন। কিন্তু সেগুলির প্রভাব তাদের উপর কতটা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ এই আন্দোলনগুলিতে প্রতিবন্ধী ইস্যুগুলিকে অর্ন্তভুক্ত বা উল্লেখ করা হচ্ছে না।”

 

রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণা যদি বাস্তবে পরিণত করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা এক বিরাট পদক্ষেপ হবে। কিন্তু ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে তা এক দূরতম কল্পনা হিসাবেই মনে হয়। অধ্যাপক, মানবাধিকার কর্মী ও বর্তমানে ৯৯% প্রতিবন্ধী জি.এন. সাইবাবা দেশদ্রোহীতার অপরাধে বিনা শুনানীতে নাগপুর জেলে আন্ডা সেল-এ বছরের পর বছর বন্দী হয়ে পড়ে থাকেন। ক্রমশ খারাপ হতে থাকা শারীরিক পরিস্থিতি, চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়া, দেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দাবি রাষ্ট্রের কানে পৌঁছায় না। পারকিনসনস আক্রান্ত অশীতিপর সামাজিক কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীও একই কারণে একইভাবে আটক হয়ে থাকেন। তাঁর প্রয়োজনীয় স্ট্র ও সিপারের দাবিটুকুও দিনের পর দিন উপেক্ষিত হতে থাকে। দেশ জোড়া নিন্দা শুরু হলে সরকারকে এই দাবিটুকু অন্তত মানতে মাথা নোয়াতে হয়। রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা যখন এভাবে প্রতিবন্ধী অধিকার তথা নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করতে থাকে, তখন তাদের কাছে অর্ন্তভুক্তিমূলক পরিকাঠামো আশা করাটাই বৃথা।

 

মনে রাখা দরকার এ দেশে এখন ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আইন, ২০১৬’ রয়েছে। তা সত্ত্বেও বারেবারেই প্রতিবন্ধী মানুষদের নিজেদের অধিকারের দাবি নিয়ে পথে নামতে হয়। তাই কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার আন্দোলনকেও কি একটা নতুন অভিমুখে যেতে হবে? ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড-এর যুগ্ম সম্পাদক শম্পা সেনগুপ্ত আজ থেকে শুরু করলেন একটা ক্যাম্পেন। তিনি একটি চিঠি পাঠিয়েছেন রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যান ও সমাজ কল্যান দপ্তরের মন্ত্রীকে। যেখানে রাজ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বৈষম্যমূলক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যে প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা কর্মসূচী বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। এই মুহূর্তে এ রাজ্যে ডিসএবিলিটি কমিশনারের পদ শূন্য। সেই পদ দ্রুত পূর্ণ করে সেখানে পূর্ণ সময়ের কমিশনার নিয়োগের দাবি করেছেন। দাবি করেছেন যেন নির্দিষ্ট কমিশনার আরপিডি অ্যাক্ট ও পশ্চিমবঙ্গের আরপিডি নিয়মনীতি অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সুও মোটো কেস করতে পারেন। তিনি বললেন, “মহামারী দেখিয়ে দিল বাড়িতে আটকে থাকাটা কেমন হতে পারে। বহু প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখন অ-প্রতিবন্ধী মানুষেরাও যদি একটু সচেতন হন প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে তাহলে লড়াইয়ের পরিসর বাড়ে। তাছাড়া আমাদের কাজগুলোও এখন বহুস্তরীয় করে তুলতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় প্রতিবন্ধকতা বিষয়টিকে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই এই কোভিডকালীন সময়ে হচ্ছেও। এটা যথেষ্ঠ আশাপ্রদ ব্যাপার।”

 

নিশ্চিতভাবেই শ্রমিকের অধিকার, কৃষকের অধিকার, নারী অধিকার, লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, জীবিকার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার – সমস্ত মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যেই প্রতিবন্ধী অধিকারের বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় ও বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন। মহামারীকালীন ও মহামারী-উত্তর পৃথিবীতে এই আলোচনার পরিসর আরও প্রসারিত হবে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে এই বিশ্বাসটুকু সঙ্গে থাক।

 

  • লেখক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক 

 

Share this
Recent Comments
1
  • আপনি ভেবেছেন এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাবে প্রকাশ করেছেন এ জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এইরকম এক শিশুর আত্মীয় হিসেবে।তারা খালি দূর ছাই পেতেই অভ্যস্ত।
    আমাদের দেশের মৌলিক অধিকারই মান্যতা পায় না সেখানে প্রতিবন্ধী তার অধিকার!.

Leave a Comment