শহরের নামজাদা শপিং মল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় প্রাণ গেল তরুণ কর্মীর


  • November 15, 2020
  • (1 Comments)
  • 3450 Views

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন

১৫.০১১.২০২০

 

চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অসচেতনতার পরিচয় দিল কলকাতা শহরের বুকে প্রথম সারিতে থাকা চোখ ধাঁথানো এক শপিং মল কর্তৃপক্ষ। স্রেফ তাদের উদাসীনতায় ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভাবে চলে গেল একটি তরতাজা প্রাণ। শহুরে স্বচ্ছলতার প্রতীক এই শপিং মলগুলিতে জীবনদায়ী ব্যবস্থা না থাকা যে প্রাণঘাতী হতে পারে তা প্রমাণ হয়ে গেল আরও একবার।

 

ঘটনাটি ঘটেছে নামজাদা কোয়েস্ট মল-এ, দীপাবলির আগের দিন অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর, শুক্রবার। এই মল-এ ট্রাভেল ব্যাগ ও অন্যান্য ট্রাভেল সামগ্রীর একটি জনপ্রিয় রিটেল চেইন Samsonite-এর স্টোরের স্টোর ম্যানেজার ৩৪ বছরের তরুণ মহঃ সাব্বির আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কোয়েস্ট মল-এই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে বারবার উপস্থিত মল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের অনুরোধ করা সত্ত্বেও দ্রুত কোনও রকম ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। এই মৃত্যুর পর মল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিষয়টিই বারবার সামনে উঠে আসছে।

 

কোনও মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে এই মৃত্যু নিয়ে খবর হয়নি সেভাবে। ডিজিটাল নিউজ পোর্টাল ই-নিউজরুম সূত্র প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে মহঃ সাব্বির গত ১৩ বছর ধরে এই রিটেল চেন-এর কর্মী ও একাধিকবার জাতীয় স্তরে সেরা কর্মীর সম্মান পেয়েছেন। ঘটনার দিন সাব্বির স্টোর খোলার জন্য আরেক কর্মীর সঙ্গে সকালবেলাতেই মল-এ পৌঁছে যান। বেলা ১১টা ৪৫ নাগাদ অপর কর্মী কাজের জন্য স্টোর থেকে বেরোনোর পরেই সাব্বির অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন স্টোরে উপস্থিত ছিলেন একজন হাউস-কিপিং কর্মী। সাব্বিরের শারীরিক অস্বস্তি, বুকে ব্যথা ও বমি ভাব দেখা দেয়। ঐ হাউস কর্মীকে তিনি বলেন তাঁর স্ত্রীকে ফোন করতে। ঐ কর্মী তাঁকে তাড়াতাড়ি বসিয়ে মাথায় জল ঢালতে থাকেন। সাব্বির বলেন সাহায্যের ব্যবস্থা করতে। ১১টা ৫৮ নাগাদ হাউস-কিপিং কর্মী তাঁর পরিবারে খবর দেন ও মল কর্তৃপক্ষকে খবর পাঠান, কর্তৃপক্ষের লোকজন এলে সাব্বির নিজের ক্রমশ খারাপ হতে থাকা শারীরিক অবস্থা বুঝতে পেরে চিকিৎসাজনিত জরুরি অবস্থার (মেডিক্যাল এমার্জেন্সি) কথা বলে মল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে। মনে রাখা দরকার কলকাতার পার্ক সার্কাসে যেখানে কোয়েস্ট মল তার থেকে অল্প দূরত্বের মধ্যেই হাসপাতাল রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স-এর ব্যবস্থা থাকলে অতি দ্রুত সেখানে পৌ্ঁছানো সম্ভব।

 

ফোন পাওয়ার ১‌৫/২০ মিনিটের মধ্যে সাব্বিরের পরিবার ঘটনাস্থলে পৌঁছে যা দেখেন তা মারাত্মক। পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে সেখানে তারা পৌঁছিয়ে দেখেন প্রবল শ্বাসকষ্টে যন্ত্রণা পাচ্ছেন সাব্বির, ঐ হাউস-কিপিং কর্মীই সাধ্যমতো তাঁকে শুশ্রুষা করছেন, বহু লোক জমে গেছে চারপাশে যারা সকলেই দর্শক এবং আশ্চর্যজনকভাবে তার মধ্যে মল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। এই পুরো সময়টায় বারবার সাব্বির অনুরোধ করা সত্ত্বেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা তো দূরের কথা, কোনও চিকিৎসককেও খবর দেওয়া হয়নি। তাঁর পরিবারের মানুষেরা প্রথমে অ্যাম্বুলেন্স ও তারপরে ক্যাব যোগাড় করে যতক্ষণে তাকে পার্শ্ববর্তী চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে নিয়ে যান, ততক্ষণে এই তরুণ মৃত, চিকিৎসকেরা জানান তাঁকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। বলে রাখা দরকার, সাব্বির একজন সুস্থ-সবল তরুণ ছিলেন, যার এর আগে কোনও অসুস্থতার মেদিক্যাল রিপোর্ট নেই। এর দায় কার?

 

সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল তা জানতে সাব্বিরের পরিবার শনিবার কোয়েস্ট মল-এ পৌঁছে প্রথমে ঐ রিটেল চেন স্টোর-এ যান সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখার জন্য। এবং চরম বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারেন ঐ স্টোরে কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা-ই নেই! ই-নিউজরুম জানাচ্ছে তাঁরা যখন মল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন কোম্পানির ভাইস-চেয়ারম্যান তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই কড়েয়া পুলিশ স্টেশনে খবর দিয়ে পুলিশ অফিসারদের ডেকে পাঠান ও তারপর সাব্বিরের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তখন আশ্বস্ত করেন যে এরপর থেকে যাবতীয় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাজনিত ব্যবস্থা মল-এ করা হবে, যেমন অ্যাম্বুলেন্স রাখা, প্রতিটি স্টোরে সিসিটিভি লাগানো ইত্যাদি।

 

শোকস্তব্ধ পরিবারের তরফ থেকে জানানো হয় তাঁরা এই মুহূর্তেই কোনও অভিযোগ দায়ের করছেন না মল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বা কোনও ক্ষতিপূরণও চাইছেন না। শুধুই চান সেদিন কী ঘটেছিল জানতে। যে প্রশ্নগুলি তাঁরা তুলছেন – (১) কেন তাঁকে কেউ সঠিক চিকিৎসা করল না, এমনকি প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও করা হল না? (২) এরকম একটি ব্যস্ত মল-এ কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা পরিকাঠামোটুকুও থাকে না? (৩) একজন মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে ঘিরে মানুষ শুধু দাঁড়িয়েই রইল? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর মৃত্যুটা দেখল? কেন? এই প্রশ্নগুলির উত্তর না পেলে তাঁরা অবশ্যই পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেবেন ভাববেন। প্রশ্নটা নিঃসন্দেহে শুধু মল-এর কর্মীদের নিরাপত্তারই নয়, যে অসংখ্য মানুষ সেখানে কেনাকাটা করতে আসেন, এরকম জরুরী অবস্থায় তাদের সুরক্ষার জন্যও যে মল-টি প্রস্তুত নয়, তাও স্পষ্ট হয়ে গেল।

 

অপরদিকে ঐ রিটেল চেন কর্তৃপক্ষ মহঃ সাব্বিরের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছে তাঁকে তাদের অন্যতম সেরা কর্মীর স্বীকৃতি দিয়ে। কিন্তু কেন অনেকবার পরিকল্পনা হ্‌ওয়া সত্ত্বেও ঐ মল-এর স্টোরে সিসিটিভি বসেনি, তার সদুত্তর তারা দিতে পারেননি।

 

কোয়েস্ট মল আর পি সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গ্রুপ-এর সম্পত্তি। বিরাট অঙ্কের ব্যবসা তারা করে থাকেন এই শপিং মল-এর মাধ্যমে। এখানে রয়েছে আর্ন্তজাতিক ও জাতীয় প্রায় সমস্ত নামজাদা ব্র্যান্ডের সগর্ব উপস্থিতি। কারা এই মল-এ ঢুকতে পারে বা পারে না তাই নিয়ে পোশাক বিতর্কেও একবার জড়িয়ে ছিল শহরের এই এক নম্বর শপিং মল। জৌলুস, অর্থ আর লাভের অঙ্কে শীর্ষস্থানে থাকলেও সচেতনতা ও মানবিকতায় যে মল কর্তৃপক্ষ শূণ্য পাবেন তাতে সন্দেহ নেই। একটি তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে বাস্তবটা প্রকাশ্যে এল।

 

মূল রিপোর্ট’টি ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্ক-এ –

How safe are you when you have a health emergency at Kolkata’s top shopping malls?

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment