বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্ত—দ্বিশতবার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ


  • September 25, 2020
  • (1 Comments)
  • 3438 Views

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত—একই দেশ ও কালে একই জীবনদর্শন ধারণ ও লালন করেছেন এবং সমাজের দুই বিভিন্ন কক্ষে তাকে বাস্তবে রূপদান করেছেন। ইউরোপীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কালে পঞ্চদশ শতাব্দ থেকে গড়ে ওঠা রেনেশাঁস আন্দোলনের তিনশ বছরের ইতিহাস থেকে দুজনেই তার রণ-শাঁসটুকু আত্মসাৎ করেছেন এবং উনিশ শতকের বাংলায় তাকে প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক সমাজবুদ্ধি, শ্রমের মর্যাদাবোধ, আধুনিক ধর্মনিস্পৃহ শিক্ষা, ইত্যাদির প্রতি তাঁদের ছিল এক দুর্নিবার আকর্ষণ ও স্ব-গৃহীত দায়বদ্ধতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত ঊনবিংশ শতাব্দের নিছক দুজন ব্যক্তি নন, বিচ্ছিন্ন দুটি চরিত্র নন; তাঁদের নিজ নিজ কর্ম ও বিচরণ ক্ষেত্রে তাঁরা উভয়েই তৎকালীন বাংলার অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে চলা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক চিন্তার অনুশীলনের দুই সুসমৃদ্ধ পরিণতি। তাঁদের সেই কার্যক্রমের ধারায় কাজের প্রয়োজনীয়তা ও অবকাশ বাংলা তথা ভারতের সমাজে আজও পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়নি। লিখেছেন অশোক মুখোপাধ্যায়

 

 তাঁরা ছিলেন বলে

 

একথা অনস্বীকার্য যে ২০২০ সালে আমরা এমন দুজন মানুষের জন্মের দ্বিশতবর্ষ উদযাপন করতে চলেছি, যাঁরা প্রায় সমচিন্তার ভিত্তিতে উনিশ শতকের সমগ্র দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে আমাদের মনন জগতের যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক সৌধ গড়ে তুলেছেন এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে এক অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ সঞ্চার করেছেন। আমাদের মুখের এবং লেখার ভাষায়, গদ্যে, ছন্দে, অলঙ্কারে, সমাসে, অনুপ্রাসে তাঁদের সরব উপস্থিতি। আমাদের চিন্তার বয়নে, কণ্ঠের বয়ানে, যুক্তির উচ্চারণে, সংস্কার বহিষ্করণে, তাঁদের অনুপেক্ষ্য কর্তৃত্ব। আমাদের আবেগ, মর্যাদাবোধ, চরিত্র, মেরুদণ্ড, দৃঢ়তা, নৈতিকতা, সংকল্প—যতটুকু যা যেখানে গড়ে উঠেছে এবং আমরা যে যতটা ধারণ করতে পেরেছি, সেখানেও এই দুই জনের অনস্বীকার্য অবদান। সুতরাং এবছর তাঁদের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী সেই উপলক্ষ হয়ে এল যখন আমরা তাঁদের গুণাবলি আরও বেশি করে আত্মীকৃত করার জন্য এক সম্মিলিত সংগঠিত পরিচর্চায় প্রয়াসী হতে পারি।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১) এবং অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬)—একই দেশ ও কালে একই জীবনদর্শন ধারণ ও লালন করেছেন এবং সমাজের দুই বিভিন্ন কক্ষে তাকে বাস্তবে রূপদান করেছেন। ইউরোপীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কালে পঞ্চদশ শতাব্দ থেকে গড়ে ওঠা রেনেশাঁস আন্দোলনের তিনশ বছরের ইতিহাস থেকে দুজনেই তার রণ-শাঁসটুকু আত্মসাৎ করেছেন এবং উনিশ শতকের বাংলায় তাকে প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক সমাজবুদ্ধি, শ্রমের মর্যাদাবোধ, আধুনিক ধর্মনিস্পৃহ শিক্ষা, ইত্যাদির প্রতি তাঁদের ছিল এক দুর্নিবার আকর্ষণ ও স্ব-গৃহীত দায়বদ্ধতা। পক্ষান্তরে ঐতিহ্য বর্জন, পরজীবিত্বে ঘৃণা, জমিদারিত্বে বিকর্ষণ, শ্বেতপ্রভুভক্তিতে অপারগতা, দেশি ও বিদেশিতে সাম্য জ্ঞান, ধর্ম-কুসংস্কার-জাতপাত-লোকাচারে অশ্রদ্ধা—এই সব ছিল দুজনেরই চরিত্র নির্ধারক উপাদান। যুক্তি বুদ্ধি জ্ঞান হাতিয়ার করে ঈশ্বরচন্দ্র কাজ করেছেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কর্মকাণ্ডে, হাতের সামনে যে সমাজকে পেয়েছেন, তার দেওয়াল ভেঙে কিছু—বাতায়ন যদি নাও হয়—ঝিলিমিলি বসিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। আর সেই সমাজ মানসেরই উন্নতি বিধানে অক্ষয়কুমার দত্ত জীবন পাত করেছেন জ্ঞান সংগ্রহ ও বিতরণে, যুক্তিবাদী ও সত্যসন্ধানী মন গড়ে তোলার দুরূহ কাজে।

 

ক্যালেন্ডারের হিসাবে আমরা যদিও বিদ্যাসাগর এবং দত্তর যুগ থেকে শতাধিক বছর পেরিয়ে এসেছি এবং দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলিতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়ে গেছে, তথাপি সকলেই স্বীকার করবেন, তাঁদের শুরু করা কাজগুলো আজ পর্যন্তও সম্পূর্ণ হয়নি। সেই সব কার্যক্রম যা নিয়ে তাঁরা পথ চলা শুরু করেছিলেন, অনেক দূর অবধি এগিয়েও গিয়েছিলেন, আজও সেসব আমাদের সমাজের বুকে অসমাপ্ত রয়ে গেছে। গণতন্ত্র বা মানবাধিকার প্রসারিত হওয়া তো দূরের কথা, যেটুকু অধিকার নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল, তাও আজ ক্রমাগত অপহৃত হয়ে চলেছে। কবি শিল্পী বিজ্ঞানী অধ্যাপক শুধু মাত্র রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন বলে, প্রতিবাদে পথে নেমেছেন বলে, বিনা বিচারে কারাগারে আটক হচ্ছেন। সাধারণ প্রতিবাদী মানুষের কথা তো দূরের কথা। ধর্ম জাতপাত কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে উন্মাদনা, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ও নির্যাতনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। দাঙ্গাকারী স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ধরবার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ায় বিচারকের মধ্য রাতে বদলির আদেশ এসে যাচ্ছে। আর দাঙ্গাবিরোধীদের নামে ভুয়ো মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে জামিন অযোগ্য ধারায় জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সারা দেশ জুড়ে আসিফা আর প্রিয়াঙ্কাদের মতো একের পর এক বীভৎস নারী নির্যাতনের ঘটনা বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন, অক্ষয় দত্তের যুক্তিকে আজ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

 

যে সমস্ত সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিদ্যাসাগর লড়াই শুরু করেছিলেন, বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ নিবারণ, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন—তার সবই প্রায় আজকের সমাজে আরও বৃহত্তর ও জ্বলন্ত অভিপাদ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। বিধবা বিবাহের বিষয়টিকে বাদ দিলে বাকি দুটো সমস্যা শুধু হিন্দু সমাজ নয়, আজ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। আসল কথাটা হল, পুরনো ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক সমাজের গর্ভ থেকে উত্থিত পুরুষতান্ত্রিক বিধিনিষেধের অনড় জোয়াল থেকে নারীমুক্তি এবং নারী পুরুষের সমান অধিকার ও সমমর্যাদার দাবিকে উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত নানা ভাবে নানা মাত্রায় উত্থাপন ও প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর সক্ষোভে লিখেছিলেন: “অস্মদ্দেশে অকপট প্রণয় প্রায় দৃষ্ট হয় না, কেবল প্রণয়ী ভর্তাস্বরূপ এবং প্রণয়িনী গৃহপরিচারিকাস্বরূপ হইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করে।” স্ত্রীশিক্ষার অভাব এবং বাল্যবিবাহের পরিণাম বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, “সেই কন্যাদিগের বর্ণপরিচয় হইতে না হইতেই উদ্বাহের দিন উপস্থিত হয়। সুতরাং তাহার পাঠের প্রস্তাব সেই দিনই অস্তগত হইয়া যায়। পরে পরগৃহবাসিনী হইয়া তাহাকে পরের অধীনে শ্বশ্রূ শ্বশুর প্রভৃতি গুরুজনের ইচ্ছানুসারে গৃহসম্মার্জন, শয্যা সজ্জন, রন্ধন, পরিবেশন ও অন্যান্য পরিচর্যার পরিপাটী শিক্ষা করিতে হয়। পিতৃগৃহে যে কয়েকটি বর্ণের সহিত পরিচয় হইয়াছিল, তৎসমুদায়ই স্থালী, কটাহ, দর্বী, প্রভৃতির সহিত নিয়ত সদালাপ হওয়াতে একেবারেই লোপ পাইয়া যায়।” [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৯৭২), “বাল্যবিবাহের দোষ”; বিদ্যাসাগর রচনাবলী (গোপাল হালদার সম্পাদিত-১৯৭২); দ্বিতীয় খণ্ড] শহরাঞ্চলে এবং উচ্চবিত্ত কিছু হাত গুনতি পরিবারের কথা বাদ দিলে এই চিত্র তো এখনও সারা দেশের কোনায় কোনায় দেখা যাবে। অক্ষয়কুমার দত্ত চেয়েছিলেন, বিবাহের আগে পাত্র পাত্রী পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হন, তাদের মধ্যে মনের এবং ভাবের আদান প্রদান হোক, তারপর যেন প্রস্ফুটিত প্রণয়ের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে পরিণয় ঘটে। তাঁদের সেদিনকার অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা প্রয়াসের যৌক্তিকতা আজ আরও বেশি করে সমাজ মননে আলোড়ন তুলতে চাইছে। সেই অর্থে বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলন এবং অক্ষয় দত্তের বৌদ্ধিক আবেদনের যুক্তিগ্রাহ্যতা ও ন্যায্যতার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হয়েছে বলা যায়।

 

যে বিজ্ঞান শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির বিকাশের জন্য অক্ষয়কুমার দত্ত যে এত যুক্তি তর্ক তথ্য দিয়ে লিখলেন, সেদিনের তুলনায় আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার যতই পাইকারি ও খুচরো কারবার বেড়ে গিয়ে থাকুক না কেন, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রশ্নে আমরা খুব দ্রুত নিজেদের খ্রিস্টপূর্ব অবস্থানে নিয়ে যেতে ব্যগ্র হয়ে পড়েছি। এক গরুর মলমূত্রই এখন সারা ভারতবর্ষের এক বিরাট অংশের মানুষের ধ্যান জ্ঞান হয়ে বসে আছে। বিজ্ঞানের বই বা পত্রিকায় নয়, শিক্ষিত এমনকি একদল বিজ্ঞানীও আজকাল আধুনিক বিজ্ঞানের খবর খুঁজে বেড়াচ্ছেন রামায়ণ মহাভারতে, ঋগ্বেদে, ভাগবত পুরাণে। জ্যোতিষার্ণবদের ঘোষিত গ্রহনক্ষত্রের দ্বারা মানব জন্ম মৃত্যু বিপদাপদ নিয়ন্ত্রণের কথা শুনে অক্ষয় দত্ত তত্ত্ববোধিনীপত্রিকায় (১৮৫১) বলেছিলেন, “সুগ্রহ কুগ্রহ এই দুইশব্দের অর্থ নিতান্ত অলীক। . . . মঙ্গল, বুধ, শুক্র, শনি, প্রভৃতি গ্রহসকল প্রস্তরাদির ন্যায় জড় পদার্থময়। বুদ্ধিমান জীবের ন্যায় তাহাদের সঙ্কল্প বিকল্প, প্রবৃত্তি নিবৃত্তি, অনুগ্রহ নিগ্রহ থাকা কোনক্রমেই সম্ভাবিত নহে। আর যদি তাহাদের এই গুণ থাকিত, তাহা হইলেও মর্ত্যলোকস্থ মনুষ্যদিগের সহিত তাহার কি সম্বন্ধ? . . . গ্রহের তুষ্টিরুষ্টিতে লোকের সুখদুঃখ উৎপন্ন হয়, একথা সদ্বিদ্যাশালী বিজ্ঞ লোকদিগের নিকট কহিলে হাস্যাস্পদ হইতে হয়।” তিনি নিজে প্রাণ খুলে হেসেছিলেন এবং আমাদের হাস্যাস্পদ হওয়া থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আর আজ কেন্দ্রীয় সরকার ইউজিসি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান সংস্থা সেই হাসির খোরাককে সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। যে শাস্ত্র আজ অবধি সূর্য এবং চাঁদের পরিচয় ঠিক ভাবে জানতে পারেনি, পৃথিবী সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনি, সেই আবার আমাদের জীবনের ভবিষ্যত নাকি বাতলে দেবে বলে দুবেলা ডজন ডজন এসএমএস পাঠাচ্ছে সকলের মোবাইলে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, অক্ষয় দত্তের যুগ থেকে আমরা শুধু সাধু ভাষার বদলে কথ্য ভাষায় লেখাপড়াকে স্থানান্তরিত করতে পেরেছি, মগজ কোষে জ্ঞান বা বোধের প্রশ্নে এক দানাও কি এগোতে পারলাম?

 

মূর্তি-ভাবমূর্তি ভাঙার গল্প

 

পঞ্চাশ বছর আগে (১৯৭০) বিদ্যাসাগরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে ঢাকায় (তখন অবধি) পূর্ব পাকিস্তান আমলে এক অসাধারণ স্মারক গ্রন্থ তৈরি হয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সঙ্কলনের ভূমিকায় সম্পাদক বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী গোলাম মুরশিদ লিখেছিলেন: “বিদ্যাসাগরের সার্ধ-শততম জন্মবার্ষিকী এবার বাঙালীরা দুভাবে উদযাপন করলো। এক দল বিদ্যাসাগরের প্রস্তর মূর্তি বিচূর্ণ করে; অন্য দল আরো নির্দয়ভাবে—পরিপূর্ণ ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে।” [গোলাম মুরশিদ (সং ১৯৭০), “ভূমিকা”, বিদ্যাসাগর; বিদ্যোদয় লাইব্রেরী, কলকাতা।] তাঁর সেই কথাটাকে আজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তকে মিলিয়ে একটু অন্য রকম আঙ্গিকে সমার্থক ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পশ্চিম বাংলার মাটিতে বাংলার এই দুই বিরল মাপের প্রতিভাবান সন্তানকে তাঁদের জন্মদ্বিশতবর্ষে আমরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছি দুই ভাবে: বিদ্যাসাগরের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের খুঁত বের করে করে; আর অক্ষয়কুমার দত্তকে নৈঃশব্দের উপেক্ষায়!

 

কোনো মানুষই চরিত্রে, জ্ঞানে, কর্মে, কর্তব্য পালনে, সম্পূর্ণ নিখুঁত হন না, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কেও আমরা সেরকম দাবি কতে পারি না! তাই এই দুই চরিত্রে ত্রুটি বা কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেলে এবং মননশীল চর্চায় তার পর্যালোচনা হলে আমাদের মতো যুক্তিবাদী দৃক্‌পাত ও সামাজিক ঐতিহাসিক চেতনার বাহকদের তরফে আপত্তির কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বরং সেই আলোচনায় তাদের উৎসাহ থাকাই স্বাভাবিক, কেন না, তাতে অংশগ্রহণকারী মাত্রেরই ঋদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ থেকে।

 

কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, আমাদের উত্তরে সমালোচিত আসামী আত্মপক্ষে কিছু বলতে আসতে পারছেন না। ফলে আমাদের এখানে দায়িত্ব অনেক। সমালোচককেই সমালোচিতের সম্ভাব্য আত্মপক্ষ বয়ান তৈরি করে নিতে হবে। সেই বয়ান সাপেক্ষেই সমালোচনাকে দাঁড় করাতে হবে। তাছাড়া, ত্রুটি সন্ধানের ক্ষেত্রে আরও দুটি কথা মনে রাখা উচিত: এক, সেই ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা সমকালে আলোচিত ব্যক্তির ঘোষিত বক্তব্য ও কৃত কর্মকাণ্ডের বিরোধী ছিল কিনা এবং কতটা। দুই, তৎকালিক সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তা কতটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। আমাদের ভাবনাচিন্তার বর্তমান পর্যায়টা আমরা দেড় শতক আগেকার মানুষদের কাছে প্রত্যাশা করতে পারি না।

 

এর বাইরে থেকে ত্রুটি ধরার যে কোনো প্রবণতার একটা খারাপ দিক আছে। আমার রাজনৈতিক সামাজিক ধ্যান ধারণার সঙ্গে মিলছে না, অতএব বিদ্যাসাগরকে নামিয়ে দিতে হবে—এরকম মনোভাব। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে এই মনোভাবের পরিচয় আমরা একাধিক সমালোচনায় পেয়েছি। উনিশশ সত্তরের দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি লাইন দিয়ে স্বপন বসু, অশোক সেন, পরমেশ আচার্য হয়ে এই বিশ্লেষকদের হাতে উপস্থাপিত খণ্ড তথ্য একের পর এক অপব্যাখ্যাত হয়ে যাচ্ছে, সাল তারিখের হিসাব পর্যন্ত তাঁরা খেয়াল রাখতে পারছেন না। মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে যে মুক্তচিন্তার খানিকটা হলেও এখনও একটা পরিসর আছে, তার পেছনে এই দুই দ্বিশতবর্ষ অতিক্রান্ত মনীষীর যে ভূমিকা রয়েছে তা বুঝতে হলে আমাদের একটু তথাকথিত গোবলয়ে ঘুরে আসতে হবে। দুজনে মিলে সেদিন তাঁরা ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রীয় ভাববাদী অচলায়তনে যে বেশ কয়েকটি ধাক্কা দিয়েছিলেন, তার ফলেই বৈদিক পৌরাণিক শাস্ত্রীয় অজ্ঞতা অন্ধতার দেওয়ালগুলো নানা জায়গায় খসে পড়েছিল। নতুন চেতনা, যুক্তিবাদ মাথা তুলেছিল।

 

এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে, উনিশ শতকের প্রগতির আন্দোলনের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে সেকালে বঙ্কিমচন্দ্রকেও বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে নিন্দা সমালোচনার অনুচিত ও অশোভন কাঁচা রাস্তায় নামতে হয়েছিল। বেশির ভাগ বাঙালি লেখক ও পাঠক বিদ্যাসাগর নিন্দায় বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসের একটি সংলাপই জানেন এবং ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা অনেকে জানেনই না, বঙ্কিমচন্দ্র আরও বড় আক্রমণ নামিয়েছিলেন তাঁর স্বল্প পরিচিত একটি গুরুভার ইংরেজি রচনায়। বিদ্যাসাগরের মনন ঐশ্বর্যকেই ধূলায় নামিয়ে দেবার আয়োজন করে তিনি বলেছিলেন: “If successful translations from other languages constitute any claim to a high place as an author, we admit them in Vidyasagar’s case; and if the compilation of very good primers for infants can in any way strengthen his claim, his claim is strong. But we deny that either translating or primer-making evinces a high order of a genius; and beyond translating and primer-making Vidyasagar has done nothing. His brief discourse on Sanskrit literature deserves, and his widow marriage pamphlets claim, no notice here.”[বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৬০), “বেঙ্গলি লিটারেচার”, বঙ্কিম রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত; সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১০৮-১০৯।]

 

অর্থাৎ, বিদ্যাসাগরের বুদ্ধি সম্পদ মানে হচ্ছে অনুবাদ, শিশুপাঠ্য আর প্রচার পুস্তিকা। সে আর এমন কী! আবার, অনুবাদকর্মে কিছু গুণ দেখেও তার গুরুত্ব নাকচ করে দেন তিনি: “The scenes are well chosen, and the expulsion of the supernatural element gives them a more realistic tone, but Vidyasagar is not free from the tautology and bombast which always disfigure the writers of the school to which he belongs.”[ঐ]

 

সেদিনের প্রগতি প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বে যখন রক্ষণশীলতার এক প্রধান মুখ বিদ্যাসাগরকে এতটা নিন্দা করতে এবং নামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন বুঝতে হবে, তাঁর কাজেকর্মে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরে নিশ্চয়ই কিছু সম্মার্জনী বার্তা পৌঁছেছিল। তার থেকে আত্মরক্ষাতেই সেই শিবিরের এক প্রধান মুখের এই ব্যাদান মুখরতা। অতএব, আমরা যাঁরা আজকের দিনের প্রগতির পতাকা হাতে তুলে নিয়েছি, তাদের এই বিরোধিতার স্বরূপ বুঝে নিতে হবে। ভাবতে হবে, বিদ্যাসাগরের সমালোচনায় সরব হতে গিয়ে আমরা সেই অনুদার শাস্ত্রপন্থী বঙ্কিমি ভাষ্যকেই গ্রাহ্য করে ফেলছি না তো!

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ভুলে থাকা কঠিন ছিল। স্কুল, বর্ণপরিচয়, সংগঠিত বিধবাবিবাহ, ইত্যাদির কারণেই। কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্তকে, তাঁর লেখনীকে আমাদের দেশবাসী তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ভুলতে শুরু করেছিল। এর একটা সুবিধা হয়েছে এই যে যাঁরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছেন বা ভাবমূর্তি ভাঙতে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেকালে এবং একালে তাঁদের কেউই অক্ষয় দত্তকে কোনো ভাবে ভাঙতে চাননি। আসলে ভাঙবার মতো তাঁর মূর্তিই নেই পশ্চিমবাংলার কোথাও। আর যাঁকে মানুষ ভুলেই গেছে, তাঁর আবার ভাবমূর্তি কী? তাকেও তাই ভাঙার প্রশ্ন ওঠে না। সেই অর্থে অক্ষয়কুমার দত্ত বেঁচে গেছেন। সরোজ দত্ত অশোক সেন বা পরমেশ আচার্য প্রমুখর তীক্ষ্ণধার কলমের হাত থেকে তিনি জোর অব্যাহতি পেয়ে গেছেন। গত-লোক থেকে কিছু বলার মতো অবস্থায় থাকলে সব দেখেশুনে তিনি আহত চিত্তে অবশ্যই বলতেন, “এই যে মশাইরা, আপনারা আমাকে নিয়েও কিছু বলুন। আমিও কিন্তু ওই বামন বামুনের সঙ্গে একই ধ্যান ধারণারই ওকালতি করে এসেছিলাম প্রায় পাঁচ দশক ধরে। আমাদের দুজনের বলার কথা এবং চলার রাস্তা একই ছিল।” বিদ্যাসাগরের স্কুলের অনেক পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে অক্ষয় দত্তেরও যে সমস্ত বই ছিল—চারুপাঠ কিংবা পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি, তারও অনেকগুলোতেই সেই শ্বেতদস্যুদের দেশের লোকের রচনার ছাপ, প্রভাব কিংবা অনুবাদ ছিল।

 

উনিশশ সত্তর পর্বের বাংলায় সুতীব্র বিদ্যাসাগর বিরোধিতার মধ্যে ছিল এক বিশেষ রাজনৈতিক সুর। ইউরোপীয় রেনেশাঁসের কোনো এক কল্পিত “মডেল”-এর ধারণা অনুসারে এই দেশেও কৃষক বিদ্রোহ আর শিল্প বিপ্লবের পাশে শহুরে বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় সদর্থক ভূমিকা খোঁজার আকুলতা ও তার অপ্রাপ্তির হতাশা থেকে যার জন্ম! তার তীব্রতা অনতিবিলম্বে মিলিয়ে গেলেও প্রতিধ্বনি থেকেই গেছে এবং একজনের পর অন্য জনে মুদ্দা-মুদ্দান্তরে সমালোচনার রথ টেনে নিয়ে গেছেন। এদিকে একুশের শতকে এসেছে আর এক ধরনের সমালোচনা, যে ধারা এক উত্তর-আধুনিক উত্তর-ঔপনিবেশিক নির্দেশতন্ত্র থেকে রেনেশাঁস নামক পরিঘটনাকে শুধু বাংলা নয়, সারা পৃথিবীর মানচিত্র থেকেই মুছে দিয়েছে; সেই চিন্তাপথিকরা বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র অক্ষয় দত্ত নরেন দত্ত—প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার সকলকেই এক বন্ধনীতে রেখে আধুনিকতা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার উন্মেষের চিত্রটিকে এক অদ্ভুত যুক্তিশৈলীতে ব্রিটিশের স্বার্থরক্ষী ও সহায়ক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলতে সক্ষম হন। তাঁদের কড়া ইউরোপ বিরোধী চোখে প্রাচীন ও মধ্য যুগের সামন্তী জাতপাত দীর্ণ ভয়ঙ্কর অমানবিক ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতবর্ষ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সর্বমানবের তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে; সেখানে দেশজ শিক্ষা দীক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি চর্চার এক বিশাল নালন্দাক্ষেত্র প্রতিভাত হতে থাকে। বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্ত প্রমুখ যার নির্দয় সমূল হত্যাকারী! উপনিবেশ আর মেকলের যান্ত্রিক বিরোধিতা করতে গিয়ে তাঁরা নিজেদের অজান্তেই ভারতের সামন্ত অচলায়তনের কোলে আশ্রয় নেবার এক চিত্তাকর্ষক উদাহরণ হয়ে ওঠেন।

 

দুচার জন ইংরেজ অফিসারের রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁরা নিজ দেশের এই দীর্ঘকালিক কৃষ্ণ প্রেক্ষাভূমি বিস্মৃত হয়ে ভাবতে পেরেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগে নাকি ভারতে লক্ষ লক্ষ স্কুল ছিল, স্কুলহীন গ্রাম নাকি ছিলই না, সেখানে নাকি জাতি ধর্ম লিঙ্গ নির্বিশেষে ছাত্ররা পড়তে আসত। রিপোর্টগুলি পড়লেই বোঝা যায়, সেগুলো কোনো উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি মেনে তৈরি হয়নি। আর তাছাড়া, যে দেশে এমনতর বিদ্যা-ভাসি সংস্কৃতির অস্তিত্ব সত্যিই থাকবে, যুগের সীমায় আধৃত হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির অবারিত বিকাশ হতে থাকবে, সেই দেশে দলিত শিক্ষয়ত্রী সাবিত্রীবাই ফুলে মুম্বাই এলাকায় মেয়েদের স্কুল স্থাপনের জন্য জায়গা পাবেন না, এক মুসলিম রমণী ফতেমা বিবি এগিয়ে না এলে সেই স্কুল করা সম্ভবই হত না; আর সেই স্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তায় “উচ্চ”-বর্ণের লোকেরা তাঁকে লক্ষ্য করে নোংরা কাদা নিক্ষিপ্ত করবে, তাঁকে ব্যাগে করে অতিরিক্ত শাড়ি নিয়ে যেতে হবে—এমন সব কাণ্ড ঘটবে কেন—সেই সরল প্রশ্নটুকুও তাঁরা আর নিজেদের করেন না। সেই লক্ষ লক্ষ পাঠশালায় তাহলে কারা, কাদের, কী, শেখাত? সত্যিই অমন লক্ষ লক্ষ শিক্ষালয় থাকলে এমনটা হতে পারত কি? এরকম প্রশ্নপ্রবণ হতে হলেও বোধ হয় বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্তের জীবন কর্ম ও রচনার চর্চা করা দরকার।

 

যে দেশে আট দশ বছর বয়সের মধ্যেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত, সতীপ্রথার নামে যে দেশে উচ্চ বর্ণের মধ্যে নির্বিচারে বিধবা নারীহত্যা জায়েজ ছিল, বহুবিবাহের ক্ষেত্রে যে দেশে কোনো সংখ্যাসীমার অস্তিত্ব ছিল না, সেরকম একটি দেশে ছোট ছোট মেয়েরা পাঠশালায় যেত এবং ছেলেদের পাশে বসে এক সঙ্গে লেখাপড়া করত—এটা যাঁরা অ্যাডাম রিপোর্ট পড়ে বিশ্বাস করতে পেরেছেন, তাঁদের পক্ষে বোধ হয় অধুনাতন সঙ্ঘজাত হিন্দু মৌলবাদীদের কোনো প্রচারেই আস্থা রাখতে অসুবিধা হবে না। রামমোহন বিদ্যাসাগর বা অক্ষয় দত্তকে নামানোর জন্য তাঁরা যে কোনো দেশজ গল্পজ “তথ্য” মেনে নিতে পারেন। অক্ষয় দত্তর রচনা সম্পদ এই আধুনিক অন্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখায়। চেতনার এই অন্ধকার এবং চিন্তার এই বন্ধ্যাত্বকে বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপ্রণালীর বেলচা দিয়েই উন্মূলন করা সম্ভব। তাই যাঁরা উনিশ শতকের সত্য মিথ্যা রেনেশাঁস বিশ্লেষণে যাবেন, তাঁদের আগে বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয় দত্তের কাছে কিছু প্রাথমিক পাঠ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির সাবালকত্ব অর্জন করা দরকার।

 

অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যাসাগর (এবং অবশ্যই অক্ষয় দত্ত-ও) নাকি সাধু বাংলা ভাষায় শিক্ষা ও পঠন চালু করতে গিয়ে আম জনতার স্বাভাবিক কথ্য বাংলাকে নির্বাসিত করেছেন এবং বাংলা ভাষার মধ্যে অ-তৎসম শব্দের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করে দিয়ে গেছেন। তাঁরা এসব সমালোচনা তোলার সময় ভুলে যান, বিদ্যাসাগর থেকে মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্র হয়ে কত অল্প সময়ের মধ্যে মোহিতলাল মজুমদার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বা কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কথ্য-বাকের কলম হাতে করে উঠে এসেছিলেন। আর বিদ্যাসাগরী সুসংস্কৃত ভাষা ব্যবহারের বিবর্তনী সড়কপথ বেয়েই তাঁদের হাত দিয়ে কত সহজেই না আরবি ফারসি তুর্কি শব্দ অক্লেশে ঢুকে গেল বাংলা কাব্য সাহিত্যের অলিতে গলিতে! যে শব্দ ছিল নিতান্তই মাঠে ঘাটে রাস্তায় মুখের লব্জ, তাকেই তাঁরা বরণ করে নিলেন সাহিত্যের সারস্বত মঞ্চে। তাছাড়া, বিদ্যাসাগরের নিজেরও বেনামে লেখা শ্লেষাত্মক রচনাগুলিতে —‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’, ‘ব্রজবিলাস’, ‘রত্নমঞ্জরী’, ইত্যাদি—পড়ে দেখলে তো সেকালে প্রচলিত বিপুল সংখ্যক আরবি ফারসি তুর্কি কথ্য শব্দ তাঁর সাধু গদ্যের মধ্যেই দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে! গোলাম মুরশিদও তাঁর লেখায় এই কথা উল্লেখ করেছেন। ফলে যে দরজা তাঁরা দেখছেন বিদ্যাসাগর বন্ধ করে দিয়েছেন, আসলে সেই দরজা তিনিই অন্য পথে হাট করে খুলে দিয়ে গেছেন। শুধু দেখার যন্ত্রপাতিতে দৃষ্টিভঙ্গিজাত বৈকল্যের কারণে সম্ভবত তাঁরা আর তা দেখে উঠতে পারেননি।

 

যাঁরা বাংলার রামমোহন-ডিরোজিও-বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্ত নির্মিত নবজাগরণকে কলকাতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উপজাত ধনসমৃদ্ধ মধ্যবিত্ত পায়রা-বাবুদের বাইরে যেতে দেখেননি, তাঁরা আশ্চর্যজনকভাবে ভুলে যেতে পেরেছেন ঈশ্বরচন্দ্র ও অক্ষয় দত্তের জন্মস্থান। জগদীশ্চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, রোকেয়া সাখাওয়াতের মতো লেখকরাও দূর মফঃস্বল বা গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে এসেছিলেন। কিংবা, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনো লেখককে হয়ত তাঁরা নবজাগৃতির ফসল হিসাবে খুঁজে পাননি। তাঁরা চব্বিশ পরগণা, হুগলী, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মানভুম, মেদিনীপুর, কুচবিহার, যশোর, ঢাকা, ময়মনসিং, চট্টগ্রামের মতো সুদূর প্রান্ত এলাকায় নতুন স্কুল কলেজ স্থাপন, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, নাটকের দল গড়ে ওঠা, পত্রপত্রিকা চালু হওয়া, নতুন সংস্কৃতির বিকাশের ঘটনাগুলিকে দেখতেই পান না। এমনকি, বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তনের দাবিপত্রে কলকাতার আশেপাশের ৯৩৬ জনের স্বাক্ষরের পাশাপাশি সারা বাংলা দেশ থেকেই যে আগে পরে অসংখ্য আবেদন পত্র জমা পড়েছিল, সে খবরও তাঁরা বিস্মৃত হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। শান্তিপুরের তাঁতিরা যে শাড়ির পাড়েতে বিদ্যাসাগরে নামে ছড়া লিখে রাখতেন—“বেঁচে থাক বিদ্দেসাগর চিরজীবী হয়ে”—সে কথা ইতিহাসে লেখা থাকলেও নবজাগরণের বাণী কলকাতার বাইরে যায়নি বলার জন্য সেই তথ্য ভুলে থাকতে হয়। হাজার হোক, মার্ক্সবাদে সুশিক্ষিত সুশোভন স্যরকে তো আর মিথ্যেবাদী বানানো যায় না! কেন না, বাংলার নবজাগরণের ভূগোলকে ছোট করে দেখাতেই হবে। তবেই তো ইতিহাসেও তার গুরুত্ব কমে যাবে। সুশোভন সরকার এক বিশেষভাবে তৈরি মার্ক্সবাদী শ্রেণিবিশ্লেষক চশমা দিয়ে কলকাতার বাইরে জাগরণ হয়েছিল বলে দেখতে পাননি, কলকাতার জাগরণের ঢেউও গ্রামেগঞ্জে পৌঁছেছিল বলে শোনেননি। তারপর থেকে অতএব লাইন দিয়ে এক দল বুদ্ধিজীবী “হয়নি” “হয়নি” বলে তাতে ধুয়ো তুলে গেলেন! ডেকে আনলে সেলুকস এই দেশের এত রকম বুদ্ধি-বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে মনে হয় পাগল হয়ে যেতেন!

 

মেকলের দেশি-সাহেব বানানোর শিক্ষানীতি চালু হওয়ার তিরিশ বছরের মধ্যেই যে ইংরেজ শাসককে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট কিংবা ইলবার্ট বিল ইত্যাদি আনতে হয়েছিল, সেই মেকলে-নীতি-উৎপাদিত মানব সম্পদের সৃষ্ট আপদকেই রুখবার জন্য—এও উত্তর-ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকলেরই হ্রস্ব-দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তাঁরা সাহেবদের বা বিদ্যাসাগরের তৈরি ইংরেজি স্কুলে পড়ে সেই ইংরেজদেরই দুপুরের ঘুমের বারোটা বাজাতে চাইছিলেন কীভাবে, কোন মন্ত্র বলে—এ তাঁদের বুদ্ধির অগম্যই থেকে গেছে। শিক্ষিত বাঙালিরা বাংলায় যে সংবাদপত্র প্রকাশ করতে লাগলেন, তাতে দেহে-ভারতীয়-মনে-ইউরোপীয় কলমেই কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে রোষের কালি নিঃসরণ হতে শুরু করেছিল। সেই শিক্ষিত ভারতীয়রা বিচারকের আসনে বসলে আর সাদা চামড়ার প্রতি ভক্তিভাব নাও দেখাতে পারেন, সেই আশঙ্কাতেই তো ইলবার্ট বিলের সর্বাত্মক বিরোধিতা। কিংবা, মেকলেকে সর্বশক্তিমান বানাতে চেয়ে তাঁদের দেশের ইতিহাসকেও ভুলে থাকতে হয়, কিংবা হয়ত চোখ বুজে থাকা শ্রেয় বলে মনে হয়।

 

আমরা অবাক হয়ে দেখেছি, ইদানীং কালে বিদ্যাসাগরের লেখা ও ছাপানো বইপত্রের দাম নিয়ে একদল অদ্ভুত বক্তব্য রাখছেন। সেই সব বইপত্রের দাম নাকি খুব বেশি ছিল, বিদ্যাসাগর নাকি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবহার করে জবরদস্তি সেই সব বই গ্রামেগঞ্জের স্কুলে চালু করে নিজের ব্যবসা বাড়াতেন, স্কুল বুক সোসাইটিতে থাকার সুযোগ নিয়ে নিজের বই চালু করে দিতেন আর অন্যদের বই আটকে দিতেন ইত্যাদি। এই সব নিয়েও আজকাল ভয়ানক রকমের সোৎসাহ গবেষণা হচ্ছে, বাজারি পত্রিকায় মাঝে মধ্যে গুরুগম্ভীর লেখা বেরোচ্ছে। অথচ, ১৮৭৫ সালে স্কুল বুক সোসাইটির এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলায় প্রকাশিত মোট পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা যেখানে ১৫৪৪, তার মধ্যে বিদ্যাসাগরের বই ক’টা? খুব বেশি হলে উনিশ বা কুড়িটা। তাহলে কাদের এবং ক’খানা বই তিনি আটকে দিলেন? যাঁরা এসব বলছেন, তাঁরা কি বোঝেন, কী প্রসঙ্গে কী বলছেন? তাঁরা বোধ হয় জানেনই না, এরকম অভিযোগ তোলার আগে কী কী তথ্য জেনে নিতে হয়। তবু তাঁরা বলেন, অভিযোগ উত্থাপন করেন। ছাপার অক্ষরে সেগুলি বেরোয়। কেন না, আসলে কিছু না জেনেই তাঁরা কে কী বলবেন ঠিক করে ফেলেছেন।

 

আর বইয়ের দাম সম্পর্কে বলতে চাই, যে সমস্ত বইতে এই বইয়ের দাম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তাদেরও কোনো কোনোটার দাম আজকের বাজার মূল্যের অর্থেও যে যথেষ্ট বেশি, এই সব লেখকরা তা আর মনে রাখতে পারেন না। বই ছাপিয়ে বিনা পয়সায় বা নামমাত্র মূল্যে বাজারে বিতরণ করতে পারে খ্রিস্টান সংগঠন বা অন্যান্য ধর্মীয় প্রচার সমিতিগুলি। যাদের নানা সূত্রে পয়সার অফুরন্ত অলকনন্দা প্রবহমান! আমরাও আমাদের মুদ্রিত বই বা পত্রিকার দাম খুব একটা যে কম রাখতে পারি না, তার কারণ যাঁরা জানেন এবং বোঝেন, তাঁদের মনে বিদ্যাসাগরের বইয়ের দাম নিয়ে কোনো প্রশ্নই জাগবে বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না। সেই সঙ্গে যদি মনে রাখা যায়, ১৮৫৫ সালে প্রথম প্রকাশিত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ১৮৯০ সালের মধ্যে ১৫২টি সংস্করণ ছাপা হয়েছিল, এবং দ্বিতীয় ভাগের ১৪০টি, তখন এইসব আজগুবি অভিযোগের একটাই মানে দাঁড়ায়। লেখক হিসাবে আমাদের পাঠক স্বল্পতার জন্য আমরা বিদ্যাসাগরের উপর মিথ্যা দোষারোপ দিয়ে প্রতিশোধ তুলি। আর সান্ত্বনা খুঁজি।

 

তা না হলে, উপরের বিভিন্ন তথ্য থেকে এটা সহজেই বোঝা যেত, নিজে বই লিখে এবং নিজের ও বন্ধুদের বই ছাপিয়ে তিনি সেকালের একজন একচেটিয়া পুস্তক ব্যবসায়ী হতে পারতেন, যার বিরাট ও ক্রমবর্ধমান সম্পদের মালিকানা তাঁর পুত্রকন্যাদের হাতে বর্তাত। কিন্তু হায়! আজ বিদ্যাসাগরের মেয়ের দৌহিত্রী বাজারি পত্রিকায় অভিযোগ করছেন, তাঁর এই খ্যাতনামা পূর্বপুরুষ তাঁদের জন্য টাকাপয়সা সম্পত্তি কিছুই প্রায় রেখে যাননি! অভিযোগকারীদের তথ্যভাণ্ডারের দৌড় এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

 

কালের ফসল যুগস্রষ্টা

 

আসলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত ঊনবিংশ শতাব্দের নিছক দুজন ব্যক্তি নন, বিচ্ছিন্ন দুটি চরিত্র নন; তাঁদের নিজ নিজ কর্ম ও বিচরণ ক্ষেত্রে তাঁরা উভয়েই তৎকালীন বাংলার অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে চলা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক চিন্তার অনুশীলনের দুই সুসমৃদ্ধ পরিণতি। যে ভারতবর্ষ কম পক্ষে দুহাজার বছর ধরে কাদামাটির রাস্তায় চলা গরুর গাড়ির চাকার নকশায় কোনো পথ-বান্ধব পরিবর্তন আনতে পারেনি, সেই দেশেই বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্তের আন্দোলনের বিশ-তিরিশ বছরের মাথায় তাঁদের সাগ্রহ অংশ গ্রহণের মাধ্যমে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে এমন একটা দেশজ সম্পদ ও মেধা নির্ভর জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠে, যেখান থেকে পাঁচ দশকের মধ্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো গবেষণা সম্ভব হয়।

 

অবশ্য কঠোর উপনিবেশ বিরোধীরা বলে থাকেন, নোবেল পুরস্কারও আসলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দেশজ প্রকৃত বিজ্ঞানের মর্যাদা লুণ্ঠনের একটা নজর ঝলসানো আপাত নিরীহ পন্থা! আসুন, আমরা বরং “দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া”! আমাদের সৌভাগ্য যে বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার এরকম ভাবেননি।

 

রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে প্রাচীন পন্থী টোল মাদ্রাসা শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষা এবং বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনের সপক্ষে যে জনমত গড়ে উঠতে থাকে, ডিরোজিও মুক্তমন শিক্ষণ পদ্ধতির যে পরীক্ষা ও প্রয়োগ হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে শুরু করেছিলেন, প্রায় তিন দশকের সেই অভিঘাতেই বিদ্যাসাগর আরও দু পা এগিয়ে তাঁর শিক্ষা সংস্কারের কর্মসূচি রচনা করে ফেলেন। অক্ষয়কুমার দত্তও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাতায় পাতায় সেই শিক্ষা সংস্কারের সপক্ষে আরও নানা দিক থেকে যুক্তিতর্ক চালাতে থাকেন। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “ভারতবর্ষীয় সর্বসাধারণ লোকে বিদ্যানুশীলনের ফলভোগী না হইলে, তাহাদিগের চিত্তক্ষেত্র হইতে চিরপ্ররূঢ় কুসংস্কারের সমূলে উন্মূলন হইবেক না; এবং হিন্দী, বাঙ্গালা প্রভৃতি তত্তৎ প্রদেশের প্রচলিত ভাষাকে দ্বারস্বরূপ না করিলে, সর্বসাধারণের বিদ্যানুশীলন হওয়া অসম্ভব।” [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৯৭২), “সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব”; বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, ৩য় খণ্ড; বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, কলকাতা;পৃঃ ১৩১]আর প্রায় সমকালেই অক্ষয়কুমার দত্তও সখেদে বলেছিলেন, “স্বদেশীয় ভাষার অনুশীলন ব্যতিরেকে কোনো দেশের আপামর সাধারণ সকল লোকের বিদ্যোপার্জন হওয়া সম্ভাবিত নহে, . . .।”

 

অন্য দিকে, বিদ্যাসাগরের অন্তত তিরিশ বছর আগে থেকে, রামমোহন ও ডিরোজিওর প্রচার আন্দোলন থেকেই বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ দূর করার পাশাপাশি হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনি সমস্যা নিয়ে চিন্তার এক আলোড়ন উঠেছিল। তরুণ ডিরোজিও তাঁর “Fakir of Janghira” গাথাকাব্যে কাঁচা হাতে সতীদাহ রোধ এবং বিধবার পুনর্বিবাহ ও সংসার পাতার অপরিণত কিন্তু প্রতিশ্রুতিমান এক গল্প শুনিয়েছিলেন। এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি অধিকাংশ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের দৃষ্টির বাইরে থেকে গেছে। তাঁর শিষ্যরা যেভাবে পত্রপত্রিকায় এই সমস্যা নিয়ে, এমনকি পরাশর সংহিতার সেই বিখ্যাত শ্লোক উদ্ধার করে এর শাস্ত্রানুমোদন নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন, ঢাকা নবদ্বীপ কলকাতায় প্রায় একশ বছর ধরে জমিদার, পণ্ডিত সমাজ থেকে শুরু করে নব্য যুবকদের তরফে বিধবাদের পুনর্বিবাহের সুযোগ সৃষ্টির দাবিতে যে ঘরোয়া ও প্রকাশ্য সভাসমিতি হচ্ছিল, ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন আন্দোলন তারই যুক্তিসম্মত ঐতিহাসিক পরিণাম।

 

আবার সেই রামমোহনের সমকাল থেকেই আধুনিক গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী চিন্তা, নতুন নীতিবোধ, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতায় সম্পৃক্ত ও সমৃদ্ধ ভাবগম্ভীর মনন, জনস্বার্থের নানান দাবি ধাপে ধাপে নানা দেশীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটু একটু করে বাংলার বোধি সমাজে ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল। মাঝখানে বিদ্যাসাগরও (সমকালীন) আধুনিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রতি আকর্ষণ তৈরির জন্য সামান্য হলেও অসামান্য কিছু উদ্যোগ নেন। তাঁর প্রায় এক দশক আগেই গ্রাম থেকে অক্ষয়কুমার দত্তের কলকাতায় পদার্পণ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক পদে যোগদান ও ইংরেজি বইপত্র থেকে বিদ্যা আহরণ করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ক বৈচিত্র্যপূর্ণ রচনাপুঞ্জ সৃষ্টির চার দশক ব্যাপী (১৮৪১-৮৩) নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম। এই সবই ছিল সেই সব খণ্ড খণ্ড প্রয়াসেরই সার্থক সমুন্নত সম্মিলনী।

 

তাঁদের সেই কার্যক্রমের ধারায় কাজের প্রয়োজনীয়তা ও অবকাশ বাংলা তথা ভারতের সমাজে আজও পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়নি। বিশেষ করে, আজকে ধর্ম জাতপাতের নামে ব্রাহ্মণ্যবাদের সংকীর্ণতা ও হিংস্রতা যে দুর্বৃত্ত-স্বরূপ  রাজনৈতিক শক্তির হাতিয়ার হয়ে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের মুখোশহীন মদতে ভারতবর্ষের মানুষ ও মানসকে আচ্ছন্ন করতে চলেছে, তার প্রয়োজন ব্যাপকতর মানুষকে অন্ধ গোঁড়ামিতে ঘৃণাবিদ্বেষে যুক্তিহীনতায় ডুবিয়ে রাখা। প্রতি দিন একটু একটু করে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিলেই যাতে সাধারণ হিন্দু জনসমাজ দেশের অর্থনীতির ডুব সাঁতার, বেকারত্বের এভারেস্ট শৃঙ্গজয়, বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের রোজগারের অবাধ পতন, দেশ জুড়ে দলিত নির্যাতন, দিল্লির গণহত্যা, বিচার ব্যবস্থার স্বৈরাচারের পায়ে নির্লজ্জ নগ্ন শিরঃক্ষেপ—এরকম সমস্ত সমস্যার দিকে নাগা সন্ন্যাসীর মায়াবী দৃষ্টিতে তাকাতে পারে, তার এক ভয়ঙ্কর আয়োজন চলছে। এই পূর্ণগ্রাস বুদ্ধিগ্রহণের কালে আমাদের আবার জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে রাখার জন্য চাই এই দুই ঋজু চরিত্র—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্তকে। তাই এই দুই পরিণত ভাবমূর্তিকে আরও বহু দিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে, আমাদের সামনে এঁরা আরও অনেক দিন পথপ্রদর্শক হিসাবে থেকে যাবেন! ভাবে কাজে ও চরিত্রে।

 

লেখক ‘সেস্টাস’ নামে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক। বিজ্ঞান ও মার্কসবাদের আলোয় বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে লোকপ্রিয় প্রবন্ধের লেখক।

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Runa Bhattacharya on September 28, 2020

    বেঁচে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে!!লেখাটি পড়ে, আরো অনেক বাঙালি মানসিকতার কূটকাচালির খবর পেলাম।তাই ভাল লেখাটি পড়ার সাথে বেশ মন খারাপও হল।

Leave a Comment