দেবতার হাত অথবা দেউলিয়া অর্থনীতির উপাখ্যান


  • September 17, 2020
  • (0 Comments)
  • 2707 Views

সারা দিন ধরে টিভির পর্দায় রূপালি পর্দার তারকাদের নিয়ে জম্পেশ খিস্তি খেউর, প্রধানমন্ত্রীর নানা পোশাকে ময়ূর কে দানা খাওয়ানোর ফটো সেশন বা পকোড়া পর্বের পর দেশি ঝাঁটা বানিয়ে উপার্জনের পরামর্শ — কোন টোটকাতেই আর কাজ হচ্ছে না। মানুষ কাজ চাইছে, অর্থনীতির হালহকিকত নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ২১ দিনে করোনা জয়ের আধুনিক মহাভারতের স্বপ্ন বা ৫ লক্ষ কোটি ডলারের চকচকে অর্থনীতির গ্যাস বেলুন চুপসে গেছে। মহামহিম প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন “জাতীয় বেরোজগার দিবস” হিসাবে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। বচনবাগীশ অর্থমন্ত্রী দেউলিয়া অর্থনীতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘দেবতার হাত’ এর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। নিন্দুকেরা বলছে বিজেপির জাতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা ক-দিন আগে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদিই পুরুষোত্তম ভগবান, তাই অর্থনীতি গাড্ডায় যাওয়ার ক্ষেত্রে দেবতার হাতের তত্ত্বটা খুব একটা ভুল নয়। লিখলেন সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আর্থিক বর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল – জুন) জিডিপির ২৩.৯% হ্রাস যা কোভিড পর্বে ভারতীয় অর্থনীতির কঙ্কালসার চেহারাটা সারা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছে। এক্ষেত্রে শাসক দল ও কর্পোরেট মিডিয়ার একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থা কারণ ৯০ এর দশকের সূচনা পর্ব থেকে নয়া-উদারনীতির মুক্তকচ্ছ সমর্থকেরা আমাদের বুঝিয়ে এসেছেন মানব উন্নয়ন সূচক নয়, রোটি-কাপড়া-মাকান এর দাবি নয়, বেকার যুবকের হাতে কাজের হিসাব নয়, জিডিপিই একমাত্র পরম ব্রহ্ম। অন্তত যে পরিসংখ্যান গুলো সামনে এসেছে তাকে যদি আমরা একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে বুঝতে পারব সংকট কতটা সর্বব্যাপ্ত। ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে হ্রাস ৩৯.৩%, নির্মাণ কার্যে ৫০%, বাণিজ্য, পর্যটন, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মিলিত হ্রাসের পরিমাণ ৪৭%, আর্থিক পরিষেবার ক্ষেত্রে হ্রাস ৫.৩%, খনি ও আকরিক উত্তোলনে ২৩%। এমনকি বিদুৎ, গ্যাস, জল সরবরাহ প্রভৃতি আবশ্যিক পরিষেবাগুলির ক্ষেত্রে অর্থনীতির হ্রাস ৭%। একমাত্র বৃদ্ধির ক্ষেত্র কৃষি যা রেকর্ড পরিমাণ রবিশস্যর ফলনের কারণে ৩.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ছবি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জুলাই মাসের মাঝামাঝি সেই গর্বিত উক্তিটিকেও নির্ভেজাল মিথ্যা প্রমাণ করল যেখানে তিনি বলেছিলেন করোনা অতিমারী থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীতে একনম্বর। সেই ফাস্ট বয় কিভাবে লাস্ট বয় হয়ে গেল সে উত্তর দেওয়ার দায়ও অবশ্যই সরকার পক্ষকে নিতে হবে কারণ পৃথিবীর আর কোন দেশের অর্থনীতি ভারতের মত এতটা সংকুচিত হয় নি। রাশিয়ার জিডিপি হ্রাস ৮.৫%, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ৯.১৭%, জাপান ৯.৯%, ইতালির ১৭.৭%। আর যে চিনকে হারিয়ে আমরা গ্লোবাল হাব হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি তারা প্রাথমিক ধাক্কা সামলে জিডিপিতে ৩.২% বৃদ্ধি ঘটাতে সমর্থ হয়েছে।

 

তবে সমস্যাটা এখানেই শেষ হচ্ছে না কারণ বহু অর্থনীতিবিদ মনে করছেন যে এটা প্রাথমিক হিসাব, সমস্ত তথ্য আসার পর হিসাবটা সংশোধিত হবে। সেক্ষেত্রে জিডিপি হ্রাসের পরিমাণ ৪০% এ পৌঁছে যেতে পারে। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ অরুণকুমার ‘দি ওয়ার’ (২ সেপ্টেম্বর, ২০২০) পত্রিকায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ উপস্থিত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন বিমুদ্রাকরণের পর থেকে কৃষি ছাড়া আর কোন অসংগঠিত ক্ষেত্রের পরিসংখ্যান জিডিপিতে যুক্ত করা হয় না। অথচ কর্মসংস্থানের ৯৪% এবং জিডিপির ৪৫% আসে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। অরুনকুমার সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কে ধরলে জিডিপি হ্রাসের পরিমাণ ৭০-৮০% হতে পারে। এছাড়াও এবারের জিডিপির হিসেবে শিল্প উৎপাদন সূচক এবং উপভোক্তা মূল্য সূচক সংক্রান্ত কোন তথ্য যুক্ত করা হয় নি, যেমন নেই রাজ্যগুলির মোট উৎপাদন এর পরিমাণ। ভারতের প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রনব সেনের মতে অর্থনৈতিক সংকোচনের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩২%।

 

যদিও জিডিপি হ্রাসের চেয়ে মারাত্মক কর্মহীনতার ছবিটা। অবশ্য একথা সবার জানা যে কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই গত ৪৫ বছরে সবচেয়ে বেশি বেকার বাহিনী তৈরি করেছিল ‘আচ্ছে দিনের’ সরকার। একশ দিনের রোজগার যোজনার কারণে গ্রামের দিকে অর্থনীতি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে নি এবং অবস্থার চাপে গ্রামে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকেরাও এই প্রকল্পে কাজ করেছেন। অন্যদিকে শহরের কর্মহীনতা ভয়ঙ্কর অবস্থায় আছে। সানিয়া ভালোটিয়া, স্বাতী ধিংরা প্রমুখেরা “City of dreams no more: the impact of covid-19 on urban workers in India” শীর্ষক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন শহুরে ১৮-২৫ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে কোভিড পর্বে বেকারত্ব মারাত্মক হারে বেড়েছে। ১২ কোটি ২০ লক্ষ শহুরে শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছেন। শহরে বর্তমান পরিস্থিতিতে মাত্র ৩১% ব্যাক্তির নিশ্চিত আয়ের সুযোগ রয়েছে অর্থাৎ ৬৯% মানুষের আয় অনিশ্চিত। এই সমীক্ষায় আরো প্রকাশ পেয়েছে যে শহরের শ্রমশক্তির ৫২% লক ডাউনের সময় অন্তত একমাস কোন উপার্জন করেন নি।যে দেশ বার বার নিজেকে ‘গ্লোবাল সুপার পাওয়ার’ হিসাবে দাবি করে সিএমআইই এর তথ্য অনুসারে শহরাঞ্চলে ২০১৮ সালে বেকারির হার ৭%, ২০১৯ সালে ৮% আর লকডাউনের বাজারে এপ্রিল মাসে ২৫%, জুন মাসে ১১%, জুলাই মাসে ৯.২%, আগস্ট মাসে ১০%।

 

শুধুমাত্র অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মধ্য শিল্পের (MSME) কাজ গেছে ২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের। এই চরম বেকারির কারণ অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মধ্য শিল্পের সম্পূর্ণ বসে যাওয়া এবং পর্যটন ও পরিবহন শিল্পের সর্বনাশ। চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদন সংকটে পড়েছে। মানুষের খরচ করার প্রবণতা ২৭% কমে গেছে যা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করে মানুষের কাছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার মত টাকা নেই। ভারতপ ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় উৎপাদক হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের বড় কর্তা জানিয়েছেন এ বছর আর তারা ঘুরে দাড়াঁবার আশা দেখছেন না। যদিও ক্ষেত্রভিত্তিক সমস্ত সমীক্ষার ফলাফল এখনো আসে নি, তবুও কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ করা যেতেই পারে। ‘দি প্রিন্ট’ প্রকাশিত প্রতিবেদন (১৭.০৮.২০২০) অনুযায়ী পর্যটন সচিব যোগেন্দ্র ত্রিপাঠি পরিবহন,পর্যটন ও সাংস্কৃতিক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি কে জানিয়েছেন কোভিড অতিমারীর কারণে শুধু পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ২.৫–৫ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ১.৫৮ লক্ষ কোটি টাকা। অন্তত দু বছরের আগে পর্যটন শিল্পের হাল ফেরার সম্ভাবনা নেই। কেন্দ্রীয় বিমান পরিবহন সচিব পি.এস.খারোলার হিসাব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অসামরিক উড়ান ৫০-৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে আনলক পর্বে। অসমর্থিত সূত্রের খবর বিমান পরিবহন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ২৫% মানুষ ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন।

 

এই সর্বব্যাপ্ত সংকট দেশের আর্থিক কাঠামোটাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। সরকারের আয় কমেছে ফলে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির জিএসটি বাবদ পাওনা মেটাতে অপারগ। সেজন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী রাজ্যগুলিকে যথেচ্ছ টাকা রিজর্ভ ব্যাংক থেকে ধার করার ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন। প্রাথমিক হিসাব অনুসারে ২১ টি রাজ্যের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ৯৭,০০০ কোটি টাকা। ওয়াকিবহাল মহলের মতে কোভিড জনিত পরিস্থিতির কারণে ও কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতায় বছরের শেষে রাজ্য সরকারগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮.২৫ লক্ষ কোটি। এই অবস্থায় অর্থনীতির নিয়ম মেনেই বিনিয়োগ এর পরিমাণ কমেছে ৪৮%। গগনচুম্বী কর্মহীনতা ভারতের মত তীব্র শ্রেণি বৈষম্যের দেশে আর্থিক ও সামাজিক ভাবে দুর্বলদের সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। Indiaspend এর রিপোর্ট (এপ্রিল -২০২০) অনুযায়ী দেশব্যাপী লকডাউনের প্রতিক্রিয়ার প্রথম পর্বেই ১০-১২ কোটি ভারতীয় কাজ হারিয়েছেন। এই পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Centre for economic data and analysis’ এর ডিরেক্টর অশ্বিনী দেশপান্ডে জানিয়েছেন লকডাউনে উচ্চ বর্নের লোকেরা যত কাজ হারিয়েছেন, তপশিলি জাতির মানুষেরা কাজ হারিয়েছেন তার তিনগুণ। আবার মোদি সরকারের সবচেয়ে সোচ্চার সমর্থক বলে বিজ্ঞাপিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও অবস্থা ভালো নয়। সিএমআইই এর তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২০২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় ১৫% কমেছে।

 

ভারতের ক্ষেত্রে এই ভঙ্গুর অবস্থার কারণ অবশ্য শুধুই করোনা নয়। ২০১৪ সাল থেকে স্বপ্নের সওদাগর যখন থেকে তার আচ্ছে দিনের রামধূন শুরু করেন তখন থেকেই কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতির অধোগমনের মাত্রা  আরো দ্রুত হয়। বিজেপির প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা বহুবার তথ্য প্রমাণ সহযোগে অভিযোগ করেন যে অর্থনীতির ঘনায়মান সংকট কে আড়াল করতে জিডিপি নির্নয়ের প্রচলিত পদ্ধতির বদল করা হয়। কোভিডের ঠিক আগেই ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৭.৫৯% যা বিগত ছয় বছরে সর্বোচ্চ। শুধু শাকসবজির দামের বৃদ্ধি হয়েছিল ৫০.১৯%। বিশ্বব্যাঙ্কের বার্তা ছিল ভারতে জিডিপির হার এবছর ৫% এর বেশি হবে না। ক্যাপিটাল গুডসের উৎপাদন ১৮% ও ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন ১৫% হ্রাস পেয়েছিল গত জানুয়ারি মাসেই। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) হিসাব অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৩% যা গত ৫৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকে জিডিপির বৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩.১% যা গত সাত বছরে সর্বনিম্ন। ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেন তাতে এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক সঙ্কটের কথা স্বীকার করা হয় এবং অটোমোবাইল, নির্মাণ শিল্প ও বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রে সরকার আর্থিক প্যাকেজের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই তথ্য পরিবেশনার উদ্দেশ্য হল যে ইতিমধ্যেই আর্থিক ভাবে দুর্বল দেশে করোনা সংক্রমণের প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া সংকট কি প্রভাব ফেলবে তা বুঝে নেওয়া। আর একথা আজ বহু আলোচিত যে বিমুদ্রাকরণ ও জিএসটির মত ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক নীতি ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়।

 

এরপর এলো ৪ ঘন্টার নোটিশে (২৫ মার্চ) নেমে আসা অপরিকল্পিত লকডাউন যা কিছু কিছু ছাড় দিয়ে ৭০ দিন জারি থেকেছে এবং তার পর চালু হয়েছে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা সহ আনলক পর্ব। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে পন্ডিতেরা লকডাউনকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় বাতলিয়েছিলেন, সমস্ত পরিসংখ্যান তাদের ভুল প্রমাণ করেছে। সেরো পরীক্ষার ফলাফল (১২ সেপ্টেম্বর) অনুযায়ী মে মাসের গোড়াতেই শতাংশের হিসাবে ভারতের ৬৪ লক্ষ মানুষ করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন অথচ সরকারি খাতায় তখন প্রকৃত সংক্রমিতের সংখ্যা ৭০ হাজার পেরোয় নি। এই লকডাউন অপরিকল্পিত কারণ সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা যখন ৫০০ চেয়েও কম তখন কঠোরতম লকডাউন, আর আজ যখন দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা গড়ে ৮৫০০০-৯০০০০ তখন কোন কার্যকর লকডাউনের প্রশ্ন নেই। আর পুরো লকডাউন পর্ব জুড়ে আমরা দেখেছি সরকার যে যে মাত্রায় টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়েছে সেই সেই মাত্রায় সংক্রমনের সংখ্যা বেড়েছে। করোনা সংক্রমণের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক টেস্ট ও আইসোলেশনের পদ্ধতি ছেড়ে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের দায় এড়ানো আসলে এক জনবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত যা নিজেদের ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আড়াল করতে ভারত সরকার নিয়েছিল। পৃথিবীর আর কোন দেশ এত দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের দেশে অর্থনৈতিক অবরোধ চালু করে নি। এই তুঘলকি লকডাউনের ফলে এক ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। শিল্প উৎপাদন স্তব্ধ হল বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে।পরিষেবা স্তব্ধ, গণ পরিবহন ব্যবস্থা অদৃশ্য। তাও মন্দের ভালো যে ২৭ মার্চ (সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণার দুদিন পর) থেকে কৃষিকাজের থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। রবিশস্যের রেকর্ড উৎপাদন হলেও পরিবহন ব্যবস্থা না থাকা, ৮০ শতাংশ মান্ডির বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কৃষকের বিপন্নতা বাড়ল। দেশের দরিদ্রতম ৫০ কোটি মানুষ উপার্জনের অভাবে একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে গেল। ফলে চলতি আর্থিক বর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে যে আর্থিক ফলাফল আমরা দেখেছি তা অনিবার্য ছিল। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে করোনা পর্বের আগে থেকেই ভারতীয় অর্থনীতি আইসিসিইউতে ছিল, করোনা তাকে ভেন্টিলেশনে নিয়ে গেল।

 

এই ভয়ংকর আর্থিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় সরকার এই সময়ে কি ধরনের আর্থিক নীতি গ্রহণ করছে। সরকারি হস্তক্ষেপ ও রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ছাড়া এই সংকট থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। কারণ সরকার যতই কর্পোরেটদের স্বার্থে সওয়াল করুন না কেন,এই কঠিন সময়ে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের আশা করাটাই বাতুলতা। ভারতে করোনা অতিমারী ও তজ্জনিত কঠিন লকডাউন যখন সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের আয়ের উপর আঘাত হানল তখন স্বাভাবিক ভাবেই খরচ করার মত টাকা তাদের কাছে থাকল না ফলে বাজারে চাহিদা কমে গেল। চাহিদা কমার কারণে উৎপাদন ক্ষেত্র গুলি সংকটে পড়ল। উৎপাদন কমল,বাড়ল চাকরি ছাঁটাই-এর হার। সরকারের দায়িত্ব ছিল এমন আর্থিক প্যাকেজ তৈরি করা যা এই সংকটের সময় কার্যকরী সাব্যস্ত হবে।

 

প্রথমত এই প্যাকেজটাকে চরিত্রগত ভাবে হতে হবে আপৎকালীন অর্থাৎ অর্থনীতিতে যেন খুব দ্রুত তার ফলাফল দেখা যায়। দ্বিতীয়ত ভারতের মত অসম আর্থিক বিকাশ ও তীব্র বৈষম্যের দেশে আর্থিক প্যাকেজের ভরকেন্দ্র হবে পরিযায়ী শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মহীন মানুষ, প্রান্তিক চাষি ও ক্ষেতমজুর। তৃতীয়ত বাজারে চাহিদা না থাকলে জোগান কমবেই। লাভের প্রত্যাশিত হারের পরিমাণ কমলে দেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমান কমবে। এই অবস্থায় অর্থনীতির রক্ষা কর্তা হতে পারে শুধু মাত্র সরকারি ব্যায়। চতুর্থত কর্মহীন, অভুক্ত, অর্ধভুক্ত মানুষদের কাছে খাদ্য ও নগদ অনুদান পৌঁছে দিতে হবে। বাধ্যতামূলক তালাবন্দীর ফলে যে অর্থনীতির কাঠামোটা ভেঙে পড়েছে সেটা জোড়া লাগানোর জন্য পরিকাঠামো নির্মাণে বিপুল খরচা করতে হবে। এতে কর্মসংস্হান হবে,মানুষের আয় বাড়বে। বেসরকারি ক্ষেত্রে পণ্যের চাহিদা বাড়বে। সরকারকে সেই টাকার জোগাড় করতে হবে। বাড়তি টাকা ছাপানো, ধনীদের উপর কর চাপানো, ধার নেওয়া (সুদের হার কম তাই শোধ দেওয়ার খরচ কম) প্রভৃতি উপায় সরকার কেই ভাবতে হবে। পঞ্চমত রাজকোষের ঘাটতির পরিমান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হতে হবে। রাজকোষের ঘাটতির পরিমাণ বাড়িয়ে যে টাকা আসবে তা খরচ করতে হবে গরিব মানুষ, শ্রমিক ও কাজ হারানো মানুষদের জন্য। ষষ্টত শুধু জোগানের ব্যবস্থা করলেই হবেনা, একই সঙ্গে চাহিদা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। খরচের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। সরকারি ত্রানের খরচ প্রকৃত অর্থে জিডিপির ১০-১২ শতাংশ হতে হবে।

 

উপরিউক্ত কথাগুলো বিগত সময়ে অর্থনীতিবিদরা নানা ভাবে বলেছেন, সরকারকে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন কিন্তু কর্পোরেট স্বার্থের বশম্বদ সরকার সেই কথায় কর্নপাত করে নি বরং উল্টোপথে হেঁটেছে (সম্প্রতি সংঘ ঘনিষ্ঠ সুবরামনিয়াম স্বামী মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি বোঝে এমব লোকেরা মোদি সরকারের কাছে পরিত্যাজ্য)। তারা বাগাড়ম্বর সর্বস্ব, অস্বচ্ছ  এবং সংখ্যাতত্ত্বের কারসাজি যুক্ত ২১ লক্ষ কোটি টাকার এক প্যাকেজ ঘোষণা করে যা করোনা পূর্ববর্তী ঘোষনাগুলওর উপর প্রলেপ মাত্র। আর্থিক বিশ্লেষকরা আজ একথা প্রমাণ করে দিয়েছেন প্রকৃত প্যাকেজের পরিমাণ মাত্র ২ লক্ষ ১৭ হাজার ৯৫ কোটি টাকা যা জিডিপির মাত্র ১.১%। অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া তাদের জিডিপির যথাক্রমে ১৩,২১,৮.৮ ও ৯.৯% করোনার সময়ে অর্থনীতিতে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নটি। সরকারের এইগল্পটা দাঁড়িয়ে আছে ঋণ নির্ভর প্যাকেজ এবং অর্থনীতিতে টাকার জোগানের উপর। অর্থনীতিতে একে বলে liquidity infusion। অর্থাৎ সরকার বিভিন্ন তহবিলের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে টাকার জোগান বাড়াবে এবং এক্ষেত্রে তার প্রধান অবলম্বন অবশ্যই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। কিন্ত করোনা অতিমারীতে আমাদের দরকার ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে টাকা খরচ (fixed expenditure)। এতে মোট চাহিদা বৃদ্ধি পায় ফলে অর্থনীতিতে বৃদ্ধি দেখা দেয়। একথা সবার জানা যে অর্থনীতিতে মন্দার সময় টাকার জোগান কাজে দেয় না কারণ মোট চাহিদা কমে যায়। ফলে ঋণের হার কম হলেও শিল্পপতিরা ঋণ নিতে উৎসাহী হন না। ফলে এই মুহুর্তে আমাদের দরকার ছিল প্রচুর পরিমাণে সরকারি টাকা বিনিয়োগ, আম আদমির হাতে টাকা দেওয়া ও জনগনের ক্রয় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা। কিন্তু তার বদলে সরকার দিল ঋণের প্যাকেজ। ফলে কাঁচামালের বিক্রিও বাড়ল না, চাহিদাও বাড়ল না, অর্থনীতির চাকাও ঘুরলো না। নির্মলা সীতারামন ঘোষিত প্যাকেজে সরকারের মুখ রক্ষা করেছে একমাত্র একশ দিনের রোজগার যোজনা প্রকল্প (নরেন্দ্র মোদির ভাষায় গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প) এর ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও চাঙ্গা রেখেছে এই প্রকল্প। যদিও শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী রাজ্য সরকার গুলি এই খাতে প্রচন্ড চাহিদার মুখে দাঁড়িয়ে তাদের বাজেট শেষ করে ফেলেছে। নগদ টাকা দেওয়ার পরিবর্তে জনধন যোজনায় মাসিক ৫০০-১০০০ টাকা বিতরণ কোন কাজেই আসে নি।

 

আজ নির্বোধ অর্থনৈতিক নীতির কারণে ভারতের শ্রমজীবী মানুষ ধ্বংসের কিনারায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুসারে জুলাই মাসে নীতি আয়োগ ও মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করে পুনরায় প্যাকেজের দাবি জানায়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কোন নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করা হয় নি। এই মুহূর্তে প্রধান কাজ হল আভ্যন্তরীন চাহিদা বৃদ্ধি, আত্মনির্ভর ভারতের ছেলে ভুলানো শ্লোগান নয়। তাই গরীব মানুষের হাতে নগদ টাকা দিতে হবে। যারা আয়কর দেন না তাদের জন্য আগামী চার মাস ৮৫০০ টাকা মাসিক অনুদান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। দ্বিতীয়ত গ্রাম ভারতে একশ দিনের রোজগার যোজনায় ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি যাতে গ্রামের গরীব মানুষের হাতে এবছর অন্তত ২০০ দিন কাজ দেওয়া যায়। তৃতীয়ত শহরাঞ্চলের গরীব মানুষের জন্য যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প চালু করা। চতুর্থত পরিকাঠামো নির্মাণে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি। পঞ্চমত আগামী ছয় মাস সার্বজনীন গণ বন্টন ব্যবস্থা চালু করা ও বিনা মূল্যে সরকারের ব্যবস্থাপনায় কোভিড চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এই দাবি গুলো পূরণে সরকারকে বাধ্য করতে পারলে তবেই অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব, নচেৎ নয়।

 

  • লেখক স্কুল শিক্ষক  গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী 

 

Share this
Leave a Comment