সংসদে প্রশ্ন নিষিদ্ধ। এবার তথ্যেরও অন্তর্জলি যাত্রা।


  • September 15, 2020
  • (0 Comments)
  • 1526 Views

এর পর হয়তো শুধু তথ্য নয়, সংসদেরও অন্তর্জলি যাত্রা আমরা দেখে যেতে পারব। সে ইতিহাস লিখে যেতে পারব কিনা, সে-কথা জোরের সঙ্গে বলা যাচ্ছে না। কেননা, এলগার পরিষদ মামলার পর দিল্লি হিংসা মামলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, এনআইএ, দিল্লি পুলিশের ভূমিকাই বলে দিচ্ছে – ভারত এখন নাগপুর নাজিবৃত্তে বন্দি হয়ে পড়েছে। লিখলেন দেবাশিস আইচ

 

* মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে ঘুমন্ত অবস্থায় মালগাড়ির চাকায় পিষে মারা যাননি মধ্যপ্রদেশের ১৬ জন শ্রমিক।

 

* রাজস্থান থেকে বিহার, ঝাড়খণ্ড, বাংলায় ফেরার পথে উত্তরপ্রদেশের আউরাইয়ায় কোনও ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটেনি। মারা যাননি বাংলার বাঁকুড়ার তিন শ্রমিক-সহ ২২জন।

 

* না, তেলেঙ্গানা থেকে হেঁটে ছত্তিশগড়ের বাড়িতে ফেরার পথে খিদে, জল তেষ্টায় কাতর হয়ে পথে লুটিয়ে পড়েনি ১২ বছরের আদিবাসী শিশু কন্যা জামলো।

 

* মুজফফরপুর স্টেশনে মৃত মায়ের মৃতদেহ ঢেকে রাখা চাদর নিয়ে খেলতে দেখা যায়নি কোনও দুধের শিশুকে।

 

* হায়দরাবাদ থেকে বীরভূমে পায়ে হেঁটে, কখনও কোনও গাড়িতে চেপে বালেশ্বরে পৌঁছে মারা যাননি ৫২ বছরের ইয়ার মহম্মদ।

 

* কেরালা থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মৃত্যু হয়নি মালদহের ২৭ বছরের তরুণ খতিপ শেখ কিংবা  খিদে তেষ্টায় কাতর হয়ে পড়া হরিশ্চন্দ্রপুরের কিশোর পীযূষ দাসের।

 

* অন্ধ্রপ্রদেশের প্রকাশম জেলায় ট্রাক্টর বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা মারায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাননি ৯ শ্রমিক।

 

* ১০ জুলাই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে রেল-চত্বরে ১১০ জনের মৃত্যুর খবরটি আসলে ভুয়ো।

 

* মিথ্যে, লকডাউনের প্রথম পাঁচ সপ্তাহে ‘পুলিশের মারে মৃত ১২’, সংবাদমাধ্যম ছেঁচে প্রস্তুত করা কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের রিপোর্টটিও।

 

* স্বাধীন সমাজকর্মী ও শিক্ষক-অধ্যাপকদের শ্রমে গড়া লকডাউন পর্বে ৩৮৩জন শ্রমিকের অকাল মৃত্যুর তথ্যও মিথ্যে।
https://thejeshgn.com/projects/covid19-india/non-virus-deaths/

 

সত্য এই, দেশের সরকারের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই। সাংসদদের লিখিত প্রশ্নের উত্তরে এমনটাই জানিয়েছেন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় শ্রম প্রতিমন্ত্রী সন্তোষকুমার গাঙ্গোয়ার।

 

 

শুধু তাই নয়, লকডাউনের জেরে কত শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন সে প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া যায়নি। মন্ত্রী জানিয়েছেন, এমন কোনও তথ্য মজুত করা হয়নি। লকডাউন হলে এই শ্রমিকরা কী কী সমস্যায় পড়তে পারেন তা বুঝতে কী সরকার ব্যর্থ হয়েছে? এমনই এক প্রশ্নের দায় এড়িয়ে রাজ্য, স্থানীয় প্রশাসন, স্বনির্ভরগোষ্ঠী থেকে অ-সরকারি সংস্থা সকলের ঘাড়ে বন্দুক রেখে পার পেতে চেয়েছেন মন্ত্রী।

 

সংসদে মৌখিক প্রশ্নোত্তর পর্ব বাদল অধিবেশনে বাতিল করা হয়েছিল আগেই। ছেঁটে দেওয়া হয় জিরো আওয়ার পর্ব। জানিয়ে দেওয়া হয় কোনও প্রাইভেট বিল আনা যাবে না। শুধুমাত্র, ১৪ দিন আগে জমা দেওয়া লিখিত প্রশ্নেরই লিখিত জবাব দেওয়া হবে। অতএব বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই, নেই অতিরিক্ত প্রশ্ন তোলার সুযোগও। কেন সরকারের কাছে শ্রমিকদের অকাল মৃত্যুর কোনও তথ্য নেই, সেই প্রশ্নের অবকাশও রইল না। দায় রইল না অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। তথ্য বিকৃত করা, অস্বস্তিকর, অপ্রিয় তথ্য প্রকাশ না করা, অর্ধসত্য কিংবা অসত্য বলার অনেক অভিযোগই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে। কিন্তু, শ্রমিকের মৃত্যুর প্রশ্নে, তাদের কর্মহীনতার প্রশ্নে দেশ দেখল তথ্যের পূর্ণ অবলুপ্তি। কিংবা বলা যেতে পারে অন্তর্জলি যাত্রা। শ্রমিকদের ভবিষ্যতের দায় চাপানো হলো রাজ্যগুলির উপর। স্বীকার করা হলো না লকডাউন-পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা বিবেচনাই করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। শুধুমাত্র একটি তথ্যই মিলেছে, তা হলো দেশে মোট পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে যে ধোঁয়াশা ছিল, তার অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। মন্ত্রী জানিয়েছেন, মোট ১০৪৬৬১৫২ জন পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্যে ফিরেছেন। এ-ও পূর্ণ তথ্য নয়। কেননা তালিকায় নেই ছত্তিশগড়, ওডিশা, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ সহ ন’টি রাজ্যের হিসেব। অনুমান করা যায় সংখ্যাটি দেড় কোটিতে দাঁড়ালে অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হবে না। এই তথ্যটুকু মিলেছে সম্ভবত এই কারণে যে, শীর্ষ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত বা সুয়ো মোটো মামলার প্রেক্ষিতে রাজ্যগুলি ও কেন্দ্রীয় সরকার ঘরে ফেরা শ্রমিকদের তালিকা দিতে বাধ্য হয়। সংসদে প্রকাশিত তালিকায় দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছেন ১৩৮৪৬৯৩জন শ্রমিক।

 

 

সরকার চেয়েছিল লকডাউন-কালে ওঠা ভুরি ভুরি অভিযোগ সংসদে এড়িয়ে যেতে। পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু ও আনুষঙ্গিক প্রশ্নে সেই অভিযোগ এড়াতে পারলেন কই মোদী? তবে, এসব প্রধানমন্ত্রীকে আদৌ বিচলিত করবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সম্পূর্ণ বিলগ্নীকরণ থেকে শ্রমআইন নখদন্তহীন করে তোলার মতো পদক্ষেপ করতে তিনি মুখিয়ে আছেন। সংসদে রূঢ় সংখ্যাধিক্যের জোরে তাঁর সরকারের শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ চাকুরিজীবী খেটেখাওয়া মানুষ বিরোধী পরিকল্পনাগুলি হাসিল করা কঠিন কাজ নয়। এর পর হয়তো শুধু তথ্য নয়, সংসদেরও অন্তর্জলি যাত্রা আমরা দেখে যেতে পারব। লিখে যেতে পারব কিনা, সে-কথা জোরের সঙ্গে বলা যাচ্ছে না। কেননা, এলগার পরিষদ মামলার পর দিল্লি হিংসা মামলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, এনআইএ, দিল্লি পুলিশের ভূমিকাই বলে দিচ্ছে – ভারত এখন নাগপুর নাজিবৃত্তে বন্দি হয়ে পড়েছে।

Share this
Leave a Comment