বিএসএনএল (ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌)-এর ঠিকা কর্মচারীদের দাবি আদায়ে তৈরি হল যৌথমঞ্চ


  • August 28, 2020
  • (0 Comments)
  • 1237 Views

বিএসএনএল, পশ্চিমবঙ্গে ৪৮৬২ জন ঠিকাকর্মী গত ১৪ থেকে ১৬ মাস যাবত কোনওরকম বেতন পাচ্ছেন না। হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কর্মীদের বেতন ধাপে ধাপে মিটিয়ে দিতে, তা-সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ নির্দেশ এড়িয়ে গেছেন। ইতিমধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন প্রায় ১১ জন ঠিকাকর্মী। এই পরিস্থিতিতে গত ১৮ অগস্ট পাঁচটি বিএসএনএল ঠিকা কর্মচারী ইউনিয়ন একটি আলোচনাসভায় মিলিত হয়ে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠিকাকর্মীদের দাবি আদায়ের জন্য তাদের যুক্ত আন্দোলনের পথেই যেতে হবে। তৈরি হয়েছে একটি যৌথমঞ্চ – বিএসএনএল ঠিকা কর্মচারী বাঁচাও মঞ্চ’। এই যৌথমঞ্চের প্রধান দাবি  – অবিলম্বে বকেয়া বেতন দিতে হবে, অবিলম্বে নতুন আউটসোর্সিং প্রথা এসএলএ বাতিল করতে হবে ও  একজন জেসিএল-কেও ছাঁটাই করা চলবে না। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট। 

 

বিএসএনএল, পশ্চিমবঙ্গে ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌-এর অধীনস্থ ৪৮৬২ জন ঠিকাকর্মী গত ১৪ থেকে ১৬ মাস যাবত কোনওরকম বেতন পাচ্ছেন না। কোভিড-১৯ সংক্রমণ, মহামারি-পরিস্থিতি, লকডাউন ইত্যাদি আপৎকালীন অবস্থাও ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌ কর্তৃপক্ষকে মানবিক করে তোলেনি। কর্মীদের বারবার আবেদন, আন্দোলন কোনও কিছুই বকেয়া বেতন মিটিয়ে দিতে তাদের সক্রিয় করে তুলতে পারেনি। জীবন-জীবিকা, পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার আতঙ্ক থেকে বেরোতে না-পেরে ইতিমধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন প্রায় ১১ জন ঠিকাকর্মী। ঠিকাকর্মীদের বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে হাইকোর্ট-এ মামলা করা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কর্মীদের বেতন ধাপে ধাপে মিটিয়ে দিতে। তা-সত্ত্বেও ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌ কর্তৃপক্ষ নানা বাহানায় সেই নির্দেশ এড়িয়ে গেছেন। বরং এখন, যখন মহামারি ও সংক্রমণের কারণে কর্মীরা অবিলম্বে আন্দোলনের পথে যেতে পারছেন না, তখন নানা ঠিকাকর্মী বিরোধী নোটিশ জারি করা হচ্ছে। সেখানে যেমন রয়েছে কর্মী আউটসোর্সিং-এর টেন্ডার, তেমনি কাজের দিন ও বেতন কমিয়ে দেওয়ার কথা। অথচ বকেয়া বেতন মেটানো নিয়ে বাস্তবিকই সরকারের কোনও হেলদোল নেই।

 

এই পরিস্থিতিতে গত ১৮ অগস্ট ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌-এর বালিগঞ্জ প্লেস ভবনে পাঁচটি বিএসএনএল ঠিকা কর্মচারী ইউনিয়ন একটি আলোচনাসভায় মিলিত হয়। সিডব্লিউইউ বিএসএনএল(সিটি), বিএসএনএলসিএলইউ, সিটিটিএমইউ, এনটিডব্লিউসি, সিডব্লিউইউ(পিবি) –এর প্রতিনিধিরা এক আলোচনায় এই সিদ্ধান্তে আসেন যে বর্তমান জরুরি অবস্থাকালীন পরিস্থিতিতে ঠিকাকর্মীদের দাবি আদায়ের জন্য তাদের যুক্ত আন্দোলনের পথেই যেতে হবে। এই কথা মাথায় রেখেই এই পাঁচটি ইউনিয়নের প্রতিনিতিদের নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি যৌথমঞ্চ – বিএসএনএল ঠিকা কর্মচারী বাঁচাও মঞ্চ’। গঠিত হয়েছে প্রতিটি ইউনিয়নের দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটি। আহ্বান জানানো হয়েছে যাতে দলমত নির্বিশেষে বিএসএনএল ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌-এর সকল ঠিকা কর্মচারী যাঁরা এখনও পর্যন্ত বিনা বেতনেও নিজেদের কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন ও যাঁদের ছাড়া বিএসএনএল-এর নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড কার্যত অচল হয়ে পড়বে এবং পড়েছেও, তাঁরা যেন নিজেদের প্রাপ্য দাবি আদায়ের জন্য এই যৌথমঞ্চের আন্দোলন, কর্মসূচিতে যোগ দেন। স্থির হয়েছে যুক্ত আন্দোলনে প্রতিটি ইউনিয়ন নিজেদের ব্যানার ও পতাকা-সহই উপস্থিত থাকবেন।

 

এই যৌথমঞ্চের প্রধান দাবি মূলত তিনটি –

 

  • অবিলম্বে বকেয়া বেতন দিতে হবে
  • অবিলম্বে নতুন আউটসোর্সিং প্রথা এসএলএ বাতিল করতে হবে
  • একজন জেসিএল-কেও ছাঁটাই করা চলবে না

 

ইতিমধ্যে গত ২৬ অগস্ট ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌-এর সমস্ত শাখায় এজিএম, ডিজিএম বা জিএম স্তরে ঠিকাকর্মীরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ‘বিএসএনএল ঠিকা কর্মচারী বাঁচাও যৌথ মঞ্চ’-এর উদ্যোগে আগামী ২ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় টেলিফোন ভবন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে। দাবি – (১) বিএসএনএল (ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌)-এর ৪৮৬২ জন ঠিকা শ্রমিককে ছাঁটাই করা যাবে না (২) ১৫ মাসের বকেয়া বেতন ও (৩) নয়া আউটসোর্সিং এসএলএ বাতিল।

 

যৌথমঞ্চের সদস্য পাপ্পু চৌধুরি বললেন, “এখন এমন একটা দিকে ক্যালকাটা টেলিফোনস্‌ এগোচ্ছে যেখানে ঠিকা কর্মচারীদের কোনও দায়িত্ব সংস্থা আর নেবে না। নতুন আউটসোর্সিং প্রথায় কর্মীদের বেতন এক ধাক্কায় কমিয়ে ৮০০০ – ১০,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে, সব কেটেকুটে একজন হাতে পাবে সাড়ে ছ’ হাজার টাকা। আমরা শেষ বেতন পেয়েছি প্রায় ১৬,০০০ টাকা। বেতন যদি এতটা কমে যায়, তাহলে একজন কীভাবে সংসার চালাবেন? রায়চক, কৃষ্ণনগর, মুর্শিদাবাদ থেকেও আমাদের ছেলেরা আসেন, কীভাবে তাঁরা এই টাকায় সবদিক সামলাবেন! যদি সব ঠিক থাকত তাহলে আমাদের বেতন আজ ২২,০০০ টাকার কাছাকাছি হতো।”

 

মনে রাখতে হবে ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত এই ঠিকা কর্মচারীরা রাজ্য সরকারের শর্তাধীন থেকে বেতন পেতেন। কিন্তু যেহেতু বিএসএনএল কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান সেহেতু তাঁরা আন্দোলন করে কেন্দ্রীয় শ্রম কমিশন-এর অধীনে কেন্দ্রীয় সরকারের শর্তাধীনে চলে এসে দক্ষ শ্রমিকদের নিরিখে বেতন পেতে শুরু করেন। সমস্যা শুরু হয় যখন ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়মানুযায়ী তাঁদের ৪২% বেতন বাড়ে। এই সময় থেকেই নানা অছিলায় ধীরে ধীরে ঠিকাকর্মীদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। চুক্তি শ্রমিকদের নেওয়া বন্ধ হয় ২০১৮-এর নভেম্বর থেকে, এমনকি ৫০ থেকে ৫৫ বছরের যে ঠিকাকর্মীরা রয়েছেন তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি না দিয়েই অবসর নিতে।

 

ভয়ের ব্যাপার হল নতুন এসএলএ নিয়মে আউটসোর্সিং হলে ঠিকা কর্মচারীরা কোনও ইউনিয়ন করতে পারবেন না, তাদের নিজ নিজ দপ্তরের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ থাকবে না, দপ্তরের কোনও ঘরে তাঁদের প্রবেশাধিকার থাকবে না। বর্তমানে যেমন ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের সরাসরি কাজের নির্দেশ দেন, সেরকম আর দেবেন না। যারা কন্ট্র্যাক্ট পাবেন তাঁরা নিজের খুশিমতো কর্মী নিয়োগ করবেন। এই আউটসোর্সিংয়ে ম্যানেজমেন্ট যতজনকে কাজ দেবেন, তাঁরাই কাজ পাবেন, বাকিরা বাদ যাবেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগুরু কর্মীর কাজ না-পাওয়ার আশঙ্কাই দানা বাঁধছে। ইতিমধ্যেই বলা হচ্ছে যেখানে ১০০ জন কর্মী সেখানে ৩০ শতাংশকে কাজ দেওয়া হবে। এই বিপদকালীন সময়ে বকেয়া বেতন না-পাওয়ার পাশাপাশি কাজ হারানোর আশঙ্কাও তৈরি হয়ে গেছে।

 

যৌথ মঞ্চের সদস্য ও সিডব্লিউইউ বিএসএনএল (পিবি)-র আহ্বায়ক শক্তিময় বিসওয়াল জানালেন, “ম্যানেজমেন্ট হঠাৎ করেই এতজন কর্মচারীর বেতন বন্ধ করে দিল। এখন যে নিয়ম আনছে তাতে এত জনের মধ্যে মাত্র ৩০০/৪০০ জনের কাজ থাকবে, বাকিরা বাদ যাবেন। কোনওরকম শ্রম আইন মানা হচ্ছে না। বারো ঘণ্টা ডিউটি করে সাড়ে আট হাজার টাকা মাইনে দেওয়া হবে বলা হচ্ছে। পিএফ, ইএসআই কিছুই পাচ্ছি না। যখন বিএসএনএল লাভ করেছে তখন এই ঠিকা কর্মচারীরাই কাজ করেছেন। আজ যদি বিএসএনএল-এর লোকসান হয়, কর্তৃপক্ষ তো এই কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে নেগোশিয়েট করতে পারত। হাইকোর্ট-এর নির্দেশও মানছে না, কোনও আইনই মানছে না। এরকমটা চলতে পারে না।”

 

এই কর্মীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানস্‌ রাইটস্‌ অর্গানাইজেশন-এর পশ্চিমবঙ্গ অধ্যায়। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে তারা এই পরিস্থিতির মীমাংসার জন্য তাঁর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। বিএসএনএল ঠিকা কর্মচারী বাঁচাও যৌথ মঞ্চ-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে তাঁরা এখন দাবি আদায়ের জন্য লাগাতার আন্দোলন করবেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মেমোরেন্ডাম দেবেন। প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পথে নেমে আন্দোলন করতেও তাঁরা তৈরি।

 

 

Also readস্বাধীনতা দিবসে আত্মহত্যা বিএসএনএল-এর আরও এক ঠিকা কর্মীর

 

Share this
Leave a Comment