শৈলেন চৌধুরী: প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আন্দোলনের এক নিরলস সংগ্রামী


  • June 9, 2020
  • (1 Comments)
  • 1529 Views

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আন্দোলনে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় সারা দেশেই যিনি অকুন্ঠ, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন আজীবন সেই শৈলেন চৌধুরি প্রয়াত হয়েছেন গত ২৭শে মে। সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে উঠতে চাননি কোনওদিনই, শুধু চেয়েছেন প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রাপ্য অধিকার, সম্মান ভারতের সংবিধান মেনে যেন আইনস্বীকৃতভাবে তাঁরা পান। নিরন্তর প্রতিবন্ধী আন্দোলনের লড়াইয়ে থাকা এই মানুষটির ব্যক্তিজীবনও অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক। নিজের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকতা নিয়ে যেমন আন্দোলনের শরিক হয়েছেন সাথীদের সঙ্গে, তেমনি জীবনের নানা বিষয়েই ছিল প্রবল উৎসাহ। পরবর্তী সময়ে তাঁর আন্দোলনের সাথী, অনুজপ্রতীম, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মীলনীর যুগ্ম সম্পাদক, ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস্‌ অফ দ্য ডিসএবেলড-এর এগজিকিউটিভ সদস্য, পেশায় বিদ্যালয় শিক্ষক অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়-এর একান্ত স্মৃতিচারণায় প্রচারবিমুখ লড়াকু মানুষটির নানা অজানা দিক তুলে ধরা গেল গ্রাউন্ডজিরো-য়।   

 

 

গত ২৭শে মে প্রয়াত হলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর রাজ্য সভাপতি তথা ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস্‌ অফ দ্য ডিসএবেলড (এনপিআরডি)-এর সহ সভাপতি শ্রী শৈলেন চৌধুরী সবার অলক্ষ্যেই, ঠিক যেভাবে সারা জীবন তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজ্য তথা দেশের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের আন্দোলনকে। আসলে, প্রচারের আলো যে যে কারণে এসে পড়ে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের ওপর, যেমন শিক্ষা অথবা কর্মক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো সাফল্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব উপস্থিতি অথবা অনর্গল ইংরাজী বলার ক্ষমতা, এর কোনোটাই শৈলেনদার (তাঁর পরিচিত মানুষদের কাছে এই নামেই জনপ্রিয় ছিলেন) ছিল না। কিন্তু, যা ছিল তা আক্ষরিক অর্থেই বিরল। জীবনের নানাবিধ ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে লড়তে লড়তে শৈলেনদা মানুষকে সংগঠিত করার, সংগঠিত রাখার এক অননুকরণীয় ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। প্রায় এক দশক ধরে শৈলেনদাকে খুব কাছ থেকে দেখে আমার এই ধারণা স্পষ্ট হয়েছে।

 

১৯৪০-এর দশকে এক উদ্বাস্তু পরিবারে শৈলেনদার জন্ম। বেড়ে ঊঠেছিলেন অভাব-অনটনের মধ্যেই। মা ছিলেন চটকলের কর্মী। তাই শৈশবেই খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন শ্রমজীবি এবং ছিন্নমূল হয়ে আসা উদ্বাস্তু মানুষের অভাব। সেই অভিজ্ঞতাই হয়তো তাঁকে টেনে এনেছিল শ্রমজীবি মানুষের লড়াইয়ে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী। সূচনা লগ্ন থেকেই এই সংগঠনের অন্যতম অগ্রণী সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন শৈলেনদা। প্রথমে যুগ্ম সম্পাদক এবং ২০১১ সাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুচারুভাবে পালন করেছেন সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব। ২০১০ সালে কলকাতায় এক কনভেনশনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিল এনপিআরডি। সূচনালগ্ন থেকেই এই সংগঠনের নেতৃত্বের অংশ হিসাবে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন শৈলেনদা। ২০১৩ সালে কোচিতে আয়োজিত এনপিআরডি-এর প্রথম সম্মেলন থেকে তিনি সংগঠনের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

 

শৈশবেই retinitis pigmentosa রোগে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকেন শৈলেনদা। এর ফলে মাঝ পথেই ছাড়তে হয় স্কুল। দারিদ্র্য এবং দৃষ্টিহীনদের শিক্ষার সুযোগের স্বল্পতার কারণেই শৈলেনদার প্রথাগত শিক্ষা শেষ হয় শৈশবেই। এই দুঃখ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাড়িত করেছে শৈলেনদাকে। এই নিয়ে বারবার তাঁকে আক্ষেপ করতে শুনেছি। প্রথাগত শিক্ষার স্বল্পতা অবশ্য শৈলেনদাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন, নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের প্রয়াসে ব্রতী থেকেছেন নিরলসভাবে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর অগ্রণী সংগঠক হিসাবে তাই তাঁর প্রধান অবদান হয়তো রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশেষ বিদ্যালয় নির্মাণের প্রক্রিয়াকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া।

 

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী প্রথম থেকেই ছিল সব ধরণের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে তৈরি একটা সংগঠন। সেই ধারা বহন করছে এনপিআরডি-ও। এই প্রয়াস যে ব্যতিক্রমী তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ, বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিরা নিজ নিজ সমস্যা সমাধানের লড়াইয়েই ব্যপৃত থাকেন বেশি। অন্য প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের সমস্যাবলী নিয়ে ভাবার সময় তাঁদের হয় না। এই ক্ষেত্রে শৈলেনদা ছিলেন ব্যতিক্রমী। নিজে দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও অন্য সমস্ত ধরণের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের সমস্যা নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের থেকে শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের সমস্যা অনেক বেশি, কারণ, তারা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পান না বললেই চলে – এ কথা আমি শৈলেনদাকে বারবার বলতে শুনেছি। এছাড়াও, মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের সমস্যা নিয়ে শৈলেনদা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। নিজে দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও যে বিদ্যালয়টি প্রায় নিজের সন্তানের মতো বড় করেছেন শৈলেনদা, সেটি একটি মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের বিদ্যালয়। বিদ্যালয় পর্বের পর মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের আশ্রয়ের বিষয়টি নিয়েও শৈলেনদা ভাবনাচিন্তা করেছেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হুগলি জেলার এরকম একটি আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, এই কেন্দ্রের আবাসিকদের ভালোমন্দের সঙ্গে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত রেখেছেন।

 

শুধু শিক্ষার বিস্তারই নয়, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদার লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও শৈলেনদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯০-এর দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে শংসাপত্র পৌঁছে দিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময়ের নিরিখে এই কাজটি ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। এই কাজেও শৈলেনদা নেতৃত্ব দিয়েছেন নিরলসভাবে। বস্তুতঃ, এই কাজ করতে গিয়েই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সংগঠকরা ঊপলব্ধি করেন যে, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিরা যে শংসাপত্র পাচ্ছেন তা কেবলমাত্র একটি রাজ্যেই বৈধ বলে বিবেচিত হচ্ছে। চাই এমন এক শংসাপত্র যা সারা দেশে গ্রহণযোগ্য হবে। এরপর ২০০৯ সালে এনপিআরডি  গঠনের জন্য আহুত প্রথম সভায় এই বিষয়টি শৈলেনদা উত্থাপন করেছিলেন। সূচনালগ্ন থেকে এই বিষয় নিয়েই এনপিআরডি-র আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। অবশেষে, ২০১৬ সালে যখন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আইন (RPD Act, 2016) সংসদে পাস হয়, তখন এই দাবীতে শিলমোহর পড়ে। সরকার নীতিগতভাবে মেনে নেয় যে, সারা দেশে বৈধ একটা শংসাপত্র দেওয়ার দায়িত্ব সরকার নেবে। পরবর্তীতে, এই শংসাপত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হয়েছেন শহুরে, ইংরাজী শিক্ষিত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিরা, এই বিষয়ে সংসদে ও রাজ্য বিধানসভায় বিবৃতি দিয়েছেন মন্ত্রীরা। কিন্তু, জাতীয় স্তরে প্রথম এই দাবি যিনি উত্থাপন করেছিলেন, তিনি থেকে গেছেন সকলের অগোচরেই। আসলে, শৈলেনদা ছিলেন এমনটাই। সারাজীবন পাদপ্রদীপের আড়াল থেকেই কাজ করে গেছেন।

 

শৈলেনদাকে প্রথম দেখি স্কুলে পড়ার সময়। তখন তিনি ছিলেন দূরের মানুষ। তাঁর দরাজ কণ্ঠস্বর, জটিল বিষয়কে গল্পের ছলে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমাকে আকর্ষণ করেছিল তখনই, কিন্তু, ওঁর আপাতকঠিন ব্যক্তিত্বের কারণেই কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি। পরবর্তীতে, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই আমি আবিষ্কার করতে পারি আপাতকঠিন ব্যক্তিত্বের অন্তরালে থাকা স্নেহপ্রবণ এই মানুষটাকে। বলা ভালো তখন এমন এক শৈলেনদার সঙ্গে আলাপ হল যিনি অনেক কাছের, অনেক ঘরোয়া। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানান সমস্যা নিয়ে যেমন তিনি অনর্গল কথা বলে যেতে পারেন, তেমনি কথা বলতে পারেন ইলিশ মাছ রান্নার কৃৎকৌশল নিয়েও। রাজনীতির কঠিন তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে যেমন তিনি তাঁর মতো করে বলে যেতে পারেন, তেমনি অনর্গল বলে যেতে পারেন ক্রিকেট অথবা ফুটবল খেলার নানা গল্প। যে বিষয়টা আমার আর শৈলেনদার মধ্যে নৈকট্য তৈরিতে সহায়তা করেছিল তা হল রেডিও। রেডিও ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তাঁর একলা ঘরের বিছানার একপাশে থাকত রেডিও আর অন্য পাশে টিভি। যখনই ওঁর বাড়ি গেছি, দেখেছি শৈলেনদা কিছু না কিছু শুনছেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা চলেছে প্রচুর। এই সময়ই দেখেছি কিভাবে ইংরাজী বোঝা ও বলার কৌশল রপ্ত করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন শৈলেনদা। দিনের যে কোনো সময় ফোন করে তাঁর কোনো একটা ইংরাজী শব্দের মানে জিজ্ঞেস করাটা এক সময় রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল আর কোনো দিন সেরকম ফোন না পেলে আমারও মনে হত কিছু যেন একটা হল না। এই নিরন্তর প্রয়াসের সুফল পাওয়া যেত এনপিআরডি-র বিভিন্ন কর্মসূচীতে যেখানে বলিষ্ঠভাবে শৈলেনদা তাঁর বক্তব্য হাজির করতেন।

 

আগেই বলেছি, শৈলেনদা ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। সমাজের সব ধরণের মানুষের সঙ্গে তিনি অত্যন্ত সহজে মিশে যেতে পারতেন এবং সেই সব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রেও তিনি যত্নবান ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে গ্রামের খেতমজুর, সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক অনন্য ক্ষমতা শৈলেনদার ছিল। সংগঠনের সব সহকর্মীর জীবনের সমস্যার খবর তিনি নিতেন এবং চেষ্টা করতেন সুপরামর্শ দেওয়ার। এভাবেই হয়তো তিনি শৈলেন চৌধুরী থেকে সবার শৈলেনদা হয়ে ঊঠেছিলেন।

 

আজ যখন কোরোনার প্রকোপ, যখন তীব্র আর্থিক সংকটে কাজ হারাচ্ছেন বহু মানুষ, যখন প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন অনেকটা পিছিয়ে পড়ল এক ধাক্কায়, তখন বড় প্রয়োজন ছিল শৈলেনদার। তীব্র সংকটের মুখে হতোদ্যম আন্দোলনকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে শৈলেনদার তেজোদৃপ্ত কণ্ঠস্বর আর অননুকরণীয় সাংগঠনিক দক্ষতার অভাব আমরা ঊপলব্ধি করব প্রতি পলে। এই বিশ্বাসও অবশ্য রাখতে ইচ্ছে করছে যে, যে লড়াই শৈলেনদা শুরু করেছিলেন, যে লড়াইকে তিনি শক্তি যুগিয়েছেন, সে লড়াই চলবে। প্রতিবন্ধী মানুষের দৃপ্ত, স্পর্ধিত মিছিলে হাঁটবেন শৈলেনদা, সবার অগোচরে, যেমনটা হেঁটেছেন সারা জীবন। যা আর ফিরে পাব না তা হল সেই সব দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা যখন নানাবিধ গল্পে আমাকে আর আমাদের মাতিয়ে রাখতেন শৈলেনদা।

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Tarun Dasgupta on June 9, 2020

    Associated with Sailenda since long time but manything was unknown to me.Now I am to much enriched with this writings.Long live Rights of Disability movement.

Leave a Comment