“ভাত দে হারামজাদা”


  • May 2, 2020
  • (4 Comments)
  • 4342 Views

করোনাভাইরাসে মৃত্যুর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। তার সঙ্গে বেকারত্ব, কর্মহীনতা। অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক ন্যায় এখন নিতান্তই আকাশকুসুম কল্পনা। সামাজিক দূরত্বের নামে এক নতুন ধারার অস্পৃশ্যতার জন্ম হয়েছে। আক্রান্ত কিংবা মৃতদের ক্ষেত্রে তো বটেই, গ্রামেশহরে সুস্থ জীবিতদের মধ্যে, পড়শিবন্ধুআত্মীয়পরিজনের মধ্যেও এই করোনাঅস্পৃশ্যতা পারস্পরিক সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা এমন স্তরে পৌঁছেছে যেন সকলে ডাইন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এমন এক সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবেশে আরও এক আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পার হয়ে গেল। দেশের কোটি কোটি প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ আজ পথে, সরকারি খোঁয়ারে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত দিন কাটাচ্ছেন। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন, শীর্ষ আদালতের রায় ঘেঁটে পরিযায়ী শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকদের দুঃসহ অবস্থা খতিয়ে দেখলেন দেবাশিস আইচ

 

 

যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন –
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে:
– রফিক আজাদ।

 

ভাত দে হারামজাদা,/ তা না হলে মানচিত্র খাবো।

 

কবি রফিক আজাদের কবিতাটির কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল রাজভবন বনাম নবান্নের কলতলার ঝগড়াকে কেন্দ্র করে। রাজনীতিকরা, ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী, লকডাউনে বোতলবন্দি হয়ে এখন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন। তাঁদের এখন ‘মুখে মারিতং জগৎ’-দশা। আর একদল ‘আপনি মোড়ল’ বাকজীবী হোমেও লাগে না, যজ্ঞেও অবান্তর, এই থালা বাজায় তো ওই  মিডিয়ার মদতে ‘নারদ নারদ’ করে চলেছে দিনরাত। করোনাভাইরাসের ত্রাস, লকডাউনে দিশেহারা লক্ষ কোটি মানুষ বিদেশ-বিভুঁয়ে রুজিহীন-রুটিহীন পশুর মতো বন্দিদশায়, মানুষের মুখের খাবার লুঠ হয়ে যায়, শিশু থেকে কর্মহীন যুবক পেটের জ্বালায় কিছু সব্জি, কিছু শাক-পাতা, কিছু ডিম নিয়ে শহরের ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে হেঁকে যায়। তাঁদের অনভ্যস্ত হাতে দাঁড়িপাল্লা কেঁপে কেঁপে ওঠে। লকডাউন দফায় দফায় বাড়তেই থাকে, লঙ্কা খামারের মুনিষশিশু লুটিয়ে পড়ে পথে। হুঁশ ফেরে না শাসকের। চাষির ফসল উঠল কি না, শ্রমিকের ঘরে চুলো জ্বলল কি না, ইতিমধ্যে কাজ হারাল কত শ্রমিক, আর কতজন কাজ হারাবে, মাইনে কাটা গেল কতশত কর্মচারীর সেদিকে নজর নেই। চিরকালই সামাজিক দূরত্ব, সামাজিক বিদ্বেষ জীবনে যাপনে বজায় রেখে চলা এই পরজীবী শ্রেণির কাছ থেকে কীই-বা আশা করা যায়! তবু, রাগের ঝোঁকে হলেও মনে পড়ে যায় — ‘ভাত দে হারামজাদা।’

 

যেদিকে তাকানো যাক না কেন একই অসহায়তার চিত্র। চা বাগান বন্ধ ছিল, খুলেছে কিন্তু বন্ধ সময়ের মজুরি মেলেনি।  চটকলেরও একই কাহিনি।  লকডাউন-কালের মজুরি অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী, নানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লকডাউনের সময়কালে বেতন দেওয়ার ‘মানবিক’ আর্জি জানিয়েছেন, তাঁরা যদিও জানেন এ নিছকই কথার কথা। বেতন না দিলে মালিকের লোমাগ্র স্পর্শ করা যাবে না। শ্রমিকরা এফআইআর করবেন, করেছেনও, তাতে মালিকের কিস্যু আসে যায় না। এই ‘মানবিক’ আবেদনের রেশ কাটতে না-কাটতেই ২২ এপ্রিল কেন্দ্র ঘোষণা করল, ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর এবং ৬১ লক্ষ পেনশনভোগীর ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে প্রাপ্য যথাক্রমে অতিরিক্ত বর্ধিত পরিমাণ মহার্ঘ্য ভাতা বা ডিএ এবং মহার্ঘ্য অনুদান বা ডিআর দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে ২০২০ সালের জুলাই থেকে প্রাপ্য পরবর্তী অতিরিক্ত বর্ধিত পরিমাণ ভাতাও ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি অবধি হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কী বার্তা গেল বেসরকারি শিল্পমালিকদের কাছে? শিল্পমহল উৎসাহিত হল বলা যায়। এই তো, ২৪ এপ্রিল খবর বেরলো, শ্রমিক সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড বা শিল্প-সংক্রান্ত সম্পর্কের আচরণবিধি, ২০১৯ বিষয়ক রিপোর্টে সুপারিশ করেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে, কারখানা না চালু হওয়া অবধি শ্রমিকদের মজুরি দেওয়াটা অসমর্থনযোগ্য হতেই পারে। কোভিড-১৯ মহামারি কি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়তে পারে? কমিটির চেয়ারম্যান বিজু জনতা দলের নেতা ভর্তুহরি মহতাবের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘তাই হওয়া উচিত।’  বন্ধকালীন তো দূরের কথা কাজ করেও মজুরি পায়নি লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। অথচ ২৯ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে বলা হয়েছিল, বেসরকারি সংস্থাগুলিকে লকডাউন পর্বে কর্মীদের পুরো বেতন দিতে হবে পাশাপাশি নির্দেশ অমান্য করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলির কয়েকটি সংগঠন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। ২৯ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশের আবেদন নাকচ করে। তবে, সরকারকে জবাব দেওয়ার জন্য দু’সপ্তাহ সময় দিয়েছে। কিন্তু, কী আইনি যুক্তি দেখিয়েছে মালিকপক্ষ? যার অন্যতম যুক্তি হল, ২০০৫ সালের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের অধীনেও কেন্দ্রীয় সরকার এমন নির্দেশ জারি করতে পারে না। কারণ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট আইনের (১৯৪৭) আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কর্মী ছাঁটাইয়ের যে অধিকার ও স্বাধীনতা সংস্থাগুলিকে দেওয়া হয়েছে এই নির্দেশ সেই অধিকার লঙ্ঘণ করে। পাশাপাশি, কর্মী কাজ না করলে তার বেতন না দেওয়ার অধিকার নিয়োগকর্তার রয়েছে। দেশের আইন, সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট, মালিকের যুক্তি সবই একসুরে বাঁধা। তাই নয় কি?

 

আরও দুটি ভয়াবহ তথ্য যা নিশ্চয় আদি চণ্ডীমণ্ডপের অধুনা চণ্ডীবক্সের সিভিল সোসাইটির মাতব্বরদের অজানা নয়। তবে, এ বিষয়ে কোনও সালিশি সভা বসেছিল কি না জানা নেই। তথ্য এই যে, কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মনিযুক্তি মন্ত্রক ২৪ মার্চ সব রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের পরামর্শ দেয় বিল্ডিং অ্যান্ড অদার কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কাস ওয়েলফেয়ার বোর্ড (বিওসিডবলিউ) যে সেস আদায় করেছে সেই অর্থ নির্মাণ শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি জমা করতে। ২৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ অবধি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জন সাহস উত্তর ও মধ্যভারতের ৩,১৯৬ জন শ্রমিকের উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখল ৯৪ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিকের কোনও বিওসিডব্লিউ কার্ড নেই। শুধু তাই নয় ১৪ শতাংশের রেশন কার্ড নেই এবং ১৭ শতাংশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও নেই। অথচ, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির ৯ শতাংশ আসে এই নির্মাণ শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে আর পরিযায়ী শ্রমিকদের এক বড় অংশই নির্মাণ শ্রমিক।

 

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, স্ট্যান্ড্রেড ওয়ার্কাস অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (এসডব্লিউএএন) -এর ১১ হাজার ১৫৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে করা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৮-১৩ এপ্রিল ওই শ্রমিকদের ৯৬ শতাংশ কোনও রেশন পাননি। ২৪ মার্চ মধ্যরাতে লকডাউন ঘোষণার পর ওই শ্রমিকদের ৮৯ শতাংশের বেশি মজুরি পাননি। ৭৪ শতাংশের হাতে মজুরির অর্ধেক পড়ে আছে। অথচ অনেককেই ২-৩ হাজার টাকা করে বাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে। সাবান, তেল, স্যানিটারি প্যাড, ওষুধ কিনতে মোবাইল রিচার্জ করতে হয়েছে।

 

সমীক্ষাকালীন ২৭ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত কমপক্ষে ৭০ শতাংশের হাতে ছিল মাত্র ২০০ টাকা। এই ১১ হাজার শ্রমিকদের মধ্যে ১৭ শতাংশ দিনমজুর এবং কারখানার বা নির্মাণ শ্রমিক, ৮ শতাংশ গৃহসহায়ক, গাড়ির চালক এবং ৮ শতাংশ ভেন্ডার, হকার ইত্যাদি। যাঁদের গড় দৈনিক আয় ৪০২ টাকা।

 

দেশ জুড়ে করা এই সমীক্ষা চিত্রটি এক ঝলকে এরকম

 

# সারা দেশে ৯৬% পরিযায়ী শ্রমিক রেশন পাননি।
প্রথম তিন রাজ্য: উত্তরপ্রদেশ ১০০%, মহারাষ্ট্র ৯৯%, কর্নাটক ৯৩%।
# তৈরি করা খাবার জোটেনি ৭০ শতাংশের
প্রথম তিন রাজ্য: উত্তরপ্রদেশ ৬৪%, কর্নাটক ৮০%, দিল্লি/হরিয়ানা ৬৬%।
# মাত্র ২ দিন কাটানো যাবে, এমন রেশন রয়েছে গোটা দেশে ৭০ শতাংশের।
প্রথম তিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ১০০%, মহারাষ্ট্র ৯০ শতাংশ, দিল্লি/হরিয়ানা ৮২ শতাংশ।
# লকডাউনের সময় হাতে রয়েছে ২০০ টাকারও কম, সারা দেশে এমন শ্রমিক হলেন ৭০%।
প্রথম তিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ৮৭ শতাংশ, হরিয়ানা ৭৬%, মহারাষ্ট্র ৭০ শতাংশ।
# সরকারের কাছ থেকে পাওয়া খাদ্যসামগ্রী পেয়েছিলেন তাতে মাত্র দু’দিন চলে এমনটা জানিয়েছেন সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত ৭০ শতাংশ।
প্রথম তিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ১০০%, মহারাষ্ট্র ৯০%, দিল্লি/হরিয়ানা ৮২%।

 

অথচ, লকডাউনের শুরু থেকে ১৭ এপ্রিল অবধি কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার লকডাউনের মধ্যে এই শ্রমিকদের বেতন ও ত্রাণের ব্যবস্থা করার জন্য ৩৫০টি নির্দেশ জারি করেছে। বোঝা যায় যা নিতান্তই কাগুজে নির্দেশ। (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড.কম, ১৭ এপ্রিল ২০২০, আনন্দবাজার.কম, ২৫ এপ্রিল, ২০২০)।

 

৮ এপ্রিল ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস জানাচ্ছে, ১৮টি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের ২৪ তারিখের নির্মাণ শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার  পরামর্শ মেনে — ১০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত — মোট ১.৮ কোটি শ্রমিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সাড়ে তিন কোটি টাকা জমা করেছে। দিল্লি শ্রমিক পিছু দিয়েছে ৫,০০০ টাকা, পঞ্জাব ও কেরালা দিয়েছে ৩,০০০ টাকা, হিমাচলপ্রদেশ ২০০০ টাকা, ওডিশা ১,৫০০ টাকা, উত্তরপ্রদেশ ১,০০০ টাকা। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মতে ৩১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এই টাকা জমা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ সালে নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা ৫.৩ কোটি। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি নির্মাণ শ্রমিক নথিভুক্ত। এবং একমাত্র নথিভুক্ত শ্রমিকরা এবং যাঁরা তাঁদের নাম নবীকরণ করেছেন তাঁরাই এই সাহায্য পাওয়ার অধিকারী। এই আর্থিক সাহায্য শ্রমিকদের প্রয়োজনের তুলনায় ‘তুচ্ছাতিতুচ্ছ’ বলে বর্ণনা করে ন্যাশনাল ক্যাম্পেন ফর কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কাস এর কোঅর্ডিনেটর সুভাষ ভাটনগর হাফপোস্টকে বলেন, রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে, তাড়িয়ে দিয়ে এখন আর্থিক ত্রাণের মানে কী? লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গেই তো তাঁদের জন্য খাবার আর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেশান্তরী হওয়ার আগেই দেওয়া উচিত ছিল আর্থিক সহায়তা। (ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ৮ এপ্রিল ২০২০, হাফপোস্ট, ২৯ এপ্রিল ২০২০।)

 

এই ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যের ভূমিকা অত্যন্ত খারাপ বলেই দাবি শ্রমিক সংগঠনগুলির। প্রথমত, গত জানুয়ারি মাসে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের অর্ধেকেরও বেশি টাকা বোর্ডের সম্মতি ছাড়াই তুলে নেওয়া হয়। ফলত, নির্মাণ শ্রমিকরা প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলেন। দ্বিতীয়ত এমন কোনও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেওয়া হল না, যা শ্রমিক-সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। প্রথম বিষয়টিতে আসি। অভিযোগ, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ওয়েলফেয়ার বোর্ডের মিটিঙে কল্যাণ তহবিল থেকে ১৭০০ কোটি টাকা ট্রেজারিতে স্থানান্তরিত করার জন্য রীতিমতো ‘জোরাজুরি’ করে সরকারপক্ষ। কিন্তু, বোর্ড বা বোর্ডের শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এর পরও ২০২০-‘২১ অর্থবর্ষের বাজেটের মুখে ১৭০০ কোটি টাকা ট্রেজারিতে স্থানান্তরিত করা হয়। অভিযোগ, বোর্ডকে অন্ধকারে রেখেই এই ‘বেআইনি ও অনৈতিক’ কাজটি করা হয়েছে। বাজেটের মুখে রাজকোষের দৈন্যতা যেন ধরা না পড়ে তার জন্যই এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। এই সময় ওই তহবিলে ছিল ২৭১৮ কোটি টাকা। ৩১ মার্চ ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে নথিভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৮ লক্ষ ৮১ হাজার ২২৫ জন। সেপ্টেম্বরে ২০১৮ সালে এ রাজ্যে নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ লক্ষে। সিটু নেতা এবং বোর্ড সদস্য দেবাঞ্জন চক্রবর্তী জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রমদপ্তরের পরিকল্পনা ছিল, রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ১ কোটি ২০ লক্ষ রেজিষ্ট্রিভুক্ত শ্রমিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এককালীন ১০০০ টাকা সরাসরি দেওয়া হবে। পরিবহন, বিড়ি, নির্মাণ শ্রমিক ছাড়াও যে সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক রাজ্য সরকারের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় রয়েছেন তাঁরাও এই সহায়তা পাবেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবের মুখ দেখল না। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১০ এপ্রিল কর্মহীন দিনমজুর ও  অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্প এবং রাজ্যের বাইরে লকডাউনে আটকে থাকা শ্রমিকদের জন্য ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্পে ঘোষণা করে। দুটি প্রকল্পেই আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ১০০০ টাকা। ‘প্রচেষ্টা’ ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত চালু থাকার কথা। ২৭ এপ্রিল অর্থদপ্তরের সচিব স্মারকী মহাপাত্র একটি নির্দেশ জারি করে প্রকল্পটি স্থগিত রাখেন। প্রকল্পের সুবিধা নিতে বিডিও, এসডিও দপ্তরে লকডাউন প্রোটোকল না মান্য করে গাদাগাদি ভিড় স্থগিত রাখার প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হলেও অন্য একাধিক কারণও ছিল। তার মধ্যে অন্যতম, বিভিন্ন উদ্যোগী ব্যক্তি ও সংগঠন এবং জেলায় জেলায় বহু কম্পিউটার সেন্টার নেট থেকে সরকারি বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে থাকা ফর্মটির অনুকরণে ফর্ম ছেপে বিলি করতে থাকে। অথচ সরকারি বিজ্ঞপ্তিতেই ফর্মপ্রাপ্তির নির্দিষ্ট স্থানের উল্লেখ ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই সেই ফর্ম গ্রাহ্য হল না। এদিকে সেন্টারগুলি কিছু বাণিজ্য করে নিল বটে, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যাও দেখা দেওয়ার উপক্রম হল। আরেকটি কারণ এসডিও বা বিডিও দপ্তর থেকে বিলি করা ফর্মের পরিমাণও ছিল চাহিদার তুলনায় ঢের কম। শ্রমিক সংগঠনগুলি মনে করছে, রাজ্য সরকারের প্রাথমিক, অর্থাৎ, ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষকে আর্থিক সাহায্যের চিন্তাভাবনাটি বাস্তবায়িত হলে ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্প চালু না করলেও হয়তো হত। অনেক সুস্থভাবে তা কার্যকর করা যেত এবং লকডাউনে নাজেহাল প্রশাসনকে এতটা নাকানিচোবানি খেতে হত না। (দেবাশিস আইচ, গ্রাউন্ডজিরো ডট ইন, ২৮ এপ্রিল ২০২০।)

 

বিভিন্ন রাজ্যের সরকারি আধিকারিক এবং ১২টি রাজ্যের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে বছরের পর বছর নির্মাণ প্রকল্পগুলির উপর ১ থেকে ২ শতাংশ সেস বসিয়ে রাজ্য সরকারগুলি ৫২ হাজার কোটি টাকার ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। শ্রমিকদের তার এক ক্ষুদ্র অংশই রাজ্য সরকারগুলি আর্থিক সাহায্য হিসেবে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। পাচ্ছেনও আরও এক ক্ষুদ্র অংশ। এই কল্যাণ তহবিলের উপযোগিতা, শ্রমিকদের প্রাপ্য-সহ নানা বিষয়ে রাজ্যে রাজ্যে কম মামলা-মোকদ্দমা হয়নি। ২০১৭ সালে তহবিল পরিচালনায় খামতির কারণে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল অবধি একদফা কড়া কথা শুনিয়ে কিছু নির্দেশ জারি করেছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল নির্মাণ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে ‘খসড়া মডেল স্কিম’ তৈরি করে ওয়েবসাইটে দেওয়ার নির্দেশ। কেননা, ক্যাগ শীর্ষ আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিল, শ্রমিকদের কল্যাণের অর্থ ল্যাপটপ, ওয়াশিংমেশিন খাতে ব্যয় হচ্ছে এবং ১০ শতাংশের কম অর্থ কল্যাণকার্যে ব্যয় করা হচ্ছে। বিল্ডিং অ্যান্ড অদার কনস্ট্রাকশন ওয়েলফেয়ার বোর্ডের শ্রমিক তহবিলের জন্য রাজ্য সরকারগুলি ১৯৯৬ সালের সেস অ্যাক্ট অনুসারে ১ থেকে ২ শতাংশ সেস আদায় করে থাকে। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সাল পর্যন্ত সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আদায় করেছিল ৪৫,৪৭৩.১ কোটি টাকা। কিন্তু, শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় হয় ১৭,৫৯১.৫৯২ কোটি টাকা। ন’টি রাজ্য তো ১০ শতাংশের কম খরচ করেছিল। ২০১৮ সালের ২১ জুলাই ওয়েবসাইটে সেই খসড়া দেখতে না পেয়ে, ক্ষুব্ধ সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল, “৩০ হাজার কোটি টাকা জড়িত আর আপনারা মজা মারছেন। কে কষ্ট পাচ্ছে? ওই গরিব লোকগুলি। আপনারা কি গরিব মানুষদের এই জাতীয় সহানুভূতি, সহমর্মিতা দেখিয়ে থাকেন?” এর পরও কি টনক নড়েছে রাজ্যগুলির? না, এই অতিমারির দিনও নয়। তা তো আমরা দেখতেই পেলাম। ২০১৬-‘১৭ সালে শ্রম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সেস তহবিল এবং তার সদ্ব্যবহার সংক্রান্ত রিপোর্টেও ছিল একই জাতীয় পর্যবেক্ষণ। কমিটি লক্ষ করে, বিগত বছরগুলিতে সেসের ব্যবহারে খামতি রয়েছে। এর কারণটি হল সেস সংগ্রহ ও কার্যকর করার কোনও নিশ্ছিদ্র  ব্যবস্থা নেই। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ৩১ মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত ৩৬,৬৩২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে ৭,৫১৬ কোটি টাকা। কমিটির সিদ্ধান্ত, যেহেতু নির্মাণ শ্রমিকরা সেস আইনের বলে উপকৃত হননি, সেক্ষেত্রে বলা যায় এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছে। কমিটির রিপোর্টে ৩১ মার্চ ২০১৭ তারিখ অবধি সব রাজ্যেরই সেস সংগ্রহ ও ব্যয়ের হিসেব দেওয়া হয়েছে। এ রাজ্যের হিসেবটি ছিল এরকম: মোট রেজিস্ট্রিভুক্ত শ্রমিক – ২,৮৮১,২২৫। মোট সেস আদায় – ১১৪৯.১২ কোটি টাকা। মোট ব্যয় – ৫৩১.৪২ কোটি টাকা। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইয়ুথ ফর ইউনিটি অ্যান্ড ভলান্টারি অ্যাকশন বা ‘যুবা’ প্রকাশিত পার্লামেন্টারি ওয়াচ রিপোর্টে ২০১৮ সালে প্রকাশিত নীচের গ্রাফ দুটি থেকে দেশের পরিস্থিতিটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

 

গ্রাফ-১

গ্রাফ-২

Source: Unstarred Question No. 272, Rajya Sabha, 12 December 2018.

২০১৯-এ ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের সমীক্ষা জানিয়েছিল, দেশে বেকারত্বের হার ৬.১ শতাংশ, যা গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। লোকসভা নির্বাচনের মুখে এই রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে কেন্দ্র কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাঁস হয়ে যায়৷ করোনাকালে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমিক রিপোর্ট জানিয়েছে, মধ্য এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়িয়ে হয়েছে ২৬.১ শতাংশ। এই সময়ে সরাসরি কাজ হারিয়েছেন ৭ কোটি। আরও ৮ কোটি কাজ খুঁজে চলেছেন। কর্মহীনতার সরকারি চিত্রটি আপাতত এই রকম।

 

অন্যদিকে, মরিয়া কেন্দ্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’দুটি নির্দেশ জারি করেছে। ২৯ এপ্রিল প্রথম নির্দেশে বলা হয়, আটকে থাকা শ্রমিকরা এখন নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে পারবে। এক রকমভাবে ফেরানোর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় রাজ্যগুলির উপর। শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে রেলমন্ত্রক। ১ মে, নয়া নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দেওয়া হল লকডাউন দু’সপ্তাহের জন্য বাড়ানো হল। এক্ষেত্রেও রাজ্যগুলোর সঙ্গে কোনও পরামর্শের প্রয়োজন মনে করা হল না। দিল্লি যে ভারত নয় এবং এই দেশে যে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা রয়েছে, ডিজাস্টার  ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টের নামে তা বেমালুম অগ্রাহ্য করে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ভারসাম্যহীন, একপেশে, বৈষম্যমূলক, পরিকল্পনাহীন লকডাউন সম্পর্কে প্রথম থেকেই সতর্ক করেছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, মেধাজীবী, চিকিৎসকরা। সে কথা শোনা, আলোচনা করা দূরে থাক, একটি নীতিহীন, চূড়ান্ত আধিপত্যকামী প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুরো সময়টি ধরে একের পর এক নির্দেশ জারি করে গেলেন এমনভাবে যে রাজ্যগুলি তাঁদের হুকুমের দাস।একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পরিকল্পনামাফিক এনপিআর-সিএএ-এনআরসি বিরোধী ছাত্র ও যুব নেতাদের ইউএপিএ ধারায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার করা শুরু হল। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের এই অভূতপূর্ব গভীর সমস্যার মর্মে পৌঁছনোর চেষ্টা দূরে থাক, একের পর এক টেলভিশন ও রেডিও ভাষণে তা প্রতীকায়িত করে গেলেন। দেশের অগণিত শ্রমজীবী মানুষ দেখলেন এই চরম দুর্দিনে দেশের  প্রধানমন্ত্রী কোনও রক্তমাংসের মানুষ নন, সহানুভূতিহীন, দম দেওয়া কাঠের পুতুল মাত্র। অপশাসনের এক নিষ্ঠুর প্রতীক-চিহ্ন।

 

লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী

 

Share this
Recent Comments
4
  • comments
    By: Amlan Roy Chowdhuri on May 2, 2020

    This article is superbly drafted and strong visualisation . I am interested to be part of this news agency and would like to put articles on various issues ( in Bengali) as per your directives . Please provide me the platform so that I can also contribute. please cofimr on my mail.

  • comments
    By: Ratish Deb on May 3, 2020

    প্রাসঙ্গিক!
    দৈনিক দশ ঘণ্টা শ্রম বিষয়ক যে আইন গুজরাতে কার্যকরী হতে যাচ্ছে, সেটা আলোচনায় রাখা যেত। অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া গেল। ধন্যবাদ ।

  • comments
    By: AMIT GHOSH on May 3, 2020

    খুবই মূল্যবান তথ্য।ব্যবস্থায় পচন ধরে গেছে।আইন যা আছে, তা সবই কাগুজে। প্রণয়ন না হলে, বিধানের কোন জায়গা নেই।

  • comments
    By: Narayan Banerjee on May 3, 2020

    Superbly written piece Not in the agenda of Subservient media

Leave a Comment