করোনাকাণ্ড, পুঁজিতন্ত্রের সঙ্কট – অতঃপর


  • April 24, 2020
  • (1 Comments)
  • 1951 Views

করোনাভাইরাস, তজ্জনিত লকডাউন এবং সরকারের তরফে কোনোরকম মানবকল্যাণ মূলক ভূমিকা পালন করবার প্রতি ঘোরতর অনীহা যেমন একদিকে দেশের শ্রমজীবী মানুষকে তিলে-তিলে দাসত্ব ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে এই অতিমারী পুঁজিতন্ত্রের সঙ্কটকে বেআব্রু করে তুলছে। এই সময় বাজার কোনদিকে যেতে পারে? কোনদিকেই বা যেতে পারে বামপন্থী আন্দোলন? এই নতুন অবস্থাটাকে বুঝতে ও ব্যবহার করতে বামপন্থীরা যদি ব্যর্থ হন, ফ্যাসিবাদছায়া স্পষ্টতর হয়ে উঠবে। লিখলেন, সৌমিত্র ঘোষ 

 

লকডাউন চলছে

আপাতত, লকডাউন কবে উঠবে বলা যাচ্ছে না। লকডাউন উঠলেও যে ঠিক কী হবে জানা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-র প্রধান জানিয়ে দিয়েছেন, ভাইরাস নিয়ে ঘর করাটা অভ্যেস করে ফেলতে হবে। ফলে, অবস্থাটা দ্রুত বদলাবে, এ আশা নেই বললেই চলে। কোভিড ১৯-এর টিকা যতক্ষণ না বেরুচ্ছে, অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত তা বাজারজাত ও সহজলভ্য হচ্ছে, অবস্থাবদল ঘটবে না, একরকম নিশ্চিত। এখন, এতে আমাদের আতঙ্কিত হবার বিশেষ কারণ ছিলো না – কবেই তো কবি বলিয়াছেন, মন্বন্তরে মরি না আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি। লোকে জন্মায়, বাঁচে, মরে, এ আর এমন কি? তাছাড়া, নিয়তির মার বলে একটা কথা তো আছেই। বিধির বিধান কে খণ্ডাতে পারে? সুতরাং, এ সব নিয়ে ভেবে কী হবে? আজকের দিনটাকে তো পার করি, কাল পরশু কি হবে সে তখন দেখা যাবে। মুশকিল হচ্ছে, আজকের দিনটাও যে পার হয় না।

 

যাঁরা এই লেখা ভুলবশত পড়বেন, তাঁদের, অর্থাৎ শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, সমাজসচেতন, মূলত বামপন্থী, বাঙালিকুলের কথা বলছি না। তাঁরা যাঁদের কথা সকালসন্ধ্যা ভাবেন, ভেবে আকুল হন, সেই মেহনতি সাবঅল্টার্ন দিন-আনি-দিন-খাই মজুরচাষী, তাঁদের অবস্থাটা ঠিক কী দাঁড়াচ্ছে? করোনা পরিস্থিতিতে কিছু সরকারি সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে, কিছু খাদ্যসামগ্রী, সামান্য অর্থ, এইরকম। কিন্তু সে সাহায্য দেশের সর্বত্র সব মানুষের কাছে একভাবে পৌঁছচ্ছে না। এই লেখক যে অঞ্চলের বাসিন্দা, বনপাহাড়, চা-বাগান, বিস্তীর্ণ নদীচরে ভর্তি সে নয়নাভিরাম হিমালয়সংলগ্ন বাংলায়, খাবারের অভাব ঘটতে শুরু করেছে। রেশনে যা পাওয়া যাচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। রেশন সবাই পাচ্ছেনও না। রাজ্য সরকার বলছেন, কার্ড না থাকলেও রেশন পাওয়া যাবে। কার্যত তা ঘটছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো চাল গম, যা কিনা হামেহাল ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া বা এফসিআই-এর জিম্মায় ঠাসগুদাম মজুদ থাকে (যা চালগম আছে, নিদেন ৯ মাস দেশশুদ্ধ লোককে বসিয়ে খাওয়ানো যায়, শ্রী রামবিলাস পাসোয়ান উবাচ), সরকারি কার্ড না থাকলে তা পাবার জো নেই। উপরন্তু রাজ্য সরকার বলছেন, এফসিআই ঠিকঠাক মাল দিচ্ছে না, লোকে খায় সেদ্ধ চাল, দেওয়া হচ্ছে আতপ, তাও যতটা দেবার কথা ততটা নয়। রাজ্য সরকার এও বলছেন, তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত চাল মজুদ, দরকারমতো লোকের কাছে পৌঁছে যাবে, এফসিআই দিক না দিক থোড়াই পরোয়া। তাহলে গণ্ডগোলটা কোথায়? লোকে উপযুক্ত মাত্রায় পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না কেন? শুধু এ রাজ্যে নয়, দেশের অন্যত্র থেকেও খাদ্যাভাবের খবর আসছে। শহরের গরীব, গ্রামের ভূমিহীন/প্রান্তিক চাষী, গ্রামীণ শ্রমজীবী, সমুদ্রপারের মৎস্যজীবী, বনে থাকা আদিবাসী বনবাসী, কেউ নিরাপদ নন। কেন নন? কেন খাবারের অভাব ঘটছে? বিষয়টা তলিয়ে বোঝা দরকার।

 

Courtesy : Down to Earth

 

রাষ্ট্র কী করে?

বলছি বটে তলিয়ে বোঝার কথা, কিন্তু বুঝবার বিশেষ কিছু নেই। অর্থাৎ না বোঝার বিশেষ কিছু নেই। দেশের লোকের নিরাপত্তার দায়িত্ব কার? খাদ্যসঙ্কট নিরসনে মূল ভূমিকা কার? লোকে না খেতে পেয়ে, বন্যা ঘূর্ণিঝড় ভূমিকম্পে, করোনায় এবং আরো দশ রকমের রোগব্যাধিতে ভুগে খামোখা মারা যাবেন, তা ঠেকানোর কথা কার? সবাই জানেন, সরকার বাহাদুরের মানে রাষ্ট্রের। বিশেষ করে যদি রাষ্ট্রটি স্বাধীন সার্বভৌম হয়। করোনার বাজারে পুরোনো মহামারী ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির কথা আসছে। একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে ভুগে এক থেকে দেড়কোটি লোক মারা গিয়েছিলেন, এমন ভাবা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বানানো মন্বন্তরে মারা গিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। ঔপনিবেশিক সরকার আঙুল নাড়ায়নি, উল্টে সরকারি নীতির ফলে লোক বেঘোরে মরেছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক স্বাধীনতার অনেক মানের মধ্যে অন্যতম – এরকম হবে না। সরকার দায়িত্ব নেবে। স্বাধীন দেশ বা রাষ্ট্র দেশের নাগরিকদের প্রতি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে। কেউ না খেতে পেয়ে অপুষ্টিতে ভুগে মরবেন না। কেউ বিনা চিকিৎসায় মরবেন না। কেউ তাঁর পরিচয়ের কারণে (ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ) সামাজিক বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হবেন না। রাষ্ট্রীয় অ-বিচারের শিকার হবেন না কেউ। স্বাধীন দেশে এইরকম হয়, হবার কথা।

 

স্বাধীন রাষ্ট্র কী করে?

এইখানে খটকা লাগতে শুরু করে। খটকা বা খটকাসমূহ নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে বিস্তর কথা এবিষয়ে বলা হয়েছে। সেই সব ইতিহাসের কথা আর কারুর না হোক, বামপন্থীদের জানা উচিত। ধরুন, রুশ বিপ্লবের পর, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিনটার্নে মানবেন্দ্র নাথ রায় (এম এন রায় নামে সমধিক পরিচিত) তাঁর বিখ্যাত পাল্টা ঔপনিবেশিক তত্ত্ব বা কলোনিয়াল থিসিস জমা দিলেন। লেনিনের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর তীব্র মতান্তর ঘটে, এবং যেহেতু পরবর্তীতে এম এন রায় কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্রব ত্যাগ করেন, সে দলিল এবং তাঁর নানান লেখাপত্র ভারতীয় বামপন্থীদের কাছে ত্যাজ্য, বিশেষ কেউ পড়েটড়ে দেখেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এম এন রায় (নরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য) মশাইয়ের প্রাথমিক রাজনীতি শিক্ষা ঘোরতর জাতীয়তাবাদীদের কাছে, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুশীলন পার্টির সক্রিয় সদস্য, বাঘাযতীনের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব-প্রচেষ্টার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এত সত্ত্বেও তাঁর মোদ্দা বক্তব্য ছিলো, ভারতীয় বিপ্লবকে হয়ে উঠতে হবে একইসঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় পুঁজিতন্ত্রের বিরোধী। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিষয়টি হয় আদ্যন্ত আবেগনির্ভর এক নির্মাণ, যা নিয়ে দেশীয় পেটি বুর্জোয়ারা মথিত, অথবা তা বড়-বড় দেশীয় বুর্জোয়াদের স্বাধীনতা-আকাঙ্খা তাড়িত, যে মুহূর্তে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে, তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে শ্রমজীবী প্রলেটারিয়েটের ওপর, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার দোহাই তুলে।

 

রায় আরো বলেছিলেন, ধর্মীয় উন্মাদনায় ডুবে আছে দেশের মানুষ। লেনিনের মূল থিসিসের বক্তব্য ছিলো ভারতবর্ষের মতো উপনিবেশে পুঁজিতন্ত্র যেহেতু শিকড় গাড়েনি, সেখানকার শ্রমিক শ্রেণী নিজের ক্ষমতায় ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী লড়াই লড়তে  পারবে না, দেশীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে নিয়ে যৌথ গণতান্ত্রিক লড়াই গড়ে তুলতে হবে। ভারতের ক্ষেত্রে সম্ভবত লেনিন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও গান্ধীর কথা বলতে চাইছিলেন। রায়ের বক্তব্য নিয়ে বিশদ চর্চার সুযোগ এ লেখায় নেই, বারান্তরে এ নিয়ে কথা বলা যাবে। উপনিবেশে বিপ্লব নিয়ে রায়-লেনিন তর্কের বিষয়টা বহু-আলোচিত, তা সত্ত্বেও এখানে এ প্রসঙ্গ টেনে আনার দুটি কারণ। এক, মৌলিক সামাজিক-রাজনৈতিক বদল যদি না ঘটে তাহলে স্বাধীনতার পুরো ধারণাটাই ফাঁপা হয়ে যায় এবং শুধু রাষ্ট্রকাঠামোর মালিকানা বদলে সে মৌলিক বদল সাধিত হয় না – এ কথাটা ভারতীয় বামপন্থার প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব তৈরির আগেই এম. এন. রায় দ্বারা সজোরে উচ্চারিত। দুই, ধর্মীয় উন্মাদনা ও আবেগনির্ভর জাতীয়তাবাদের সঙ্গে পুঁজিতন্ত্রের সংশ্লেষ ও সহাবস্থান, এই অবস্থাটা একশো বছরেও বদলায় নি। তরুণ রায় যখন কমিনটার্নে গিয়ে লেনিনের সঙ্গে তর্ক করছেন, ফ্যাসিবাদ বিষয়টা ভবিষ্যতের গর্ভে। তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিলো না, যে দ্রুত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মায়া ছিঁড়েখুঁড়ে রাষ্ট্রের দখল নেবে ফ্যাসিবাদ, পরিচয়ের রাজনীতির উন্মাদনায় আবেগনির্ভর জাতীয়তাবাদের মিশেল দিয়ে, পুঁজির/পুঁজিতন্ত্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ও সংযোগে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বাস্তব হয়ে উঠবে। পুঁজিতন্ত্রের সময়েই শুধু নয়, লিখিত মানব ইতিহাসের আদি পর্ব থেকেই রাষ্ট্র বস্তুত, মূলত শাসকের, শাসনের ব্যবস্থা।

 

মাথা ও পা

যে সব আদি প্রজাতন্ত্রের কথা আমরা জানি, তাদের প্রত্যেকটিতে  সমাজবহির্ভূত দাসগোষ্ঠী বর্তমান ছিলো, স্থানকালনির্বিশেষে মহিলারা সাধারণত রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরেই থাকতেন। যে ইংরেজদের কাছ থেকে আমাদের রাষ্ট্রবীক্ষা শেখা, যাদের হাত ধরে আমাদের আধুনিক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র নির্মাণ, ষোড়শ এমনকি সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের উচ্চকোটির শিক্ষিত সমাজে সাধারণ ধারণা ছিলো, রাজা, অভিজাতকুল ও ধর্মযাজকেরা হচ্ছেন সমাজের মাথা, ভূসম্পত্তির অধিকারী কৃষকেরা ও শহুরে ব্যাবসায়ী ও পেশাজীবীরা বুকপেট, এবং বাকি সব, যাদের খেটে খেতে হয়, তাঁরা পা। রাজার, অর্থাৎ মাথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার পায়ের থাকতে পারে না, এটাই সর্বজনগ্রাহ্য নিয়ম। সময় বদলেছে, কিন্তু মাথা-পা, রাজা-প্রজা ও রাষ্ট্র-রাষ্ট্রবিরোধীর বুনিয়াদি ক্ষমতাসম্পর্কের বদল ঘটে নি। অর্থাৎ, যা-ই ঘটুক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় হয়ে যাক, নিয়মের ব্যত্যয় হবে না, মাথা মাথায় থাকবে, পা পায়ে। এমন বিপদ যদি আসে যখন মাথা বুকপেট পা একসঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছে, মাথা ঠিক করবে পা বাঁচবে কি বাঁচবে না, খাবে কি খাবে না। অথবা, কোয়ারান্টিনে থাকবে কি না, লকডাউনে ঘরে বসে কতদিন থাকবে, এমনকি নিজের বাড়িতে, নিজের পরিবারের কাছে যাবে কি না। রাষ্ট্র অর্থাৎ মাথা সর্বশক্তিমান, মহাপরাক্রমশালী, সে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা শুধু নয়, সামাজিক শৃঙ্খলার রক্ষাকারী, তার আদেশ অমান্য করে পা যে এদিক ওদিক ছুটবে সেটি হবে না।

 

পা আর মাথা, মাথা আর পা-য়ের গল্পটা সরল। না বুঝবার কিছু নেই। তবু কেন যে কিছু লোক বুঝতে চান না! কেন যে তাঁরা ভাবেন যে মাথা যখন, পায়ের খেয়াল রাখতে সে বাধ্য, নিজের পায়ে কোন মাথা জেনেশুনে কুড়ুল মারে? বিশেষ যখন আমরা বাস করি সাংবিধানিক গণতন্ত্রে, যেখানে পা যা মাথাও তাই, যেমন ধরুন গে ভারতবর্ষে একজন সাধারণ চা-ওলা প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, ব্রাজিলের এক বস্তি থেকে উঠে আসা আর এক দুর্দমনীয় রংবাজ সে দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন অনায়াসে। তা ছাড়া সময়টা বদলে গেছে, সবাই মিলে ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করে, মাথা-পায়ের তুলনাটা এখন সেকেলে। আসলে কিন্তু দেশকাল নির্বিশেষে মাথার দাপটে পায়ের দল ত্রাহি ত্রাহি রব তুলছে। তবু বিশ্বাসীর দল অনড়। কারণ মাথার মাথাত্বে ভরসা হারালে ঘোর নৈরাজ্য আসতে বাধ্য।

 

অথচ দেখুন, ভারতের মোদি-শা, ব্রাজিলের বলসোনারো, হাঙ্গেরির অরবান, তুরস্কের এরদোগান, ইসরায়েলের নেতায়ানহু, ব্রিটেনের বরিস জনসন এবং সর্বোপরি আমেরিকার ট্রাম্পসাহেবকে। সাংবিধানিক গণতন্ত্র এবং বিশুদ্ধ গাছগাম্বা‌ট বজ্জাতি ও সদর্প ফ্যাসিবাদ, এদের মধ্যে যে বিভাজনরেখা, সেটা যে বস্তুত বায়বীয়, যে কোনো দিন উবে যেতে পারে, যায়, হামেশা গিয়েছে – এইটা গণতন্ত্রবিশ্বাসীরা ভুলে যান। ঘটনা উল্টোবাগে গড়াচ্ছে, সবাই যারপরনাই শংকিত, তবু ভেবে যাচ্ছেন, আহা, মাথা তো, একটু বায়ু চড়েছে, খানিক বাইপোলার ঝামেলা, ওষুধ দিলে, যত্নআত্তি করলে সেরে যাবে।

 

Courtesy : Newslaundry

 

মাথা নয় পা

মাথা অর্থাৎ আধুনিক সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার প্রজাদের কেমন যত্নআত্তি করে থাকে, এমনিতে আমরা সবাই জানি। অষ্টাদশ শতকের শেষ, উনিশ শতকের পুরোটা, বিশ শতকের মাঝামাঝি অবধি বিশ্বজুড়ে পুঁজিতন্ত্রের জাল ছড়াচ্ছে, আধুনিক রাষ্ট্রের অবয়বও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই রাষ্ট্রের কাজ কী? এক, পুঁজি যাতে অবাধে বাড়তে পারে, যে কোনো সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা যাতে সুরক্ষিত থাকে, তার সুব্যবস্থাদি করা। দুই, এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে বা যারা আঙুল তোলে, তাদের কচাকচ দমন করা। তিন, সুবিধাসুযোগ হলে, গরীবদুঃখীদের ত্রাণ পৌঁছনো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি, মার্ক্স যে সময় তাঁর পুঁজির মহাকাব্য রচনায় ব্যাপৃত, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মক্কা-মদিনা-কাশী-বিশ্বনাথ-জেরুজালেম ইংল্যান্ডে শ্রমজীবী আমমানুষের জীবন কীভাবে কাটতো, চার্লস ডিকেন্সে‌র লেখার সঙ্গে পরিচিত মাত্রেই তা জানেন।

 

সর্বব্যাপী শাসন-শোষণ-দমন-নিপীড়নের এই চেনা ছবি খানিক বদলাতে শুরু করলো মোটামুটি দুটি কারণে। এক, ১৭৮৯-র ফরাসী বিপ্লব এবং তৎপরবর্তী গোটা উনিশ ও বিশ শতক জুড়ে অসংখ্য ছোট বড় অভ্যুত্থান ও বিপ্লবপ্রচেষ্টায় শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণ, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠা। পা আর মাথার অধীন থাকতে চাইছিলো না, উল্টে সে মাথায় চড়তে চাইছিলো। এর সঙ্গে যুক্ত হলো, পুঁজির তথাকথিত অবাধ বিচরণ ও রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে লাগাতার যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সঙ্কট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ১৯৩০ নাগাদ বিশ্বব্যাপী যে মহামন্দা দেখা দিলো, পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা তাতে ভেঙে পড়বার উপক্রম হলো। তার পরপরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পত্তন। ইউরোপের কিছু দেশে রুশ সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে সরাসরি ‘সমাজতন্ত্র’ চালু হলো, এশিয়া আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুরু হলো ঔপনিবেশিকতা বিরোধী লড়াই। বহু ক্ষেত্রে তা মিশে গেলো বা রূপান্তরিত হলো সমাজবদলের বিপ্লবী লড়াইয়ে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন বা রেজিস্ট্যান্স-এ কমিউনিস্ট ও অন্য বামপন্থীদের মুখ্য ভূমিকার প্রভাবে পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশে কমিউনিস্ট দল ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলি শক্তি বাড়িয়ে ফেললো বহুগুণ। এই সার্বিক অবস্থাটা – অর্থাৎ একদিকে মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে বামপন্থী আন্দোলনের, বিশেষত কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি – যেমন রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করলো, তেমনই বদলালো পুঁজিতন্ত্রকেও। না বদলালে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিতন্ত্র টিঁকে থাকতে পারতো কিনা সন্দেহ। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের যে ধাঁচার মধ্যে আমরা এখন আছি, তাও এভাবে সাধারণগ্রাহ্য হয়ে উঠতো না।

 

শয়তানি কল

১৯৪৪ সাল নাগাদ সমাজতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তা কার্ল পোল্যানয়ি বলছেন, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা আসলে একটা দানবীয় শয়তানি কল, স্যাটানিক মিল, লোভ এবং ক্ষমতার চূড়ান্ত পৈশাচিক প্রকাশ।[1] ব্যবস্থাটা যে শুধু যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধকে নষ্ট করছে তাইই নয়, ধ্বংস করছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকেও।  পোল্যানয়ির বক্তব্য ছিলো, এরকম চলতে পারে না। কোথাও থামতেই হবে, থেমে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে, যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে কি না। নাহলে মানবসভ্যতার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।

 

পোল্যানয়ির শয়তানি কল তত্ত্ব পরবর্তীতে – বিশেষত যখন থেকে পৃথিবী তছনছ করে নিওলিবরল লুটপাট শুরু হলো – বহুচর্চিত। বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু বদল ও সাধারণভাবে সামগ্রিক পরিবেশ সঙ্কট নিয়ে আলোচনায় বারবার পোল্যানয়ির কথা আসে। শয়তানি কল তো ঘুরছেই, থামবে কখন? কীভাবে? না থামলে আমরা বাঁচবো কী করে?

 

তলিয়ে দেখলে মনে হতে বাধ্য, পোল্যানয়ির তত্ত্বের মধ্যেই এক মূলগত সমস্যা প্রথমাবধি মজুদ ছিলো। পোল্যানয়ি ধরে নিয়েছিলেন, যেহেতু শয়তানি কল না থামলে মানবসভ্যতার বিলয় অনিবার্য, তা থামতে বাধ্য। পোল্যানয়ির এই ভাবনা পশ্চিমী জ্ঞানতত্ত্বের কার্তেজিয় ধাঁচার অনুবর্তী, বা হেগেলীয় ন্যায়তত্বের। উভয়ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয়েছিলো, যে ব্যবস্থা বাস্তব, তার ভিতরে সহজাত ন্যায়পরায়নতা এবং যুক্তির এক সহ-অবস্থিত বিন্যাস থাকবে। সভ্যতার ধ্বংস কে চায়, চাইতে পারে? চাইলে তাকে সভ্যতা বলা যায় কী করে? অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হলো, মাথা নিজেকে বাঁচাবে, এবং নিজে বেঁচে পা-কেও বাঁচাবে।

 

Courtesy : Deccan Herald

 

ওয়েলফেয়ারের মায়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে কল্যাণমুখী অর্থনীতি বা ওয়েলফেয়ার ইকোনমির গোড়াপত্তন হয়, তা দেখে মনে হতে পারে, ঠিকই তো, সভ্যতা নিজেকে বাঁচাবে। নাজি-দের বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধ, যুদ্ধের পরে ওয়েলফেয়ার ইকোনমির রমরমা, এসবের মধ্যে এক ধরনের একটা সহজবোধ্য যুক্তিক্রম ছিলো। শ্রমিক সংগঠনগুলো শক্তিশালী, রাষ্ট্র তাদের সঙ্গে রফা করে মজুরি বাড়িয়ে দিলো বহুগুণ। পুঁজিমালিকের অধিকার খর্ব করে, ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্র শ্রমিকের অধিকার বাড়ালো রীতিমতো আইন করে, যে মালিক ইচ্ছামতো কাজের সময় কমাতে বাড়াতে পারবে না, ছাঁটাই লক আউট করতে পারবে না। শুধু শ্রমজীবী নন, সমস্ত নাগরিকের সামাজিক সুরক্ষার, অর্থাৎ বাসস্থানের, স্বাস্থ্যের, শিক্ষার, রোজগারের দায়িত্ব নিলো রাষ্ট্র। পুঁজি কোথায় কীভাবে লগ্নি হবে, ব্যাংক কীভাবে কাকে ঋণ দেবে, শেয়ারবাজার কীভাবে চলবে, কোন ব্যবসা কোথায় কীভাবে চলবে, এসবের মধ্যে অর্থাৎ পুঁজির স্বাধীন ও এতাবৎকালের অবাধ চলনের মধ্যে রাষ্ট্র ঢুকে এলো। আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে সমতুল্য ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি শুরু হয়েছিলো মহামন্দার পরপরই, রুজভেল্টে‌র নয়া ব্যবস্থা বা নিউ ডিলের মাধ্যমে। মোদ্দা, শিল্পোন্নত পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রায় গোটাটাই ওয়েলফেয়ারের যৌক্তিক ও ন্যায়পরায়ন ব্যবস্থার মধ্যে চলে এলো। সদ্য স্বাধীন অন্য দেশেও, যেমন ভারতবর্ষে, ধীরে ধীরে রাষ্ট্রনির্ভর কল্যাণমুখী পুঁজিতন্ত্রের এক মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠলো।

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশের এই ঘোর দুঃসময়ে, খামোখা এসব চর্চায় কালক্ষেপ করে কি দশটা হাত গজাবে? ধান ভানতে শিবের গাজনই বা কেন, অর্থাৎ কিনা করোনা অতিমারী এবং তজ্জনিত খাদ্যসঙ্কট ও রেশনব্যবস্থার দুর্নীতি/সুনীতি অথবা বিজেপি তৃণমূল কেন্দ্র রাজ্য এসব ছেড়ে আমরা ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির মরা কিস্যায় মন দিচ্ছি কেন? দিচ্ছি একারণে, যে করোনা বলুন আর রেশন বলুন, কিছুই পুঁজিতন্ত্রের বাইরে নয়। করোনা-বিপর্যস্ত ধনী ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকান। আমেরিকা থেকে ফ্রান্স-জার্মানি হয়ে ইংল্যান্ড অবধি একের পর এক দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, দেড় থেকে দু মাস প্রায় সমস্ত উৎপাদন বন্ধ, বেকারির হার আকাশ ছুঁচ্ছে। সংখ্যাটংখ্যার মধ্যে ঢুকছি না, শুধু একটা তথ্য থেকে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরশু, অর্থাৎ ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত, আমেরিকার নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা নিদেনপক্ষে ২৬.৪ মিলিয়ন, মানে ২.৬ কোটিরও বেশি। সরকার এদের এককালীন ১২০০ ডলার করে দেবে, এইরকম কথা আছে। এই হিসেবটা গত পাঁচ সপ্তাহের। আমেরিকার সরকার ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলোকে লকডাউন চলাকালীন শ্রমিকদের বকেয়া ও চালু মজুরি বাবদ যে অর্থসাহায্য করছে, সেটা বন্ধ হলে সংখ্যাটা বহুগুন বেড়ে যাবে। ব্রিটেনে বরিস জনসনের টোরি সরকার শ্রমিকদের মজুরি বাবদ প্রতি মাসে ২৫০০ পাউন্ড স্টার্লিং অবধি বরাদ্দ করেছে। জনস্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় আমেরিকা ইউরোপে গত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে নিয়ম করে কমছিলো, করোনার ধাক্কায় তা আবার উর্ধমুখী। এর মধ্যে, বিশ্ব অর্থ সংস্থা মানে আই এম এফ বলেই দিয়েছে ১৯৩০-র মহামন্দার পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতি সবচাইতে বড় সঙ্কটের মুখোমুখি, সম্ভবত করোনামন্দা তিরিশের মন্দাকেও ছাপিয়ে যাবে।

 

তিরিশের মন্দা ঠেকাতে ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির (যাকে কিনসিয় অর্থনীতিও বলা হয়ে থাকে) প্রবর্তন হয়েছিলো। এবারও কি তাইই হতে চলেছে? গত তিন দশক ধরে বাজার অর্থনীতি ও মুক্ত বাণিজ্যের নামে ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির ইঁটকাঠকড়িবরগা খসানো হয়েছে, পুঁজির অবাধ চলন নিয়ন্ত্রণে যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, তা ক্রমহ্রাসমান। দ্বিতীয়ত, করোনা সঙ্কটের পূর্বমুহূর্ত অবধি বিশ্বের প্রায় সর্বত্র সামাজিক সুরক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় ব্যতিক্রমহীনভাবে কমেছে। এই গোটা প্রক্রিয়াটাকে আবার উল্টোদিকে ঘোরানো সম্ভব? তৃতীয়ত, এবং যেটা আজকে বিশেষভাবে বোঝা দরকার, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা যে রাষ্ট্রকে মধ্যিখানে রেখে কল্যাণমুখী হয়ে উঠছিলো, তার একটা প্রধান কারণ, শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি, বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্য বামপন্থীদের উত্থান। সে অবস্থাটা দৃশ্যত এখন নেই। শ্রমিক আন্দোলন বিপর্যস্ত, বড় সংগঠিত ইউনিয়নগুলো প্রায় সর্বত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণে অক্ষম, অন্যরা, অর্থাৎ কম মজুরিতে কাজ করা বা তথাকথিত স্বনিযুক্ত শ্রমজীবীরা, কৃষিশ্রমিকেরা এবং আর্ন্তদেশীয় ও অর্ন্তদেশীয় পরিযায়ী শ্রমিকেরা – এঁরা মুখ্যত অসংগঠিত। ফলে শ্রমিক আন্দোলনের চাপে নিওলিবরেল অর্থনীতি রাষ্ট্রনির্ভর ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি হয়ে যাবে, এ সম্ভাবনা কম।

 

Courtesy: Newsclick

 

পুঁজিতন্ত্রের অ-যুক্তি

বাকি থাকে যুক্তির ও ন্যায়ের কথা। করোনায় পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে, ব্যবস্থাগত সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, ঠিক। কিন্তু ব্যবস্থাটা তো সঙ্কটের মধ্যে ছিলোই। বিশ্বব্যাপী খোলা বাজার/অবাধ মুক্ত বাণিজ্যের দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো ক্রমশ ফ্যাসিবাদ অভিমুখী ডানপন্থী পরিচয়ের রাজনীতির দিকে ঝুঁকছিলো, যেমন ভারতে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি, আমেরিকায় ট্রাম্পের আসা, ইতালিতে মালভিনির উত্থান, ব্রিটেনে ব্রেকজিটের দাবীতে বরিস জনসনের ভোটে জেতা। তদুপরি, জলবায়ু বদলের চূড়ান্ত, দূরপেনয় সঙ্কট, যা শুধু পুঁজিতন্ত্রকে নয়, সমগ্র মানবসভ্যতাকে, এমনকি পৃথিবীর সমগ্র প্রাণব্যবস্থাকে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়, দিতে থাকে। পুঁজিতন্ত্র কিভাবে চলবে, রাষ্ট্র কী আচরণ করবে, তার সাথে যুক্তি বা ন্যায়ের কোনো সম্পর্ক নেই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হোক, করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সঙ্কটের অভিঘাতে হোক, জাতিরাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী আক্রমণে হোক, কি বন্যায় দাবানলে ঘূর্ণিঝড়ে দুর্ভিক্ষে এখানে ওখানে দু-দশ লাখ লোক মরলেও তাতে ব্যবস্থাটা আরো যৌক্তিক বা ন্যায়পরায়ন হয়ে উঠবে না।

 

ভারতবর্ষে ফিরি। রাষ্ট্রের মাথায় যাঁরা বসে আছেন, দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো ও রামমন্দির নির্মাণ ছাড়া তাঁদের অন্য কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। অর্থনৈতিক ভাবনা তো নেইই। নোটবন্দী আর তড়িঘড়ি জিএসটি চালু করা ছাড়া গত ছ বছরে এনডিএ সরকার এমন কিচ্ছু করেনি যা থেকে বোঝা যেতে পারে তাদের কোন অর্থনৈতিক নীতিটিতি আছে। ফলত তাঁরা পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা, কৃষকদের দারিদ্র্য, ক্রমবর্ধমান বেকারি ও মূল্যবৃদ্ধি, মন্দা এসব নিয়ে ভাবতে যাবেন বলে মনে হয় না। আসলে, ভাবার ক্ষমতা, প্রয়োজন বা ইচ্ছা কোনোটাই তাঁদের নেই, তাছাড়া, না থেকেও দিব্যি চলে যাচ্ছে।

 

বাজার কি বাঁচবে? পুঁজিতন্ত্র ও আজকের জাতিরাষ্ট্র

সুতরাং, রাষ্ট্রকে দেখে, রাষ্ট্রনায়কদের আচরণ কথাবার্তা দেখে (বিশেষত ফ্যাসিবাদ অভিমুখী ডানপন্থী নেতাদের) পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্য-অসুখ এসব বোঝা যাবেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে বা এখন যে অঞ্চলকে সাধারণভাবে গ্লোবাল সাউথ বলা হয়ে থাকে, সেখানে একের পর এক নতুন ‘স্বাধীন’ জাতিরাষ্ট্রে রাষ্ট্র ব্যাপারটাকেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকান, কি আফ্রিকার বেশির ভাগ জায়গায়, কি লাতিন আমেরিকায়। রাষ্ট্র থেকেও নেই, রাষ্ট্রনেতারা যথেচ্ছ পুকুর নয় সাগরচুরি করছেন, গুন্ডাবদমাশ ড্রাগ মাফিয়া পেশাদার যুদ্ধবাজদের দখলে চলে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এ থেকে মনে করার কারণ নেই, পুঁজিতন্ত্র বিপন্ন। যেখানে তেল ওঠার উঠছে, যেখানে হীরে সোনা কি অন্য খনিজ আছে তা আবাদ হচ্ছে, অন্যত্র যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসা কি ড্রাগের কারবার চলছে।

 

যেটা বোঝা দরকার, সেটা হচ্ছে, পুঁজিতন্ত্রের যে গূঢ় চলন, রাষ্ট্র সেখানে ঐতিহাসিকভাবেই পরজীবী। গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে পৃথিবীতে মোট যে পরিমাণ পুঁজি সঞ্চালিত হয়, তাতে আমাদের চেনা তথাকথিত উৎপাদন ক্ষেত্রের(প্রোডাক্টিভ সেক্টর) ভাগ কমছে। বাড়ছে তুলনায় অচেনা অর্থপুঁজি বা ফিন্যান্স ক্যাপিটাল। আজকের পৃথিবীতে কি শেয়ারবাজার কি ফিন্যান্স বাজারে নতুন লগ্নি, তার প্রায় সবটাই ফাটকা। ধরুন একটা ব্যাংক বাজারে বিস্তর ধার দিচ্ছে। সেই ধার শোধ হবে কি হবে না তা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ফাটকা চলে। যথা, কোনো ব্যাংকের পুরো ধার কেউ কিনে নিলো কিম্বা ধারের ওপর বীমা করলো। তারপরে ধার শোধ হওয়া না হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বাজারে প্যাকেজ ছেড়ে দিলো। নানারকম প্যাকেজ ও নানারকম লেনদেন হয়, যথা কোল্যাটেরাল ডেট অবলিগেশনস (সংক্ষেপে সি ডি ও), বা ডেট সোয়াপ। এছাড়াও আছে হেজিং। যে কোনো লগ্নি নিয়ে, তা সে ধার হোক, শেয়ার হোক, বীমা হোক, তা লাভ করবে না লোকসান তা নিয়ে হেজিং হতে পারে। অর্থপুঁজির বাজারে এই জাতীয় পণ্যগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ফাইন্যান্সিয়াল ডেরিভেটিভ। সমস্ত বিষয়টা অদ্ভুতুড়ে, মাথাগুলোনো। পরে এ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। মোদ্দা, ব্যাংকের ও অর্থসংস্থাগুলোর হাতে পুঁজির নিরবচ্ছিন্ন যোগান থাকতে হবে, যাতে ধারের ও ফাটকার অর্থনীতি ভেঙে না পড়ে। ২০০৮-এর মন্দার পর, যখন ব্যাংকের পুঁজি উবে যাচ্ছিলো, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুগপৎ অর্থবাজারে পুঁজির যোগান দেয়। এবারও সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এখানেই মূল খিঁট বা প্রশ্নটা ছুপে থাকে। রাষ্ট্রের হাতে কত পুঁজি থাকে? রাষ্ট্র ব্যাংকের হাতে তরল পুঁজি মাখাতেই থাকবে, এবং একইসঙ্গে, বেকার শ্রমিককে মজুরিও দেবে, লোকের খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যবস্থাও করবে? ধরুন ভারতের কথা – সরকারের কাছে কি এত পুঁজি আছে? অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দরকার হলে টাকা ছাপাও। প্রশ্ন, কত টাকা ছাপানো হবে? কতদিন ধরে? ছাপানোর পর কী? ছাপানো টাকায় মূল্য সংযোজন হবে কী করে? উৎপাদন পুরো বন্ধ হয়ে থাকলে বা হঠাৎ করে অনেকটা কমে গেলে শেয়ারবাজার চাঙ্গা থাকবে কী করে? কতদিন?

 

 

Courtesy: TOI

 

বামপন্থীরা কী ভাবেন?

রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাজার, কারুর কাছেই এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। তারপরেও, বিপর্যস্ত ও তালগোল পাকানো অবস্থায় পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা বেঁচে থাকতে পারে, অনিবার্য আত্মধ্বংস অর্থাৎ ইমপ্লসনের দিকেও এগিয়ে যেতে পারে। এই সঙ্কটদীর্ণ, গোলমেলে অবস্থাটাকে বামপন্থীরা পড়ার, বোঝার, চেষ্টা করছেন কি? করোনা সঙ্কটে বিপর্যস্ত আক্রান্ত যে শ্রমজীবী মানুষ, যথা পথেপ্রান্তরে হঠাৎ আবিষ্কৃত পরিযায়ী শ্রমিকের ঢেউ, তাঁদের পাশে থেকে, মধ্যে ঢুকে পুঁজিতন্ত্রের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে রাজনৈতিক সঙ্কটে বদলে দেবার কোন পরিকল্পনা বামপন্থীদের আছে কি? ভারতীয় বামপন্থীদের কিছু দাবীপত্র হাতে এলো, এদিক ওদিক আরো কিছু লেখাজোখা। কোথাও আঁকাড়া আশাবাদ, পুঁজিতন্ত্র খতম এবং নতুন সমাজ এলো ঐ ও কোথাও সরকার কী কী করবে তার লম্বা ইচ্ছাপত্র বা উইশ লিস্ট। রাজনীতি কোথায়, নতুন সংগঠন, নতুন ভাবনা কোথায়? বামপন্থীরা কী করবেন, কীভাবে ভাববেন, আদৌ ভাববেন কিনা, এসব প্রশ্ন ক্রমেই আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই নতুন অবস্থাটাকে বুঝতে ও ব্যবহার করতে বামপন্থীরা যদি ব্যর্থ হন, ফ্যাসিবাদছায়া স্পষ্টতর হয়ে উঠবে, উঠতে বাধ্য। অনেক আগে জাঁ পল সার্ত্ৰ বলেছিলেন, পুঁজিতান্ত্রিক সঙ্কটের সময় বামপন্থীরা যদি আন্দোলনে না থাকেন, ফ্যাসিবাদ আসবেই, ঠেকানো যাবে না। সম্প্রতি, পিটার এঙ্গেলমানের সঙ্গে একগুচ্ছ সাক্ষাৎকারে (অবশ্য করোনার আগে) আঁলা বাদিউ একথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।[2]  বর্তমান লেখক তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত।

 

 

[1] Karl Polanyi, The Great Transformation, 1944

[2] For a Politics of the Common Good, Alain Badiou and Peter Engelman, Polity Press, 2019

 

লেখকপরিবেশ আন্দোলন ও বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত।

 

Feature image courtesy : The Guardian

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Ahasan on April 25, 2020

    গণতান্ত্রিক ক্ষমতা লাভের আশা ব‍্যতি রেখে বাম জন আন্দোলনের আশু প্রয়োজন। তাহলে হয়তো পূঁজিকে তথা রাষ্টকে পুনরায় ওয়েলফেয়ার নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করবে।

Leave a Comment