গোলা ভরা খাবার আছে, গালভরা আইন আছে, খাদ্য নিরাপত্তাটুকুই নেই


  • April 16, 2020
  • (0 Comments)
  • 3186 Views

হাসিখুশি, অনর্গল কথা বলা সুন্দর, বনবাসীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করা সুন্দর অসহায়ের মতো জানালেন জঙ্গলে আলু খুঁড়ে খাচ্ছে সব। সকাল হলেই জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে। নদীতে চুনো মাছ ধরছে। আর কী খাচ্ছে? জঙ্গলে ঝোপ হয়ে থাকা  মুংরিচাক পাতা পাতা। আর? তাইর তাইর। শুনলেন দেবাশিস আইচ

 

সরকারের গোলা ভরা ধান। অথচ, দেশের নানা প্রান্ত থেকে অভুক্ত, অর্ধভুক্তের হাহাকার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এ লেখা যখন লিখছি ১৩ এপ্রিল — ২০ দিন হল লকডাউনের। আর ১৮ দিন হল তিন মাস রেশনে ৫ কেজি খাদ্যশস্য (চাল-গম) এবং ১ কেজি ডাল ৮১ কোটি গরিব মানুষকে বিনামূল্যে দেওয়ার ঘোষণার। লকডাউন যে অপরিকল্পিত তার আরও এক বড় প্রমাণ সম্ভাব্য খাদ্যসঙ্কট নিয়ে অর্থনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক বসল ২৫ মার্চ। লকডাউন ঘোষণার প্রায় একদিন বাদে। প্রধানমন্ত্রী যার সভামুখ্য। গৃহীত হল খাদ্যমন্ত্রকের প্রস্তাব। ২৬ তারিখ তা ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। লকডাউনের প্রথম পর্যায়ের ২১ দিন কাটল, দ্বিতীয় দফার লকডাউনও ঘোষিত হয়েছে। এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য — বিশেষ করে চাল — বোঝাই রেক এ রাজ্যে এসে পৌঁছয়নি বলে অভিযোগ তুলেছে রাজ্য সরকার। খাদ্যমন্ত্রীর দাবি, ১৪ এপ্রিলের পর্যন্ত মাত্র ১৩ হাজার মেট্রিক টন চাল রাজ্যের এফসিআই গুদামে মজুত রয়েছে। রাজ্যের হিসাব মতো কেন্দ্রীয় খাদ্যসুরক্ষা যোজনা বাস্তবায়িত করতে হলে ৬ লক্ষ মেট্রিক টন চাল প্রয়োজন। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো বা পিআইবি-র ৯ এপ্রিলের পোস্ট সূত্রে জানা যাচ্ছে, কেন্দ্র তেলেঙ্গানা, ছত্তিসগড় ও ওডিশা থেকে এ রাজ্যের জন্য বরাদ্দকৃত সিদ্ধ চাল এপ্রিলের শেষাশেষি যোগান দেবে। একই পোস্টে ২৪ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত রাজ্যে সরবরাহকৃত খাদ্যসামগ্রী বিষয়ক লিংক থেকে জানা যাচ্ছে, ওই সময়ে রাজ্যে ৬১টি রেকে গম এসেছে ১.৭ লক্ষ মেট্রিক টন আর মাত্র ৫টি রেকে চাল এসেছে ০.১৪ লক্ষ মেট্রিক টন।  অথচ এ রাজ্যের মানুষের প্রধান খাদ্যই ভাত। যদিও, গত সপ্তাহে খাদ্যমন্ত্রী হিন্দুস্তান টাইমসকে জানিয়েছিলেন, রাজ্যে খাদ্যে ঘাটতি নেই। ৯.৪৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে। আরও ৪ লক্ষ মেট্রিক টন চালকলে জমা আছে। এই চাল রাজ্যে উৎপাদিত এবং সরকার সংগ্রহ করেছে।

 

এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী ২০ মার্চ ঘোষণা করেন বিনামূল্যে ছ’মাস খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। ১ এপ্রিল থেকে এ রাজ্যে রেশনে সেই চাল, গম দেওয়া শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে রাজ্য তার খাদ্য প্রকল্প জুড়ে দিয়েছিল সেই ২০১৬ সালেই। নামকরণ করা হয় খাদ্য সাথী। ২০১৮ সালে খাদ্য ও সরবরাহ বিভাগের বিজ্ঞাপন বলছে, ‘৮ কোটি ৪৬ লক্ষ রাজ্যবাসীকে খাদ্য সাথী প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা হয়েছে।’ আর তাদের সকলকেই ‘ডিজিটাল রেশন কার্ড প্রদানকারী করা হয়েছে’।

 

রাজ্যে খাদ্য সুরক্ষা আইনে অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনায় (এএওয়াই) উপভোক্তা ৫৪,৭০,৮৬২, এবং বিশেষ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত পরিবার ৫,৪৭,১৭,৩৪২। মোট ৬,০১,৮৮,২০৪। এর পর রয়েছে রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা-১, রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা- ২। ২ ছাড়া সব ক্ষেত্রেই চালের দাম ২ টাকা কেজি এবং গমের ৩ টাকা কেজি। এই মুহূর্তে রাজ্য সরকার বিনামূল্যে এই গ্রাহকদের খাদ্য সরবরাহ করার অঙ্গীকার করেছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা মিলিয়ে সংখ্যাটি যদিও ৭.৮৮ কোটি।  ২০১৮ সালের ৮ জুলাইয়ের খাদ্য দফতরের বিজ্ঞাপনের সংখ্যার থেকে যা ৫৮ লক্ষ কম। হতে পারে গ্রাহক সংখ্যা সংশোধিত হয়েছে। তাহলে তা বাড়ারই কথা। ২০১৬ সালের পর এই সংযোজন হওয়া উচিত। অথবা, রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা ২ প্রকল্পে যে এপিএল গ্রাহকরা বর্তমান সময়ে ১৩ টাকা কেজি দরে রেশন পাচ্ছেন তাঁদের সংখ্যাটি কি ৫৮ লক্ষ? ডিজিটাল কার্ড সকলে পাননি এখন তা স্পষ্ট। এই না-পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য কুপন দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গিয়েছে ৫৬ লক্ষ কুপন ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপিত সংখ্যার সঙ্গে বর্তমানে ঘোষিত সংখ্যার মধ্যে ডিজিটাল কার্ড না-পাওয়া এপিএল-বিপিএল দুই লুকিয়ে থাকতে পারে।

 

ঠিক কত খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে এফসিআই-এর গোডাউনে বা কেন্দ্রীয় সরকারের শস্যগোলায়। তাদের ওয়েবসাইট বলছে, ৩১ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত চালের মজুত — ৩০৯.৭৬ মিলিয়ন টন। গম — ২৫৫.২১ মিলিয়ন টন। সর্বমোট — ৫৮৪.৯৭ মিলিয়ন টন। এবং আনমিলড প্যাডি বা ধান রয়েছে ২৮৭.০৮ মিলিয়ন টন। এছাড়াও রয়েছে, তিন মিলিয়ন টন ডাল, ১.১ মিলিয়ন টন তৈল বীজ এবং ৪ মিলিয়ন টন চিনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যা খাদ্যশস্য (চাল-গম) মজুত রয়েছে তা বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের (যেমন, রেশন) জন্য যে ন্যূনতম মজুত থাকা প্রয়োজন তার তিনগুণ। যা দিয়ে ৮১ কোটি মানুষকে ছ’মাস খাওয়ানো সম্ভব। অথচ যে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে আটকে রয়েছেন তাদের তো রেশন কার্ড স্ব স্ব রাজ্যে। কেমন করে টিকে আছেন তাঁরা? একের পর এক অসন্তোষ, বিক্ষোভের খবরে প্রমাণিত তাঁরা ভালো নেই। বর্তমানে আমরা মন দেব এ রাজ্যের অন্যতম পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীরগুলির বিপর্যস্ত ছবিটির দিকে।

 

ডুয়ার্স

 

চা আর পর্যটন নির্ভর এক ভৌগোলিক অঞ্চল। এক কথায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। প্রথমে আসাম পরে পশ্চিমবঙ্গ সিএএ বিরোধী আন্দোলনের জেরে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলে তার প্রভাব পরে উত্তরের পর্যটন ব্যবসায়। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি ডুয়ার্সের পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবার পড়ল কোভিড-১৯-এর চরম ধাক্কা। অন্যদিকে, বন্ধ হয়ে গেল চা বাগান। বন্ধ হল মজুরি। ( ১৩ এপ্রিল চা বাগান খোলার খবর পাওয়া গিয়েছে।) রেশন যা মিলেছে তা দিয়ে তো একমাস দূরে থাক পুরো এক সপ্তাহ চলে না। আর কী অবস্থা বনবাসীদের? বনবস্তির বাসিন্দাদের? যাদের জমি রয়েছে তারা রেশনের চাল শেষ হলে ঘরে সঞ্চিত চাল দিয়ে সামাল দিচ্ছেন। যাদের জমি নেই কিংবা রেশন কার্ড হয়নি তাদের পরিস্থিতি অবর্ণনীয়। যেন দুর্ভিক্ষ লেগেছে দেশে। একদিকে মারির ভয়, অন্যদিকে যেন মন্বন্তরের। চিলাপাতা কুরমাই বনবস্তির সুন্দর সিং রাভার মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না। যদিও সে এখনও খেয়ে পড়ে আছে। ওঁর জমি আছে। চারজনের পরিবারে রেশনে মিলেছে মাথা পিছু ২ কেজি করে চাল আর সব মিলিয়ে দেড় কেজি আটা। পাওয়ার কথা মাথা পিছু ২ কেজি করে চাল আর তিন কেজি করে গম বা ২,৮৫০ গ্রাম আটা। ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা খাদ্য সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী — ২ টাকা কেজি দরে চাল এবং ৩ টাকা কেজি দরে গম — এই পাঁচ কেজি খাদ্যশস্য তার পাওয়া উচিত এই সময়ে অবশ্যই বিনামূল্যে — কিন্তু আটা পেলেন কম। কম মানে ১১ কিলো চারশো গ্রামের জায়গায় দেড় কেজি। এই পরিমাণ চাল তিনদিনেই শেষ হয়ে যায় একজন গ্রামবাসী কিংবা শ্রমজীবীর। সুন্দরের ঘরে চাষের চাল আছে বলে বাঁচোয়া। কিন্তু, যাঁদের নেই? হাসিখুশি, অনর্গল কথা বলা সুন্দর, বনবাসীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করা সুন্দর অসহায়ের মতো জানালেন জঙ্গলে আলু খুঁড়ে খাচ্ছে সব। সকাল হলেই জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে। নদীতে চুনো মাছ ধরছে। আর কী খাচ্ছে? জঙ্গলে ঝোপ হয়ে থাকা মুংরিচাক…পাতা পাতা। আর? তাইর তাইর। আর? ঢেকি শাক আছে। নিজের ভাষায় যা বললেন সুন্দর তা হল জঙ্গলে হয়ে থাকা ছোট ছোট পাতার এক জাতীয় গুল্ম হল মুরিংচাক। চাক মানে পাতা। আর তাইর মানে বেত। ওই পাতা কেউ শুকিয়ে রাখছে এবং ফ্যান ভাতের সঙ্গে সেই শাক কিংবা বেত পোড়া বা ছ্যাঁকা, আলু কিংবা ঢেকি শাক খাদ্য নিরাপত্তা দিচ্ছে। ঠিক কতটা সুষম খাদ্য জোটাতে পারলেন তাঁরা? তা বোঝার জন্য পুষ্টি বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সুষম খাদ্য এ পোড়া দেশে আজও লকডাউন বাবুদের দখলে। সুন্দর জানালেন, সকাল হলেই দলে দলে হাতি, বাইসন, চিতাবাঘের ভয় উড়িয়ে ক্রমে বনাঞ্চলের গভীরে ঢুকে পড়ছেন রাভা কিংবা ওঁরাওরা। এই অভিযানে মানুষ-পশু সংঘাত অনিবার্য। ঘটেছেও তাই। বাইসনের গুঁতোয় গুরুতর আহত গেন্দা ও দিলীপ রাভাকে ভর্তি করতে হয়েছে আলিপুরদুয়ারে সরকারি হাসপাতালে। কুরমাই লাগোয়া আন্দু, বানিয়া, কোদাল বস্তি, শালকুমার সর্বত্র একই চিত্র।

 

একই চিত্র বক্সায়। তবে, এখানে জঙ্গলে ঢোকার কিংবা নদীতে নামতে গেলে রীতিমতো কড়া প্রতিযোগিতায় পড়তে হচ্ছে। বক্সা অরণ্য লাগোয়া চা বাগানের শ্রমিক ও অন্যান্য বাসিন্দারাও খাবারের খোঁজে নেমে পড়ছেন ঝোরায়। চুনো মাছ, শামুক, জলের শাক সিমরাই, কচু শাক, জঙ্গলের ঢেকি শাক, হাতির প্রিয় খাদ্য পুরুন্ডি উজার করে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। উপায় নেই। বক্সা পাহাড়ের ডুকপাদের পরিস্থিতি সঠিক কী তা জানার প্রায় কোনও রাস্তা নেই। লকডাউনের জেরে পৌঁছনোর উপায় নেই সেই সব গ্রামে। তাঁদের প্রতি সপ্তাহে ১০-২৫ কিলোমিটার নামতে-উঠতে হতো সান্তালাবাড়ির হাটে বিকিকিনির জন্য। তাও বন্ধ। জঙ্গল-পাহাড় পাড়ি দিয়ে ভুটানে যান ওঁরা। সামাজিক-ধর্মীয় নানা কারণেই তাঁরা ভুটানের উপর নির্ভরশীল। ভুটান বহু আগেই তার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন খাবার বলতে থাকতে পারে বড়জোর স্কোয়াশ আর আদা। নুন চাও বোধহয় জুটছে না। ভরসা তবে কি জঙ্গল? বক্সা গারো বস্তির লালসিং ভুজেল অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল। তাঁর মতো কয়েকজন মিলে দিন আনা দিন খাওয়া গারোবস্তি, পাম্পুবস্তি, রাজাভাতখাওয়া এফডি, বামনি আর পানিঝোরার কয়েকটি পরিবারকে একবারই কিছুটা খাবার দিতে পেরেছেন। কিন্তু, বক্সাতেই তো রয়েছে ৪২টি বনবস্তি, কোচবিহার ফরেস্ট ডিভিশনে ১৮টি, জলপাইগুড়ি ডিভিশনে ২০টি। সেখানে বিপন্ন থেকেও বিপন্নদের কাছে কীভাবে পৌঁছবে খাবার? অসহায় লালসিং হিসেব কষে বোঝালেন, ৮০টি বনবস্তির ১০ জন করে ৮০০ জনকে যদি জনপ্রতি ৩ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ২৫০ গ্রাম তেল, ১ কেজি মসুর ডাল, ১টা সাবান দিতে হয় তবে খরচ পড়ে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। কে দেবে এই টাকা, কার কাছে হাত পাতবেন লালসিংরা? আলিপুরদুয়ারের অর্থনীতিই তো বেহাল।

 

পুরুলিয়া

 

বান্দোয়ান ব্লকের কুচিয়া গ্রামের চিরঞ্জিৎ শবরও রেশনে বিনামূল্যে চাল ও আটা পেয়েছেন। চার জনের পরিবারে চাল মিলেছে ৩ কেজি। আটা চারটি ছোট প্যাকেট। কতটা? কত গ্রাম? বলতে পারলেন না। কত পাওনা তা জানেনই না ওঁরা। তবে কি ৭৫০ গ্রাম করে চার প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন এফপিএস ডিলার? চিরঞ্জিৎ শুধু বললেন, ‘আমাদের খালি কম দেয়।’ তবে উপায়? ২২ টাকা কেজি চাল কিনেছেন। নামালে গিয়েছিলেন ফিরতে পেরেছেন মজুরি আর চাল নিয়ে। টোলার ন’টি পরিবারের হাল কমবেশি একই। জোড় (ছোট নদী) থেকে ছোট ছোট মাছ ধরে মাহাত, মাঝিদের গ্রামে বিক্রি করছে কেউ কেউ। ১৫ টাকা ‘শ।

 

জেলার খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি লকডাউনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করেছিল রাজ্য ও জেলা প্রশাসনকে। এর ফলে কাজও হয়েছে। তবুও দেখা গেল কেন্দা থানার চিপিদা-ভান্ডারপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের শবরটোলা রমাইগড়ায় একটি দানাও পৌঁছয়নি ৯ এপ্রিল পর্যন্ত।জেলার সাংস্কৃতিক সংস্থা কাব্যায়নের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা তাঁদের দু’-তিনদিনের খাবার পৌঁছে দেন।

 

ঝাড়গ্রাম পশ্চিম মেদিনীপুর

 

এই অঞ্চলের আদিবাসী পল্লিগুলি থেকে অভিযোগের শেষ নেই — রেশনে কম চাল দেওয়া, অপ্রতুলতা থেকে লরি ভর্তি চাল পাচারের চেষ্টা কত অভিযোগ! স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সাধারণের হস্তক্ষেপে প্রশাসন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিয়েছে বটে, কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেছে প্রশাসনিক দুর্বলতার দিকটিও। যেন পঞ্চায়েতি রাজ উবে যাওয়ার কড়া মাসুল গুনছে গ্রামবাংলা।

 

কেশপুর ব্লকের ট্যাবাগেড়া গ্রামের প্রথম থেকেই কম রেশন দেওয়ার অভিযোগ ছিল। একটি পরিবারের যেখানে ১০ কেজি চাল পাওয়ার কথা সেখানে রেশন ডিলার দিচ্ছিল ৮ কেজি। গ্রামবাসীদের নিয়ে প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন শেখ লিয়াকত আলি। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতেই ‘মীমাংসা’ করতে এগিয়ে আসেন ‘দলের দাদারা’, দেখা দেন প্রধান। ‘রেশন কাটা’র একই অভিযোগ ওঠে বিনপুরের ভুরশা গ্রামের রেশন ডিলারের বিরদ্ধে। কলকাতা-সহ সারা রাজ্য থেকেই এমন বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। আর প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে জেলা প্রশাসন, পুলিশকে। এমন ৪০ জন রেশন ডিলারকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। আসলে এই সংখ্যাটিই বহুগুণ বাড়তে পারত যদি অধিকাংশ মানুষের রেশনে প্রাপ্য বিষয়ে, অধিকার বিষয়ে ন্যূনতম সচেতনতা থাকত। থাকত প্রতিবাদের সক্ষমতা। অথবা যথাযথ সচেতনতা থাকলে হতে পারত না এই দুর্নীতি।

 

বেলপাহাড়ির বামুনডিহা গ্রাম। সাঁওতাল, মাহাত ছাড়াও উচ্চ ও মধ্যবর্ণের মানুষের বাস। তারই এক কোনায় ডোমপাড়া। ৭০টি পরিবার। ২০০৫ সালে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এখানে। তো এই ডোমপাড়ার মানুষ রেশনের চাল-গম দু’চারদিনে শেষ হতেই ফের সঙ্কটে পড়লেন। বিনপুর -২ এর বিডিওকে সমস্যা জানিয়ে চিঠি দিলেন সমাজসেবী ঝরনা আচার্য। শেষ পর্যন্ত ৪৯টি পরিবার পেল টোকেন আর বাকিরা জিআর-এ পেল ৬ কেজি করে চাল।

 

পূর্ব বর্ধমান

 

জেলার ২১টি ব্লকের মধ্যে আটটি ব্লকে প্রধানত আলু চাষ হয়। আলু উঠে গিয়েছে। পাশাপাশি বোরোধান রয়েছে। আষাঢ়ে শুরু হবে খরিফ চাষ। বাকি ব্লকগুলিতে মূলত ধান চাষ হয়। এখন বোরোর মরসুম। এই আলু তুলতে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, সুন্দরবন থেকে মজুররা তো আসেনই পাশাপাশি বিহার ও ঝাড়খণ্ডের মজুর রয়েছেন। আলু তোলা হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোথাও সিংহভাগ আলু হয় হিমঘরে ঢুকে গিয়েছে না-হয় বিক্রি হয়ে গিয়েছে। এদিকে লকডাউনে এক বড় সংখ্যক মজুর গিয়েছেন আটকে। কত তাঁরা? জেলার পূর্ণ হিসেব জানা যায়নি। টুকরো টুকরো কিছু সংখ্যা পাওয়া গেল। মেমারি ১ ব্লকে এ রাজ্যের আটকে পড়া শ্রমিকের সংখ্যা ৫৭২ এবং ভিনরাজ্যের সংখ্যাটি ৫২৭। ব্লকের ১০টি পঞ্চায়েতে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আলু তুলেছেন ওঁরা।পঞ্চায়েতগুলির মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে ৭ এপ্রিল পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য মাথা পিছু তিন কেজি চাল ও ৩৫০ কেজি ডালের বরাদ্দ করে পঞ্চায়েত সমিতি। সভাপতি বসন্ত রুইদাস শ্রমিকদের বার্তা পাঠিয়েছেন প্রয়োজন মাফিক আরও খাদ্য সরবরাহ করা হবে।

 

বর্ধমানের কালনা এক, গ্রাম: বাঘনাপাড়া। এখানে পুরুলিয়ার বান্দোয়ান ব্লকের সুমি শবর-সহ চিরগিচামির ১১ জন শবর এবং কারুর, আমঝরনা শবর পাড়ার আরও কিছু শবর নামালে আলু তোলার কাজে গিয়ে আটকে পড়েছেন। সঙ্গে ওই  ব্লকের কয়েকজন সাঁওতালও আছেন। মোট ৪০ জন। তাঁরা বাঘনার চাষি সজল ঘোষের জমিতে কাজে গিয়েছিলেন। সুমি ও সজল ঘোষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এঁদের তালিকা দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতকে এপ্রিল মাসের প্রথমেই রেশন দেওয়ার অনুরোধ করেছেন সজলবাবু। কিন্তু রেশন মেলেনি। সুমিদেবী জানান, মজুরির টাকা খাবার খেতে শেষ হচ্ছে আর বাড়ির লোক পথ চেয়ে বসে আছেন। কলকাতা, নদিয়া, কালনার কয়েকজন উদ্যোগী যুবক গণ-তদারকি উদ্যোগ-এর ফেসবুক পেজ থেকে খবরটি পেয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) খোঁজখবর নেন বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাবার মেলে স্থানীয় উদ্যোগপতি সুব্রত পাল ও কালনা থানার সহায়তায়। শ্রমিকদের ১ কুইন্টাল চাল, ১ বস্তা আলু, ১০ কেজি ডাল, ১ টিন সরষের তেল, ২৫ কেজি চিঁড়ে, ১০ কেজি গুড়, দুটি শিশুর জন্য ১ কেজি আমূল দুধের প্যাকেট, রান্নার মশলা, তেল-সাবান, মাস্ক দেওয়া হয়।

 

পুরুলিয়ার বান্দোয়ান ব্লকের কুচিয়া শবরপাড়ার ন’জন শবরের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, বর্ধমানের মেমারি দুই ব্লকের রানিহাটি গ্রামেই আলু তুলতে গিয়ে আটকে আছেন প্রায় ২৫০ পরিযায়ী কৃষিশ্রমিক। গ্রামটি বোহাড় – এক গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন। পঞ্চায়েত এলাকা ধরলে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি। কুচিয়ার শবর শ্রমিকরা এসেছিলেন রানিহাটির মান্নান শেখের জমিতে কাজ করতে। তিনিই জানিয়েছেন, তাঁর গ্রাম রানিহাটিতে পুরুলিয়া, সুন্দরবন ও ঝাড়খণ্ডের দুমকা থেকে আসা শ্রমিকরা আটকে আছেন। দিন পাঁচ-ছয় আগে, অর্থাৎ এপ্রিলের শুরুতে পঞ্চায়েত থেকে শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে নিয়ে যাওয়া হলেও খাবার বা রেশনের ব্যবস্থা করা হয়নি। তিনিও চান সরকার খাবার দিক, এঁদের বাড়ি ফেরাবার ব্যবস্থা করুক। শেষ পর্যন্ত জানা যায় ১১ এপ্রিল এই শ্রমিকেরা পঞ্চায়েত থেকে মাথাপিছু মাত্র ২ কেজি চাল পেয়েছেন। এই শ্রমিকদের সঙ্গে মনিব চাষিদের বংশ পরম্পরায় চাষের সম্পর্ক। অভাবের দিনে মনিবরা সাহায্য করেন তাই বাঁচোয়া।

 

কালনা ২ ব্লকে প্রথম থেকেই প্রায় ৬০০ পরিযায়ী শ্রমিককে রান্না করা খাবার বসিয়ে খাওয়ানো শুরু হয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামের অন্যান্য গরিব মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে চার হাজারের উপর। বর্ধমান শহরেও এমন আরও উদ্যোগ রয়েছে। কোনও সংস্থা ৩০০০ দু:স্থ মানুষকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে। কেউ-বা শহরের ৪০০ কোরা আদিবাসী পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

 

কালনা ২ ব্লকের স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের পাশাপাশি অন্যতম উদ্যোক্তা জেলার সহ-সভাধিপতি দেবু টুডু। সমস্ত স্তরের গ্রামবাসীদের সহায়তায় ও আর্থিক সাহায্যে এই গণউদ্যোগ নিয়ে গর্বিত তিনি। কিন্তু, পঞ্চায়েতের উদ্যোগ কেন চোখে পড়ছে না? দেবুবাবুর উত্তর, ‘যে যার মতো কাজ করছে।’ বললেন বটে, কিন্তু চোখে তো পড়ছে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা, পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা। চোখে পড়ছে নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সিভিক কর্মীর ভূমিকা। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি আটকে গেলে দ্বারস্থ হচ্ছে এডিএম, বিডিও কিংবা থানার বড়বাবুর। পঞ্চায়েতের নয়। উলটে, অনেক জায়গা থেকেই বিপন্ন অথচ রেশন কার্ডহীন মানুষকে হাঁকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে। তবে, খাদ্য সুরক্ষার অর্থ কী? আইনে তো ভবঘুরে মানুষকেও প্রতিদিন একবেলা খাবার দেওয়ার সংস্থান রয়েছে। গৃহহীনদের জন্য গণরান্নাঘর থেকে নামমাত্র মূল্যে খাবার কেনার সংস্থান রয়েছে। যে কোনও দুর্যোগের শিকার মানুষের জন্য তিন মাস পর্যন্ত বিনামূল্যে খাবার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যে অধিকার বলে সারা দেশে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। খাদ্য যোজনা, মিড ডে মিল, অঙ্গনওয়ারি, গণবণ্টন ব্যবস্থা সবই তো খাদ্য সুরক্ষা বলয়ের অন্তর্ভুক্ত।

 

সংসদীয় গণতন্ত্রে সর্বনিম্ন স্তরের শাসন ব্যবস্থা পঞ্চায়েতি রাজ। রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিটা তো ফেলনা নয়, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের দাবি। তাহলে সব ক্ষমতা শহরেই থাকবে কেন? নবান্নের নির্দেশই-বা শেষ কথা হবে কেন? পঞ্চায়েতের হাতে গ্রামের মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, পঞ্চায়েতের অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে না কেন? ২০০২ সালে ‘গ্রামবাসীদের দ্বারা গ্রাম পরিকল্পনা’ নামে তৎকালীন রাজ্য সরকার একটি বিকেন্দ্রীকৃত পরিকল্পনা হাজির করেছিল। তখন অর্থবরাদ্দ ছিল কম। বরাদ্দ যখন বাড়তে শুরু করল, পঞ্চায়েত প্রধান ও গ্রাম উন্নয়ন কমিটি পরিকল্পনা তৈরি করে টাকা খরচ করতে শুরু করল তখনই হল মুশকিল। বিধায়ক, মন্ত্রীরা বিপদের আঁচ পেলেন। পঞ্চায়েত প্রধান, গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সচিব যদি এত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়েন তবে বাবুদের মান্য করবে কেন গ্রামের মানুষ। ২০১০ সালে ‘স্বচ্ছ ও নীতিনিষ্ঠ পঞ্চায়েত পরিচালনা’র নামে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে বাম-ডান নির্বিশেষে গ্রাম উন্নয়ন কমিটিকে ‘দুর্নীতিবাজ’, ‘চোর’ বানিয়ে তার উন্নয়ন পরিকল্পনার অধিকার, উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ ও ব্যয় করার অধিকার খর্ব করল বাম সরকারই। এতো হবেই। কেননা মন্ত্রী-আমলারা যে শত শত প্রকল্প নেয় তার এক বড় অংশেই তো বরাদ্দ অর্থ খরচ হয় না। আর দুর্নীতির কথা, বাবুদের কমিশন খাওয়ার কথা যত কম বলা যায় তত ভালো।  তবে, বাম সরকার পঞ্চায়েতকে একদম ঠুঁটো জগন্নাথ করে ছাড়েনি। ২০১২ সাল থেকেই পরিবর্তনের সরকার জনগণের দ্বারা জনগণের পরিকল্পনার ধারণাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে তা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বদলে ফেলল। জেলাপরিষদের যে সহ-সভাধিপতির দায়িত্ব ছিল সারা জেলায় নিম্নতম স্তর পর্যন্ত প্রতিটি বিপন্ন মানুষকে খাদ্য সঙ্কট থেকে রক্ষা করার জন্য নেতৃত্ব দেওয়া, তাঁকে দেখা গেল নিজের ব্লকে দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে চাঁদা তুলে ‘চ্যারিটি’ করতে। অন্যত্র, প্রবল ক্ষমতাশালী সাংসদকেও ‘হোম ডেলিভারি’তে হাত পাকাতে দেখা গেল।

 

অথচ, গ্রাম সংসদ ও গ্রাম পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করে ‘সহায় প্রক্রিয়া ও কর্মসূচি’ চালু করা যেত। এই প্রক্রিয়া ও কর্মসূচির মাধ্যমে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে রান্নাকরা খাবার অতি দু:স্থ, সহায়-সম্বলহীন এবং কর্মক্ষমতাহীন পরিবারগুলিকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার, পোশাক, বাসস্থান, কাজের উপায় এবং অন্যান্য ন্যূনতম পরিষেবা সুনিশ্চিত করার সংস্থান রয়েছে। বর্তমান সময়ে এই প্রক্রিয়াটিকেই উদ্ভাবনী উপায়ে ব্যবহার করা যেত। অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা, জাতীয় সামাজিক সহায়তা প্রকল্প, ১০০ দিনের কাজের সুবিধা কাজে লাগানো, গণবণ্টন ব্যবস্থার সঠিক বিতরণে বেশি বেশি করে তদারকি, অঙ্গনওয়ারি — এই জাতীয় পরিষেবাগুলিকে যুক্ত করার এবং সহায়তা দেওয়ার সংস্থান রয়েছে এই কর্মসূচিতে।পঞ্চায়েত ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের সমন্বয়ে কীভাবে এই কর্মসূচি রূপায়ণ করা যায় তার সুনির্দিষ্ট ছক ও কর্মপদ্ধতিও রয়েছে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগ প্রকাশিত প্রধান ও উপপ্রধানদের প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালে। সে পথে হাঁটার পথে এখন যে নবান্নই প্রধান বাধা।

 

অথচ কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় অপেক্ষাকৃত সফল ও অগ্রণী রাজ্য কেরালা সেখানকার লোকাল সেল্ফ-গভর্নমেন্ট বা পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলিকে সর্বস্তরে কাজে লাগিয়েছে। সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা, কোভিড-১৯ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি থেকে হোম কোয়ারান্টিনে থাকা অভাবী মানুষদের খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করা। খাদ্য দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে খাদ্যলভ্যতা নিশ্চিত করা থেকে ওষুধের দোকানে জেনেরিক মেডিসিনের লভ্যতা নিশ্চিত করা ও নজর রাখা। খাদ্যের অভাব হলে কিংবা মজুতদারির খবর পেলে জেলাশাসককে অবহিত করা। বিশেষ শ্রেণি বিভাগ তৈরি করে তাঁদের সার্বিক সাহায্যের জন্য, ওয়ার্ড সদস্যের নেতৃত্বে স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়ারি কর্মী, স্বাস্থ্য স্বেচ্ছাসেবক, সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এই বিশেষ শ্রেণিটি হল শয্যাশায়ী ব্যক্তি, গুরুতর অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রতিবন্ধী, অন্তঃস্বত্ত্বা, দরিদ্র আদিবাসী ও দলিত কলোনি, বস্তিবাসী, পরিযায়ী শ্রমিক।  আমরা কী কিছু শিখব কেরালার কাছ থেকে?

 

এদিকে আমাদের পুরপিতা, পঞ্চায়েত সদস্যরা শুধু ‘নিরুদ্দেশ’ নন, ২৯ মার্চ অল ইন্ডিয়া ফেয়ার প্রাইস শপ ডিলার্স ফেডারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক বিশ্বম্ভর বসু খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, ত্রাণের নামে চাল-গম দেওয়ার জন্য রেশন ডিলারদের উপর পুরপিতা, পঞ্চায়েত সদস্য, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মানসিক চাপ সৃষ্টি করছেন। চালকল, হিমঘর, আড়তদার, ঠিকাদারদের অ্যাসোসিয়েশনগুলিও একই অভিযোগ আনতে পারত। আনেনি এই যা। এক জেলা সভাধিপতি তো একরকম বলেই ফেললেন এই বাজারে নরনারায়ণ সেবার নামে চালকল, হিমঘর মালিকদের চাপ দিয়ে টাকা, খাদ্যসামগ্রী তোলা আর ছবি তুলে প্রচারের হিড়িক দেখা গিয়েছে। বিশ্বম্ভরবাবুর অভিযোগপত্রে কারও নাম না থাকলেও খাদ্যমন্ত্রী স্বয়ং উত্তর দমদমের এক পুরমাতার কাছ থেকে ১০ বস্তা চাল উদ্ধারের কথা এবং অন্যত্র আরেক কীর্তিমানের ২২ কুইন্ট্যাল চাল তুলে নেওয়ার কথা সাংবাদিক সম্মেলনেই জানান। মুখ্যমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অবশ্য এই ত্রাণবাজি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু লুঠের দায়ে ধরা পড়া কাউন্সিলর, দলীয় নেতারা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন।

 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে করোনা মহামারি এ দেশে এক অভূতপূর্ব বিপর্যয়। এই বিপর্যয়কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে চূড়ান্ত গরিব বিরোধী, শ্রমিক বিরোধী, কৃষক বিরোধী, দলিত ও আদিবাসী বিরোধী এক সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র। শীর্ষ আদালত, সামরিক বাহিনী-পুলিশ থেকে আমলাতন্ত্র,  শিক্ষাকেন্দ্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান কোনও-না-কোনওভাবে এই অত্যুক্তি, ঘৃণা, বিদ্বেষবানিয়াদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। এদের যোগ্য দোসর হয়ে উঠেছে ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট ও  নির্লজ্জভাবে সাম্প্রদায়িক ও অমেরুদণ্ডী মিডিয়া। বিগত সাত বছরের মোদী রাজত্বে ক্রমে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে ভারত। আজ সেই দেশ ঘরবন্দি হয়ে চরম ক্ষুধার্ত, কর্মহীন, জীবিকাহীন। করোনা মহামারি কি এ দেশের টিমটিম করে জ্বলতে থাকা গণতন্ত্রটুকুকে নি:শেষ করে তুলবে না কি মানুষের অসীম উদ্যোম, সৃজনশীলতায় তা মশাল হয়ে জ্বলে উঠবে? তলিয়ে যাওয়ার আগে কি মিলবে এই প্রশ্নের উত্তর? আশা করা যায়, পশ্চিবঙ্গের মানুষও এ রাজ্যে সর্বত্র, সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রসারের দাবিতেও সোচ্চার হবেন।

 

সূত্র:

 

১। লকডাউনের ২১ দিন পার, মোদীর আশ্বাসের চাল এখনও পায়নি বাংলা, তাপস প্রামাণিক, এই সময়, ১৫ এপ্রিল ২০২০।

 

২।
https://pib.gov.in/PressReleasePage.aspx?PRID=1612712

 

৩। 400 families block Bengal highway for three hours alleging no food amid lockdown, Shreyasi Pal, hindustantimes.com, 15 April 2020.

 

৪। খাদ্য ও সরবরাহ বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞাপন, এই সময়, ৮ জুলাই ২০১৮।

 

৫।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2919181814841191&id=100002482029374

 

৬।
https://www.facebook.com/100002482029374/posts/2919186338174072/

 

৭। সাবধান, গ্রামের মানুষের হাতে লক্ষ লক্ষ টাকা যাচ্ছে, স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মার্চ ২০১০।
দেড়শো প্রকল্পে খরচ হয়নি বরাদ্দের এক পয়সাও, স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ মার্চ ২০১০।

 

৮।
সৌজন্য: দিলীপ ঘোষ, প্রাক্তন সচিব, স্বাস্থ্য দফতর, পশ্চিমবঙ্গ।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10215483707797142&id=1571954290

 

৯।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1549854381843859&id=435160536646588

 

লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।

 

Cover Image courtesy : https://economictimes.indiatimes.com

 

Share this
Leave a Comment