করোনার দিনগুলিতে রাজনীতি


  • March 30, 2020
  • (0 Comments)
  • 2074 Views

সমাজের নিচুতলায় যাদের রেখেছি, যারা সামান্য ক্ষুণ্ণিবৃত্তির প্রয়োজনে মাটির বুক চিরে ফসল ফলায়, আমাদের জীবনযাপনের প্রতি মুহূর্ত যাদের কাছে ঋণী, তারা আজ উপার্জনহীন, খাদ্য-বস্ত্র-কর্মহীন। প্রতিশোধ নেবে না? আমার সন্তানের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক গ্লাভস আর ঘরে বস্তা বস্তা খাদ্য মজুত। আর তাদের ঘরে উনোন না জ্বললে তারা কী মাস্ক আর গ্লাভস চিবোবে? প্রশ্ন তুললেন পার্থপ্রতিম মৈত্র

 

আপনাদের মধ্যে অনেকেরই নিশ্চয়ই ১৯৯৪ সালের ভারতে প্লেগের কথা মনে রয়েছে। আমারও রয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া এবং পরবর্তী সপ্তাহগুলিতে মারাত্মক দাঙ্গা ভারতের পটচিত্র বদলে দেওয়া? আজ এত বছর পর, বেশিরভাগ ভারতবাসী আমার সাথে একমত হবেন যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং শিবসেনার বিজয় আখ্যানগুলিতে, বিরানব্বই সালের ডিসেম্বর একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল, যেখানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেশে রাজনৈতিক জীবনকে রূপ দিতে শুরু করেছিল এবং ভারতীয় সমাজকে আগের চেয়ে আরও গভীরভাবে বিভক্তও করেছে।

 

‘ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতা’, নাগরিকত্ব, ভূমিপুত্র, বৃহত্তর হিন্দু, কমন সিভিল কোড, তিনশো সত্তর ধারা, দেশভাগ, বানিয়াবৃত্তি, কাশ্মীর লকডাউন, গান্ধী, সাভারকার সম্পর্কে ভারতবাসী এক ঐকমত্যে পৌঁছে গিয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের প্রভেদ রেখাও মুছে গেছে। বোম্বের বিশ্বতত্ত্ব শহরের হাজার হাজার আবাসন কলোনির ভিতরে পৌঁছায়নি। শিক্ষা, যথাযথ চাকরি এবং উন্নয়ন শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাব সরিয়ে ফেলবে, এই বিশ্বাসের কোনও প্রমাণ কখনও ছিল না, আজও নেই। বিপরীতে, মুসলিম জেনোসাইড গুলিকে উৎসাহের সাথে অনেক সুশিক্ষিত হিন্দু সমর্থন করেছিলেন। ‘প্রতিশোধ নেওয়া’ অনেককেই উত্তেজিত করে তোলে কারণ এটি হয়তো বা মানুষের বেসিক ইন্সটিংক্ট। এবারও মনে করে দেখুন প্রাক করোনা পর্বে  দেশজুড়ে আর্থিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি কাশ্মীরের লকডাউন, এনআরসি আর সিএএ-এর বিরুদ্ধে যে প্রবল বিক্ষোভ তার কথা। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্ম আবরণ খুলে দিয়েছিল শাহিনবাগ, পার্কসার্কাস আর অন্যদিকে ভারতের সবকটি প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি। ছাত্র-ছাত্রীরা নেতৃত্ব দিচ্ছিল এনআরসি আর সিএএ বিরোধী আন্দোলনের। গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিরোধ আন্দোলনে মোটামুটি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রীয়বাহিনী। সেই প্রতিবাদী শক্তিও এই মুহূর্তে ব্যাকফুটে । ফলে এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই বা ছিল না, এটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে কোথায়?

 

১৯৯৪ সালের প্লেগের কথায় ফিরে আসি। ঠিক আজকের করোনা ভাইরাসের দ্রুততায় সে প্লেগও এইরকমই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং তার মধ্যে বিউবোনিক ও নিউমনিক দু’ধরনের প্লেগই ছিল। ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ ভোরে এক অদ্ভুত আতঙ্কে ঘুম ভেঙ্গেছিল গুজরা়টের সুরাট শহরবাসীর। জল খেলেই তাৎক্ষণিক মৃত্যু। দলে দলে মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত এই বিপুলসংখ্যক মাইগ্রেশন দেখেনি কখনও। দুদিনে সুরাট ছেড়ে তিন লক্ষ মানুষ মাইগ্রেট করে। তারা মূলত এবং মাত্র পাঁচটি ভারতীয় রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গে রাজধানী শহর নয়াদিল্লিতেও। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রে ৪৮৮টি, গুজরাটে ৭৭টি, কর্নাটকে ৪৬টি, উত্তরপ্রদেশে ১০টি, মধ্যপ্রদেশে ৪টি এবং নয়াদিল্লিতে ৬৮টি কেস পাওয়া যায়। এছাড়া ভারতের অন্য কোনও রাজ্য থেকে অন্য কোনও রিপোর্ট নেই। এবং এই পাঁচটি রাজ্যই তখন হিন্দুত্বের বিষ্ফোরণের অপেক্ষায়। এখান দিয়ে অপ্রতিহত বিজয়রথ চালিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল বাজপেয়ী আদবানি জুটি।

 

একুশে সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ রাত থেকে সকলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এবং মেডিকেল স্টোরগুলি, হাসপাতাল থেকে খুব দ্রুত টেট্রাসাইক্লিন হাওয়া হয়ে যেতে শুরু করে। মানুষ এমনকি হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে শুরু করে শুধুমাত্র অন্যান্য অসুস্থ রোগীদের থেকে দূরে থাকার জন্য। এর পরবর্তী সময়ে ভারতের আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই প্লেগের এপিসেন্টার ছিল গুজরাটের সুরাট। ৫২জন মানুষ তাদের জীবন হারিয়েছিল এবং শহরের নাগরিকেরা আতঙ্কে দূরবর্তী পালাতে শুরু করে যাতে কোয়ারেন্টাইন হতে না হয়। যদিও প্লেগ মাত্র দুই সপ্তাহের সামান্য বেশি সময় স্থায়ী ছিল তবু এর প্রভাব ছিল বিপুল এবং তা যে প্যানিক সৃষ্টি করেছিল, ভারতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাব হয়েছিল ঋণাত্মক। ১৯৯৪ সালের এপিসোড ভারতবর্ষে স্মর্তব্য হয়ে থাকবে তার কারণ যে প্যানিক তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির মধ্যে সেই কারণে।

 

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ তারিখে ‘দ্য হিন্দু ইউনিভার্স’ পত্রিকার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণে পরিস্থিতি বর্ণনা করে। “ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলি থেকে পালিয়ে আসা লোকেরা সমস্ত দিকে এগিয়ে চলেছে এবং তাদের সাথে হিস্টিরিয়া নিয়ে চলেছে।” মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে প্লেগজনিত তিনজন ব্যক্তির সন্ধান পাওয়ার পরে, সেই শহরটিও আতঙ্কিত। প্লেগের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক টেট্রাসাইক্লিন কেবল মুম্বাইতেই নয়, দিল্লিতেও রসায়নবিদদের দোকান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সুরাতকে বিচ্ছিন্ন করা হবে এই সিদ্ধান্ত ছিল বিলম্বিত কেননা তখন সুরাতবাসীর এক-চতুর্থাংশ (৪০০,০০০ থেকে ৬০০,০০০ লোক) মহামারী ঘোষণার চার দিনের মধ্যেই শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে প্লেগ সংক্রমণের ইনকিউবেশন পর্বের লোকও ছিল। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কেনার আতঙ্কের কারণে শহরবাসী তখন ক্লান্ত। শহর থেকে পালিয়ে আসা চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্টরা তাদের বন্ধু এবং আত্মীয়দের জন্য প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন শহরে, রেলস্টেশন এবং বিমানবন্দরগুলিতে চেকপয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছিল আগত সুরাত বাসিন্দাদের নজরদারি করার জন্য। যারা তৎকালীন সময়ে চিকিৎসা পাচ্ছিলেন তাদেরকে পৃথক করা হয়েছিল। প্লেগ-সংক্রামিত লোকদের আগমনের জন্য আশেপাশের বেশ কয়েকটি শহরে হাসপাতালগুলিকে সতর্ক করা হয়েছিল। আধাসামরিক বাহিনীর সহায়তা নিতে হয়েছিল সরকারকে যাতে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে এই রোগ ছড়াতে বাধা দেওয়া যায়। যেহেতু প্লেগ ছিল পরিচিত রোগ এবং তা দ্রুত দমন করা হয়েছিল, ফলে এর প্রকোপটি প্রথমে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেনি। তবে বিশ্বব্যাপী এটি যথেষ্ট ভারী উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল যার ফলে দেশে ভারী অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। উত্তর ভারতে, দীপাবলিতে, আলোর উৎসব উদযাপন এবং ব্যবসা উভয়ের জন্য একটি সময়। প্লেগের প্রকোপটি উৎসবের ঠিক আগে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনে।

 

ভারতের অন্যান্য বড় শহরগুলি যেমন দিল্লি ও মু্ম্বাইয়ের উপরও বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। রাজধানী নয়াদিল্লিতে, কীভাবে এই রোগের বিস্তারকে মোকাবিলা করতে হবে সে সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে তথ্যের অভাবে সার্জিক্যাল মাস্ক ও টেট্রাসাইক্লাইন বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয়েছিল। সতর্কতা হিসাবে প্রশাসন সমস্ত স্কুল এবং পাবলিক বিনোদন স্থান বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। মহামারী এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত এই পদক্ষেপের খবরটি বহু মানুষকে আতঙ্কিত করে। কিছু লোক বাড়ির অভ্যন্তরে থাকাটা বেছে নিয়েছিল এবং অন্যরা যারা বাইরে বেরিয়েছিল তারা তাদের মুখ ঢাকতে মুখোশ ব্যবহার করে। কীভাবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সে বিষয়ে সরকারি আধিকারিকদের অনিশ্চয়তার চিত্র পরিষ্কার হয় যখন দিল্লির স্কুলগুলি বন্ধ হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন পরে পুনরায় চালু হয়।

 

পাশাপাশি ওড়িশার মতো পূর্বের রাজ্যগুলিতে, সুরাত থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে প্লেগের প্রকোপটি পরীক্ষা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। গুজরাটের সীমান্তবর্তী রাজস্থান থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গ্রামবাসীরা তাদের অঞ্চলে ইঁদুর হত্যা করার জন্য একটি নিবিড় অভিযান শুরু করেছিল। কীভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সে সম্পর্কে সঠিক নির্দেশ জনগণকে দেওয়া হয়নি। ২৩সেপ্টেম্বর, সুরাত কর্তৃপক্ষ একটি অনিশ্চিত সময়ের জন্য সমস্ত স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল, পার্ক বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। শিল্প ইউনিট, ব্যাংক, অফিস এবং হিরা কাটার ইউনিট পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সুরাটের বস্তিতে দ্রুত প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরা রুমাল দিয়ে ঢাকা মুখ নিয়ে রাস্তায় হাঁটত, এটি খুব কার্যকর পদ্ধতি ছিল না।

 

১৯৯৪ সালের প্লেগের ঘটনার এই বিস্তারিত উল্লেখ এই কারণে যে পদ্ধতিগত ভাবে এবং ভৌগোলিকভাবে ভারতে অন্ধকার গভীর গভীরতর হয়েছে। এক এক করে মিলিয়ে দেখুন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগের প্লেগ প্রতিরোধ আর আজকের করোনা প্রতিরোধ এর একটাই দাওয়াই সব স্তব্ধ করে প্রত্যেককে বিচ্ছিন্ন করে ফেলো। শুধুমাত্র বর্তমানে তার একটি গালভরা নাম হয়েছে লকডাউন (সৌজন্য: কাশ্মীর)। আক্রান্তের সংখ্যাবিচারে, সর্বোচ্চ তালিকায় সেই রাজ্যগুলিই রয়ে গেছে যা একদা প্লেগ আক্রান্তদের শহর ছিল। সেই মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং নয়াদিল্লি। অবশ্যই এবারে কেরালা, তেলেঙ্গানা, তামিলনাডু আর রাজস্থান সর্বোচ্চ তালিকায় উঠে এসেছে। সেদিন এক বন্ধু রসিকতা করে বলছিল, হিন্দুত্বের পুনরুত্থানের সঙ্গে মনে হয় অতিমারীর কোনও যোগ আছে।

 

দ্বিতীয়ত, যেহেতু মোদীভক্তরা তাঁর গুণকীর্তনের কোনও সুযোগ মিস করেন না, তাই তাঁরা বলতে শুরু করেছেন মোদীর সময়মতো পদক্ষেপেই, ভারতে এসে করোনা অশ্বমেধের ঘোড়ায় লাগাম পড়ানো গিয়েছে। সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলি যা পারেনি, ভারতবর্ষ তাই পেরেছে।একবারের জন্যও বলা হচ্ছে না ভারতবর্ষে করোনা টেস্ট হয়েছে কতজনের? নাকি যারা বিদেশফেরত অথবা ধুঁকতে ধুঁকতে হাসপাতালে পৌঁছে যায় শুধু তাদেরই পরীক্ষা হয়। মোদী এবং তাঁর বাহিনীর শুধু নয়, সারা বিশ্বেই অজ্ঞতা একটি আশীর্বাদ। নাহলে এটা মনে হতো ১৩৪ কোটির দেশে মাত্র ১০৭১ আক্রান্তের পিছনে মোদী ক্যারিশমা ছাড়াও অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে।

 

১৯৯৪ সালের প্লেগের প্রকোপে ভারতের অন্যতম প্রধান বাজার (কৃষি রফতানি) ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। এই ঘটনার ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়। একমাত্র রফতানি থেকে মোট লোকসানের ক্ষতি হয়েছিল ৪২০ মিলিয়ন ডলার। বিবিসি এবং সিএনএন মিডিয়া এজেন্সিগুলি প্লেগের পরিস্থিতি প্রকাশের পরে লন্ডনে গ্লোবাল ডিপোজিটরি ক্র্যাশ করে। স্থানীয় স্টক এক্সচেঞ্জে, কৃষি পণ্যের শেয়ারের মূল্য হ্রাস পায়। বর্তমান ভারতের অর্থনীতি এমনিতেই মোদী যশে বিধ্বস্ত। তাও গরুর গাড়ির হেডলাইট জ্বেলে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছিল, এবার সেটাও গেল। হাতে রইল শুধু পেন্সিল।

 

১৯৯৪ সালে ভারতে প্লেগের প্রকোপ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ব্ল্যাক ডেথের পর থেকে হঠাৎ করে রোগের ছড়িয়ে পড়ার স্মৃতি এখনও খুব শক্তিশালী। এর প্রাদুর্ভাবের মারাত্মক অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছিল। যদিও প্লেগের বিস্তারটি স্থানিক ও সাময়িক। তবু এত ক্ষতির পরেও আজ পর্যন্ত হু নিজেও নিশ্চিত কোনও প্রমাণ পায়নি এটা বলার যে রোগটা সত্যিই প্লেগ ছিল? আজ থেকে আরও পঁচিশ বছর পরে যদি আবিষ্কৃত হয় যে কোভিদ – ১৯ একটি মাত্র ভাইরাসের ফলোদ্ভূত ছিল না, বরং প্রাকৃতিক বিবর্তনে বহু দেশ, মহাদেশ, উপমহাদেশে তার চরিত্র ভিন্নতা ছিল, ততদিনে তো আমাদের স্যোশাল ফেব্রিক ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমাদের দেশজ অর্থনীতি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মানবিক সম্পর্কগুলি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আজ যে মানুষগুলি শুধুমাত্র নিজের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রতিবেশীর পরিবারকে ধ্বংস হতে দেখল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তাকে কোন বিবেচনায় কাল আমি রেয়াত করব সেটা আমার বিবেচনাধীন। সারা জীবন সার্ভিস দেবার পর যে বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে তার কুশলী পুত্র-কন্যা আনপ্রোডাক্টিভ বলে ছেড়ে যাচ্ছে নিজেদের হোম আইসোলেশনের ঘেরাটোপে, তার আনপ্রোডাক্টিভ পুত্র- কন্যাকে সমাজ কেন রেয়াত করবে? সমাজের নিচুতলায় যাদের রেখেছি, যারা সামান্য ক্ষুণ্ণিবৃত্তির প্রয়োজনে মাটির বুক চিরে ফসল ফলায়, আমাদের জীবনযাপনের প্রতি মুহূর্ত যাদের কাছে ঋণী, তারা আজ উপার্জনহীন, খাদ্য-বস্ত্র-কর্মহীন। প্রতিশোধ নেবে না? আমার সন্তানের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক গ্লাভস আর ঘরে বস্তা বস্তা খাদ্য মজুত। আর তাদের ঘরে উনোন না জ্বললে তারা কী মাস্ক আর গ্লাভস চিবোবে?

 

আমি মেডিকেল প্রাকটিশনার নই ফলে এ বিষয়ে চর্চার অনধিকারী। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত কিনা ডাক্তাররাই বলতে পারেন। আমিও পারি না, মোদীও পারে না, দিদিও না। ডাক্তারদের মধ্যেও মতদ্বৈধতা রয়েছে। হবে নাই বা কেন? একে তো এক এক দেশের প্রকোপ এক এক রকম। ডেথ রেট আর রিকভারী রেটের মধ্যেও বিপুল প্রভেদ। ৩৫টি কোম্পানি কিওর এবং তার পেটেন্টের জন্য দৌড়চ্ছে। যে আগে পৌঁছবে সে রাজা। পৃথিবী কেনার টাকা এক সিজনে জমবে তার ঘরে। কাল হু প্রকাশিত আফ্রিকার করোনা ম্যাপে চোখ বোলাচ্ছিলাম। হু-র আফ্রিকান রিজিয়নে কনফার্ম আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৩,২১৭। তার মধ্যে মৃত্যু মাত্র ৬০। তাদেরও অধিকাংশই অন্যান্য মহাদেশ থেকে পালিয়ে ঢুকে পড়া। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। কোনও দেশের হিসেব নয় গোটা মহাদেশে। তবু আফ্রিকা আলোচনায় নেই। অনেক তো হল। স্যোশাল মিডিয়ায় হিজ মাস্টার্স ভয়েস এর পুনঃপ্রচার করে। এবার একটু সুস্থ এবং মৌলিক আলোচনাও হোক। রাজনীতি যখন হচ্ছেই তখন তার আলোচনা হতেই বা বাধা কোথায়?

 

লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক।

 

Share this
Leave a Comment