ভাইরাস আক্রান্ত নব্য উদারপন্থা


  • March 28, 2020
  • (0 Comments)
  • 1428 Views

লকডাউনের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী অনেকবার তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। অনেক উদাহরণ দিয়েছেন এবং কোনো পরিস্থিতিতেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার ইচ্ছা লেখকের নেই। রাজ্যেও মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এইসব প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাচ্ছি, তবুও কিছু প্রশ্ন করতে হল। লিখেছেন ঝচীক

 

স্মৃতির সরণি বেয়ে যখন একবার তিন বছর আগের ঘটনার দিকে তাকাই তখন মনে পড়ে যায় মুম্বাই হাইকোর্টের সেই বিখ্যাত উক্তি, “যদি কাজ করতে ভয় পান তবে ঘরে থাকুন।” আজ পর্যাপ্ত পিপিই (Personal Protection Equipment) ছাড়াই চোয়াল শক্ত করে কাজে নেমে পড়েছেন ডাক্তাররা। ৫৬ ইঞ্চির ছাতি নেই কিন্তু মানবতাটা এখনো বিসর্জন দিতে পারেননি তাঁরা। গ্লাভস, মাস্ক, হ্যাজমেট, কভার অল সুটস – এইসবের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে আসছে দু-সপ্তাহে সুনামির আকার নিতে চলেছে করোনা। বিশ্বায়ন পরবর্তী বিশ্বে এই বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় আগে দেখা যায়নি। বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশেরাও আজ হিমশিম খাচ্ছে করোনা ঠেকাতে।

 

নব্যউদারপন্থী পৃথিবীর এই ভাইরাসও নব্যউদারপন্থা অবলম্বন করেছে। ব্যাঙ্ক, কর্পোরেট এবং বড় ব্যবসায়ীদের আর্থিক মন্দা থেকে মুক্ত করতে গিয়ে ক্যাপিটালিজম ভুলে গেছে তার প্রতিশ্রুতি। ফরাসি বিপ্লবের তিন প্রতিশ্রুতি – স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব। ডেনমার্ক ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ইউ কে ৪০০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক দপ্তরকে সহায়তা করছে। ট্রাম্পের ইউএসএ দিয়েছে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়াও বিভিন্ন কর্পোরেটকে তারা দিয়েছে ৭০০ বিলিয়ন ডলার কিন্তু বেকারত্ব দূর করার ক্ষেত্রে এর সিকিভাগ খরচ হয়নি। এর সমতুল্য টাকা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক উন্নতির খাতে খরচ হয়নি। স্ক্যান্ডিনিভিয়ান এয়ারলাইনস ১০,০০০ কর্মীকে ছাঁটাই করেছে এই করোনার প্রকোপে।

 

ইউকে মাত্র কিছুদিন আগে লকডাউন ঘোষণা করে। বরিস জনসন একে বলেছেন ভার্চুয়াল লকডাউন। সেখানকার রাজনীতিবিদদের বক্তব্য, “The virus mostly kills the old, ill, undernourished poor and we do not really care whether such unproductive people live or die.” অর্থনীতির এই যুক্তিকেই সামনে রেখে তাদের প্রশ্ন করা যায়, প্রতি বছর যখন লক্ষ লক্ষ ক্ষুধাতুর শিশু মারা যায় তখন আপনারা অর্থনীতির কথা ভেবে কেন খাদ্য সরবরাহ করেন না?

 

আমেরিকার চিত্রটা অন্যরকম। মানে ওই নতুন বোতলে পুরনো মদের গল্প। ৩০ মিলিয়ন আমেরিকাবাসীর কোনো স্বাস্থ্যবিমা নেই তাই তারা নিজেদের করোনা ভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করাতে পারছে না। ১০০ মিলিয়নের বিমা করানো থাকলেও তাতে প্রচুর ডিডিউসিবল আছে। তার সাথে “কো- পে” টাও কম নয়, তাই তারা ডাক্তার দেখাতে বা নিজেদের পরীক্ষা করাতে যাচ্ছে না। এখানেই শেষ নয় – পরীক্ষায় পজিটিভ এলে চাকরি হারাবার সম্ভাবনা রয়েছে। গত দু’সপ্তাহে আমেরিকায় বেকারত্বের পরিমাণ ঐতিহাসিক। আমেরিকার ইতিহাসে কোনোকালে এত মানুষ একসাথে চাকরি হারায়নি। অর্থনীতির চাকা শুধু থেমে যায়নি দেখা দিয়েছে ঋণাত্মক বৃদ্ধি। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ করতে গিয়ে ক্যাপিটালিজমের ভীষ্ম পিতামহ সেই দেশের নাগরিকদের শরসজ্জায় শুইয়ে দিয়েছে। সেই দেশে কোয়ারেন্টিনের আইন তো আছে কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা কে দেবে? এয়ারলাইন্স এবং পর্যটন কোম্পানিগুলোকে আয়করে ছাড় দিয়ে আমেরিকা আবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে ক্যাপিটালিজমের কাছে কার অগ্রাধিকার বেশি। আজ সেই দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে বাজারনীতি। মাস্ক, পরীক্ষার সামগ্রী, সব আজ যার কাছে পয়সা তার হাতে রয়েছে। আমিরেরা বিলাসবহুল জাহাজে, বাড়ির নীচে বানানো বাঙ্কারে আশ্রয় নিচ্ছে। মাস্কের দাম সেখানে প্রায় ১০০০ ডলার। চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছুই নেই। ট্রাম্পের নজর ছিল শুধু শেয়ার বাজার আর নির্বাচনের দিকে।

 

মার্চের ১১ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে প্যান্ডেমিক ঘোষণা করে। ফেব্রয়ারি ৭ তারিখ অসুখটি প্রথম দেখা দেয় আমেরিকাতে। মার্চের ৯ তারিখে ৫০০ জন আক্রান্ত হয় এবং ২২জন মারা যায়। ট্রাম্পের তাতেও টনক নড়ে না। নড়বেই বা কেন? তিনি তো বিজ্ঞান বিরোধী। বিশ্ব উষ্ণায়নকে তিনি বলেন ধাপ্পাবাজি। হ্যাঁ তাই তিনি বলেছিলেন ‘হোক্স’। তার কোভিড সম্বন্ধে বক্তব্য ছিল, “Risk is low to average Americans”। দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় মাইক পেন্সের হাতে। সেই পেন্স যার শাসনাধীন ইন্ডিয়ানাতে এইচআইভি মহামারী হয়। সিডিসির তরফ থেকে ১,৬০,০০০ টেস্টিং কিট বিতরণ করা হলেও মাত্র ২০০টি ব্যবহৃত হয়েছে। আজ ২৮মার্চ সকাল পর্যন্ত, আমেরিকাতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০৪২৫৬। ট্রাম্পের মূর্খামি না ক্যাপিটালিজমের নির্লজ্জতা, অমানবিকতা ও নৃশংসতা কাকে দায়ী করবেন এর জন্যে?

 

ভারতের কি আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল? ভারতের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে ঠিক কীরকম?

 

যেই দেশে প্রতি বছর ৮০,০০,০০০ মানুষ মারা যায়, ৪,০০,০০০ মানুষ শুধু টিবি তে মারা যায়, সরকার এতদিনেও সবার জন্য স্বাস্থের গুরুত্ব কেন বুঝতে চায় না ? ভারতের ৩৭% মানুষ নৈমিত্তিক শ্রমে যুক্ত। ৫৫% মানুষ দিনমজুর। ভাইরাসের আক্রমণের প্রকোপে প্রায় এক তৃতীয়াংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ। কর্মহীন ২০ লাখ মানুষ আর তাদের ২০ লক্ষ পরিবার। তারা আজ চায় “শুধু ভাত একটু নুন” সত্যি করোনা নব্য- উদারপন্থী। সে সত্যিই গরীবের মুখের ভাত কেড়ে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কোথাও এদের জন্য কোনো প্রকল্পের ঘোষণা ছিল না। কিছুদিন আগেই পাশ হয়ে গেছে ২০,০০০ কোটি টাকার দিল্লী পাওয়ার করিডোর রিভাম্প প্ল্যান। সজ্জিত হবে লোকসভা। কেরল সরকার ২০,০০০ কোটি টাকা করোনার মোকাবিলায় বরাদ্দ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

 

সে যাই হোক শুধু লকডাউন কি এই মহামারী সামলাতে সক্ষম? না। এর জন্য চাই আরো পরীক্ষা (টেস্ট)। মার্চের ২৭ তারিখ অবধি ভারতে ২৮০০০ জনের করোনার জন্য পরীক্ষা করা হয়েছে। ভারতে এই মুহূর্তে সার্টিফাইড ল্যাবের সংখ্যা ১২২। এর মধ্যে ১১৬টি সরকারি হলেও মাত্র ৮৯টি ল্যাবে পরীক্ষা করানো যাবে। ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে আশা করা যায়। এইবার বলব দক্ষিণ কোরিয়ার কথা যেইখানে রোজ প্রায় ১৭,০০০ মানুষের পরীক্ষা করা হচ্ছে অভিনব পদ্ধতিতে যেমন – “ড্রাইভ থ্রু টেস্টিং স্টেশন”, “টেলিফোন বুথ” এর মাধ্যমে। স্পেনের সরকার কিন্তু প্রথম দিন থেকেই তৎপরতা দেখিয়েছে। সেইখানে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫৭১৯। এইভাবে তারা বাগে আনতে চাইছে মহামারীকে। পিছিয়ে নেই তুরস্ক। ইরানের সীমান্তবর্তী এই দেশে আজ অবধি মৃতের সংখ্যা ৯২। তারাও এই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে। আইসল্যান্ড দেশের অর্ধেক নাগরিকের পরীক্ষা করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।

 

বিত্তমন্ত্রীর ঘোষণা করা প্রকল্প অপরিহার্য কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়। এই মুহূর্তে জিএসটি সংগ্রহ কম। ১০০ দিনের কাজের টাকা মানুষ তখনই পাবে যখন কাজ হবে। পিএম কিসান যোজনার ২০০০ টাকা যেটা অগ্রিম দেওয়া হচ্ছে সেইটা পরের অর্থবর্ষে কেটে নেওয়া হবে। মহিলাদের শুধু ৫০০ টাকা করে কেন ৩ মাস দেওয়া হবে? বাকি সমস্ত শ্রমিকদের কেন নয়?

 

ভারত সরকার অনুরোধ করেছে পুঁজিপতিদের সামনে এগিয়ে আসতে, সাহায্য করতে। যেই সরকার মুহূর্তের সিদ্ধান্তে ডিমনিটাইজেশন করতে পারে, একতরফা ৩৭০ ধারা ছিড়ে ফেলতে পারে, নাগরিক আইন পাশ করতে পারে তারা আজ কেন পুঁজিপতিদের অনুরোধ করবে? আদেশ কেন করবে না?

 

নব্যউদারপন্থার অন্যতম উপহার — শ্রেণিবিভাগ, জাত বিভাগ, ধর্ম বিভাগ। তাই আজ আমরা নির্বিকার চিত্তে বলতে পারি সোশ্যাল ডিসটান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব। একবারের জন্যেও ভাবলাম না শারীরিক দূরত্ব ও সামাজিক বন্ধন। ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ফিজিক্যাল ডিসটান্সিং অ্যান্ড সোশাল বন্ডিং।

 

একেই বলে নব্যউদারপন্থা আর এই পৃথিবীর ভাইরাসও আজ সেই নব্যউদারপন্থাই অবলম্বন করেছে।

 

লেখক গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী।

 

Share this
Leave a Comment