করোনার জের। পুরুলিয়ার শবরটোলায় খাদ্যাভাব। বিশেষ প্যাকেজের দাবি।


  • March 28, 2020
  • (1 Comments)
  • 2351 Views

পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার খেড়িয়া শবরদের জন্য বিশেষ ত্রাণের আবেদন জানাল পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি।  এই অত্যন্ত পশ্চাদপদ ভূমিহীন আদিবাসীদের পক্ষে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষিতে সরকার যে বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক পরিকল্পনাগুলি নিয়েছে তার সুযোগ যথাযথ ভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। দেবাশিস আইচের প্রতিবেদন।

 

পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার খেড়িয়া শবরদের জন্য বিশেষ ত্রাণের আবেদন জানাল পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা সেই আবেদন পত্রে বলা হয়েছে, এই অত্যন্ত পশ্চাদপদ ভূমিহীন আদিবাসীদের পক্ষে কোভিড -১৯ মহামারীর প্রেক্ষিতে সরকার যে বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক পরিকল্পনাগুলি নিয়েছে তার সুযোগ যথাযথ ভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় খেড়িয়া শবরমুখী বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে।

 

সমিতির অধিকর্তা প্রশান্ত রক্ষিত জানান, এই আদিবাসী মানুষদের সরকারি পরিকল্পনার সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নথি নেই। ফলত তারা বঞ্চিত হবেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি জানালেন, শবরদের অনেকেরই রেশন কার্ড আছে আবার অনেকেরই নেই। এছাড়া অনেক শবর যুবক ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে যান। মূলত তারা নির্মাণ শিল্পে কাজ করেন। কিন্তু অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক হলেও তাদের কারোরই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ হিসেবে কোনও পরিচয়পত্র নেই। স্বাভাবিক ভাবেই কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে আসা এই শ্রমিকরা সরকারি অনুদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।

 

শবর জনজাতি প্রধানত প্রাক কৃষিসভ্যতার আদিম জনজাতি। শিকার ও খাদ্যসংগ্রহই তাদের মূল জীবিকা। সমিতির সম্পাদক জলধর শবর জানান, বন লোপাট হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ শবরই কৃষিশ্রমিক ও দিনমজুর। অভাব ও অপুষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী।

অনেকেই জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। এখন বাজার বন্ধ। মাঠে কাজ বন্ধ। যারা সামান্য জমিতে সবজি চাষ করেছেন তা জলের দরে গ্রামেই বিলি করে দিতে হচ্ছে। সরকার পয়লা এপ্রিল থেকে বিনা পয়সায় বিশেষ রেশন ব্যবস্থা চালু করার ঘোষণা করেছে। জলধরবাবু বলেন, সে ব্যবস্থা চালু হলে এ যাত্রায় শবর বাঁঁচবে বটে তবে তা যথেষ্ট হবে না। তেল, নুনের সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও প্রয়োজন। উদাহরণ দিয়ে তিনি জানালেন, লটপদা গ্রামে জোড়গুলিতে (নদীর ক্ষীণ স্রোত) বালি-মাটির বাঁধ দিয়ে কোনও কোনও বাসিন্দা চুনোমাছ ধরে বিক্রি করছে। এক পলাশ পাতা মাছের দাম ১০ টাকা। এছাড়াও অনেক সহায়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ঝুড়গুন্ডা ঘাস, বাঁশ, খেজুর পাতার ঝাঁটা তৈরি করে জীবিকা অর্জন করেন। তাঁরাও মহাসঙ্কটে।

 

পুরুলিয়া জেলায় প্রায় ১২ হাজার খেড়িয়া শবরের বাস। পাহাড় থেকে সমতলে ১৬৪টি টোলায় ২৪৬০টি পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমনই টোলা ঘুরে ফিরে খবর নিয়ে এসেছেন সমিতির তরুণ স্বেচ্ছাসেবী ফটিক হেমব্রম। ফটিক জানালেন বান্দোয়ানের পাহাড়ি গ্রাম আমঝরনার শবরটোলায় কয়েকদিন আগে দু’সপ্তাহের রেশন একসঙ্গে মিলেছিল। ফলে আর দু’চারদিন সঙ্কট সামাল দেওয়া যাবে। টোলার অনেকে বর্ধমানে নামালে গিয়েছে। তাদের জানানো হয়েছে সেখানেই থাকতে। বান্দোয়ানের কুচিয়া পঞ্চায়েতের দুটি টোলার ন’জন শবর নারী-পুরুষও বর্ধমানের সাতগাছি-রানিহাটিতে ইটভাটায় কাজে গিয়েছেন। জানা গিয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত তাদের দায়িত্ব নিয়েছে। পুরুলিয়া কেন্দা গ্রাম পঞ্চায়েতের ব্যাঙথুপি ও কোনাপাড়া শবর গ্রামে পঞ্চায়েত ৩৬টি পরিবারকে সাড়ে পাঁচ কেজি করে চাল দিয়েছে। তবে, ফটিকও মনে করেন পরিস্থিতি সঙিন। মাঠে টমাটো, শসা, লাউ পড়ে আছে। পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সবজি পুরুলিয়া শহর তো বটেই ধানবাদ, রাঁচি, টাটার পাইকারি বাজারেও যায়। সব বন্ধ। সবজি একরকম বিনি পয়সায় বিলিয়ে দিতে হচ্ছে। মার্চের প্রথমে যে শসা ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা এখন তিন টাকাতেও বিকোচ্ছে না। এই অবস্থায় অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। ইতিমধ্যেই পুঞ্চা ব্লকের কৈরাটোলায় খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে বলে সমিতির অভিযোগ। সেখানে খাবার পৌঁছে দেওয়ার তোড়জোড় করা হচ্ছে বলে জানান প্রশান্তবাবু। এমত অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শবর কল্যাণ সমিতির নির্দিষ্ট দাবি, (এক) প্রত্যেক পরিবারকে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদান এবং (দুই) রেশনে চাল, আটার পাশাপাশি ডাল, তেল, চিনি, সাবান ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দেওয়া হোক।

 

সমিতির আর এক মাথাব্যথা গুজরাট, কেরালা থেকে ঘরে ফিরে আসা শ্রমিকরা। ইতিমধ্যেই সমিতির পক্ষ থেকে গ্রামে গ্রামে করোনা ভাইরাস বিষয়ে সচেতন করার জন্য প্রচার চালানো হয়েছে। ফিরে আসা শ্রমিকদের ১৪ দিন আলাদা থাকার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয়েছে। ফটিক জানান, প্রশাসন যথেষ্ট উদ্যোগী নয়। তারা ফিরে আসা শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু শারীরিক পরীক্ষা কিংবা ১৪ দিনের জন্য পৃথক থাকার ব্যবস্থা করছে না। সেই শ্রমিকরাও গ্রামে ঘুরেফিরে।বেড়াচ্ছে। বোঝাতে গেলে তারা জানিয়ে দিচ্ছে, প্রশাসন যখন জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে তখন অসুবিধা কোথায়? সমিতি মনে করে এই শ্রমিকদের যেহেতু বাড়িতে আলাদা থাকার মতো সংস্থান নেই, এদের জন্য কোনও স্কুল বাড়িতে কোয়ারান্টাইন সেন্টার খোলা জরুরি। শেষ খবর শনিবার বান্দোয়ানের পপ গ্রামের ছ’সাত জন শবর যুবক গুজরাত থেকে পুরুলিয়া শহরে পৌঁছন। এর পর তাঁরা পায়ে হেঁটেই ৬৫ কিলোমিটার দূরের বাড়ির দিকে রওনা হন। অভিযোগ, বান্দোয়ান থানার ওসিকে তাঁদের বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানালেও তিনি কর্ণপাত করেননি।

 

Share this