সবার নাটক, কষ্টের নাটক, এই সময়ের নাটক / কিস্তি ৩ – ‘মিছু মিছু’


  • March 24, 2020
  • (0 Comments)
  • 1294 Views

নাটক তার জন্মকাল থেকেই যেমন বিনোদনের মাধ্যম, তেমনই প্রতিবাদের মাধ্যম। এ দুটি রূপ যে একে অন্যের থেকে সবসময় আলাদা – তাও নয়। এই মুহূর্তে এনআরসি-সিএএ-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে (কিন্তু শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ থেকে নয়) চলছে বেশ কয়েকটি বাংলা নাটকের অভিনয়, যাতে বিনোদন আর প্রতিবাদ অদ্ভুতভাবে মিশে যাচ্ছে। এই নাটকগুলির বিষয় অনেকসময়ই শ্রম ও শ্রমজীবী মানুষ; তার একটা কারণ হয়তো এই যে এনআরসি-সিএএ-র ফলে সবচাইতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন এই মানুষরাই। নাটকগুলির অধিকাংশ অভিনয়ও হচ্ছে পথেঘাটে-হাটেবাজারে। এই লেখায় এরকম ছ’টি নাটকের কথা বলা হবে ছয় কিস্তিতে, যদিও সব মিলিয়ে এসময় যতগুলি নাটক তৈরি হয়েছে, হচ্ছে, তার সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। নাটকের রাস্তা আর রাস্তার নাটক এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে। ছাত্র-মেহনতী মানুষ-নাট্যকর্মী-রাজনৈতিক কর্মী পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাটক দেখছেন, করছেনও। হয়তো এইভাবে তাঁরা একে অন্যের দিনযাপনেও খানিকটা মিশে যেতেও চেষ্টা করছেন। আশাহীন সময়ের এই আলোর ঝলকগুলি নিয়ে লিখেছেন মধুশ্রী বসু

 

কিস্তি ১ (মধুসূদন দাদা) – এই লিঙ্কে 

কিস্তি ২ (ভুল রাস্তা) – এই লিঙ্কে

 

লোকে বলে, পচ্চিম দেশ, মানে বিদেশ থেকে এইচে। সাদাপানা, নীল অক্ত গলার কাছে চকচক করতিচে। দুটো পাকা আচে। উড়তে পারে অনেএএএএএক দূর দেশ পজ্জন্ত…”
না করোনাপোকা নয়। কম্মপোকা।
এর আবার ভ্যা
কচিন কি ? কিচু হলে তবে না তার ভ্যাকচিন ! এ তো  কিচু নয় ! এ তো মিছু মিছু !

 

মিছুমিছুরা কোথায় ছিল?

  

গল্পে পড়া যায় সমাজে, বিশেষ করে গাঁয়েগঞ্জে, কয়েক দশক আগেও এক-আধজন করে মাথা-পাগলা লোক থাকত। খালি পড়া কেন, স্বচক্ষে দেখেওছি। আমাদের ছোটবেলা অব্দি অন্তত শহরে বসেও দেখা যেত। ঘিলুতে জট পাকিয়ে যাওয়া একজন মানুষ – ন’দা বা রাণুমাসি বা হাঁদাকাকা – তারা হয়তো কারুর কাকা, মাসি কিম্বা দাদা নয়ই মোটে। তবু তাদের মাথার উপর একটা ছাদ রয়েছে, তিনবেলা ঠিক খেতে পায়। হয়তো রান্নাঘরে যোগালির কাজ করে বা থলি হাতে ফাইফরমাশ খাটতে বাজারে যায়। ঘুরে-ঘুরে পাঁচজনের কুশল প্রশ্ন করে, বা অনর্থক সময় জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করে।

 

হয়তো সবসময় নিজের উপর রোখটোক থাকে না, জামাকাপড়ের ঠিক থাকে না, ছোঁয়াছুঁয়ির হিসেব বা উচিত-অনুচিতের বিচার ঘেঁটে যায়, টাকাপয়সার গুনতি ভুল হয়, কাজের জায়গায় অকাজ করে, পরের ঘাড়ে চেপে পরের ভাত খায়, বাচ্চারা খেপালে ইঁট তুলে মারতে অব্দি যায়, কথা বলে বড্ড বেশি বা বড্ড কম।

 

হয়তো ঠিক তারকাটাও নয় – বেকার, রুগী, কুঁড়ে – যেন উৎপাদন চক্রের বাইরে লাট খাওয়া ল্যাজকাটা ঘুড়ি, তবু সমাজে তাদের মতন করে প্রতিষ্ঠিত। তাদের উপর অত্যাচার-অনাচার হত না এমনটা নয়। তবু খেটে খাওয়া সমাজ তাদের ঝেঁটিয়ে বার করে দেয়নি। ভিড় বাসের পিছনে ধাওয়া করা, রোজ লেট হওয়া বেকুব যাত্রীকে যখন একদল হাত যত্ন করে ফুটবোর্ডে তুলে নেয়, সেই মুহূর্তটির মতো, উপযোগিতা বিচার না করেই, এই মিছিমিছি মানুষগুলোকেও আমাদের কেজো সমাজ তার ঝাঁকে টেনে নিত।

 

মিছু মিছু – পার্ক সার্কাস

 

যেমন পাগলী মতি, চালকুমড়ো কাটা সদা, হেঁয়ালিবাজ গদাধর পণ্ডিত, বিধবা আহ্লাদীদের জড়িয়ে রেখেছিল কুসুমপুর গ্রাম। এই কুসুমপুরেরই খেটে খাওয়া, ঝাঁক বাঁধা, টেনেটুনে বেঁচেবর্তে থাকা সমাজের ছবি সহজ আদুরে রেখায় ফুটিয়ে তোলেন ‘প্রস্থান’ নাটক দলের অভিনেতারা, নাটক ‘মিছু মিছু’র প্রথম অঙ্কে। কিন্তু এত সহজ হলে সে কি কষ্টের নাটক হয়?

 

তাই আর কেউ না দেখলেও উনুনের আগুনের ভিতর মতি ঠিক দেখতে পায়, “কুসুমপুর জ্বলছে!”

 

নাটক ‘মিছু মিছু’

 

আলসে গাছের পাতার হাওয়ায় কুসুমপুর গ্রাম হয়ে উঠেছে এক হট্টমেলার দেশ – কাউকে পিছনে ফেলে না যাওয়ার দেশ, সবাইকে ঝাঁকে টেনে নেওয়ার দেশ, মানুষের ঘুম পেলে তাকে ঘুমোতে দিয়ে হাতে-হাতে তার কাজটুকু করে নেওয়ার দেশ।

 

কিন্তু সবদিন সমান যায় না। ঝাঁক ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যে যার নিজের পথ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষ ঝাঁক বাঁধে শুধুমাত্র শত্রু খুঁজতে। বহু বছর ধরে ঘোষিত নির্বিবাদী পাগলকে হঠাৎ সেয়ানা শয়তান বলে রাতের অন্ধকারে পিটিয়ে মারে পাড়ারই মানুষ। এত বড় সাহস! অকম্মা হয়ে দু’বেলা ভাত সাঁটানো! লাভের অংশে ভাগ বসানো!

 

কিকরে এমনটা হয়? কুসুমপুরে পশ্চিম দেশ থেকে উড়ে আসে সাদাপানা, গলার কাছে নীল রক্ত চকচক করা ঘিন্নুটে ভয়ানক কম্মপোকা। যার কামড় খেলে লোকে বলতে শুরু করে মানুষ মরে গেলে যাক, মনুষ্যত্ব হেজে গেলে যাক। যেকোনো মূল্যে চাই উৎপাদন, ফল, লাভ। সাফল্য আর ক্ষমতার বাইরে জগৎ মিথ্যা। বলতে শেখে, নিজের ক্ষমতা না হলে অন্যের ভালো করবে কিকরে? নিজে সফল না হলে অন্যকে সাফল্যের পথ দেখাবে কিকরে? হেরো বোকা ফালতু অকম্মারা কি পৃথিবীর মানে বোঝে? তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে?

 

মিছু মিছু – টাক হেং রেস্টুরেন্টের ছাদ

 

কার পৃথিবী? কোনদিকটা এগিয়ে যাবার দিক? কোভিড ১৯-এর এই সময়ে দাঁড়িয়ে, কম্মপোকার কামড়ের ফল কেমন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আমাদের ‘কেজো লোকের স্বর্গে’? যারা ঘরে বসে কাজ করলেও লাভের চক্র ঘুরবে, তারা নাহয় ঘরে বসেই সে চাকা ঘোরাক। কিন্তু যারা ঘরে থাকলে উৎপাদনের চাকা বন্ধ, তাদের ছুটি নেই। ছুটি দিলেও আরেক কাণ্ড। এমনিতেই দিনভর খাটুনি আর পিটুনি। কাজ বন্ধ হলে তখন আবার পেটের ভাতে টান।

 

কম্মপোকা এই ভাবে সব দিক থেকে ঘিরে ধরে কামড়ায়। কারণ তার ছকে দেওয়া সিস্টেমে না নিজের ভাত নিজে ফলিয়ে রাখবার অবসর আছে, না আছে ঘরে বসিয়ে খাওয়াবার রেওয়াজ। তাই কিছু অকম্মা যদি এই ফাঁকে ফৌত হয়, সবদিক দিয়েই মঙ্গল। আশ্চর্য এই, এত করেও জগতে অকম্মার অভাব হয় না।

 

এইভাবে, মিছিমিছি মানুষদের আমরা রোজ, প্রতিনিয়ত নির্বাসন দণ্ড দিয়ে যাই। কারণ কম্মপোকার কামড়ে ভালো বই মন্দ হয় না! হয় কুঁড়ে কেজো হয়, নয় তার ঘা বিষিয়ে ওঠে।

 

মিছু মিছু – প্রসেনিয়াম থিয়েটার

 

কুসুমপুরের মোড়ল তো ধমকেচমকে চালকুমড়ো সদা, বিধবা আহ্লাদী আর গদা পণ্ডিত – তিন আলসেকে গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিল কম্মপোকার কামড় খেতে। ওদিকে কম্মের ঠেলায় দ্রুত বইতে লাগল ভবিষ্যি বাতাস। চাষার গাঁ কুসুমপুর শিল্পবিপ্লব-টিপ্লব পেরিয়ে তিন আলসেকে উড়িয়ে নিয়ে সোজা হাজির হল একদম বর্তমান কালে, যেখানে ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট, রাষ্ট্র মানেই রাইট’; সত্যি মানে তার ঠাঁই ক্ষমতার চোরকুঠুরি, যেখানে তাকে জাঁতায় পিষে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে যেমন-খুশি নকল সত্যি তৈরি করেন হত্তাকত্তারা। নয়া-কুসুমপুরে – যেমন নয়া-ভারতবর্ষে – প্রমাণের আর কোনো মানে নেই, সব সত্যি।

 

মিছু মিছু – পার্ক সার্কাস

 

তবু মিথ্যে আছে। ক্ষমতার জাঁতা এড়িয়ে, যে এক-দু’টি সত্যি কথা সমাজের সামনে এসে দাঁড়ায়, কিছুতেই তামাদি হতে রাজি হয় না, তারাই এই দুনিয়ায় মিথ্যে নাম পায়। মানুষ হয় তাদের পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেয়, নয় ভিখিরির মতো খেদিয়ে দেয়, নয় দল বেঁধে রাতের অন্ধকারে সেয়ানা শয়তান বলে…

 

এখানেও শেষ নয় – ‘মিছু মিছু’-র রচয়িতারা বলেন। গত দেড়-দু’শতকে লেখা কল্পবিজ্ঞানের ভয়ানক সব গল্প যেমন আস্তে-আস্তে সত্যি হয়ে উঠছে, সেভাবেই কুসুমপুর এগিয়ে যেতে থাকে এক সর্বশক্তিমান সর্ববুদ্ধিমান অপরাজেয় ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিকল্পনার দিকে, যেখানে শোষণপীড়নের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।[1] শত্রু খুঁজতে হলেও যে ঝাঁকটুকু বাঁধবার প্রয়োজন – তাও আর নেই। প্রতিটি মানুষ একা – “এক ইলিউশনে ঘুরপাক খেতে থাকে, খেতে-খেতে ভুলেই যায় সে কথা।”

 

মিছু মিছু

 

মিছুমিছুরা কী খায়? 

 

‘এই সময়ের নাটক / কষ্টের নাটক’ নিয়ে যখন লেখার কথা প্রথম ভেবেছিলাম, তখনও দিল্লীর গণহত্যা হয়নি, করোনা আসেনি, মুকেশ সিংদের ফাঁসি হয়নি। অর্থাৎ এবছরের সন্ত্রাসের কোটা চালু হয়ে গেছে, কিন্তু পীক-এ পৌঁছয়নি।

 

এদিকে একেকটা নাটক নিয়ে লিখতে, যা ভেবেছিলাম তার চাইতে ঢের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমশ আমাদের প্রাসঙ্গিকতার মাপকাঠি হয়ে উঠছে (সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর কালে আরোই বেশি)। তাই যেকোনো নাটক, যেকোনো লেখা, যেকোনো অনুভূতির পক্ষেই ‘এই সময়ের’ হয়ে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে উঠছে। প্রতি দু’সপ্তাহে ঘটনার সমসাময়িকতার, প্রাসঙ্গিকতার দর বদলে যাচ্ছে।

 

কম্মপোকার দৌলতে, আমরা যা নিয়ে চর্চা করি সবেতেই সারাক্ষণ উপযোগিতা-প্রাসঙ্গিকতার লড়াই চলতে থাকে। সে বিজ্ঞান হোক বা শিল্পসাহিত্য, ইকোনমি হোক বা কালচার। এই মুহূর্তে হাতে গরম কাজে লাগলে তবেই জুটবে দানাপানি। কাজ মানে, হয় সরাসরি খেটেখুটে কাজ, নয়তো বড় প্রভুর আন্ডারে ছোট প্রভু হয়ে অন্যকে খাটাবার রাখার কাজ, আর নয়তো শত্রু খোঁজার কাজ। সত্যি শত্রু না থাকলে মিথ্যে করে, বাড়িয়েচড়িয়ে শত্রু নির্মাণ করা আর তাকে খতম করে বাহবা নির্মাণ করার কাজ। খালি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর হিন্দুত্ব নয়, এই আমাদের রোজকার জীবনদর্শন। যার যাতে হাতযশ, কখনো সে-ই তুলে নেয় সে কাজের ভার, কখনো আবার আমরা তাকে দিয়ে তুলিয়ে নিই।

 

মিছু মিছু – টাক হেং রেস্টুরেন্টের ছাদ

 

তাই চালকুমড়ো কাটা সদাকে দেওয়া হয় সমস্ত সন্দেহজনক মানুষকে পৃথিবী থেকে কাটিয়ে দেওয়ার কাজ। আর হেঁয়ালিবাজ গদাধর পণ্ডিতের দায়িত্ব হয় রাষ্ট্রের হয়ে মানুষের ভিতর সেই সন্দেহ ছড়িয়ে দেওয়া। যাতে পরস্পরকে যখন খুশি পৃথিবী থেকে, সমাজ থেকে, হৃদয় থেকে কাটিয়ে দেওয়ার কাজটা ক্রমশ সাধারণ মানুষ নিজের হাতেই তুলে নিতে পারে। এইভাবে লাগু হয় কম্মপোকা আর প্রভুর কানুন: মানুষ মরবে যত, খেয়েপরে বাঁচবে তত।

 

নাটক কোন কাজে লাগে? উপযোগিতা, প্রাসঙ্গিকতা, কর্মদক্ষতার বাজারিকরণের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে মনে হয়, নাটকের একটা মস্ত ‘উপযোগিতা’ এইখানে, যে তা এই উপযোগিতা বা প্রাসঙ্গিকতার লড়াইটাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে; উপযোগী হয়ে উঠবার লড়াইয়ে ক্লান্ত মানুষকে ছায়া দিতে পারে; ঘানিটানা উৎপাদন চক্রের বাইরেও যে একটা দুনিয়া আছে, সেই দুনিয়ার মানুষও যে এই সমাজেরই মানুষ, তার আভাস দিতে পারে। ‘মিছু মিছু’ নাটকে আলসে গাছের অনুষঙ্গটি যেমন।

 

নাটক আর কি পারে? রাষ্ট্র যখন ইতিহাস মুছে দেয়, বৈচিত্র্য মুছে দেয়, তখন নাটক তার স্মৃতিতে সেসব ধরে রাখতে পারে। মনে করিয়ে দিতে পারে, আজকের এই অবস্থাটা খালি আজকের নয়, আজকের দিনটা পার হয়ে গেলে সেটা বদলেও যাবে না। নাটক হতে পারে, মিছুমিছুদের অস্ত্র না হয়ে উঠবার অস্ত্র।

 

মিছু মিছু – প্রসেনিয়াম থিয়েটার

 

তাই মিছুমিছুদের আঁতুড় ঘরে টিপে মারাটা কম্মপোকাদের জন্য জরুরি। আর ঠিক সেই কারণে, যাঁরা চান সমাজটা অন্যরকম হোক, তাঁদের জন্য যত্ন নিয়ে নাটক দেখা, নাটক নিয়ে কথা বলা, নাটক করা বা করানোটা মিটিং-মিছিল করার পাশাপাশি একইরকম জরুরি হওয়ার কথা। অমুকবাদ তমুকইজম-এর সাথে-সাথে জানতে ইচ্ছে হওয়ার কথা, যে এইরকম একটা সময়ে এইসব অন্য ধরনের নাটকের দলগুলোর রুজিরোজগার কীভাবে চলে, তারা মহড়ার ঘর পায় কোথায়, কীভাবে তারা একে-অন্যকে ঠেকা দিয়ে নাটককে বাঁচিয়ে রাখে।

 

মূল কথা, নাটক কী, তার বিচার যেন প্রভুদের আইন মতো না হয়। রাস্তাতেই হোক বা ঘরে, নাটকের জীবনকাল যেন শো-এর ওই একটি ঘণ্টার মধ্যে আটকে থেকে না-আঁচাতেই শেষ না হয়ে যায়। কারণ নাটক মানে ফেসবুক পোস্ট নয়, প্রস্থান দলের কাছে নাটক মানুষে-মানুষে “সংযোগের ভাষা”।

 

মিছু মিছু

 

মিছুমিছুরা তবে কোন পথে যায়?

 

প্রস্থান দল জানায়, ‘মিছু মিছু’র চরিত্রগুলো উঠে এসেছে তাদের জীবন থেকে। যেমন চালকুমড়ো কাটা সদা। গ্রামবাংলায় মেয়েদের চালকুমড়ো কাটতে সংস্কারে বাধে। তাই সত্যি সেখানে এমন মানুষ রয়েছেন, যাঁরা আধুনিক বাজারে উপযোগিতার বিচারে হয়তো ডাহা ফেল, কিন্তু যাঁদের কাজই হল যে ঘরে সমত্থ পুরুষমানুষ নেই সেখানে চালকুমড়ো কেটে দিয়ে আসা।

 

এই তথ্যটাকে আমরা গেঁয়ো কুসংস্কার ছাপ্পা মেরে মুখ বেঁকাতে পারি। আবার তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে পারি, কীভাবে এই কাজটা এই মানুষটিকে সামাজিক উপযোগিতা দেয় – তার ভালমন্দ দিকগুলো কি কি। মুখ বেঁকানোর পথটা সহজ এবং তা বেশি সময় নেয় না। মানুষকে ফালতু মিছিমিছি বলে দাগিয়ে দিতে, তাকে ধর্তব্যের মধ্যে না ধরে বেমালুম ভুলে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। অন্য পথটার মুশকিল হল – ভীষণ সময়খাকী পথ। তার যত গভীরে ঢোকা যায়, শত্রু খুঁজে পাওয়া, অস্ত্র খুঁজে পাওয়া তত কঠিন হয়ে ওঠে।

 

তবে এটুকু আমরা বুঝি, যে মিছুমিছুদের আমরা যত দূরে ঠেলে দিই, প্রভুদের তত সুবিধা। প্রভুরা তাদের নাম লিখে নিয়ে, গায়ে উর্দি চড়িয়ে দিয়ে, দানাপানি দিয়ে, যত্ন করে হাতে বন্দুক তুলে দেয়। আমরা বুঝি, তবু কিছু করতে পারি না।

 

মিছু মিছু – পার্ক সার্কাস

 

আসলে আমাদেরও তো প্রার্থনা, আমরা যেন মিছিমিছিদের ঝাঁকে ভিড়ে না যাই। বেঁচে থাকতে-থাকতে যেন আমরা (শুধুমাত্র আমরাই) প্রভুদের চুল ধরে গিলোটিনের তলায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারি। আমাদের তাড়া আছে, ভয়ানক দরকারি সব প্ল্যান আছে, তাই আমাদের এই লড়াইয়ে আমরা অকম্মাদের দলে চাই না।

 

মিছু মিছু’ নাটকে বলে, “যারা হুকুম দেয়, তাদের গলাগুলো একইরকম।”

 

 

 

লেখক নাচ এবং লেখালেখি করেন।

 

 

[1] এই নাটকের জন্য, অ্যালডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়র্ল্ড, অরওয়েল-এর ১৯৮৪ ইত্যাদি বিভিন্ন ডিসটোপিয়ান নভেল নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে প্রস্থান দল।

Share this
Leave a Comment