বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা: আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী অপবিজ্ঞান বিরোধী এক হাতিয়ার


  • February 17, 2020
  • (0 Comments)
  • 5892 Views

গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি ছিল বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার ৬৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। জন্ম ৬ অক্টোবর, ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার শেওড়াতলী গ্রামে। জীবনের শুরুটা খুব সহজ তাঁর ছিল না। “নিচুজাত” হওয়ার কারণে বারবার তাঁকে চলার পথে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিজ্ঞান জগতে মেঘনাদ সাহার কি অবদান সে নিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালী মহলে আলাপআলোচনা থাকলেও তাকে ছাপিয়ে গিয়ে মানুষ মেঘনাদ সাহা, দার্শনিক মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে চর্চার পরিসর আজও অনুপস্থিত। লিখেছেন অনিমেষ দত্ত

 

 

‘এই সময়’ দৈনিক খবরের কাগজে ৫ই জানুয়ারী ২০১৫ সালে খবরটা দেখেই আঁতকে ওঠার জোগাড়। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১০২তম অধিবেশনে আমন্ত্রিত বক্তা ক্যাপ্টেন বোদাস বলেছেন, “ঋক বেদেই প্রাচীন বিমানের কথা উল্লেখ আছে।” তার মতে সাত হাজার বছর আগে মহর্ষি ভরদ্বাজ ‘বৈমানিক শাস্ত্র’ নামক গ্রন্থে এমন বিমানের কথা উল্লেখ করে গেছেন যা কেবল এক দেশ থেকে আর এক দেশে নয়, এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহেও পাড়ি দিতে পারত। প্রাচীন ভারতে যেসব বিমান চলত সেগুলি আকারে ছিল বিশাল এবং তার চল্লিশটি ইঞ্জিন থাকত। এমনকি সেই বিমানের প্রযুক্তি এতটাই উন্নত ছিল, যে মাঝ আকাশে একটি বিমানকে স্থিরভাবে ভাসিয়ে রাখাও সম্ভব হত”। বোদাস এখানেই থামলেন না, “স্থির হয়ে ভেসে থাকার পর বিমানটি আবার আকাশপথে যে কোনও দিকে রওনা দিতে পারত। এই বিমানে গরু বা হাতির মূত্রকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হত।” এই বিজ্ঞান অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর যিনি বোদাস-এর সঙ্গে এই বিষয়ে সহমত পোষন করেন। যিনি পরে উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী হন। এবার আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে সত্যিই কি প্রাচীন বৈদিক যুগে বিমান আবিষ্কার হয়েছিল? এখানে নতুন করে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না যে বিমান কবে কোথায় কীভাবে কারা আবিষ্কার করেছিলেন। স্কুলের পাঠ্যবইগুলিতে এই তথ্য সমস্ত পড়ুয়াদের পড়া হয়ে যায় মাধ্যমিকের আগেই। তাহলে এই প্রসঙ্গ কেন আনলাম? আরেকটু পিছনের দিকের একটা ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাই।

 

সাল ২০০১। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানা। তৎকালীন মানবশক্তি উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনকে (ইউজিসি) নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্নাতক স্তরে জ্যোতিষবিদ্যা চালু করা হয়। জ্যোতিষবিদ্যার আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এ কথা নতুন করে আবার বলার প্রয়োজনও বোধ করছি না। এবার আসছি মূল প্রসঙ্গে।

 

গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি ছিল বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার ৬৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি ঠেলে টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা যে মানুষটি আজও পথ দেখায় তিনি হলেন মেঘনাদ সাহা। জন্ম ৬ অক্টোবর, ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার শেওড়াতলী গ্রামে। জীবনের শুরুটা খুব সহজ তাঁর ছিল না। “নিচুজাত” হওয়ার কারণে বারবার তাঁকে চলার পথে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একই আসনে বসতে দেওয়া হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি প্রথম জীবনে একটা দুটো সরকারি বৃত্তির সুযোগ পেয়ে থাকলেও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় তিনি তাঁর প্রথম স্কুল ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলে ছাত্র হিসেবে যোগদান করেন। একই সাথে সবক’টি বৃত্তিও বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপরের যাবতীয় তথ্য উইকিপিডিয়ায় পাওয়া যায় তাই ‘জীবনী’ ভারে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। মূল বিষয়টা হচ্ছে মেঘনাদ সাহা এমন একটি সময়ের মানুষ যখন বাঙালী হিন্দু বাবুদের মধ্যে একটা ধরণের মনুবাদী হিন্দুত্বের দর্শন প্রভাব বিস্তার করছে। ‘প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি’ বা ‘ঐতিহ্য’কে তুলে ধরা অবশ্যম্ভাবী ছিল সে সময়। কারণ ইংরেজ ‘জাতি’ তাদের শ্রেষ্ঠ জাতি আকারে দাঁড় করিয়েছিল ‘ভারতীয়দের’ সামনে। তার পাল্টা হাতিয়ার হিসেবে দরকার ছিল একটা ‘ইতিহাস’-এর, দরকার ছিল সিম্বল-এর। সেই প্রয়োজন থেকেই ভারতের যা কিছু প্রাচীন তাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ ধরে নেওয়ার চেষ্টা সেকাল থেকেই। ইউরোপের রেনেসাঁর আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান কে নিকৃষ্ট প্রমাণ করতে প্রাচীন ভারতের বর্ণব্যবস্থা থেকে শুরু করে যা যা বস্তাপচা ধ্যানধারণা তাকেই জোরে উঁচিয়ে ধরতে হল। অথচ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ধারণার চর্চার বাইরেও বিজ্ঞানের চর্চা, বিশেষ করে প্রয়োগভিত্তিক বিজ্ঞানের চর্চা হত; তাকে চলমান বর্ণব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা থামিয়ে দিয়ে এবং শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের প্রভাবে দর্শনগত স্তরেও যুক্তিবাদের চর্চা সেখানেই শেষ করে দিয়ে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়। সেই হাজার বছর আগের বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজ বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাত ধরে আবার শুরু হয়। মেঘনাদ সাহা এই পথেরই একজন অগ্রভাগের সৈনিক। আরএসএস, হিন্দু মহাসভার মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির বিরোধী মানুষদের মধ্যেও মেঘনাদ সাহা একজন। বিজ্ঞান জগতে মেঘনাদ সাহার কি অবদান সে নিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালী মহলে আলাপ-আলোচনা থাকলেও তাকে ছাপিয়ে গিয়ে মানুষ মেঘনাদ সাহা, দার্শনিক মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে চর্চার পরিসর আজও অনুপস্থিত।

 

আমরা জানি ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক অনুষ্ঠানে, বিজ্ঞান অধিবেশনে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা আলটপকা অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা বলেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী যাদের মধ্যে সবথেকে উপরের স্থানে। বিজ্ঞান জানা বা না জানা অল্প শিক্ষিত সব ধরণের মানুষই স্যোশাল মিডিয়ায় ট্রোল করেছে, হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু চিন্তার বিষয় তখনই বোধ করি যখন আইআইটি বা বিজ্ঞান অধিবেশন-এর মতো জায়গায় কয়েকশো বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী, রিসার্চ-স্কলার, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিজ্ঞানীদের সামনে বুক ফুলিয়ে এই ধরনের অপবিজ্ঞান প্রচার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে আসে না কোনো প্রতিবাদ; উল্টে জোটে হাততালি। সাম্প্রতিক কিছু বিষয়ে কথা বলা যাক।

 

মৃণাল দাসগুপ্ত ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান আকাদেমীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী। উনি দাবি করেন, আজ আধুনিক বিজ্ঞান যে সমস্ত নতুন তত্ত্ব ও তথ্য প্রতিদিনই আবিষ্কার করছে, তার সবকিছুই নাকি প্রাচীনকালের মুনি-ঋষিরা বের করে গেছেন, ‘বেদ’এ নাকি সে সমস্ত আবিষ্কার ‘খুবই পরিষ্কারভাবে’ লিপিবদ্ধ আছে। মৃণাল দাসগুপ্তের ভাষায়, রবার্ট ওপেনহেইমারের মতো বিজ্ঞানীও নাকি ‘গীতা’র বিশ্বরূপ দর্শনে এতই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, ল্যাবরেটরিতে আণবিক শক্তির তেজ দেখে ‘গীতা’ থেকে আবৃত্তি করেছিলেন–

 

দিবি সূর্য্যসহস্রস্য ভবেদ যুগপদুত্থিতা।

যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ ভাসন্তস মহাত্মনঃ

 

বিজ্ঞান জানা কিছু শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবী আছেন যারা ভাবেন, আধুনিক বিজ্ঞান আজ যা আবিষ্কার করছে, তা সবই হিন্দু পুরাণগুলোতে লিপিবদ্ধ জ্ঞানের পুনরাবৃত্তি। রামকৃষ্ণ মিশন তাদের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’-এ বলা শুরু করেছে যে, ‘কৃষ্ণ গহ্বর’ কিংবা ‘সময় ধারণা’ নাকি মোটেই নতুন কিছু নয়। হিন্দুধর্ম নাকি অনেক আগেই এগুলো জানতে পেরেছিল। কীভাবে? ওই যে বহুল প্রচারিত সেই আপ্তবাক্যে, ‘ব্রহ্মার এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছরের সমান’।

 

কিছু ধর্মবাদীর দৃষ্টিতে, মহাভারতের কাল্পনিক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল আসলে এক ‘পারমাণবিক যুদ্ধ’ (Atomic War)। প্রশান্ত প্রামাণিক নামে ভারতের এক ‘জনপ্রিয়’ বিজ্ঞান লেখক ‘ভারতীয় দর্শনে আধুনিক বিজ্ঞান’ বইয়ে তার কল্পনার ফানুস মহেঞ্জোদারো পর্যন্ত টেনে নিয়ে বলেছেন– ‘সম্ভবত দুর্যোধনেরই কোনো মিত্রশক্তি পারমাণবিক যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে থাকবে মহেঞ্জোদারোতে’।

 

‘সবই ব্যাদে আছে’ মার্কা এইসব বকচ্ছপ ভাববাদীরা অবলীলায় দাবি করে ফেলেন যে, নলজাতক শিশু (Test Tube Baby) আর বিকল্প মা (Surrogate Mother) আধুনিক বিজ্ঞানের দান মনে করা হলেও তা হিন্দু সভ্যতার কাছে নাকি নতুন কিছু নয়। দ্রোণ-দ্রোণী, কৃপ-কৃপীর জন্মের পৌরাণিক কাহিনিগুলো তারই প্রমাণ। এমনকি কিছুদিন আগে উপসাগরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত স্কাড আর প্যাট্রিয়ট মিসাইল নাকি হিন্দু পুরাণে বর্ণিত ‘বরুণ বাণ’ আর ‘অগ্নিবাণ’ বই কিছু নয়। তারা সবকিছুতেই এমনতর মিল পেয়ে যান।

 

যেমনভাবে ভারতের ‘দেশ’-এর মতো প্রগতিশীল পত্রিকায় ২২ এপ্রিল, ১৯৯৫ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান ও ভগবান’ নিবন্ধের লেখক হৃষীকেশ সেন বেদান্তে বর্ণিত উর্ণনাভ বা মাকড়শার মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মডেলের মিল পেয়ে গেছেন। অনেকেরই হয়তো মনে আছে ২০১২ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখে সার্নের হিগস বোসনপ্রাপ্তির খবরের পর জি নিউজ সংবাদ পরিবেশন করেছিল এই শিরোনামে– ‘ইনসান খুঁজে পেল ভগবান’।

 

এ প্রসঙ্গে আবারও বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার (১৮৯৩-১৯৫৬), যিনি বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি অবদান রেখেছেন কুসংস্কার বিরোধিতাতেও, সেই বিখ্যাত ঘটনাতে ফিরে যেতে হবে। মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় মেঘনাদ সাহা ‘একটি নতুন জীবন দর্শন’ (১৩ নভেম্বর, ১৯৩৮) শিরোনামের একটি প্রবন্ধে, ‘সবই ব্যাদে আছ’ নামে একটি কটাক্ষমূলক উক্তি করেছিলেন। উক্তিটি নিয়ে অনিল বরণ রায় নামের এক হিন্দুত্ববাদী ব্যক্তি জলঘোলা করা শুরু করলে, এর ব্যাখ্যায় মেঘনাদ সাহা যা বললেন, তা এক কথায় মণিমাণিক্য–

 

“… প্রায় আঠারো বৎসর পূর্বেকার কথা। আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহরবাসী লব্ধপ্রতিষ্ঠিত এক উকিল আমি কী বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি উৎসাহভরে তাহাকে আমার প্রথম জীবনের তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে সবিশেষ বর্ণনা দিই। তিনি দু-এক মিনিট পরপরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, ‘‘এ আর নতুন কী হইল, এ সমস্তই ব্যাদ-এ আছে।’’

 

আমি দু’-একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, ‘‘মহাশয়, এ সব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে তাহা অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?’’

 

তিনি বলিলেন, ‘‘আমি তো ব্যাদ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবি কর, তাহা সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।’’

 

“বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসর ধরিয়া বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব নিহিত আছে।”

 

অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি স্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নতুন কী করিয়াছে? কিন্তু এই সমস্ত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চারিদিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে– এ কথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর এবং অপরাপর গ্রহের পরিভ্রমণ পথ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু, গ্রিক বা আরবি পণ্ডিত কেপলার, গ্যালিলিও বা নিউটনের বহু পূর্বেই মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এইরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছু নয়। …”

 

কিন্তু মুশকিল হল, হিন্দু সমাজে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার দর্শন নয়, অনিল বরণ রায়রাই দাপটে রাজত্ব করছেন, মাথার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন অবিরত। আর এদের মতো মানুষদেরই পিছনে দার্শনিক ভিত্তি জোগাচ্ছে আরএসএস।

 

পরিশেষে এটাই বলার যে এ প্রবন্ধের শিরোনামে হিন্দুত্ববাদী অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে হাতিয়ার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা বলার কারণ এটাই যে এমন একটা সময়ে আমরা বসবাস করছি যেখানে আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী দর্শন সমাজের ছত্রে ছত্রে সাংস্কৃতিক আধিপত্য লাভ করেছে। একটা সমাজের প্রগতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে সমাজে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বাতাবরণ কতটা উপস্থিত তার উপর। আর সেখানেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে অপবিজ্ঞানের চাষাবাদ। নতুন প্রজন্মের কাছে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ঠিক কতটা গ্রহণযোগ্য হবে বা আদৌ হবে কি না তা সন্দেহের বিষয়। অন্তত বাংলায় এক দশক আগে পর্যন্ত বিজ্ঞান আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা উপস্থিত ছিল। চর্চা ছিল। আজ তার পরিসরেও ভাটা। এরপর সিলেবাস থেকেই বাদ যাবে না তো মেঘনাদ সাহার নাম? বাদ গেলে আশ্চর্য হবো না। কিন্তু আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী অপবিজ্ঞানের বিরোধী, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো, প্রগতির পক্ষে দাঁড়ানো মানুষেরা কতটা প্রস্তুত মেঘনাদ সাহাকে হাতিয়ার হিসেবে রাখতে?

 

(তথ্য: অভিজিৎ রায়, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা)

 

অনিমেষ দত্ত ছাত্রছাত্রী আন্দোলনের কর্মী।

 

Share this
Leave a Comment