ওরা যে সব এই আকালেও স্বপ্ন দেখে


  • January 6, 2020
  • (0 Comments)
  • 787 Views

সুমন কল্যাণ মৌলিক লিখেছেন এক সাইকেল র‍্যালির কথা,যা ২০২২শে ডিসেম্বর (২০১৯) আহ্বান করা হয়েছিল আসানসোলদুর্গাপুর শিল্পাচলে। যখন এক চরম অগণতান্ত্রিক কর্পোরেটদের পদলেহী সরকার প্রতিদিন নিয়ম করে একটার পর একটা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে বিক্রি করে দিচ্ছে ,তখন বেসরকারিকরণ বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে, সকলের কাজের দাবিতে, শ্রমিক ছাঁটাই রুখতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এই প্রয়াস।

 

রমজান খান, দুগাউ মুরমু, উমেশ দুষাদ, সব্যসাচী নায়ক – এই নামগুলো ধর্মপরিচয়ে আলাদা, কিন্তু কঠোর জীবনযুদ্ধে, রুটি রুজির লড়াইয়ে এঁদের একটাই পরিচয় – এঁরা সবাই ঠিকা শ্রমিক। আরো নির্দিষ্ট করে বললে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা কোম্পানি ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের (ইসিএল) অধীনে বিভিন্ন কয়লাখনিতে এঁরা কাজ করেন। কয়লা শিল্পের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ঠিকা শ্রমিকদের নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করে না, কারণ তারা জানে ঠিকা শ্রমিকদের শোষণ করে যে মুনাফার পাহাড় গড়ে ওঠে, তার ছিটেফোঁটাই স্থায়ী শ্রমিকদের মেলে। আর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কাজকারবার যেহেতু স্থায়ী শ্রমিকদের নিয়ে, তাই তারাও এই অচলায়তনকে ভাঙতে চায় না। আবার বাস্তবতা হল নব্বই এর দশকে যে সংস্কার কার্যক্রম ভারতবর্ষে শুরু হয়েছে, তার বিধ্বংসী প্রভাব থেকে কয়লা শিল্পও মুক্ত থাকতে পারেনি। ১৯৯৩ সাল থেকেই কয়লা শিল্পকে ধাপে ধাপে ব্যক্তি পুঁজির হাতে তুলে দেবার ফলে ক্রমশ বন্ধ হয়েছে শ্রম নিবিড় মাটির তলায় খনি ও বেড়েছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কম সময়ে বেশি বেশি কয়লা তোলা যায় এমন খোলামুখ খনির সংখ্যা। যত বেশি বেসরকারিকরণ, তত দীর্ঘ হয়েছে ঠিকা শ্রমিকের সারি। এই ঠিকা শ্রমিকদের উপর বহুদিন ধরে চলত ঠিকাদারদের দাদাগিরি ও প্রধান নিয়োগকর্তা হিসেবে ইসিএল কখনোই তার দায়িত্ব পালন করতো না। ছাটাইয়ের খাঁড়া মাথায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরিতে এঁরা কাজ করতে বাধ্য থাকতেন। কিন্তু আসানসোল-রাণীগঞ্জ অঞ্চলে ছবিটা পাল্টাতে থাকে ২০০৬-এর পর থেকে। পরিচয়পত্র, বোনাস, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ঠিকা শ্রমিকরা, তৈরি হয় ইসিএল ঠিকা শ্রমিক অধিকার ইউনিয়ন।

 

শ্রমিকদের রোজগার লড়াইয়ের সালতামামি প্রস্তুত করা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। বরং তুলে ধরবো এক সাইকেল র‍্যালির কথা যা এই অধিকার সংগঠনের পক্ষে ২০-২২ ডিসেম্বর (২০১৯) আহ্বান করা হয়েছিল। যখন ছদ্ম দেশপ্রেমের ধব্জাধারী এক চরম অগণতান্ত্রিক ও কর্পোরেটদের পদলেহী সরকার প্রতিদিন নিয়ম করে একটার পর একটা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে বিক্রি করে দিচ্ছে, তখন বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে, সকলের কাজের দাবিতে, শ্রমিক ছাঁটাই রুখতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তাদের এই প্রয়াস। শ্রমিকদের কথায়, “আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ বিদেশী পুঁজি নিয়োগের অনুমতি দিয়েছে সরকার। শ্রমআইন সংস্কারের মাধ্যমে মালিকদের হাতে আরো বেশি ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা তুলে দিতে চাইছে সরকার। এ অবস্থায় লড়াই ছাড়া পথ নেই।” অবশ্য আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাচলে বন্ধ কারখানার শ্রমিক সংখ্যা হয়েছে ৫০ হাজারের উপর। তাই জনবিরোধী এইসব নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হলে প্রয়োজন মেহনতি মানুষকে সচেতন করা, সেই লক্ষ্যেই অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে এই সাইকেল র‍্যালির আয়োজন। তবে এ যাত্রায় শুধু কয়লা খনির ঠিকা শ্রমিকরাই ছিলেন না। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থেকেছে অল ওয়েস্ট বেঙ্গল সেলস রিপ্রেজেনটিটিভ ইউনিইয়ন ও সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন।

 

এই যাত্রার প্রাক মুহূর্তে শ্রমজীবী মানুষদের উপর সরকারের আঘাত অন্যভাবেও নেমেছে। এনআরসি, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ন্যাশানাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার প্রভৃতি কর্মসূচির একটাই লক্ষ্য – তা হল, শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে বিপন্ন করা। অধিকার সংগঠন তাই তাদের প্রচারপত্রে বলেছে – “নাগরিক সংশোধনী আইন (২০১৯) বাতিল কর। বিভাজনের রাজনীতি রুখে দিতে, উচ্ছেদ লুট ও সস্তার শ্রম যোগানোর হাতিয়ার NRC রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।”

 

রমজান, উমেশরা মনে করেন, ক্রমাগত বেড়ে চলা দারিদ্র, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই দুর্বল করতে হিন্দু মুসলিম, বাঙ্গালি-অসমিয়া, নিচুজাত-উঁচুজাতের বিভাজনের রাজনীতি আমদানি করছে মোদী সরকার। ওঁদের ধারণা, এই সরকার জেলখানায় ঢোকানো মুসলিমদের ও শরণার্থী শিবিরে সব হারানো অসহায় মানুষদের খেতে দেবার বিনিময়ে দেশি বিদেশি কোম্পানির বিনা পয়সার শ্রমিকে পরিণত করবে।

 

২০ ডিসেম্বর দুর্গাপুর গ্যামনব্রিজ থেকে লাল পতাকায় সজ্জিত হয়ে এই সাইকেল র‍্যালির শুরু। তারপর মায়াবাজার, এএসপি মেইনগেট, অন্ডাল মোড়, কাজোড়া হয়ে সিঁদুলিতে প্রথমদিনের যাত্রা শেষ। রুগ্ন কারখানা থেকে কোলিয়ারি এলাকা – বেশ কয়েক জায়গায় ঠিকা শ্রমিকরা পথসভা করেছেন, মানুষের কাছে প্রচারপত্র বিলি করেছেন। ২১ ডিসেম্বর মূলত কোলিয়ারি এলাকায় প্রচার হয়েছে, সঙ্গে ছিল সুসজ্জিত ট্যাবলো। হরিপুর, চাকদলা, পাঞ্জাবি মোড়, সাতগ্রাম, নরসুদা, ডিসেরগড় এবং শেষে চিত্তরঞ্জন। ২২ ডিসেম্বর আসানসোলের আশ্রম মোড় থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে মিছিল যায় শহরের প্রাণকেন্দ্র বি.এন.আর মোড়ে। সেখানে মিছিলকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন আসানসোল সিভিল রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের বন্ধুরা। সভা করে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রচার অভিযানের সমাপ্তি হয়। সাংগঠনিক আকার বড় না হলেও প্রতিকূল আবহাওয়া ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অতিক্রম করে আসানসোল দুর্গাপুর অঞ্চলের কয়লাখনির ঠিকা শ্রমিকরা এই আকালে যে উদাহরণ স্থাপন করলেন, তা বহু অভিনন্দন যোগ্য।

 

 

 

লেখক স্কুলশিক্ষক  গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী 

Share this
Leave a Comment