রামধনু গরিমা মিছিলে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরূদ্ধে লড়াইয়ের আওয়াজ


  • December 30, 2019
  • (0 Comments)
  • 1409 Views

কলকাতা রেইনবো প্রাইড ওয়াক এ বছর হল উত্তর কলকাতার মহঃ আলি পার্ক থেকে বাগবাজার পর্যন্ত। অবমাননাকর ট্রান্সজেন্ডার বিল পাশ হয়ে যাওয়া, এন আর সি, সি এ এ নিয়ে দেশজোড়া বিক্ষোভের মাঝে এই উদ্‌যাপনও লড়াইয়েরই বার্তা দিল, চোখ টানা পোস্টারটির মতোই – ‘শাড়ি, জামা খুলব না/ডকুমেন্টস দেখাবো না’। সব লড়াই-ই যে আসলে মানুষের সম্মানের লড়াই। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী 

 

 

বছর শেষের রবিবারে কলকাতা সাক্ষী থাকল এক অন্য রকম উষ্ণতার। উত্তর কলকাতার শীত দুপুরের নির্জনতা ভেঙে গেল ‘হাম কেয়া চাহ্‌তে? আজাদি!’, ‘এন আর সি মানছি না’, ‘মেয়ে মেয়েতে চুমু খেয়েছে/ছেলে ছেলেতে চুমু খেয়েছে/বেশ করেছে বেশ করেছে’ স্লোগান-এ। রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের পরিচিতির উদ্‌যাপন আর মৌলিক অধিকারের দাবিগুলি নিয়ে কলকাতা রেইনবো প্রাইড ওয়াক এ বছর হল উত্তর কলকাতার মহঃ আলি পার্ক থেকে বাগবাজার পর্যন্ত। রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের নিয়ে সামাজিকভাবে যে ট্যাবু, যে ছুঁৎমার্গ তা ভাঙতেই এবার বেছে নেওয়া উত্তর কলকাতার তুলনামূলকভাবে কিঞ্চিৎ রক্ষণশীল প্রতিবেশ। নিশ্চিতভাবেই পথচলতি মানুষ, কাজের সূত্রে এ শহরে থেকে যাওয়া ভিন্‌রাজ্যের মানুষ, অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দারা যে উৎসাহ নিয়ে রাস্তার দু’ধার, বাড়ির ছাদ-বারান্দা থেকে ভিড় করে এই রামধনু রঙা মিছিল দেখেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন – তাতে বোঝা যায় দূরত্ব সত্যিই ক্রমশ কমছে।

 

তবে এই গরিমা যাত্রা ব্যতিক্রমী হয়ে থাকবে আরও একটি কারণে। শুধু রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষেরা তাঁদের অধিকারের দাবিই তুললেন না এই মিছিলে, স্পষ্টভাবেই আওয়াজ উঠল এই দেশের হিন্দুত্ববাদী, ফ্যাসিস্ত সরকারের বিরূদ্ধে। যে সরকার এন আর সি, সি এ এ দিয়ে দেশের মানুষকেই দেশছাড়া করার ষড়যন্ত্র করছে সেই সরকারের প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ্‌-র বিরূদ্ধে একটানা স্লোগান চলল মিছিল জুড়ে। পোস্টার, ব্যানার-এ যেমন সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের পরিচিতির কথা লেখা ছিল, তেমনি অসংখ্য পোস্টার-এ লেখা হয়েছিল সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরূদ্ধে বার্তা। এ বছরের প্রাইড ওয়াক তাই প্রমাণ করছে যা কিছু ব্যক্তিগত, তাই রাজনৈতিক।

Kolkata Rainbow Pride Walk, 2019. Picture courtesy: Panchali Kar.

এই মিছিল ছুঁয়ে যাচ্ছিল যাত্রাপথের উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলি, যা কলকাতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সেই জায়গাগুলিতে থেমে গিয়ে যেমন হচ্ছিল নাচ-গান-কবিতার পারফর্ম্যান্স, তেমনি কেন জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সে কথাও। মিছিল যখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সামনে তখন রামধনু রঙা পতাকা হাওয়ায় উড়িয়ে গান বেজে উঠল – ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ প্রাইড ওয়াক-এ এ এক বিরল মুহূর্ত। মিছিল যখন প্রবল উৎসাহে চলতে শুরু করল, সঙ্গে গান বাজছে – ‘বাঁধ ভেঙে দাও।’

 

লিবার্টি সিনেমা হল-এর সামনে দাঁড়িয়ে গানে, নাচে, ভালবাসার সীমারেখা পেরিয়ে সমপ্রেমকে বিসমপ্রেমের মতোই স্বাভাবিকভাবে দেখার কথা ভেসে এল। আর সিনেমা হল যখন, তখন কি আর বাদ দেওয়া যায় কলকাতার প্রিয়তম ঋতুপর্ণ ঘোষের নাম! লিবার্টি সিনেমা হল-এর সামনে তাই সমপ্রেম, রূপান্তরকামী সত্তা এই সবের সগর্ব উচ্ছাস উঠে এল ঋতুপর্ণ-র প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়।

Kolkata Rainbow Pride Walk, 2019. Picture courtesy: Panchali Kar.

ধীরে ধীরে মিছিল যখন এগিয়ে চলেছে তখন ক্রমশই পুরনো বাঙালি পাড়ার সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এক মিশ্র সংস্কৃতির কলকাতার ছবি। যেখানে নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা রাজ্যের মানুষ বসতি গড়ে তুলেছেন বছরের পর বছর ধরে। এ শহর তাদের আপন। তাই রঙীন এই মিছিলের প্রতি কৌতুহল ভরে তাকানো, মোবাইল ফোন-এ ছবি তোলার পাশাপাশি ছিল এই মিছিলের মানুষদের প্রতি সমর্থনের সুরও। এমনকি নানা বয়সের মানুষকে মিছিলে বাজতে থাকা গানের সুরে নেচে উঠতেও দেখা গেল।

 

মিছিল যখন এসে পৌঁছল শোভাবাজারে একসঙ্গে আওয়াজ উঠল – ‘গতর খাটিয়ে খাই/শ্রমিকের মর্যাদা চাই’, ‘যৌনকাজ একটি কাজ’। সোনাগাছি এলাকার অসংখ্য মহিলা, পুরুষ, রূপান্তরকামী যৌনকর্মী সাথীদের প্রতি সহযোদ্ধাদের সমর্থন উঠে এল মিছিলের প্রত্যেকটি কন্ঠ থেকে। এলাকার যে যৌনকর্মীরা তখন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন শেষ দুপুরের আলোয় তাদের চোখেও যেন একজোট লড়াইয়ের আশ্বাস। সেখানে দাঁড়িয়েও নাচে, গানে ভালবাসার বার্তা গেল। মিছিল দেখতে আসা এক যৌনকর্মীর কাছে জানতে চাওয়া গেল এমন মিছিল আগে দেখেছেন না কি? উত্তরে বললেন, “আমরা মাঝেমাঝে মিছিল করি, তবে এমন মিছিল আমি আগে দেখিনি। এরা সবাই পথে নেমেছেন, আমাদের কথা-ও বলছেন, আমার খুব ভালো লাগছে।”

Kolkata Rainbow Pride Walk, 2019. Picture courtesy: Panchali Kar.

পোশাকে, প্রসাধনে নজর কাড়ছিলেন দীপঙ্কর/কোমলজিৎ। জানালেন এটিই তার প্রথম প্রাইড ওয়াক। “খুব ভালো লাগছে। এত সুন্দর করে সেজে আসতে পেরেছি আমি। সবার সঙ্গে রাস্তায় হাঁটছি। জোড়াসাঁকোর উপর দিয়ে আসতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, আমার ছোটবেলার কথা। যখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নাচতাম। আজ এত বছর পর সেই স্মৃতি ফিরে এল।” তন্ময় আর উদ্দীপ্ত বেশি উৎসাহিত ছিলেন উত্তর কলকাতার রাজপথে হেঁটে। দু’জনেই বললেন, “অনেক সাহস নিয়ে আজকে এসেছি। আসলে তো আমরা সবাই এক। কোনও ভেদাভদ কেন মানব? ট্রান্সজেন্ডার বিল হোক বা এন আর সি – মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা কোনও কিছুই ভালো নয়। সব মানুষের জন্য সম্মানের দাবি জানাই আমরা।”

 

রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের বাইরেও বহু মানুষ এই মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। কারণ এই মিছিল আর শুধুই পরিচিতির লাড়াইয়ের বৃত্তে আটকে নেই। নাচের দলের সঙ্গে পারফর্ম করতে আসা এক কিশোরীর সঙ্গে যেমন মিছিলে পথ হাঁটছিলেন তার প্রৌঢ় মা, বাবা। কেন তাদের এনেছেন জানতে চাওয়ায় কিশোরীর হাসিমুখ উত্তর – “আমার নাচ দেখতে এসেছেন, আর তাছাড়া আমার মা, বাবা লিবারেল।” মূক, বধির অংশগ্রহণকারীদের কথা মাথায় রেখে ছিলেন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রেটার-ও।

Kolkata Rainbow Pride Walk, 2019. Picture courtesy: Sudarshana Chakraborty

মহঃ আক্রম যাচ্ছিলেন শ্বশুরবাড়ি, উত্তর কলকাতারই বাসিন্দা। মিছিল দেখে তার সঙ্গে জুটে গেছেন। কেন? “কারণ এই মিছিল দেশের জন্য হচ্ছে। এন আর সি, সি এ এ-এর মতো কালা কানুন দেশকে ছারখার করে দেবে। এরা এই মিছিলে এর বিরোধীতা করছেন। এই তরুণরাই তো আমাদের ভবিষ্যত। দেখে মনে হচ্ছে কলেজ, ইউনিভার্সিটি-তে পড়ে। কিন্নর মানুষেরাও আছে। সবাই জোটবদ্ধ হয়ে এরকম লড়াইয়ে পথে নামলেই দেশ বাঁচবে,” বললেন তিনি। আক্রম হয়তো প্রাইড ওয়াক জানেন না। কিন্তু এই ওয়াক যে বৃহত্তর বার্তা দিতে পারছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

 

মৈনাক রাজ্যের বাইরে থাকেন পড়াশোনার সূত্রে। তুতো বোনের সঙ্গে মিছিলে এসেছেন। রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের প্রতি সমর্থন তো আছেই তবে তারই সঙ্গে এই মিছিল থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরূদ্ধে যে বার্তা যাচ্ছে তাতে শরিক হতেও মিছিলে পা মেলানো। “এন আর সি হলে বহু রূপান্তরকামী মানুষ নথি দেখাতে পারবেন না। অসমে ইতিমধ্যেই তেমনটা ঘটেছে। তাদের নাগরিকত্ব নিমেষে বাতিল হয়ে যাবে। এটা মানা যায় না। এই সরকার স্বেচ্ছাচারী। মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। এর বিরূদ্ধে আমাদের একসঙ্গে লড়তেই হবে। এই মিছিলে এসে একজন তরুণ হিসাবে আমার আবার দেশের তরুণদের ক্ষমতার প্রতি আস্থা ফিরে আসছে।”

Kolkata Rainbow Pride Walk, 2019. Picture courtesy: Sudarshana Chakraborty

আসল নাম নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিত নামে দেবী রায় জানালেন বহু বছর ধরেই তিনি রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের সঙ্গে রয়েছেন। প্রৌঢ় মানুষটি সমকামী হিসাবে পরিচয় দিলেন। তবে তার পোস্টারে সরাসরি ফ্যাসিজম-কে ধ্বংস করার বার্তা। তার কাছে এই ওয়াক দু’টি কারণে উল্লেখযোগ্য হয়ে রইল, “উত্তর কলকাতা কিছুটা রক্ষণশীল। সেখানে এই মিছিল করে সামাজিক ট্যাবু ভাঙার চেষ্টা প্রসংসার যোগ্য। দ্বিতীয়ত আজকের ভারতে সব লড়াইয়ের অভিমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরূদ্ধে হওয়া দরকার। যৌন ও লিঙ্গ পরিচিতির যে উদ্‌যাপন, অধিকারের যে দাবি তাতেও যেন সেই লড়াইয়ের বার্তা থাকে। এবারের মিছিলে তা দারুণভাবে ফুটে উঠছে। যত বেশি এই বার্তা সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছবে ততই লড়াই মজবুত হবে,” বক্তব্য তার।

Kolkata Rainbow Pride Walk, 2019. Picture courtesy: Panchali Kar.

মিছিলে বিরাট রামধনু পতাকার পাশেই উজ্জ্বল নীল রঙের জয় ভীম লেখা পতাকা। যেন এই মিছিল, সেই মিছিল, সব মিছিল দিচ্ছে ডাক এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের। অবমাননাকর ট্রান্সজেন্ডার বিল পাশ হয়ে যাওয়া, এন আর সি, সি এ এ নিয়ে দেশজোড়া বিক্ষোভের মাঝে এই উদ্‌যাপনও লড়াইয়েরই বার্তা দেয়, চোখ টানা পোস্টারটির মতোই – ‘শাড়ি, জামা খুলব না/ডকুমেন্টস দেখাবো না’। সব লড়াই-ই যে আসলে মানুষের সম্মানের লড়াই।

 

লেখক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক 

 

Share this
Leave a Comment