কারখানার দূষণ প্রতিরোধে আন্দোলনে নালিকুল


  • November 8, 2019
  • (0 Comments)
  • 2639 Views

হুগলির নালিকূলে ওয়াক্স সেটিং কারখানার ভয়ঙ্কর দুষণ নিয়ে গত কয়দিন রে শোরগোল চলছে অ্যাসিড ব্যবহার রে ধাতু গলিয়ে কাস্টিঙের কাজ চলার জন্য মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছে এলাকার বাতাসে আরোহণ বল-এর রিপোর্ট।

 

 “পুলিশ কি আর আমাদের জন্য! মালিকের থুতু দিয়ে গোনা টাকা হাতে নিয়ে ফেলেছে তো”, বাড়ির সামনে ভাঙা কংক্রিট, রাবিশের উঠোনে ব’সে বলছিলেন সুষ্মিতার ঠাকুমা।

 

হুগলি জেলার নালিকুল পূর্ব গ্রাম পঞ্চায়েতের বড়গাছিয়ায় ১২ নং রোডের ধারে বাঁধের বসতি। সব মিলিয়ে ৩০-৩৫ ঘর পরিবারের বাস। কেউ রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন, কেউ মাঠে খাটেন, কেউ বাড়িতেই ঠোঙা বানান বা গেঞ্জিসুতো পাকান। বেশিরভাগই দিনমজুর। বাড়ির ছেলে, বউ প্রত্যেককেই উদয়াস্ত খেটে রোজগার করতে হয়। আধ ছটাক জমিও কারোও নেই। মাথা গোঁজার ঘরও খাসজমির ওপর। এর মধ্যেই বাঁধের বাচ্চারা বড় হচ্ছে। তবুও খাটুনির রোজগারে শখ-আহ্লাদ ভুলে সংসার চলে যায় টেনেটুনে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা-র মত এসে জুটেছে শ্বাসের টান, চামড়ার রোগ। একবছরের শিশু থেকে বুড়ো-বুড়ি, বিষ হাওয়ায় ভুগছে কমবেশি প্রত্যেকেই।

 

বড়গাছিয়া বাঁধ এলাকায় ওয়াক্স (মোম) সেটিং কারখানা থেকে ভয়ঙ্কর দূষণ ছড়াচ্ছে। নালিকুল পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট ১৫টা এই ধরণের কারখানা রয়েছে ব’লে জানাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা। শুধু বাঁধসংলগ্ন এলাকাতেই রয়েছে তিনটে ওয়াক্স সেটিং কারখানা। কারখানাতে ওয়াক্স সেটিং ও মেটাল কাস্টিঙের কাজ চলে। ওয়াক্স সেটিং হচ্ছে গয়না নির্মান শিল্পে ব্যবহৃত পদ্ধতি যাতে মোমজাতীয় পদার্থ ব্যবহার ক’রে ধাতুর তৈরি গয়নায় রঙিন পাথর বসিয়ে সুদৃশ্য রূপ দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে সস্তায়, স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক খাটিয়েই একই ডিজাইনের প্রচুর ইমিটেশনের গয়না তৈরি করা যায় ব’লে গয়না শিল্পের কর্ণধারদের কাছে এই পদ্ধতি বেশ লাভজনক। গয়না তৈরির ধাতু গলাতে ব্যবহার হয় মেটাল কাস্টিং পদ্ধতি। বোরিক অ্যাসিড, সোডিয়াম ক্লোরাইড, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ইত্যাদি রাসায়নিক ব্যবহার ক’রে ধাতু গলানোর কাজ হয়। মেটাল কাস্টিং ও ওয়াক্স সেটিং থেকে ছড়ায় ভয়ঙ্কর দূষণ। ওয়াক্স কাস্টিঙে উৎপন্ন ওয়াক্স ফিউম, মেটাল কাস্টিং থেকে মেটাল ফিউম ও জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি ধাতুর ভারি, বিষাক্ত ক্ষুদ্র কণা বাতাসে মেশে। মানুষ, পশু, পাখিরা সেই বাতাসে শ্বাস নিলে এই বিষ ধোঁয়া শরীরে ঢোকে। বিষের প্রভাবে মাথাধরা, বমি, জ্বর দেখা দেয়। প্রতিদিন এই ধোঁয়ায় শ্বাস নিলে স্নায়ুতন্ত্র, ফুসফুস, চামড়া, চোখের মারণ রোগ হয়। হ’তে পারে লিউকোমিয়া। কারখানা থেকে ফেলা দূষক পদার্থ জমি, জলে মিশে আরও ভয়ঙ্কর, বিষাক্ত ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চলেছে।

 

অদূরেই সিঙুরের উল্টোদিকে মহিষটিকারি-র হিমাদ্রী কেমিক্যালস। রাসায়নিকের কারখানা। গত প্রায় বছর পনেরোর বেশি সময় ধ’রে ভয়ঙ্কর দূষণ উগড়ে চলেছে লাগোয়া গ্রামগুলোয়। ওখানে গেলে দেখা যাবে কঙ্কালসার বাছুর, ছাগল, কুকুর, মানবশিশু কিংবা মৃত পক্ষীশাবক। চাষজমির রঙ– কালচে বাদামি। আবেদন-অনুনয়-আন্দোলন কোনোকিছুকেই পাত্তা দেয়না হিমাদ্রির মালিকেরা। ফি বছর বন্যার সময়ে মধুসূদনপুর স্টেশনে খিচুড়ি রেঁধে গ্রামবাসীদের খাইয়ে দেয় একবার, ব্যাস।

 

যাইহোক, নালিকুল বড়গাছিয়া গ্রামের বাঁধের বসতির একদম পাশেই ইলেক্ট্রিক অফিসের পূব দিকে পিডব্ল্যুডি-র জায়গার ওপর প্রায় বছর দশেক আগে বিকাশ দাসের ওয়াক্স সেটিং কারখানা গ’ড়ে ওঠে। প্রথম দিকে তুলনামূলক অল্প মাত্রায় কাজ চললেও গত তিন-চার বছরে কারখানার চিমনি ও ভাঁটি, কখনও কখনও কারখানার চাল ফুঁড়েও বেরনো ধোঁয়ার পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে গেছে ব’লে লক্ষ্য করেছেন বাসিন্দারা। অন্যান্য কারখানায় পালিশের কাজ হ’লেও এই কারখানাতে শুধুমাত্র ভাঁটি জ্বালিয়ে মেটাল ও ওয়াক্স গলানোর কাজ হয়। কখনও দিনে, কখনও মাঝরাতে কারখানা থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়া হ’লে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধে এলাকা ছেয়ে যায়। কাশি, বমি, চোখ-নাক জ্বলা নিয়ে একটু একটু ক’রে বিষ গিলতে হয়। দূষণে জেরবার হয়ে এলাকাবাসীরা গত ২৬ জুলাই গণস্বাক্ষর সম্বলিত অভিযোগপত্র পাঠান বিডিও, জেলাশাসক, মহকুমাশাসক, কামারকুণ্ডু ও হরিপাল থানার এসপি, ওসি সহ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পরিবেশ মন্ত্রকে। কোনো জায়গা থেকেই কোনওরকম সাড়া পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে গত ২৯ অক্টোবর মাঝরাতে বিকাশ দাসের কারখানা থেকে হঠাৎ বিষ-ধোঁয়া বেরতে শুরু করে। ঘুম ভেঙে যায়। প্রায় প্রত্যেকেরই কাশি, কয়েকজনের বমি হয়। একজন বয়স্ক মানুষ জ্ঞান হারান। অসহায় হয়ে ছুটোছুটি ক’রে বাঁধের বাসিন্দারা টহলরত পুলিশ ভ্যান দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। পুলিশ দাঁড়ায়নি।

 

৩১ অক্টোবর ফের কারখানায় কাজ শুরু হয়, ধোঁয়া ছাড়া হ’লে দুপুর নাগাদ থানায় জানানো হয়। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা ক’রে কোনও পুলিশি বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে না দেখে ক্ষুদ্ধ বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে ১২ নং রাস্তা অবরোধ করেন। এবার পুলিশ আসে। পরদিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর এলাকাবাসীদের সঙ্গে আলোচনা ক’রে সমাধান খোঁজার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। আলোচনায় পুলিশ জানায় তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারখানা খুলবে না। কিন্তু পরদিনই ফোন ক’রে জানায়– বিকাশ দাসের কারখানার সব নথিপত্র বৈধ। সেদিন থেকেই আবার চালু হয়ে যায় কারখানার কাজ। এলাকাবাসীরা রুখে দাঁড়ালে কারখানার কর্মচারীরা পালান।

 

৪ নভেম্বর সন্ধ্যেয় তিন কারখানার মালিকরা একটি রাজনৈতিক দলকে ধ’রে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন। এর আগে বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে বারংবার বলা সত্ত্বেও মালিকরা আলোচনায় বসতে রাজি হননি যদিও। সেই আলোচনাতেও বাঁধের বাসিন্দারা তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য জানান—

১. কাস্টিং পোড়ানো চলবেনা।

২. প্লাস্টার অফ প্যারিসের গুঁড়ো ফেলা যাবেনা।

 

কারখানা বন্ধ ক’রে দেওয়ার দাবী তাঁরা করেননি। অন্য দুই কারখানার মালিক কমল বাগ ও প্রণব ভুঁই এলাকাবাসীদের শর্ত মেনে নেন। চুক্তিপত্রে সই করেন। কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি অফিসের পূবে যে কারখানাটি সবচেয়ে বিপজ্জনক সেটির মালিক বিকাশ দাস আলোচনার মধ্যেই এলাকার বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে হুমকি দিতে শুরু করেন। বোম মারা, খুন করার হুমকি দিতে দিতে বেরিয়ে যান।

 

পরদিন ৫ নভেম্বর, বিকাশ দাস তাঁর অন্যান্য কারখানা থেকে শ্রমিক এবং অন্য লোকদের এনে পথ অবরোধের চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের কাছে এলাকাবাসীর নামে মিথ্যে মারধোরের অভিযোগ করান নিয়ে আসা মানুষদের দিয়ে। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতেই বাসিন্দাদের তাচ্ছিল্য ক’রে লোকদেখানো লম্বা চিমনী লাগিয়ে কারখানা চালু ক’রে দেওয়া হয়।

 

৬ তারিখ কারখানা থেকে ধোঁয়া ছাড়া হ’লে এলাকার যুবক প্রদীপ দে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্ষুদ্ধ বাসিন্দারা কারখানার ওপর চড়াও হ’লে হরিপাল থানার পুলিশ আসে। এলাকার মহিলারা লাঠি, ঝাঁটা হাতে প্রতিরোধ করেন। পুলিশ বেগতিক দেখে কামারকুণ্ডু থেকে আরও পুলিশ ডাকে।কামারকুণ্ডু এস.পির নেতৃত্বে দু’ গাড়ি পুলিশ এসে নিরস্ত্র বাসিন্দাদের ওপর চড়াও হ’লে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে অসুস্থ প্রদীপ দে বমি করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জ্ঞান হারায়। তাকে হরিপাল হাসপাতালে নিয়ে যায় এলাকাবাসীরাই। সে COPD (Chronic Obstructive Pulmonary Disorder)-তে আক্রান্ত হয়েছে ব’লে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে। নিরস্ত্র, দূষণের প্রতিকার চাইতে যাওয়া এলাকার বাসিন্দাদের ওপর পুলিশ লাঠি, লাথি, ঘুষি চালায়। কুরুচিপূর্ণ, অশালীন গালিগালাজ করে বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে। মেয়েদের, বয়স্কদের ধাক্কাধাক্কি করে পুরুষ পুলিশের বাহিনী। আঁচড়ে, মেরে জামাকাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয় এলাকার এক যুবকের।

 

গতকাল (৭ নভেম্বর) এই ঘটনার প্রতিবাদে, মারণ দূষণ ছড়ানো কারখানা বন্ধের দাবীতে হরিপাল স্টেশন থেকে হরিপাল বিডিও পর্যন্ত মিছিল ক’রে বিডিও-র সঙ্গে দেখা করতে যান এলাকাবাসীরা। বিডিও-র কাছে কারখানার মালিক বিকাশ দাস কোনও বৈধ নথি দেখাতে পারেননি। জানা যায় তার কারখানার কোনও বৈধ নথি নেই। অথচ পুলিশ এতদিন এলাকাবাসীদের ব’লে এসেছে– কারখানার নথি বৈধ; কারখানার বিরুদ্ধে বেগড়বাই করলে অ্যারেস্ট করা হবে, কেস দেওয়া হবে!

 

কারখানার মালিক বিকাশ দাস, তাঁর তিন সাঙ্গোপাঙ্গ, হরিপাল থানার বড়োবাবু, মেজবাবু ও এলাকাবাসীদের উপস্থিতিতে বিডিও মৌখিক সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন– কারখানার কাজ বন্ধ রাখতে হবে এবং সঠিক সমাধানের আগে কারখানার কাজ পুনরায় চালু হ’তে দেখা গেলে বিডিও নিজে বিকাশ দাসের বিরুদ্ধে এফআইআর করবেন। এলাকাবাসীরা একে তাঁদের দীর্ঘ প্রতিবাদের সাময়িক সুফল হিসেবেই দেখছেন।

 

পুলিশ অবশ্য প্রদীপ দের অসুস্থতাকে ‘ড্রামা’ বলেছে। বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে বলেছে, “তোরা ফেসবুকে পোস্ট করেছিস তো! তোদের কী করতে হয় দেখে নেব!”। বলেছে, পুলিশের সঙ্গে জোর গলায় কথা বলায় পুলিশ গ্রেপ্তারও করতে পারে। বেআইনি, দূষণ-ছড়ানো কারখানার মালিক বিকাশ দাস ফের বাঁধের বাসিন্দাদের খুনের হুমকি দিয়েছেন। বলেছেন, মেয়েদের বিয়ে ভেঙে দেবেন। এরমধ্যে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে– বিজেপি-র লোকেরা বলছে, মালিকের সঙ্গে ‘ঝামেলা’ ‘মিটিয়ে’ নিতে। “স্বচ্ছ ভারতের ভক্তদের মনে করিয়ে দিতে চাই সামনের মাসেই কিন্তু জাতীয় দূষণ প্রতিরোধ দিবস”, বললেন বাঁধের মানুষের পাশে দাঁড়ানো পাশের পাড়ার প্রৌঢ়া।

 

কারখানার বড়লোক, ক্ষমতাধর মালিক ও তার ভাড়া করা পুলিশের হুমকির মধ্যে তাঁদের সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার মোটেই অনায়াসলব্ধ হবেনা বুঝতে পারছেন বাঁধের মানুষ। অবশ্য ‘ছোটজাতের’ ‘ছোটলোক’ সনৎ দাস, শম্পা লোহারাদের জীবনের একটা দিনও অনায়াসে যায়নি। দূরদেশ থেকে ঠিকানা হারিয়ে চলে আসার পর তিলতিল ক’রে গ’ড়ে তুলতে হয়েছিল এক-একটা ছিটেবেড়ার আশ্রয়। সে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগেকার কথা। আবছা হয়ে আসা চোখে বলছিলেন প্রদীপের বাবা। বয়স নব্বই ছুঁয়েছে। বলছিলেন, “পুলিশ মেয়ে, বউদের ধাক্কাধাক্কি করছে দেখে আমি এবয়সেও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারিনি। মুখ খারাপ ক’রে ফেলেছি, পুলিশকে ঠেলা দিতেও গেছিলাম।”

 

বাঁচতে চাওয়ার ঠেলায় বাঁধের অনেককেই আগেরবার উন্নয়ন-উদবাস্তু (development refugee) হতে হয়েছিল। এবার কি দূষণ-উব্দাস্তু (pollution refugee) হওয়ার পথে? প্রশ্ন আর উত্তরের সম্পর্কগুলো ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে দুষিত বাতাসে।

 

 

 

লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

 

 

Share this
Leave a Comment