লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন” – একটি পাঠ 


  • October 22, 2019
  • (0 Comments)
  • 4635 Views

মৌসুমী ভৌমিক সম্পাদিত “লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন” বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। বইটি আমাদের কাছে ‘চারু মজুমদারের স্ত্রী’ নামের অবশ্যম্ভাবী, অথচ অনাম্নী ছায়াটিকে একটি নাম দেয়, তাঁকে একজন সশরীর ব্যক্তি হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করে। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও, বইটিতে তেমনভাবে ধরা পড়ল না  লীলাদির নিজস্ব কণ্ঠস্বর, রাজনৈতিক জীবন ও মতামত। লিখেছেন নন্দিনী ধর। 

 

চারু মজুমদারের কোনও স্ত্রী আছে বলে আমি কোনোদিন জানতাম না। আমার ধারণা, আমরা যারা অনেকেই নকশালবাড়িজাত আন্দোলনক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াই, আমরা অনেকেই জানতাম না এবং, সক্রিয় ভাবে কোনোদিন জানতে চাইওনি। কিন্তু, চারু মজুমদারের সন্তানদের কারো কারো কথা আমরা জানি। কেউ চিকিৎসক, কেউ অধ্যাপক এবং দীর্ঘকাল একটি নকশালপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বস্থানীয় কর্মী। আর, সন্তান থাকলে তো স্ত্রী’ও থাকতে হবে। তাই না? কাজেই, বিষয়টা হল অনেকটা এইরকম — চারু মজুমদারের স্ত্রী আছেন, ছিলেন এই কথা আমরা জানি, জানতাম। কিন্তু যা আমরা জানতাম না, তা হল — চারু মজুমদারের স্ত্রী একজন ব্যক্তিবিশেষ। তাঁকে আমরা কখনও জানতাম না তাঁর ব্যক্তিবিশেষ রাজনৈতিক বৈষয়িকতায়। এবং, জানতে চাইওনি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে মৌসুমী ভৌমিক সম্পাদিত ‘লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন’ বইটি এক অর্থে আমাদের কাছে ‘চারু মজুমদারের স্ত্রী’ নামের অবশ্যম্ভাবী, অথচ অনাম্নী ছায়াটিকে একটি নাম দেয়, তাঁকে একজন সশরীর ব্যক্তি হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করে।

 

বইটিতে লীলা মজুমদারের নিজের কোনও লেখা নেই। দু-একটি চিঠির ভগ্নাংশ ছাড়া। কাজেই লীলা মজুমদারকে আমরা তাঁর নিজের কণ্ঠস্বরে পেলাম না। আত্মজীবনী জাতীয় বা ডাইরি ইত্যাদি, এসব কিছু লীলা মজুমদার রেখে গেছেন কিনা, তাও আমরা জানলাম না। ঐতিহাসিকভাবে, সারা পৃথিবীতেই মেয়েরা এই জাতীয় ব্যক্তিগত লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেদের ব্যক্ত করেছেন, তথাকথিত সাধারণ রোজনামচার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন সমসময়ের রাজনীতি। বাংলা তথা এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেরও একটি ঘনিষ্ঠ জটিল চিত্র আমরা পেয়ে থাকি মহিলা কমরেডদের আত্মজীবনীর মধ্য দিয়ে। গত কয়েক বছরে তো বেশ কয়েকটি এই ধারার আত্মজীবনী  প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মণিকুন্তলা সেনের ‘সেদিনের কথা’, রেবা রায়চৌধুরীর ‘জীবনের টানে, শিল্পের টানে’, ছবি বসুর ‘ফিরে দেখা’। এই বইটি সেই ধারার কাছাকাছি, জীবনী-আলেখ্যর ধারায় সংকলিত। কিন্তু, আবার কোথাও যেন সেই ধারা থেকে আলাদাও। কারণ, এখানে লীলা মজুমদারের নিজস্ব কণ্ঠস্বর প্রায় নেই বললেই চলে।

 

লীলা মজুমদারকে এখানে আমরা পেলাম অন্যান্যদের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ, ‘লীলা মজুমদার’ নামের ব্যক্তিটি আমাদের কাছে এলেন পরোক্ষভাবে, অন্যের দৃষ্টির সূত্র ধরে। তাতে করে একটি অদ্ভুত জটিলতা তৈরি হল। একদিকে, একথা অনস্বীকার্য যে, আমরা তো বেঁচে থাকি অন্যের মধ্যে দিয়েই। কোনও অস্তিত্বই তো কখনো হয় না সম্পূর্ণ একক অস্তিত্ব। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও কোনও কোনও অস্তিত্ব যেন একটু বেশিই অন্যের দৃষ্টি দ্বারা নির্ধারিত হয়। মানে, একটু স্পষ্ট করে বলি। একজন মধ্যবিত্ত গৃহবধূর জীবনে ঠিক কতটা থাকে অন্যের স্মৃতিচারণ করার মতো? কী থাকে সেই স্মৃতিচারণের কেন্দ্রস্থলে? রাঁধাবাড়া, অন্যের যত্নআত্তি আর সংসারটাকে ধরে রাখার নিত্যনৈমিত্তিকতা ছাড়া? যে নিত্যনৈমিত্তিকতা আবার ঠিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়, কোনোদিন সেইভাবে হয়েও ওঠেনি? পারিবারিকতাই তাই বহু সময়ে হয়ে ওঠে একজন মধ্যবিত্ত গৃহবধূর জীবনের প্রধান বেঁচে থাকার কেন্দ্র, পরিচিতির কেন্দ্র।

 

তাই, অনেকটা সেই নিয়ম মেনেই যেন, অনেকটা প্রত্যাশিতভাবেই, ‘লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন’ বইটিতেও পারিবারিক স্মৃতিচারণের সংখ্যাধিক্য। কিন্তু মধ্যবিত্ত কমিউনিস্ট গার্হস্থ্যতা তো বহু সময়েই অন্য আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত গার্হস্থ্যতার মতো হয়েও আলাদা। সেখানে পারিবারিক সদস্য ভিন্নও থাকে পার্টির সদস্য-সমর্থক কর্মী, বন্ধু, কমরেডরা। ঘরের চার দেওয়ালে গার্হস্থ্যতার রোজনামচার মধ্যেও কোথায় যেন পড়ে আন্দোলনের ছোঁয়া, বাইরের পৃথিবীর শব্দ, রাষ্ট্রের উপস্থিতি। মেয়েদের জীবনটাও তাই সেখানে অনেকটাই বদলে যায়, যেতে বাধ্য।

 

চিরাচরিতভাবে, এই বাংলায় যে কমিউনিস্ট গার্হস্থ্যতাকে আমরা চিনেছি, তার ছিল একটি চেনা ছক। এই যে অগণিত কর্মী-বন্ধুদের আনাগোনা, থাকা-খাওয়া-শোওয়া, তার দায়ভার গ্রহণ করতে হয়েছে বাড়ির মেয়েদেরই। বিশেষত, গৃহিণীদেরকেই।অথচ, খুব অদ্ভুতভাবে, যে রাজনৈতিক মতাদর্শ তাত্ত্বিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমের রাজনীতির ওপর, সেইখানে কোনোভাবে মূল্যায়িত হল না কমিউনিস্ট গার্হস্থ্যতা অন্তর্গত এই শ্রমের বাস্তবতা, ইতিহাস ও রাজনীতি। এই শ্রমকে আমরা কখনও জানলাম ‘আত্মত্যাগ’ বলে। কখনও জানলাম অবশ্যম্ভাবী বলে। কখনও জানলাম ভালোবাসা বলে। যেমনভাবে এই শ্রমকে বাইরের মূলস্রোতের পৃথিবীতে দেখা হয়, কমিউনিস্ট আন্দোলনেরর ভেতরও তার কোনও খুব মূলগত পরিচয় হল না।

 

এমনকী, এই শ্রমের মধ্যে দিয়েই নাকি বৃহদাংশ মেয়েরা কমিউনিস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবে কারণ, মেয়েরা তো আদতে পিছিয়ে পড়া, তাই ‘আসল রাজনীতি’ তাদের পক্ষে ঠিক সম্ভবপর নয় — এমন কথাও হল কখনও কখনও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরে।

 

বইটির অন্তর্গত নিমাই ঘোষের লেখা ‘একজন আত্মগোপনকারী কমরেডের চোখে লীলাদি’ অনেকটা ওই ধাঁচের। নিমাই ঘোষ আজ নেই। আমাদের অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন অতীব প্রিয়, ভালোবাসার মানুষ। কাজেই, তাঁর মতামতের এই সমালোচনার মধ্যে আছে একধরনের গভীর যন্ত্রণাবোধ। নিমাইদার লেখাটির মধ্যে আছে এক অদ্ভুত ধরনের নির্বাপণ। লেখাটি লীলাদিকে নিয়ে হলেও, সেখানে চারু মজুমদারের কথাই অনেক বেশি। লীলাদি আছেন সেখানে চারু মজুমদারের ‘সহধর্মিণী’ হিসেবে। এছাড়াও লেখাটিতে আছে লীলাদির আতিথেয়তার কথা, তাঁর ‘মাতৃময়ী’ প্রতিমূর্তির কথা। কেমনভাবে অভাবের সংসারে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মোড়া পরিমণ্ডলেও  তিনি  খেয়াল রাখতেন আগত কমরেডদের খাদ্যাভ্যাসের কথা, তার বিবরণও আছে। মানে, এই লীলাদিকে আমরা চিনি। এই লীলাদির মতো মহিলাদের আমরা চিনি। এঁরা বামপন্থী আন্দোলনের যে নিবিড়, অন্তরঙ্গ ক্ষেত্র, সেখানকার পরিচিত মুখ।

 

নিমাইদা লিখলেন, “লীলাদির মতো মানুষের কথা ইতিহাসে বহুল প্রচারিত হয় না। জীবনসঙ্গীর পাশে প্রেরণাময়ী হয়ে থাকেন। দুর্যোগেও এঁদের মনোবল ভাঙতে দেন না। বরং অনুপ্রাণিত করেন, প্রকৃত জীবনসাথী হয়ে, কমরেড হয়ে। নেপথ্যে থেকে এঁদের যে অবদান, সে কথা আগামী প্রজন্মের মানুষের জানা উচিত, যাতে তাঁদের ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার আলোকে অন্যেরা উদ্দীপ্ত হতে পারেন।” লক্ষণীয় বিষয় এই যে, লীলাদির মতো মানুষজনের প্রতি নিমাইদার অসীম শ্রদ্ধা। যে শ্রদ্ধা আসলে কমিউনিস্ট আন্দোলনেরই অন্তর্গত। সেই শ্রদ্ধাবনত অবস্থান থেকেই নিমাইদা লিখলেন, “লীলাদি যদি পার্টির সক্রিয় কর্মী হতেন তাহলে অনেক উচ্চপদে আসীন হতে পারতেন। কিন্তু নকশালবাড়ির রূপকার কম: চারু মজুমদার অসুস্থ অবস্থায় ওই সংগ্রামে সারা দেশকে যেভাবে উত্তাল করে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তাঁর পাশে লীলাদির মতো মানুষ ছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছে।” কাজেই, বিষয়টা এখানে বোধহয় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অভাব নয়। বিষয়টা হল, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরে মেয়েদের জন্য একটি অন্য ধরণের রাজনৈতিক বৈষয়িকতার কল্পনার অভাব। যে রাজনৈতিক বৈষয়িকতা আদতে একজন নেতার ‘সহধর্মিণী’ হয়ে থাকার ওপর নির্ভর করে না।

 

বইটিতে লীলাদির এই ‘সহধর্মিণী’ পরিচয়টিই প্রকট হয়ে উঠল। সহধর্মিণী হওয়ার সাথে সাথে অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রকট হল আরও কতগুলি  পরিচিতি — মা, দিদা, মাসিমা। অর্থাৎ, পারিবারিকতার বন্ধন, গার্হস্থ্যতার বন্ধনজাত পরিচিতি। সেই গার্হস্থ্যতার বন্ধনের একরকম  ধারাবাহিকতাতেই এল লীলাদির রাজনৈতিক পরিচয় এবং ক্রমে ক্রমে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়ে প্রধানতর হয়ে উঠল তাঁর পারিবারিক পরিচয়। যেমনটা হয়েছে বাংলার বামপন্থী আন্দোলন  অন্তর্গত বহু নারী কমরেডদের সাথেই। বলা যেতে পারে, একটা বড় সময় জুড়ে এইটাই ছিল বাংলার বামপন্থী আন্দোলনের লিঙ্গায়িত মূলস্রোত। নকশালবাড়ি আন্দোলন ও তার পরবর্তী তৃতীয় ধারার বহুধাবিভক্ত সংগঠনগুলির মধ্যেও যার খুব পরিবর্তন হয়নি।

 

তৎসত্ত্বেও, বইটির বিভিন্ন লেখায় অনেকটা যেন মাটি ফুঁড়ে বেরোনোর মতো করে বেরোলো একটি অন্য চিত্র। যেমন, বাসন্তী রামণ লিখলেন, আটের দশকে নকশালবাড়ি বিষয়ে তাঁকে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করলেও, পরবর্তী সময়ে, তাঁদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, লীলাদি কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর বহু স্মৃতি ও চিন্তাভাবনা বাসন্তীর কাছে ব্যক্ত করেন। কারণ, তেভাগা আন্দোলন ও তৎপরবর্তী কমিউনিস্ট আন্দোলনের লীলা মজুমদার ছিলেন একজন  সক্রিয় সদস্য। ছিলেন পার্টির সদস্যও। ছয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত। ঠিক এইখানটিতেই একজন পাঠক হিসেবে, আমি আরও আরও গভীরভাবে জানতে চাই, লীলা মজুমদারের রাজনৈতিক স্মৃতিচারণ ও ভাবনাচিন্তা। কারণ, বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে ব্যাপক ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা, সেখান থেকে হারিয়ে গেছে — অনেকাংশেই — এই নারীদের পূর্ণাঙ্গ, জটিল কণ্ঠস্বর।

 

তবে, জনপরিসরের একদম বাইরে বসবাস করেছেন লীলা মজুমদার, এটাও সম্পূর্ণরূপে ঠিক নয়। যেমন, বহুবছর ইন্সুরেন্সের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সেইভাবে দেখতে গেলে, বামপন্থী সংস্কৃতির অভ্যন্তরে এর মধ্যেও কোনও নতুনত্ব নেই। একটা বড় সময় জুড়ে পুরুষটি হোলটাইমার, চাকুরিরতা/রোজগেরে স্ত্রী, এটাই ছিল বামপন্থী মধ্যবিত্ত গার্হস্থ্যতার আধিপত্যকারী চিত্র। একদিক থেকে দেখতে গেলে এরমধ্যে একটা সামাজিক অগ্রসরতার পরিচয় আছে। আছে মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার গল্প। কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরেও, লিঙ্গের প্রশ্নে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধান মান্যতা দেওয়া হয়েছে মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাই মনে হয় যে এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। বরং, আছে একধরনের নতুন, বহির্মুখী নারীত্বের নিদর্শন।

 

ব্যাপারটা বোধহয় আরেকটু জটিল। মানে, যেমন ধরুন, কমিউনিস্ট ‘সহধর্মিণী’-এর কাছে তাঁর চাকরি কি আসলে গার্হস্থ্যতারই একটি পরিবর্ধিত অংশ নয়? সংসারটাকে ধরে রাখতে গেলে তাঁকে যেমন রান্নাবান্না, ঘরকন্নার হাজারটি কাজ করতে হবে, তেমনি চাকরিটিও করতে হবে। কমিউনিস্ট-বামপন্থী আন্দোলনের ভিতরেও — অকথিত যদিও — তবুও, এইভাবেই দেখা হয় গোটা বিষয়টি। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, আলাপ-আলোচনা থেকে হারিয়ে যায় একটি বিষয়। এই যে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, সেটা ঠিক কেমনভাবে কমিউনিস্ট ‘সহধর্মিণী’-র শ্রমচেতনাকে নির্ধারণ করে? ঠিক কেমনভাবেই বা এই শ্রমচেতনা ছাপ ফেলে তাঁর রাজনৈতিক চেতনায়? একজন অ-কমিউনিস্ট মেয়ে যখন চাকরি করতে যায়, সেই প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে তার যে চেতনার উন্মেষ ঘটে, একজন কমিউনিস্ট মেয়ের ক্ষেত্রেও কি বিষয়টি একই থাকবে? তাহলে কমিউনিস্ট পার্টি অন্তর্গত যে রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া, সেটিকে আমরা কীভাবে দেখব একটি মেয়ের জীবনে, তার লিঙ্গায়িত বিশিষ্টতায়?

 

সেইদিক থেকে দেখতে গেলে সংকলনের অন্তর্গত ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্যের লেখাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সম্পর্কে লীলা মজুমদার ছিলেন ইন্দ্রনীলের মামিমা। এই লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, জীবনবিমার এজেন্সির কাজ কেমনভাবে লীলা মজুমদারের কাছে ছিল রাজনৈতিক জনসংযোগ রক্ষা করার কাজও। জানতে পারি, কেমনভাবে এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন লীলা। অথচ, আমাদের আন্দোলনের আলাপচারিতায় কখনও উঠে আসেনি এইসব ইতিহাস। চারু মজুমদারকে আমরা কিংবদন্তি বানিয়েছি। কিন্তু লীলা বা তাঁর মতো আরও আরও কমিউনিস্ট ‘সহধর্মিণী’-দের রাজনৈতিক-গার্হস্থ্য শ্রমের কোনও মূল্যায়ন হয়নি আন্দোলনের অভ্যন্তরে।

 

এর পাশাপাশি, বইটি থেকে আমরা এটাও জানতে পারলাম যে, লীলা মজুমদার দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন। ‘শিশু মহল’ নামে যে স্কুলটিতে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন, তার সম্পর্কে সমরেশ রায় লিখলেন — ”’শিশু মহল’ও কমিউনিস্ট আন্দোলনেরই একটা গণসংগঠন যে, সে সত্য অনেক পরে জেনেছি।” আবারও, বামপন্থী সংস্কৃতির সঙ্গে এক ধরনের নিবিড় পরিচয় না থাকলে, না লীলা মজুমদারের শিক্ষকতার ইতিহাস, না কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় স্কুলের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী কিছু ধরা পড়বে। বাংলার কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে, পার্টির পরিচালনায় এইরকম বহু শিক্ষাকেন্দ্রিক পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। সেই পরীক্ষানিরীক্ষার পুরোভাগে বহু সময়েই থাকতেন মেয়েরা। আরও অনেক বাম সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মতো, সেই ইতিহাসও আজ অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরেও, এর কোনও সেইরকম মূল্যায়ন হয়নি।

 

মানে, ব্যাপারটা কিন্তু ভেবে দেখার মতো। এমনিতে, সামাজিকভাবে, শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একধরনের সম্মানবোধের প্রশ্ন। ঐতিহাসিক ভাবে, মেয়েরা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকেন বেশি। কোথাও যেন একটা মেয়েদের শিক্ষকতা করার সঙ্গে একধরনের সামাজিক গ্রাহ্যতা আছে, যা অনেক পেশার ক্ষেত্রেই নেই। শিক্ষকতার সাথে আছে গার্হস্থ্য শ্রমের এক ধরনের মিল, দুইয়ের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয় প্রভূত পরিমাণের আবেগগত শ্রমের। তবে আবার শিক্ষকতার সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে বৌদ্ধিকতা। কিন্তু আমরা বৌদ্ধিকতাকে ঠিক গার্হস্থ্য শ্রমের সঙ্গে এক করে দেখি না। তাই, শিক্ষক মেয়েদের বৈষয়িকতার মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে একধরনের দ্বৈততা। একধরনের টানাপড়েন আর, এই টানাপড়েনকে কেটেছেঁটে একধরনের মান্যতা দেওয়ার জন্য, মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে দেওয়া হয় অগ্রগণ্যতা। কর্মক্ষেত্রে শিশুদের শিক্ষাদান তাই অনেকাংশেই হয়ে ওঠে গৃহশ্রম ও মাতৃত্বের শ্রমের পরিবর্ধন।

 

সেই ধরনের টানাপড়েন কি অনুভব করেছিলেন লীলা মজুমদারও? সংকলনটির লেখাগুলির মধ্যে দিয়ে এই সূক্ষ্মতর জায়গাগুলি বড়ো একটা উঠে আসে না। কিন্তু যা বোঝা যায়, তা হল, কমিউনিস্ট-সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘাত- প্রতিঘাতকে বাদ দিয়ে, লীলা মজুমদারের জীবনের অর্থ অনুধাবন কোনোমতেই সম্ভব নয়।

 

বইটির বিভিন্ন লেখায় — বিশেষ করে তিথি ভট্টাচার্য ও ইলিনা সেনের কলমে যা উঠে এল, তা হল, কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন লীলা। ইলিনা সেন লিখলেন, “কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি সমাজের ছককে এতটাই অগ্রাহ্য করেছেন যে প্রশ্ন জাগে, ‘আসল’ লীলা কোনজন? তিনি পাশের বাড়ির মমতাময়ী দিদি নাকি, না এক বিমাকর্মী – যাঁর কাজের ভরকেন্দ্র ছিল মহিলাদের স্বার্থ, নাকি জ্বালাময়ী কোনও রাজনৈতিক সংগঠক যাঁকে গ্রামের মহিলারা কয়েক দশক পরেও একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে মনে রেখেছিলেন? নাকি তিনি সেই পোড় খাওয়া রাজনৈতিক কর্মী, স্বামীর মৃত্যুর পরের বহু ঘটনা ও চিন্তাধারার সাক্ষী হয়েও যিনি সেইসব প্রসঙ্গে এক রহস্যময় নীরবতা রক্ষা করেছিলেন?”

 

প্রসঙ্গত, বইটিতে বারবার ঘুরে ফিরে এল লীলা মজুমদারের নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্পর্কে নীরবতা রক্ষার প্রশ্নটি। বইটি যেন সামগ্রিকভাবে তাঁর এই নীরবতাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করছে, রাজনৈতিকভাবে! সম্পাদক মৌসুমী ভৌমিক লিখলেন এই প্রসঙ্গে – “political শব্দটির অর্থ আসলে কতই ব্যাপক হতে পারে, নৈঃশব্দ্যও তো রাজনৈতিক হয়ে যায়।”

 

অবশ্যই। কিন্তু কী ধরনের রাজনীতি, সেই বিষয়ে বিশদে গেলেন না মৌসুমী। ঠিক কীরকম রাজনীতির বশবর্তী হয়ে এতগুলো বছর নকশালবাড়ি-বামপন্থী রাজনীতি-কমিউনিস্ট আন্দোলন ইত্যাদি সম্পর্কে নীরব রইলেন লীলা? মানে, একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে লীলার নীরবতাকে আমি প্রশ্ন করছি না। কিন্তু লীলা মজুমদারের নীরবতা বোধহয় ঠিক শুধুই তাঁর ব্যক্তিগত নীরবতা নয়। বরং, বাংলার কম্যুনিস্ট আন্দোলনের এটাই সবচাইতে পরিচিত ছবি। যাকে বলা যেতে পারে, আধিপত্যকারী বয়ান। একসময়ের সক্রিয় নেত্রী পিষছেন সংসারের জাঁতাকল, রাজনৈতিকভাবে নিশ্চুপ হয়ে। মেয়েদের যূথবদ্ধ এই নিশ্চুপতার মধ্যে আজ তাই আমাদের আরেকটু সমালোচনামূলক, গভীর দৃষ্টি হানতে হবে। যে দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও এনেছেন বাসন্তী রামণ তাঁর লেখায়, লীলা মজুমদারের সাথে দার্জিলিং অঞ্চলের লড়াকু শ্রমিকনেত্রী লীলা কিষাণের সাথে তুলনার মধ্যে দিয়ে। বাসন্তী লিখলেন, “দুই লীলা; একজন অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলার উচ্চবর্ণ বৈদ্যবাড়ির মেয়ে, শিক্ষিতা। […] অন্য লীলা, দার্জিলিং জেলার আধা আদিবাসী, নাগোশিয়া কিষাণ। [….] দুজনেই ঘরের ছায়ায় থেকে সমস্ত জরুরি সাংসারিক কাজ করে যাবার ফলে ক্রমশ জনপরিসর থেকে হারিয়ে যান।”

 

কোথাও কি তাহলে একটি সার্বিক পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন? প্রয়োজন ভাবার যে আসলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্তর্গত পরিসরগুলিতে আসলে মেয়েদের স্থায়ী রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর দেওয়া যায়নি? এবং কেন যায়নি, তাও বোধহয় অতীব নিবিড় গভীরতার সঙ্গে ভেবে দেখা প্রয়োজন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাষা ও রাজনৈতিক চেতনা কি তবে রয়ে গেছে পৌরুষকেন্দ্রিক?

 

লীলা মজুমদারের জীবনকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্নগুলি আরও সুসংহতভাবে তোলা যেতো বইটিতে। কিন্ত সেটা ঠিক হল না। বরং যেন তাঁর নীরবতাকেই বড়ো একটু — বকলমে হলেও — উদযাপন করা হল। যেমন ধরুন, নিমাই দা লিখলেন, “অবাক হয়ে যাই ওঁর (অর্থাৎ, লীলা মজুমদারের) সহিষ্ণুতা দেখে। […..] একবারও বুঝতে দেননি, কী অমানুষিক পরিশ্রম করে ফিরেছেন।” আবারও, এই নিশ্চুপে পরিশ্রম করে চলা কমিউনিস্ট গৃহিণীর প্রতিমূর্তি কেন এত মান্যতা পায় আমাদের কাছে? কেন আমরা তাঁদের শ্রমের সাথে সাথে চাই তাঁদের নীরবতাও? মানে, মেয়েদের নীরব শ্রম কেন এত বেশি শ্রদ্ধাবনত করে তোলে আমাদের? যে রাজনীতির রাজনৈতিক ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে ‘গর্জে উঠুন’ এই বাক্যবন্ধের উপরে, সেখানে মেয়েদের নীরবতা কেন এত বেশি শ্রেয় বলে গণ্য হয়? মানে ঠিক একই বাক্য যদি আমরা একটু অন্যভাবে লিখি- ‘লীলাদির’ নামের পরিবর্তে কোনো শ্রমিকের নাম ঠুকে – তাহলে দাঁড়াবে তো বামপন্থী রাজনীতির ভরকেন্দ্র?

 

কিন্তু, এসবের পরেও তো আছে, লীলা মজুমদারের রাজনৈতিক স্বকীয়তার প্রশ্নটি। যা অনেকটাই বেরিয়ে আসে ইলিনা সেনের লেখায় – “তাৎপর্যপূর্ণ হলো, সিপিআই(এম-এল) তৈরি হওয়ার পরে তিনি যেমন নতুন দলে যোগদান করেননি, তেমনই সিপিআই(এম)-এর সদস্য পদেরও আর পুনর্নবীকরণ করাননি। সংগঠন নিয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য থাকলেও তিনি কোনোদিনই তা প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন থেকেই এমন আভাস পাওয়া যায় যে, প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের সঙ্গে  তাঁর স্বামীর এতখানি মতপার্থক্য এবং দূরত্ব তৈরি হবার পরেও কম্যুনিস্ট পার্টির ভিতরকার সমস্যাকে তিনি কখনোই অনতিক্রম্য বলে মনে করতেন না।”

 

একজন পাঠক হিসেবে, আমি চেয়েছিলাম, গোটা বইটিতে এই জায়গাটিকে ধরে আরও একটু গভীর আলোচনা থাকুক। চারু মজুমদার অর্থাৎ, নিজের জীবনসঙ্গী সম্পর্কে তিনি সারাজীবন একটিও কথা না বলতে পারেন। কিন্তু, পার্টি ভাগের রাজনীতি তো কম্যুনিস্ট আন্দোলনের, বিশেষ করে এই দেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিষয়টি ঘোরতরভাবে জনপরিসরগত বিষয়ও বটে। তবুও, কেন সে সম্বন্ধে কোনও কথা কোনোদিন বলেননি লীলা? প্রসঙ্গত পার্টি ভাগের রাজনীতির সম্পর্কে মহিলা কমরেডদের অস্বস্তির ইতিহাস ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে কোনও নতুন কথা নয়। মনে করে দেখুন মণিকুন্তলা সেনের কথা। যিনি কিনা ১৯৬৪-এর পার্টি ভাগের পরে রাজনৈতিক জনপরিসর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সজোরে। কোথাও কি তবে মহিলা কমরেডরা পার্টিভাগের রাজনীতির সাথে পৌরুষের রাজনীতির সম্পর্ক দেখেছেন? কিন্তু, কমিউনিস্ট রাজনীতির যে স্বীকৃত ভাষা, তাঁর মধ্যে দিয়ে সম্ভব হয়নি তাঁদের এই সমালোচনার অভিব্যক্তি? তাই, লীলার এই নীরবতা আমাদের একটি প্রশ্ন করতে বাধ্য করে। তা হল, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ভাষা কি মূলত পৌরুষের ভাষা, যার মধ্যে আসলে পার্টির অগ্রণী মহিলা কমরেডদের রাজনৈতিক চেতনাও আসলে স্থান পায়নি?

 

সেই জায়গা থেকে দেখতে গেলে, এই বইটির ভূমিকা দ্বিবিধ। একদিক থেকে এক অদ্ভুত ধরনের পারিবারিকতার রাজনীতি ঘনীভূত হয়েছে বইটির মূলগত সংকলনের কাজের মধ্যে দিয়ে। যে পারিবারিকতার রাজনীতি লীলা মজুমদারের রাজনৈতিক বৈষয়িকতাকে ম্রিয়মাণ করে তোলে।

 

ইলিনা সেন বা বাসন্তী রামণের লেখায় অন্য সুর ধরা পড়লেও কেমন যেন মনে হয়, এই লেখাগুলি অনেকটাই কেটে ওপর থেকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি লেখাগুলির সাথে এদের আছে একটি বড় তফাত। অন্যদিকে বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল, এই বিষয়েও সন্দেহ নেই। এক ব্যক্তির জীবনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে যে গল্পটি এই বইটি শোনাতে চেয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অতীব জটিল। কোনও নিটোল গল্প এই বইটির লেখাগুলি থেকে উঠে আসে না। যা উঠে আসে, তা হল বহু বহু প্রশ্ন। এই প্রশ্ন তোলার কাজে বইটি সফল। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, প্রশ্ন তোলাই বোধহয় আমাদের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ।

 

লেখক কবি ও সাহিত্যের অধ্যাপক।

 

 

Share this
Leave a Comment