প্রসঙ্গ রাষ্ট্রভাষা: ভ্রম নিরাশ


  • September 30, 2019
  • (1 Comments)
  • 2958 Views

“রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ নিয়ে চতুর্দিক ব্যাপ্ত কিছু ভয়ানক আকারের ভুল ধারণার অবসান ঘটানোর জন্য নীচে কয়েকটি কথা তুলে ধরতে চাই। সৌজন্য—জেনারেল অমিত শাহ।” লিখছেন অশোক মুখোপাধ্যায় এই লেখার মতামত লেখকের নিজস্ব। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও লেখার জন্য গ্রাউন্ডজিরো পাঠকদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছে।

 

দিন কয়েক আগে (১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯) ভাজপা-রাজের কোতোয়াল অমিত শাহ হিন্দিকে দেশের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেবার পর থেকে অনেকেই বলে যাচ্ছেন, এই লোকটা কিচ্ছু জানেন না, ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বলে কিছু নেই, হিন্দি সহ সমস্ত ভাষাই আঞ্চলিক ভাষা, এটা হিন্দিভাষীদের প্রচার, মিডিয়ার প্রলাপ, ইত্যাদি।

 

সত্যিই কি তাই? অমিত শাহ কিছুই না জেনে স্রেফ নাগপুরি চাপে বা চালে এই কথা বলে ফেলেছেন? নিছক ভাজপা আর আরএসএস-এর আদর্শের(?) দায়ে? এক দেশ এক ভাষা মন্ত্র উচ্চারণের তাগিদে?

 

হ্যাঁ, এই তাগিদের কথায় মনে পড়ল, এটা সত্য যে বিজেপি-র অধিকাংশ নেতারই গণিতের সংখ্যা জ্ঞান ‘এক’-এর পরে আর তেমন এগোয়নি। ফলে মাঝে মাঝেই তাঁরা এক দেশ + এক আইন + এক ভাষা + এক ধর্ম + এক দল + এক খাদ্য + . . . প্রচার করে ফেলেন! সে এক অন্য অজ্ঞতার কথা। কিংবা চিন্তা দৈন্যের। হিন্দির প্রশ্নেও কি তাই?

 

দুঃখিত। যাঁরা এরকম বলে যাচ্ছেন, তাঁদের দুটো জায়গায় মস্ত ভুল হয়ে যাচ্ছে। [১] তাঁরা দেশের সাবেক তাবড় কংগ্রেসি পাণ্ডাদের দুর্বুদ্ধির মাত্রাকে খুবই অবগ্রামিত করে দেখছেন; [২] ভারতের সংবিধানকে তাঁরা সম্ভবত উল্টেপাল্টে কখনও দেখেননি। দেশের ভাষা নীতি সম্পর্কে লোকমুখে এধারে ওধারে যা শুনেছেন, তাই নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে বলে যাচ্ছেন।

 

[১]
অতঃপর তাঁদের পঠন ও চিন্তনের জন্য ভারতের পবিত্র সংবিধান থেকে দুতিনটে পৃষ্ঠা তুলে ধরতে বাধ্য হচ্ছি [পেলব-লিপির ভিত্তিতে]। প্রথমেই সবাইকে দেখতে অনুরোধ করছি, সরকারি ভাষার প্রশ্নটা আলোচনা করা হয়েছে সংবিধানের যে সপ্তদশ অংশে, সেখানে চারটে অধ্যায় আছে, আমরা এখানে তার মধ্য থেকে কিছু উদ্ধৃতি সহযোগে কথা বলব। এই পর্ব শুরুই হচ্ছে CHAPTER I.—LANGUAGE OF THE UNION দিয়ে। এখন প্রশ্ন হল, Language of the Union এই শব্দসমষ্টির মানে কী? কিংবা আরও আগে ভাবুন, এখানে এই Union-এরই বা মানে কী?

 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকদের জিগ্যেস করলে তাঁরা বলে দেবেন, এই Union হল আসলে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা প্রতিচিত্রিত ভারত রাষ্ট্র; আর Language of the Union মানে হল, সেই ভারত রাষ্ট্রেরই কেন্দ্রীয় সরকারি ভাষা। এবং সেই অধ্যায়ের প্রথম ধারাতে (৩৪৩ নং ধারার উপধারা-১) ভারি স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে, “343. (1) The official language of the Union shall be Hindi in Devanagari script.” অহো, সরল বাংলায় যার অর্থ হচ্ছে, ভারতীয় রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা হচ্ছে দেবনাগরী হরফে লিখিত হিন্দি ভাষা।

 

১৯৫০ সনে সংবিধান প্রণয়ন ও প্রবর্তনের সময় কংগ্রেসি বাঘা বাঘা নেতারা যখন এই সব ভাষার সুমিষ্ট প্যাঁচ খেলছিলেন, তখন দেশে বিজেপি-ও ছিল না, গড়ে উঠলেও জনসঙ্ঘেরও তেমন কিছু করার সাধ্য ছিল না। বরং ওদেরই পূর্বপুরুষ ও রাজগুরু হিসাবে নেহরু চাচার আমলেই এই সব লেখা হয়ে গিয়েছিল। তবে “Hindi is the Official Language of India” না বলে এই যে চালাকিটুকু করে তাঁরা The official language of the Union shall be Hindi লিখে দিয়েছিলেন, এর ফলেই নেহরুর উদার(?)নৈতিক রাজনীতিতে আস্থাবান অহিন্দিভাষী গুচ্ছ গুচ্ছ লোক শব্দার্থ ধরে মাথা না ঘামিয়ে এতকাল ধরে ভেবে চলেছেন, হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয়, কোনোকালেই নাকি ছিল না! সংবিধান প্রণেতারা নাকি অত মূর্খ বা কট্টর ছিলেন না, তাঁরা দেশের বাস্তবতা বুঝতেন, ইত্যাদি। অথচ, তাঁরা একবারও ভেবে দেখেননি, ভারত বা ভারতরাষ্ট্র না হলে এই Union ভদ্রলোক তবে কে?

 

এই সব আলোচনার শেষে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে CHAPTER II.—REGIONAL LANGUAGES এবং সেখানে স্বভাবতই হিন্দি প্রসঙ্গ আর উচ্চারিত হয়নি। আছে বিভিন্ন রাজ্য এবং বাংলা তামিল অসমিয়া মারাঠি ইত্যাদি “আঞ্চলিক” ভাষার কথা। অবশ্য কারও নাম না তুলে। সুতরাং হিন্দির জায়গাটা অমিত শাহ কথিত স্থানেই অনেক কাল আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। আমরা যে বুঝিনি, সে তো আর সংবিধায়কদের দোষ নয়। বারুখ স্পিনোজা বহু দিন আগেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, Ignorantia non est argumentum; জানতুম না তো—কোনো যুক্তি নয়! জেনে নেওয়াটা আপনার এবং আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

 

[২]
অনেকেরই ধারণা, অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলির জনগণের ব্যাপক হিন্দি-বিরোধী মনোভাব লক্ষ করে এবং সেই বিক্ষোভের চাপে পড়েই ইংরেজিকেও হিন্দির পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে পনের বছর, পরে যত দিন না সারা ভারতে হিন্দি গৃহীত হয়, তত দিন। কিন্তু একের পর এক জায়গায় যে এই সিদ্ধান্তও লঙ্ঘিত হয়েছে বা এখনও হচ্ছে, বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ক্রমাগতই ইংরেজিকে হঠিয়ে হিন্দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে সেই নেহরুর “আংরেজি হঠাও” মন্ত্র উচ্চারণ করে, তা অনেকে লক্ষ করলেও পেছনে সংবিধানের মদতের বিষয়টি দেখতে পাননি।
পশ্চিম বঙ্গে ১৯৮০-র দশকে সিপিআই (এম) পরিচালিত রাজ্য সরকার যখন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের অপপ্রচারের আড়ালে আসলে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি শিক্ষা তুলে দিল, এবং তার বিরুদ্ধে এসইউসিআই-এর উদ্যোগে যখন প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি শিক্ষা চালু রাখার দাবিতে আন্দোলন চলছিল, তখন বামফ্রন্ট সমর্থক অনেক বুদ্ধিজীবীকেই বলতে শুনেছি, আপনারা যে এমন দাবি করছেন, ভারতে সেই ১৯৪৮ সালে রাধাকৃষ্ণান কমিশন থেকে শুরু করে ১৯৬৮ সালের কোঠারি কমিশন পর্যন্ত যতগুলি শিক্ষা কমিশন বসেছে, তাতেও তো প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়ানোর বিরোধিতা করা হয়েছে।

 

এইটুকু তাঁরা ঠিকই বলেছেন। শুধু আবারও যদি বলার আগে সংবিধানের প্রাসঙ্গিক পাতাগুলি তাঁরা একটু নেড়েচেড়ে দেখে নিতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন, এরকম বলা ছাড়া (রাধাকৃষ্ণান কমিশন ছাড়া) সেই সব কমিশনের সদস্যদের হাতে অন্য কিছু সুপারিশ করার কোনো সুযোগ বা ক্ষমতা ছিলই না। ভারতের সংবিধান সেই অধিকার তাঁদের দেয়নি।

একটু পড়ে নিন:
344. (1) The President shall, at the expiration of five years from the commencement of this Constitution and thereafter at the expiration of ten years from such commencement, by order constitute a Commission which shall consist of a Chairman and such other members representing the different languages specified in the Eighth Schedule as the President may appoint, and the order shall define the procedure to be followed by the Commission.
(2) It shall be the duty of the Commission to make recommendations to the President as to —
(a) the progressive use of the Hindi language for the official purposes of the Union;
(b) restrictions on the use of the English language for all or any of the official purposes of the Union;
ইত্যাদি [মোটা হরফ আরোপিত]।

 

অর্থাৎ, ৩৪৪ নং ধারার ২ক ও খ উপধারা মতে, কমিশন বসলেই তাকে রাষ্ট্র(ইউনিয়ন)-এর সরকারি কাজকর্মে হিন্দির ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধির পরামর্শ দিতে হবে এবং সমস্ত (all or any) ব্যাপারে ইংরেজির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রস্তাব পেশ করতে হবে। “সমস্ত” বললে যে শিক্ষাও তার মধ্যে পড়ে, আশা করি কাউকে ব্যাখ্যা করে বলে দিতে হবে না। অস্যার্থ, কংগ্রেসের সেইকালের জ্ঞানীগুণীরা কোনো ঝুঁকি নেননি। কমিশনে বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিই থাকবেন, কিন্তু তাঁদের সবাইকে ভাষার প্রশ্নে কী বলতে হবে, কী সুপারিশ করতে হবে, তা বলে দেওয়া রইল।
অতুল প্রসাদ তত দিন বেঁচে থাকলে গাইতেন —
“এক ভাষা এক মত এক পরিধান,
বিবিধ চুলোয় যাক, “এক” সুমহান!”

 

মহান ভারতবর্ষেই আপনি পাচ্ছেন পৃথিবীর একমাত্র সংবিধান, যেখানে কোনো ভাষা কমিশন বা শিক্ষা কমিশন বসলে তাকে কী সুপারিশ করতে হবে, তা অগ্রিম বলে দেওয়া আছে। বহুত পয়সা খরচা করে ঢাক ও ঢোল পিটিয়ে এক একটা এরকম তোতা-কমিশন বসানোর দরকার কী — আশা করি, কেউ জিগ্যেস করবেন না। এই বাবদ রাজকোষে যে অর্থ বরাদ্দ করা থাকে, তাকে খরচ না করলে চলে?

 

[৩]
সুতরাং ভাষার প্রশ্নে ভারত রাষ্ট্রের কাজ কী হবে? ভাবছেন সেই বিশাল সংবিধান গ্রন্থ তা বলে দেয়নি? আবারও ভুল ভাবছেন। চতুর্ধ অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদটি পড়ুন (ধারা নং ৩৫১):

“351. It shall be the duty of the Union to promote the spread of the Hindi language, to develop it so that it may serve as a medium of expression for all the elements of the composite culture of India and to secure its enrichment by assimilating without interfering with its genius, the forms, style and expressions used in Hindustani and in the other languages of India specified in the Eighth Schedule, and by drawing, wherever necessary or desirable, for its vocabulary, primarily on Sanskrit and secondarily on other languages.” [মোটা হরফ আরোপিত]

 

অমিতজিও ঠিক এই কাজই করছেন। কেন্দ্রের মন্ত্রী হিসাবে হিন্দি পক্ষে হিন্দির বিস্তারের সপক্ষে কথা বলেছেন। যা সেই পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর আমল থেকে ১৯৫০ সালে প্রবর্তিত স্বাধীন ভারতের সংবিধান করতে বলেছে। একদম আক্ষরিক আনুগত্য সহ। খামোখাই লোকটাকে আপনারা অনেকে গাল দিচ্ছেন! কংগ্রেসি নেতারাও বলতেন!

 

আমার স্কুল জীবনের একটা গল্প বলি।

আমাদের আমলে স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে এক বছর হিন্দি পড়ানো হত। ১৯৬৬ সালে আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, একজন হিন্দি ভাষী স্যর (নাম এখন মনে নেই) খুব যত্ন সহকারে বাংলার মাধ্যমেই হিন্দি পড়িয়ে আমাদের ক্লাশের সবাইকেই কম বা বেশি ২৬টার মতো হিন্দি শব্দ শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তার সাহায্যে আমরা সহপাঠীরা প্রায় সকলেই স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় হিন্দিতে পত্রোত্তর নম্বর পাই। সেই সেবারেই আমরা শিখেছিলাম, শুদ্ধ হিন্দিতে জলকে জলই বলে, পানি বলে না: “ছোটি ছোটি জল কি বুঁদি সাগর কো ভর দেতি হ্যায়।” বাংলার সাথে কেমন একাত্মতা বোধ হয়েছিল। সেকালেই, অন্য একজন শিক্ষক, বাংলার স্যর, বাঙালি এবং কংগ্রেসি, ক্লাশ নিতে এসে নিয়মিত আমাদের বোঝাতেন — “দ্যাখ চাঁদেরা, হিন্দি আমাদের রাষ্ট্র ভাষা। ভালো করে শিখে নিস। বিদেশে গেলে এই হিন্দি দিয়েই লোকে আমাদের চিনবে।” এই একটি বাক্য আমাদের দুই কানের ফুটোর মধ্যে সহজে বাতাস প্রবাহের সক্ষমতা জানিয়ে যেত। সেকালে কংগ্রেসের তাবড় নেতারা রাস্তায় ঘাটে চায়ের দোকানে পাড়ার মোড়ে তাসের আড্ডায় বিয়েবাড়ির আসরে সুযোগ পেলেই এই বাণী ঝাড়তেন।

 

মাঝখানে কংগ্রেসের লোকজন এটা আর খুব একটা বলতে পারছিল না। তাদের সমস্যা হয়ে গিয়েছিল, ১৯৫২ সালের পর থেকে সংসদীয় শক্তি কমে আসছিল, বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। সরকার গঠনের স্বার্থে অনেক সময় তাদের সাথেই বোঝাপড়া, আঁতাত, বা জোট করে নির্বাচনে যেতে হচ্ছিল। ফলত, সংবিধানে যাই লেখা থাক, তাঁদের কথাবার্তায় একটু যুক্তরাষ্ট্রীয় হাবভাব রেখে চলতে হচ্ছিল। হিন্দির কথা তেমন চেঁচিয়ে বলা যাচ্ছিল না।

 

বিজেপি-র আবার উলটো। কংগ্রেসের পতন পথে তার যে সুধীর অভ্যুদয়, সেখানে তাকেও অনেক দিন পর্যন্ত আঞ্চলিক নানা দলের সঙ্গে আপস করে চলতে হয়েছে। ফলে হিন্দির কথাটা সে অনেক দিনই সাহস করে খুব জোরে উচ্চারণ করতে পারছিল না। এখন আপাতত তার সেই সমস্যা নেই। তাই এখন সে নেহরুর দেখানো রাস্তায় পা ফেলতে আর তেমন ভয় পাচ্ছে না। ভারত রাষ্ট্র নির্ধারিত সত্য কথাই সে বলছে। অন্তত এই একটি ব্যাপারে তারা ভারতীয় সংবিধান মেনেই পা ফেলছে। সেই দিক থেকে বলা যায়, ৫৩ বছর বাদে সেই সহি মিঠি বচন আবার শুনলাম।

 

[৪]
এই অবধি পাঠ করে পরিচিত দুচারজন হয়ত জানতে চাইবেন, আমাদের তাহলে এখন করণীয় কী। অভয় দিলে এবার সেই ব্যাপারেও দুচারটে কথা পেশ করে ফেলি।

 

একেবারে প্রথম কাজ হচ্ছে হিন্দিভাষীদের উদ্দেশ্যে বাজে কথা একদম না বলা। কংগ্রেসের নেতারা যে অপকর্ম করে রেখেছিলেন, তার দায় আমরা হিন্দিভাষীদের উপর চাপাতে পারি না। রাষ্ট্রীয় ভাষা নীতিতে তাদের অনেক বাড়তি সুবিধা হলেও তারা নিজে থেকে এই সুবিধা আদায় করে নেননি। ভারত রাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের এই সব সুবিধাপ্রাপ্তি ঘটেছে। রাষ্ট্র কেন এই নীতি নিয়েছে তা অন্য আলোচনা, এখানে খুব বেশি কিছু বলার অবকাশ নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে এরকম একটা আবেগও কাজ করে, কেন এখনও ভারতে সর্ব ব্যাপারে হিন্দি চালু করা গেল না। নেতাদের দুর্বলতার জন্যই এই কাজ সম্ভব হচ্ছে না। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন, এই আবেগ থাকা খুব স্বাভাবিক। না থাকলেই বরং অবাক হতে হত।

 

আগে যাই হোক, হিন্দিভাষীদের মধ্যেও খুব ব্যাপক ভাবে না হলেও ধীরে ধীরে এই বোধ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে যে ভারতের মতো একটা বহুভাষিক দেশে হিন্দিকে সারা দেশে বাধ্যতামূলক ভাবে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, এবং দেওয়া উচিত নয়। অন্যান্য অনেক পরিবর্তনের সাথে সমাজ মাধ্যমের বিকাশ এবং ভিন্ন ভাষিক চেনা অচেনা জনসাধারণের অনেকের মধ্যে প্রতি নিয়ত আলাপন এই বোধি লব্ধিকে ত্বরাণ্বিত করে তুলেছে। অতীতের ভাষা গোঁড়ামির বরফ গলতে শুরু করেছে।

 

পশ্চিমবঙ্গে বা অন্যান্য অহিন্দি রাজ্যে হিন্দিভাষীরা বাংলা বা স্থানীয় ভাষা শিখতে বলতে চান না — এরকম একটা অভিযোগ ওঠে। অভিযোগটা ভুল বা মিথ্যা নয়। কিন্তু এই প্রবণতা কেন, তা বোঝা দরকার। এর মধ্যে আছে ভাষিক সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্ব। “বাংলা বলতে থাকলে আমি হিন্দি ভুলে যাব, আমার সন্তানরা হিন্দি শিখবে না” ইত্যাদি। এই সমস্যা তো আছেই। ভারতের ভাষা নীতির কল্যাণে, প্রতিটি রাজ্যেই ভাষিক সংখ্যালঘুদের আপন মাতৃভাষা মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই বা কমে গেছে। স্কুল কিছু থাকলেও শিক্ষক নেই, বই নেই, প্রশ্নপত্র করার বা পরীক্ষার খাতা দেখার লোক নেই, এই রকম অনেক সমস্যা। বিহার উত্তর প্রদেশে বাংলা স্কুল কার্যত উঠেই গেছে। পশ্চিম বাংলায় হিন্দি স্কুলগুলি চলছে ধুঁকতে ধুঁকতে। আমাদের সহানুভূতির সঙ্গে এই সমস্যাকে দেখতে এবং কাটাতে হবে। বোঝাতেও হবে, আবার বুঝতেও হবে।

 

আমার এক কালের আধা-ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষ (উপরে উপরে যতই বাঙালি বিরোধী বলে মনে হোক) বাংলা সাহিত্যের যতটা খবর রাখেন, আমরা বাংলার শিক্ষিত সমাজ অন্য ভাষার সাহিত্যের সেই তুলনায় কিছুই প্রায় জানি না বা খবর রাখি না। প্রেমচাঁদ ছাড়া আর ক’জন হিন্দি সাহিত্যিকের খবর আমাদের আছে? কটা বই আমরা পড়েছি? ওড়িয়া বা কন্নড় সাহিত্যেরই বা কতটুকু আমরা পাঠ করেছি? নাটক বা সিনেমার বাইরে ভিন্ন ভাষী মানুষদের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অর্জন নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। এতটা গুটিপোকা-মনন নিয়ে আমরা ভাবছি, শাসক শ্রেণির ভাষা আগ্রাসন রুখে দেব!

 

অন্যদের লেখাপত্র পড়তে হবে। জানতে হবে। জানার বৃত্তটাকে বড় করতে হবে। শাসক শ্রেণির তরফে ভাষা আগ্রাসনকে রুখতে হলে জনগণের স্তরে ভাষা আলিঙ্গন বাড়াতে হবে।

 

সমাপনী বাক্য: পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চাপিয়ে দেবার সাথে ভারতে হিন্দি চাপিয়ে দেবার মিল আছে। শাসন কর্তাদের জবরদস্তির মিল। কিন্তু বাংলাদেশের উর্দু বিরোধী বাংলা ভাষার আন্দোলনের সাথে আমাদের হিন্দি আগ্রাসন বিরোধী অহিন্দি ভাষা রক্ষার আন্দোলনের কোনো মিল নেই। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উর্দুভাষীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ভাবতেই হয়নি। সেই প্রশ্নই সেখানে ছিল না। আমাদের আন্দোলনে হিন্দি ভাষীদেরও চাই। সেখানেই বিরাট ফারাক। লক্ষ্য এবং কৌশলে। আমরা বাংলা পক্ষ; আমাদের আন্দোলনটা হিন্দি সহ সকল ভাষা পক্ষ।
এরকম নানা অভাবিতপূর্ব জটিল প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। প্রশ্নগুলো সরল হল না কেন ভেবে কান্নাকাটি করে লাভ নেই। এটাই এখন সময়ের দায়!

 

লেখক ‘সেস্টাস’ নামে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক। এবং বিজ্ঞান ও মার্কসবাদের আলোয় বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে লোকপ্রিয় প্রবন্ধকার।

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Hafizur Rahaman on October 2, 2019

    Bhul dharona kaatlo.
    Hindi birodhita korbo kina confused chilam.Amar anek priyo manush Hindi/
    Urdu bhasi. Tai DHARMOSANKAT e chilam. POST ta moner megh katate sahajyo korlo. BIG THANKS.

Leave a Comment