সশস্ত্র সীমা বলের ছোঁড়া পাথরে কুমারগ্রামে বনগ্রামবাসী কিশোরের মৃত্যু


  • September 26, 2019
  • (0 Comments)
  • 1885 Views

গত শনিবার সশস্ত্র সীমা বলের (এসএসবি) ৩৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জওয়ানদের ছোঁড়া পাথরে স্থানীয় বনবস্তির কুশল লামা নামে ১৪ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। কুশল জঙ্গল লাগোয়া সঙ্কোশ নদীর চরে ঘাস জমিতে গরুছাগল চরাতে গিয়েছিল। লিখছেন আরোহণ বল

 

আসাম-পশ্চিমবঙ্গ-ভুটান সীমান্তে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গল লাগোয়া কুমারগ্রাম বনবস্তি। সঙ্কোশ নদী বয়ে গেছে পাশ দিয়ে। নদীর চরে ঘাস জমিতে গরু-ছাগল চরাতে যান গ্রামবাসীরা। গত শনিবারও কুমারগ্রামের তিন কিশোর গরু চরাতে গিয়েছিল। সশস্ত্র সীমা বলের (এসএসবি) ৩৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জওয়ানরা ওদের আটকায়। পালাতে গেলে রাজকুমার ছেত্রী নামে এক কিশোরকে ধরে ফেলে এসএসবি জওয়ানরা। তাকে টেনে হিঁচড়ে সেনা ছাউনির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাকিরা সেসময়ে নদী পেরিয়ে পালাতে গেলে জওয়ানরা এলোপাথাড়ি পাথর ছুঁড়তে আরম্ভ করে কিশোরদের লক্ষ করে। জওয়ানদের ছোঁড়া পাথর লাগে স্থানীয় কুশল লামা নামে ১৪ বছরের এক কিশোরের মাথার পেছনে। পাথরের আঘাতে সে নদীতে লুটিয়ে পড়ে। রাজকুমার বলে, ‘ছেলেটা নদীতে পড়ে গেছে, ওকে তুলতে হবে…।’ জওয়ানরা সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রাজকুমারকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এদিকে গ্রামবাসীরা কিশোরদের খোঁজে এসএসবি-র ক্যাম্পের সামনে জড়ো হতে শুরু করলে রাজকুমারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পেয়ে রাজকুমার গ্রামবাসীদের বলে পাথরের আঘাতে বন্ধুর নদীতে লুটিয়ে পড়ার কথা। সবাই সেখানে কুশলকে খুঁজতে গেলে দেখা যায় কুশলের প্রাণহীন দেহ সঙ্কোশের জলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ভেসে গেছে।

 

কুশল স্থানীয় আদর্শ হিন্দু উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ত। গ্রামের ছেলেকে এমন নৃশংসভাবে খুন করার খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন গ্রামবাসীরা। সেনা ছাউনির সামনে গাছের গুঁড়ি, টায়ারে আগুন লাগিয়ে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। অভিযোগ, কুমারগ্রাম থানার পুলিশ এসে লাঠিচার্জের ভয় দেখিয়ে তাড়া করে গ্রামবাসীদের। পুলিশই কুশলের মৃতদেহ নিয়ে যায় ময়নাতদন্ত করতে। রবিবার সেই মৃতদেহ পাঠানো হয় আলিপুর জেলা হাসপাতালের মর্গে।

 

উত্তরবঙ্গের বনগ্রামবাসীদের সংগঠন উত্তরবঙ্গ বন জন শ্রমজীবী মঞ্চের প্রতিনিধিরা এসএসবি আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলতে যান। এসএসবি-র আধিকারিকরা তাদের জানান, ‘গ্রামবাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে দু’-চার বোতল করে ফরেন লিকার আনে, তারা মদ খায়। আমাদের কাজ জঙ্গল পাহারা দেওয়া।’ তখন মঞ্চের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন করেন ১৪ বছরের ছেলেটা কি ফরেন লিকার নিয়ে নদী পেরোচ্ছিল? মঞ্চের দাবি, জবাবে ফের ‘আজগুবি’ গল্প ফাঁদেন এসএসবি-র ডিআইজি। বলেন, ‘না ওরা জঙ্গলে গাছ কাটতে গেছিল।’ আবার পালটা প্রশ্ন আসে, তাহলে আপনারা জঙ্গল থেকে কেটে আনা মাল সিজ করেছেন? ডিআইজি বাধ্য হয়ে বলেন, না তারা সেরকম কিছু পাননি। এখানেই শেষ নয়, এসএসবি-র আধিকারিক বলেন, কুশল নাকি ‘বদ-সঙ্গে’ পড়েছিল। ওর বাবা-মা কবে নাকি এরকম জানিয়েছে। মঞ্চের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন করেন, ‘বদ’ বন্ধুদের সাথে মিশেছে বলে মনে হওয়ার জন্যে ছেলেটাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলবেন! ডিআইজি বলেন, এরা জঙ্গল থেকে খড়ি কেটে আনে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে এসএসবি-কে বলা হয়েছে খড়ি কাটা বন্ধ করতে।

 

প্রসঙ্গত বন অধিকার আইন (২০০৬) অনুসারে খড়ি, গাছের শুকনো ডাল ইত্যাদি গৌণ বনজদ্রব্যের (মাইনর ফরেস্ট প্রোডিউস) মধ্যে পড়ে এবং বনবাসী, বনজীবী, মৎস্যজীবীদের গৌণ বনজদ্রব্যের অবাধ ব্যবহারের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বন অধিকার আইনে। বন দপ্তর, এসএসবি যে বেআইনি কথা বলছে তা স্পষ্ট।

 

একজন প্রত্যক্ষদর্শী তদন্তকারী দলকে জানিয়েছেন যে, যে জওয়ানরা পাথর ছুঁড়েছিল সে তাদের চিহ্নিত করতে পারবে। তার ব্যবস্থা করতে ডিআইজিকে তদন্তকারীরা অনুরোধ করলে ডিআইজি বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী ছেলেটা ‘ইল্লিগাল’কাজের সাথে যুক্ত আছে, এসএসবি ক্যাম্প যবে থেকে এখানে আছে,  তার কাজে ব্যাঘাত ঘটছে, তাই সে এখন এসব বলছে। ডিআইজিকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি কি তখন ওখানে ছিলেন যে প্রত্যক্ষদর্শীর ব্যাপারে এসব বলছেন?’ এর পর  ডিআইজি’র কাছে আর কোনও উত্তর ছিল না বলে জানান তদন্তকারীরা। গ্রামবাসীরা ততক্ষণে দাবি তোলেন, অভিযুক্ত জওয়ানদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করার। কিন্তু জানা যায় অভিযুক্ত জওয়ানদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

 

উত্তরবঙ্গে বনগ্রামগুলোতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বা সেনার উপদ্রব, হামলা, খুন, ধর্ষণ নতুন ঘটনা নয়। কুমারগ্রামেই ২০১০ সালে সীতা ছেত্রী নামে চল্লিশোর্ধ্ব এক মহিলাকে জওয়ানরা ধর্ষণ করে খুন করে বলে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন। উত্তরবঙ্গের এক গ্রামে ছ’বছরে সাত জন মানুষের বন দপ্তরের গুলিতে মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। জঙ্গল-নির্ভর মানুষগুলোকে, বনাধিকার আইন মোতাবেক বনের ওপর যাবতীয় অধিকার যে বনগ্রামবাসীদের, কাঠচোর অপবাদ দিয়ে তাদেরকেই খুন করে জঙ্গল-ব্যবসায়ী বনদপ্তর। প্রায় প্রত্যেকবারই তারা গুলি চালায় ‘আত্মরক্ষার্থে’ কিন্তু গুলিগুলো এসে লাগে বনগ্রামবাসীদের পিঠে, বুকে, মাথায়।

 

ইদানীং কুমারগ্রামে গ্রামের ফুটবল খেলার মাঠ দখল করে এসএসবি-র সেনা ছাউনি তৈরি হওয়ার পর গ্রামের মেয়েরা বাইরে বেরোলেই জওয়ানদের বিশ্রী কটুক্তির মুখে পড়ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। গুরুতর অভিযোগ যে, গ্রামের মেয়েদের উদ্দেশ্যে সেনা বলছে, ‘রেপ কর দেঙ্গে’। আরও অভিযোগ, এমনকী গ্রামের মেয়েদের বাড়ি খুঁজে খুঁজে সেখানে আড্ডা বসাচ্ছে এসএসবি জওয়ানরা। তাদের আত্মীয়দের ওপর হুমকি, মারধোর চলছে। এসএসবির অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রামবাসীরা মুক্তি পেতে চাইছেন। তাঁদের দাবি কুশলের হত্যার সাজা দিতেই হবে দোষী জওয়ানদের। গ্রামবাসীরা জওয়ানদের তাঁদের গ্রামের আওতায় থাকতে দিতে নারাজ। গ্রামবাসীরা কুশলের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। গত সোমবার মোমবাতি জ্বালিয়ে মিছিলও করেন শোকসন্তপ্ত গ্রামবাসীরা। তাঁদের স্পষ্ট দাবি, এসএসবি ক্যাম্প তুলে নিতে হবে গ্রাম থেকে। খুনি সেনাকে গ্রামের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিতে চান না তাঁরা।

 

 

 

Cover Image : সঙ্কোশ নদী  (ভুটান ঘাট অঞ্চল); video : মৃত গ্রামবাসী  কুশল লামার মায়ের কথা ।  Courtesy  :  উত্তরবঙ্গ বন জন শ্রমজীবী মঞ্চ ।

 

লেখক আরোহণ বল একজন সামাজিক কর্মী।

 

 

Share this
Leave a Comment