যাদবপুর : একটি ফ্যাসিস্ত অভিযান এবং গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের কাহিনি। 


  • September 24, 2019
  • (0 Comments)
  • 1288 Views

যাদবপুর ক্যাম্পাসে তখন গানে গানে প্রতিরোধের শপথইনকিলাব জিন্দাবাদ’-এর সঙ্গেই রব উঠছিলহোক হোক হোক কলরব গোলপার্ক থেকে এবিভিপি নামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অভিযান, যোধপুর পার্কে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে এসে কেমন মিইয়ে গেল লিখেছেন দেবাশিস আইচ এবং সুদর্শনা চক্রবর্তী 

 

এক।

দলিত, ফ্যাসিস্ত, আজাদি কী শব্দচয়নএবিভিপি‘- অভিযানে? প্রশ্ন তুললেন দেবাশিস আইচ


বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া।  এবিভিপি’র নামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অভিযান, যোধপুর পার্কে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে এসে কেমন মিইয়ে গেল। মুহুর্মুহু উড়ে এল না ইট, ভেঙে পড়ল না ব্যারিকেড, লাঠিয়াল অলস, জল কামান রইল দুপুরের ভাতঘুমে। রোবো কপদের টিকি দেখা যায়নি লাইভ  টেলিকাস্টে। অথচ কী হয় কী হয় ভাবের অভাব ছিল না।

 

শোনা কথা, সত্যি-মিথ্যা জানি না। টেলিভিশনের অ্যাঙ্কররা নাকি ভোরবেলা ভীষ্মলোচনের মতো গান জুড়ে থাকেন। এমন দিনগুলিতে সেই রেওয়াজের মাত্রা বাড়ে। বুমদা, বুমদিদেরও নাকি রেওয়াজ করতে হয়। দুর্ভাগ্য, ‘দিল্লি থেকে বর্মা’ কাঁপানো হানাদারি গলাগুলোও এইদিন কেমন নিস্তেজ শোনালো। এমন স্যাঁতসেঁতে আন্দোলনে অ্যাড্রিনাল থেকে কতটুকু রসই-বা নি:সৃত হতে পারে!

 

গোলপার্কের জমায়েতের প্রথম ছবি যখন দেখা গেল, তখন কোথায় ছাত্র-ছাত্রীরা? দেখা যাচ্ছে দাদাদের, লাল পাড় সাদা শাড়ির দুর্গা দিদিদের, কাকা-কাকিমারাও আছেন, দু’চারজন বড় জেঠু, ছোট দাদুকে দেখা গেল। তবে যে টেলিভিশন স্ক্রিনে এক উইন্ডোর উপরে ক্যাপশান ‘এবিভিপি’র মিছিল’ অন্যটিতে ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখা? অ্যাঙ্কর কিংবা গ্রাউন্ড জিরো থেকে রিপোর্টারও বলছে এবিভিপি’র মানে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের যাদবপুর অভিযানের কথা। কিছুক্ষণের মধ্যে রহস্য উদঘাটিত হল। এক সাংবাদিক ধরে ফেললেন এক শীর্ষ যুবনেতাকে। তিনি অভিযান নিয়ে কিছু বললেন না। স্রেফ জানালেন, এটা ছাত্রদের আন্দোলন  আর তাঁরা নাকি এসেছেন জল, খাবার নিয়ে সাহায্য করতে। তো সে আর দোষের কী! কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কেন্দ্রে কিংবা চাকরির ইন্টারভিউ কেন্দ্রেও অনেক বাপ-মা’কে দেখা যায় জলের বোতল আর টিফিন বাক্স হাতে। এ বাঙালির সাম্প্রতিক পারিবারিক সাংস্কৃতিক অর্জন। আর এতো ছেলে চলেছে যুদ্ধে।

Pic courtesy : Soumyajit Pramanick

যাই হোক, মিছিল শুরু হতে ছাত্রদেরই দেখা গেল সামনের সারিতে। খুব বেশি হলে শ’খানেক। পরের সারি থেকেই ‘অভিভাবক’রা। মিছিলের শীর্ষ ব্যানারও চমকে দেওয়ার মতোই। দু’লাইনে লেখা ‘গণতন্ত্র-বিরোধী, দলিত-বিরোধী / ফ্যাসিস্ট, দেশদ্রোহী কমিউনিস্টদের জানাই ধিক- ধিক-ধিক্কার’। কী কাণ্ড! নাগপুর তো মুর্ছা যাবে। গুরু গোয়ালকার হিটলারের যে ফ্যাসিস্ত আদর্শকে ভিত্তি করে হিন্দু  ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ নির্মাণ করলেন, সেই ফ্যাসিবাদকেই ধিক্কার জানাচ্ছে বাংলার বিদ্যার্থী পরিষদ? তাও আবার শীর্ষ ব্যানারে। শুধু কি তাই? ব্যানারে  আবার লেখা হয়েছে ‘দলিত’। আরএসএস-এর অভিধানে ‘দলিত’ বলে কোনও শব্দ কস্মিনকালে কখনও ছিল না। আরএসএস-এর ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবাদে দলিত, মহাদলিত ভাগাভাগি নেই। সকলেই হিন্দু, আদিবাসীরাও। এই তো এক বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ পাঠিয়েছে, সরকারি ফাইলে যেন ‘দলিত’ শব্দটি ব্যবহার না-করা হয়। বিস্ময়ের আরও কিছু বাকি ছিল। ক্যামেরা ছাত্রদের কলাম পেরিয়ে একটু ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, দাদাগোছের কয়েকজন ভরপুর স্লোগান দিচ্ছে, ‘জোরসে বলো আজাদি’, ‘কমিউনিস্টসে আজাদি’, ‘মাওবাদী সে আজাদি’। আজাদি? এযে দেশদ্রোহীদের শ্লোগানের অঙ্গ। বাংলার সঙ্ঘীরা তো সব গুলিয়ে দেবে দেখা যাচ্ছে।

 

পুনঃ : মিনিট ১৫-২০ ব্যারিকেড ভাঙার, টপকানোর চেষ্টার পর পুলিশের অনুরোধ মান্য করে এবং একরকম হতাশ হয়ে অবস্থানে বসে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। এরই মধ্যে এক ছাত্রকে দেখা গেল ব্যারিকেডে মাথা ঠুকতে আর এক পুলিশ কর্মী তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। সার্জিকাল স্ট্রাইকই বটে।

Pic courtesy : Utsarjana Mutsuddi

 

দুই।

যাদবপুর ক্যাম্পাসে তখন গানে গানে প্রতিরোধের শপথ উষ্ণতা মাখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী 

 

 

সকাল সাড়ে এগারোটার একটু পরে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছলাম, তার অনেক আগে থেকেই সেখানে পড়ুয়ারা মজুত হয়ে গেছেন। চলছে পোস্টার লেখা, ব্যানার তৈরির কাজ। আগে থেকে তৈরি করা ব্যানার-পোস্টার এনে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। বেলা যত এগোতে থাকে, ততই শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রী এসে হাজির হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, আশেপাশের চায়ের দোকান, রাস্তার এপার-ওপার জুড়ে তখন ফ্যাসিবাদীদের রুখে দেওয়ার জন্য জোট বাঁধছেন সকলে। গানের সুরে ভেসে যাচ্ছে ক্যাম্পাস। ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল’, ‘গাঁও ছোড়াব নাহি’, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। প্রতিরোধের গানে গানে নানা দলে ভাগ হয়ে চলছে — এক ইঞ্চি মাটিও মানুষ-বিরোধী ধর্মীয় জিগির তোলা দলকে, তার ছাত্রশাখাকে, ছেড়ে না দেওয়ার শপথ। স্ট্যান্ড উইথ জেইউ ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন একে অপরকে। ১৯ তারিখ ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিক প্রতিবন্ধী তড়িৎ দাশকে দেখা গেল ভিড়ে ঠাসা দোকান সামলাতে। আহত ছাত্র পবনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছেছিলেন। বামমনস্ক দলের পড়ুয়াদের পাশাপাশি একজোট হয়েছিলেন সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি অনেক প্রাক্তনী তথা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নন এমন বহু মানুষও, যারা এই প্রতিরোধের সমর্থনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-এর সঙ্গেই রব উঠছিল ‘হোক হোক হোক কলরব’। তার মাঝেই এক বিরাট লাল পতাকায় শ্লোগান লিখে প্রথমে তা ক্যাম্পাসের ভেতরে ও তারপর চার নম্বর গেটের সামনে এনে বাজনার তালে উত্তোলন করে যেন ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরূদ্ধেই বার্তা পাঠাতে থাকেন পড়ুয়ারা। এবিভিপি-র মিছিল আসার সময় এগিয়ে আসতেই তীব্র রোদকে উপেক্ষা করে চার নম্বর গেটের সামনে হাতে হাত ধরে মানবপ্রাচীর তৈরি করে দাঁড়িয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা। একটি শব্দও না-বলে তাঁরা জানিয়ে দেন — ছাত্রছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটিও আঘাত হানার আগে তাঁদের মোকাবিলা করতে হবে। রাস্তায় তখন পুলিশ আর গণমাধ্যমের জটলা এদিকে-ওদিকে। বহুক্ষণ তাঁরা পড়ুয়াদের নিয়ে সেই প্রাচীর তৈরি করে দাঁড়িয়েছিলেন। এই দৃশ্য সাম্প্রতিককালে বিরল। নানা সূত্রে খবর আসতে থাকে মিছিলের। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে  কৌতূহল  বাড়তে থাকে। যদি সত্যিই এবিভিপি-র মিছিলকারীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছতেন তাহলে এক বিরাট প্রতিরোধের সামনে পড়তেন সন্দেহ নেই। সময় পেরিয়ে যাওয়া ও তাদের রণভঙ্গ দেওয়ার খবর এসে পৌঁছালে অধ্যাপক, পড়ুয়া ও সমর্থনকারীরা ধীরে ধীরে প্রতিরোধ তোলেন, মুখে তাঁদের জিতে যাওয়ার আনন্দ আর ভবিষ্যতে আরও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা।

 

 

 

Cover Image : সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

Share this
Leave a Comment