নিয়মগিরি: হাসপাতাল নয়, তৈরি হচ্ছে স্থায়ী পুলিশ ছাউনি, চলছে অবৈধ গ্রেপ্তারী।


  • September 7, 2019
  • (1 Comments)
  • 2920 Views

নিয়মগিরির মানুষ পাঁচ ফুটের বেশি চওড়া রাস্তা চান না। তাঁদের মতে খুব বেশি চওড়া রাস্তার প্রয়োজন এখানকার মানুষের নেই। তাঁদের আশঙ্কা, রাস্তা বেশি চওড়া হলে গ্রামে পুলিশের আনাগোনা বেড়ে যাবে, আর মাওবাদী দমনের নামে নিরীহ গ্রামবাসীদের হয়রানি করার প্রবণতাও চরমে উঠবে। এই চওড়া রাস্তা তৈরির প্রস্তাবে সম্মতি না-দেওয়ার কারণেই নিয়মগিরিকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিষেবাগুলো থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। লিখেছেন জসিন্তা কেরকেটা

 

 

 

ওড়িশার কালাহান্ডি আর রায়গড়া জেলার মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত নিয়মগিরির ডোঙরিয়া কোন্ধ আদিবাসীরা ইদানীং কালে হরেক রকমের মরশুমি অসুখ-বিসুখের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। এই অঞ্চলে কখনও কোনও ডাক্তারের দেখা মেলে না। কোনও হাসপাতালও এখানে নেই। নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি-র সঙ্গে যুক্ত উপেন্দ্র ভাইয়ের কথায়, “আমরা সমিতির তরফ থেকে মাঝেমাঝে চিকিৎসা শিবিরের আয়োজন করি। কিন্তু পুলিশ আমাদেরকে গ্রামে ওষুধ পৌঁছে দিতে বাধা দেয়। পুলিশের বক্তব্য, এইসব ওষুধ নাকি মাওবাদীদের হাতে গিয়ে পৌঁছায়। এর অর্থ এটাই যে পুলিশের চোখে নিয়মগিরির প্রতিটি গ্রামবাসীই মাওবাদী, আর তাই তাদের কাছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় ন্যূনতম জিনিসগুলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাধা দেওয়া হয়। এটা খুবই দুঃখের।”

 

উপেন্দ্র ভাই আরও জানালেন যে নিয়মগিরির মানুষও হাসপাতাল এবং তাঁদের মাতৃভাষা ও অন্যান্য ভাষায় পড়াশুনো করার জন্য স্কুল চান। কিন্তু এইসব সুযোগ-সুবিধার বদলি হিসেবে তাঁদের সামনে রাস্তা তৈরির শর্ত রাখা হয়। নিয়মগিরির মানুষ কিন্তু পাঁচ ফুটের বেশি চওড়া রাস্তা চান না। তাঁদের মতে খুব বেশি চওড়া রাস্তার প্রয়োজন এখানকার মানুষের নেই। তাঁদের আশঙ্কা, রাস্তা বেশি চওড়া হলে গ্রামে পুলিশের আনাগোনা বেড়ে যাবে, আর মাওবাদী দমনের নামে নিরীহ গ্রামবাসীদের হয়রানি করার প্রবণতাও চরমে উঠবে। তার সঙ্গেই খনিজ পদার্থ খোঁড়াখুঁড়ির জন্য চাপও বাড়বে (গ্রামসভাগুলোর অসম্মতি সত্ত্বেও কুখ্যাত মাইনিং সংস্থা বেদান্ত গত কয়েক বছর ধরে নিয়মগিরির বক্সাইটের উপর তাদের নজর দিয়ে বসে আছে)। বাইরের লোকজনের সঙ্গে সঙ্গেই বড় বাজারের অনুপ্রবেশ ঘটবে, আর তার ফলে নিয়মগিরির আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ওড়িশার বেশ কিছু অঞ্চলে এই সংস্থাটি সরকারের সায় নিয়েই রাস্তা তৈরি করছে। আর এ জাতীয় সংস্থা চওড়া রাস্তাই বানিয়ে থাকে। এই চওড়া রাস্তা তৈরির প্রস্তাবে সম্মতি না-দেওয়ার কারণেই নিয়মগিরিকে ইচ্ছাকৃতভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিষেবাগুলো থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, এইসব পরিষেবা কি একমাত্র চওড়া রাস্তা দিয়েই নিয়মগিরিতে ঢুকতে পারে?

 

নিয়মগিরিতে মোট ১১২ টা পদর বা গ্রাম আছে। এইসব গ্রামের কোনওটাতেই স্কুল বা হাসপাতালের মতো কোনও পরিষেবা নেই। নিয়মগিরিতে আবহাওয়ার ভারসাম্য বজায় রাখে এখানকার পাহাড়গুলো। এই অঞ্চলে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সবই ভালোরকম টের পাওয়া যায়। এখানকার মানুষজন সম্পূর্ণভাবে চাষবাসের উপর নির্ভরশীল। পটাংপদর গ্রামের যুবক বাসিন্দা কৃষ্ণ মানঝির বক্তব্য অনুযায়ী নিয়মগিরির মানুষ প্রচুর পরিমাণে হলুদ ফলিয়ে থাকেন। এখানে একটা কোল্ড স্টোরেজ থাকলে লোকে নিজেদের ফসল সুরক্ষিত রাখতে পারবে, আর সেই ফসল বাজারে বিক্রি করাও সম্ভব হবে। কিন্তু সরকার এইসব প্রয়োজনীয় দাবিদাওয়ার প্রতি মোটেই কর্ণপাত করে না।

 

এখানকার মানুষের বক্তব্য, মাওবাদীদের হদিশ জানার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ বহু লোককে বছরের পর বছর হাজতে আটক রাখে। মাওবাদীদের সুলুকসন্ধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০১৬ সালে নিয়মগিরির গরটা গ্রাম থেকে আটক হওয়া দশরু ছাড়া পান প্রায় বছর দেড়েক পরে। একইভাবে ২০১৯-এর ৬ জুলাই রাত ১২টার সময় ময়াবলি গ্রামের সিকডু সিকোকা ও গিরাসন ফলাঙ্গ নামে দুই ব্যক্তিকে পুলিশ তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। একেবারে হালে গত ২৩ জুলাই নিয়মগিরির দুটো আলাদা গ্রামের পাঁচ জন বাসিন্দার কাছে পাঁচ-ছ বছরের পুরনো এক মামলার সমন পাঠানো হয়। সেই পাঁচজন ভবানীপাটনা আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন। সেখানেই পুলিশ তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে। কুনাকাডু গ্রামের সুনা মানঝি ও রাংগে মানঝি এবং পালবেরি গ্রামের জিলু মানঝি, পাত্রো মানঝি ও সলপু মানঝিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মাস খানেক পরে গত ২৯ আগস্ট তাঁরা ছাড়া পান।

 

পাত্রো মানঝির মা বোংগারির কথায়, “আমার একমাত্র ছেলেটাকে পুলিশ কেন তুলে নিয়ে গেল তা আমাদের জানা নেই। নিয়মগিরি আন্দোলনের জন্যই যদি পুলিশ আজও লোকজনকে ধরে থাকে, তাহলে আন্দোলনে কি শুধু ওই পাঁচজন লোকই ছিল? হাজার হাজার লোক ছিল সেই আন্দোলনে। অথচ ধরা হচ্ছে বেছে বেছে। কেউ কেউ তো বছরের পর বছর কেটে গেলেও বাড়ি ফেরে না। জিজ্ঞাসাবাদের নামে লোককে বছরের পর বছর এভাবে জেলে রাখাটাই কি নিয়ম?” জিলু মানঝির স্ত্রী কোচাড়ির বক্তব্য, “আমার আটটা ছেলেমেয়ে। জিলু এখন কোথায়, কীভাবে আছে, সেসব কিছুই জানা যাচ্ছে না। টিলায় আমি একা কাজ করতে পারি না। চাষের সব কাজকর্ম বন্ধ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এভাবে মাসের পর মাস আটক রাখার ব্যাপারটা আমাদের মাথায় একেবারেই ঢোকে না।”

 

লখপদর গ্রামের ড্রেঞ্চুর বক্তব্য হল, তলায় তলায় নিয়মগিরির তরাই অঞ্চলে স্থায়ী পুলিশ ছাউনি তৈরির প্রস্তুতি চলছে। সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই তহশীলদারদের ত্রিলোচনপুরে আনাগোনা লেগেই আছে। নিয়মগিরির মানুষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই পুলিশ ছাউনির বিরোধিতা করে কালাহান্ডির ডিসি এবং ওড়িশার রাজ্যপালের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি পাঠান, কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই ত্রিলোচনপুরে অস্থায়ী পুলিশ ছাউনি খোলা হয়। সেখানে এখন বেলগুড়ায় স্থায়ী পুলিশ ছাউনির জন্য বাড়ি তৈরির কাজ চলছে।

 

 

জসিন্তা ঝাড়খণ্ডের রাঁচির বাসিন্দা এবং একজন কবি ও স্বাধীন সাংবাদিক। তিনি কুরুখ/ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষ। ২০১৬ সালে আদিবাণী প্রকাশনী তাঁর কবিতা সংকলন ‘অ্যাংগোর’ প্রকাশ করেছে। তাঁর দ্বিতীয় কবিতা সংকলনের নাম ‘ল্যান্ড অফ দ্য রুটস’; ২০১৮ সালে নয়া দিল্লির ভারতীয় জ্ঞানপীঠ থেকে প্রকাশিত।

 

মূল লেখাটি হিন্ডি ভাষায় www.adivasiresurgence.com – এ প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রাউন্ডজিরোর জন্যে বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রশিত দাস। মূল লেখাটা পড়ার জন্যে ক্লিক করুন এখানে

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: santosh banerjee on September 9, 2019

    A state with a govt. run by a chief minister who has no power to give justice to this village people? His party’s name is BJD,Biju JANATA Dal? Where is the relevance of JANATA ? Shame!

Leave a Comment