হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের মূল লক্ষ্য বাঙালি ও বাংলা সংস্কৃতি। রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চলে অবাঙালি মহল্লার একটি অংশ কিংবা রাজ্যে এক শ্রেণির শিক্ষিত উচ্চবর্ণ বাঙালির মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী প্রভাব চিরকালই ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত ছিল। আবার এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সামাজিক–সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য রয়েছে। শিক্ষিত বাঙালির সাংস্কৃতিক অহংমন্যতা হিন্দি–উর্দুভাষী বিশেষ করে শ্রমজীবীদের অপর করেই রেখেছে। ফলত দুই সম্প্রদায়ের দুই ফল্গুধারা পাশাপাশি বইলেও মিলনের অবকাশ পায়নি। আর এই দুইয়ের কদর্য এবং উগ্ররূপটি খোলস ভেঙে বেরিয়ে না আসার এক মস্ত কারণ ছিল এ রাজ্যে ধারাবাহিক সামাজিক–সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঐতিহ্য। তার মধ্যে বাঙালিয়ানা অনেক বেশি থাকলেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের উপাদানের অভাব ছিল না। এই জায়গাটাকেই আঘাত করতে চাইছে বিজেপি। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
কথা ছিল, গণতন্ত্রের প্রতি ‘আস্থা ও বিশ্বাস’ ফিরিয়ে আনবেন। কথা ছিল, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা’ করবেন। কথা ছিল, ‘দলতন্ত্র’, ‘দলবাজি’র অবসান হবে। পরিবর্তিত হবে ‘একদলীয় শাসনের সর্বগ্রাসী রূপ’-এর। অঙ্গীকার ছিল, ‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে’ সব রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সরকার ও দল সহনশীল হবে, ‘সমস্ত নাগরিকের জন্য একটি সম্মানজনক শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের মানসিকতা’ গ্রহণ করা হবে। কথা রাখেননি মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী।
অভিযোগ ছিল, অনেকটাই সঠিক ভাবে ছিল, সিপিআই (এম) ‘বিরোধী চিন্তাধারার প্রতি সীমাহীন অসহিষ্ণু’, তারা ‘বিরোধী রাজনীতির কণ্ঠরোধ করে এক জঘণ্য স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ করেছে। আজ এই একই অভিযোগে কি সমভাবে বিদ্ধ নয় তৃণমূল ? আজ অভিযোগ উঠছে, বিগত আট বছরে পশ্চিমবঙ্গের অবক্ষয়ী গণতন্ত্রকে শুধু চূড়ান্ত অবক্ষয়ের পথে টেনে নামানো হয়নি, রাজ্যটিকে শ্বেতসন্ত্রাসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। চরম ফ্যাসিবাদী সর্বনাশ আজ আর দরজায় কড়া নাড়ছে না, ঘরে ঘরে জাঁকিয়ে বসেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ ধরেই তা এসেছে। পাহাড় থেকে জঙ্গলমহবলেরাখা মানুষ চেয়েছে বলেই এসেছে। ইতিহাস বলে গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়েই ফ্যাসিজম ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছায়। এও সত্য বটে, হিন্দুত্ববাদের ভাগোয়া ঝান্ডা উড়িয়েই তারা এসেছে, তবে আংশিক সত্য। এই অংশটি সার্বিক মাপটির ঠিক কত শতাংশ তার তল খুঁজতে গেলে দীর্ঘ গবেষণা জরুরি। তবে, আইনি শাসনের প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা রাজ্য জুড়ে যে বেআইনের স্রোত দলীয় নেতা-কর্মীরা বইয়ে দিয়েছিলেন, পরাজয়ের পিছনে তারও মস্ত ভূমিকা রয়েছে। প্রথম ও শেষ কথা বলা দলনেত্রী দেখেও দেখেননি, ‘দুষ্টু ছেলে’ বলে পাশ কাটিয়েছেন।
ক্ষমতায় আসার পর পরই নাগরিক ও মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি, ২০১১ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারের লিখিত প্রতিশ্রুতি একটি একটি করে ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া শুরু হল। অথচ ক্ষমতায় আসার পর পরই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৎকালীন ১৯টি জেলায় মানবাধিকার আদালত স্থাপন করে সদর্থক পদক্ষেপ করেছিল নতুন সরকার। যদিও তার কার্যকারিতা কখনোই সংশয়ের ঊর্ধ্বে ছিল না। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন যেখানে অল্প সময়ের মধ্যে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয় তখন জেলা কমিশনের হাল সহজেই অনুমেয়। মনে পড়ছে নিশ্চয়ই, বিরোধী দলের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম চেতাবনি ছিল ‘৩৫ বছর চুপ’ করে থাকতে হবে। মুখে লিকোপ্লাস্ট লাগানোর পরামর্শও দিয়েছিলেন। এই চেতাবনি, এই পরামর্শ আসলে বিরোধী রাজনীতির কণ্ঠরোধ করারই সামিল। আজ বোঝা যায় শুধু কণ্ঠরোধ নয় এ ছিল এক বৃহৎ পরিকল্পনার অঙ্গ। পরিকল্পনাটি ছিল ক্রমে ক্রমে কী সিপিআই(এম), কী কংগ্রেস দলকে ছলে-বলে-কৌশলে সম্পূর্ণ বিনাশের পথে নিয়ে যাওয়া। এবং সেই শূন্যস্থানে একমেবাদ্বিতীয়ম ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে ওঠা।
সিপিআই(এম), কংগ্রেস তো অনেক বড় বিষয়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। মনে করুন, মনের মতো প্রশ্ন না-হওয়ায় কলেজ ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে একই সঙ্গে সিপিএম ও মাওবাদী বলে দেগে দিয়ে জাতীয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যাওয়া। মনে করুন, স্রেফ সেচের জল নিয়ে প্রশ্ন করায় সভামঞ্চ থেকে ছোট চাষি শিলাদিত্য চৌধুরীকে মাওবাদী তকমা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। কার্টুন-কাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হল অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। প্রেস কনফারেন্স করে অভিযোগ করা হল, মুখ্যমন্ত্রীকে খুনের চক্রান্ত করা হয়েছিল। কামদুনিতেও ফের খুঁজে পাওয়া গেল মাওবাদী। কেননা এক সদ্য যুবতীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিলেন। এই কি ছিল এগারোর ইস্তেহার মাফিক ‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সমস্ত রকম রাজনৈতিক মতাদর্শকে সহনশীলতার মাধ্যমে সমস্ত নাগরিকের জন্য একটি সম্মানজনক শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের মানসিকতা’? এই ফিরিস্তি মাত্র প্রথম ১৮ মাসের। আজ যদি অভিযোগ ওঠে এই আঠারো মাসেই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল গণতন্ত্রের প্রতি ‘আস্থা ও বিশ্বাস’ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল মিথ্যে। ক্ষমতা দখলের জন্য এ কথাগুলি বলার প্রয়োজন ছিল মাত্র। তবে কি খুব বেশি বলা হবে? হয়তো আরও বেশি প্রয়োজন ছিল অন্তত নির্বাচন পর্যন্ত পরিবর্তনপন্থী তৎকালীন বিদ্বৎসমাজ, এক শ্রেণির বামপন্থী, মানবাধিকার কর্মীদের সহযোগিতা ও সমর্থনকে ধরে রাখা। এই ইস্তেহারে তাই তাঁদেরও নানা ভাবনা, ধ্যানধারণা প্রতিফলিত হতে দেখা গিয়েছে। সে দোষের নয়। জঙ্গলমহল, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পরিস্থিতিতে রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ একটা সুস্থ রাজনৈতিক বাতাবরণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। রাজ্যের নাগরিক সমাজ সেই কাজেই এগিয়ে এসেছিলেন। তবে, সকলেই যে নিঃস্বার্থ ছিলেন, কোনও লুকোনো অ্যাজেন্ডা ছিল না, তা নয়। এঁরা যথাসময়ে পুরস্কৃত হয়েছেন এবং বিগত আট বছরে আর তাঁদের বিবেকবোধ জাগ্রত হতে দেখা যায়নি।
আজ যখন একটির পর একটি পুরসভায় দলের পুরপিতা, পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদের সদস্য মায় বিধায়ক দল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তখন কোথাও কেউ কুমিরের কান্নাটুকুও কাঁদছেন না। নীতি-নৈতিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলারও কেউ নেই। কেননা যাঁরা প্রশ্ন তুলতে পারতেন, তাঁদেরও তো মনে পড়ছে ঠিক কীভাবে তৃণমূলের প্রাক্তন প্রধান সেনাধ্যক্ষের নেতৃত্বে এবং পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় একটির পর একটি নির্বাচিত পুরসভা, জেলা পরিষদ কখনো উৎকোচ, কখনো মিথ্যা কিংবা পুরনো মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দখল করা হয়েছিল? বেয়ারাদের জেলে ভরা হয়েছে। এমনকী ‘পানি কেসে’, অর্থাৎ মাদক আইনে। সেদিনের নীরবতা আজ নিশ্চয়ই আমাদের কারো কারো বুকে শেলের মতো বিঁধছে। এ কথা বলা তো অত্যুক্তি হবে না যে, এ রাজ্যে মমতাই ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতির জননী। আজ বিজেপি’র এই দল- ভাঙানোর রাজনীতি তাঁকেও আঘাত করছে। শাপশাপান্ত কিংবা হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিই-বা করার আছে। এই কর্মকাণ্ডে একদা সহায় সর্বশ্রী মুকুল রায় শিবির বদলের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার বর্শামুখটি স্রেফ বদলে দিয়েছেন।
আর, শুধু তো কণ্ঠরোধের হুমকি নয়, সরকার বিরোধিতার গন্ধ পেলেই নাগরিক, মানবাধিকার সংগঠনগুলিরও সভা, মিছিল করার অনুমতি নিয়ে টালবাহানা করা হয়েছে কিংবা অনুমতিও দেওয়া হয়নি। কলকাতায় প্রতিবাদী জমায়েতের একের পর এক চিরাচরিত স্থানগুলি নিষিদ্ধ হয়েছে। কেড়ে নিয়েছেন শ্রমিক, সরকারি কর্মী, শিক্ষকদের আন্দোলন করার অধিকার, কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন বন্ধ করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দলীয় ছাত্রদের একপেশে আধিপত্য। আক্রান্ত হয়েছেন নাগরিক সমাজ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা, তাঁদের বিরুদ্ধে জারি হয়েছে ইউএপিএ’র মতো নির্মম আইন। ভাঙর, ভাবাদিঘি, বোলপুরের জমি অধিগ্রহণ, লাটাগুড়ির এলিফ্যান্ট করিডরে কিংবা যশোর রোডে গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন, উত্তরের বনবাসীদের অধিকার আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় এবং রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট দলীয় সন্ত্রাস আর যাই হোক স্বাধীন নাগরিক ও রাজনৈতিক মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রকাশ নয়। সে সহিষ্ণুতা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী দেখাতে বাধ্য হয়েছেন জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের রেশ ধরে প্রায় ৯০০ চিকিৎসকের প্রতীকী পদত্যাগের পর।
সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণও কোনও নতুন কথা নয়। বিগত ৭০ বছরে এ রাজ্যে এ বিষয়ে অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। মোদি সাম্রাজ্যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা তলানিতে ঠেকেছে। জরুরি অবস্থা ছিল স্বাধীনতার অন্ধকার যুগ। সে সময়টুকু বাদ দিলে আজ এ রাজ্যেও সংবাদমাধ্যম, সম্পাদক, কী কলকাতা কী জেলার সাংবাদিকদের এক বড়ো অংশকে যেভাবে আত্মবিবাচনে ব্রতী হতে, নুয়ে চলার আদেশ এলে হামাগুড়ি দিতে দেখা গিয়েছে তার কোনও তুলনা হয় না। কী আশ্চর্য আনুগত্যে ফিরে এসেছে ‘প্রেস রিলিজ’ সাংবাদিকতা। প্রশ্নহীন। নবান্ন যেন দুর্গ, সাংবাদিকদের পায়ে আইনের বেড়ি, গণ্ডি পার হলে গ্রেফতারের হুমকি। অপছন্দের খবর হলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে মালিক ও সম্পাদকের উপর চাপ সৃষ্টি, জেলার সাংবাদিকদের নরমে-গরমে কিংবা উৎকোচ দিয়ে কিনে ফেলার চেষ্টা আর খবর করার বেয়াদপি করলে কিল-চড়-লাথি-ঘুষি তো আছেই। এক সময় জেলা কিংবা মহকুমা সদরগুলি থেকে প্রকাশিত হত বহু বহু ছোট, মূলত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। পক্ষে-বিপক্ষে যাই সংবাদ প্রকাশিত হোক না জেলা স্তরের সরকারি বিজ্ঞাপন মিলত। এই উদ্যোগগুলির সিংহভাগ মৃত। এই সময় সরকারি বদান্যতা পেয়েছে চিটফান্ড সংস্থাগুলির সংবাদমাধ্যম।আদেশ জারি করে গ্রন্থাগারগুলি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রধান দৈনিকগুলি, পরিবর্তে স্থান পেয়েছে ‘চিটফান্ড সংবাদপত্র’। আর প্রভাবশালী রাজনীতিকরা আক্ষরিক অর্থেই চিটফান্ড মালিকদের বস্তা বস্তা টাকা লুঠ করেছে। চিটফান্ড সাংবাদিকতার দিন গেলে কবজা করার চেষ্টা হয়েছে বৃহৎ সংবাদমাধ্যমকে। একদেশদর্শী সংবাদমাধ্যম এবং স্তাবক সাংবাদিকুল সাময়িক ভাবে ‘ফিল গুড’ পরিবেশ তৈরি করলেও গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। বিগত চার-পাঁচ বছরে বাংলার সংবাদমাধ্যমে সঙ্গত কারণেই যে পরিমাণে বিজেপি ও সঙ্ঘী মতাদর্শের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তার কণামাত্র প্রকাশিত হয়নি রাজ্য সরকার কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় স্বৈরাচার, সরকারি নীতি-দুর্নীতির সমালোচনায়। একের পর এক প্রশাসনিক বৈঠকে সব সাফল্যের ঝোল চেটেপুটে নিয়ে ব্যর্থতার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সাধারণ জনপ্রতিনিধি কিংবা আমলাদের উপর।সংবাদমাধ্যম প্রশ্নহীন আনুগত্যে লাইভ টেলিকাস্ট করেছে কিন্তু যে প্রশ্নগুলি উঠে এল তার কোনও স্বাধীন বস্তুনিষ্ঠ ফলোআপ করল না। স্বাভাবিকভাবেই উঠে এল না সাধারণ মানুষের মনের কথা।ফলত নির্বাচনী বিপর্যয়ের আগাম পূর্বাভাষ দিতেও ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা। অথবা এমনও হতে পারে বিপর্যয়ের আঁচ পেলেও ভয় কিংবা ভক্তিতে উটের মতো মুখ গুঁজে থেকেছেন।
পিছনে তাকালে দেখতে পাব, শুধুমাত্র নাগরিক সমাজ নয়, রাজ্যবাসীর এক বড়ো অংশ, সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘রাজনৈতিক সমাজ’ একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই পরিবর্তনমুখী হয়ে উঠছিল। ২০০১ সালে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে উপরের তলায় আনুষ্ঠানিক জোট হলেও নীচের তলায় বনিবনার অভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ৮৭টি বিধানসভা ক্ষেত্রে বামেরা সুফল পায়। ২০০৬ সালে ২৩৫টি আসনে বিপুল জয় বামফ্রন্টকে একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। বামফ্রন্ট যা ভুলে বসেছিল যে, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে ভোট কাটাকাটির ফলে ৬৮টি আসনে বামপন্থীরা লাভবান হয়েছিল। ২০০১-এর তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র সঙ্গে জোট বেঁধেছিল তৃণমূল। বিজেপি ২৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১.৯৩ শতাংশ ভোট পায়। এই প্রথম নয়, বাংলায় বাম কিংবা দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসী রাজনৈতিক পরম্পরায় অতি দক্ষিণপন্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৮ সালেই, লোকসভা নির্বাচনে। যাই হোক, পরবর্তীতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে একের পর এক জেলায় ভেসে গেল বামফ্রন্ট। সৌজন্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। পঞ্চায়েত স্তরে অলিখিত মহাজোট ৪৮ শতাংশ, পঞ্চায়েত সমিতিতে ৪৫ শতাংশ এবং জেলা পরিষদে ৩২ শতাংশ আসন পায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, মালদা ও উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদ দখল করে। উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, বীরভূমে তিন স্তরেই সাফল্য মিলেছিল বলার মতো। যে সাফল্য বিরোধীদের কাছেও ছিল অবিশ্বাস্য। স্রেফ মানুষ বদলে দেওয়ার কথা ভেবেছিল বলে। সেদিন উন্নয়নকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়নি। বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েতের ডাক দিতে হয়নি। ৩৪ শতাংশ আসনে জিততে হয়নি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। মনে রাখতে হবে ২০০৮ সালে বামপন্থীরা ৫.৫৭ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবচেয়ে বেশি আসনে জিতেছিল ২০০৩ সালে — ১১ শতাংশ। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনেই তৃণমূল গণতান্ত্রিক রীতিনীতি শিকেয় তুলে সন্ত্রাসী নির্বাচনের সমস্ত রেকর্ড মুছে দিয়েছে। সম্ভবত বাহাত্তরের নির্বাচনের সঙ্গে যা তুলনাযোগ্য। ২০১৮ সালে এমনটি যদি না হত, তাহলে হয়তো জনসমর্থন ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তার একটি সম্ভাব্য আগাম হিসেব কষা যেত। তা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন এ রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত দিয়েছিল ২০১৯-এর লোকসভা কি সেই একই ইঙ্গিত বহন করছে? ভবিষ্যৎ তা বলবে।
২০১৪’র তুলনায় বিজেপি’র এই উল্কাবৎ উত্থানের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির গভীর প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। আগেই বলেছি ২০০৬-এ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র ভোট শতাংশ ছিল ০১.৯ শতাংশ। ২০০৯-এর সংসদীয় নির্বাচনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ০৬.১ শতাংশে। ২০১১’র বিধানসভা নির্বাচনে আবার কমে দাঁড়ায় ০৪.১ শতাংশে। ২০১৪ সালে সংসদীয় নির্বাচনে বিজেপি’র গুজরাট মডেলে ও উন্নয়নের স্বপ্নে ভর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র ভোট গিয়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে। শতাংশের হিসেবে ভোট বাড়ে তৃণমূলেরও। ২০০৯-এর ৩১.২ শতাংশ থেকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯.৮ শতাংশে। উল্লেখযোগ্য হ্রাস পায় সিপিআই(এম) -এর ভোট। ৩৩.১ শতাংশ থেকে তা নেমে যায় ২৩ শতাংশে। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ফের বিজেপি’র ভোট কমে হয় ১০.৩ শতাংশ। তৃণমূল ৪৫.৬ শতাংশ, কংগ্রেস ১২.৪ শতাংশ এবং সিপিআই(এম) ২০.১ শতাংশ। ২০১৯-এ আমরা ইতিমধ্যেই জানি বিজেপি যেমন দুই থেকে ১৮-তে পৌঁছেছে তেমনি ভোট পেয়েছে ৪০.২২ শতাংশ। তৃণমূল ৩৪ থেকে ২২-এ নেমে এলেও ৪৩.২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ২০০৯-এর তুলনায় ভোট বাড়িয়ে নিতে পেরেছে। সিপিআই(এম) ১৬ শতাংশ ভোট হারিয়ে ৭.১ শতাংশে এবং কংগ্রেস চার শতাংশ ভোট হারিয়ে ৫.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এই উত্থানের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল বিজেপি’র দেশজোড়া রাজনৈতিক আধিপত্য। এ রাজ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান প্রকল্প এবং ঘৃণার চাষ। এই হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের মূল লক্ষ্য বাঙালি ও বাংলা সংস্কৃতি। রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চলে অবাঙালি মহল্লার একটি অংশ কিংবা রাজ্যে এক শ্রেণির শিক্ষিত উচ্চবর্ণ বাঙালির মধ্যে সাম্রদায়িক ও বর্ণবাদী প্রভাব চিরকালই ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত ছিল। আবার এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য রয়েছে। শিক্ষিত বাঙালির সাংস্কৃতিক অহংমন্যতা হিন্দি-উর্দুভাষী বিশেষ করে শ্রমজীবীদের অপর করেই রেখেছে। ফলত দুই সম্প্রদায়ের দুই ফল্গুধারা পাশাপাশি বইলেও মিলনের অবকাশ পায়নি। আর এই দুইয়ের কদর্য এবং উগ্ররূপটি খোলস ভেঙে বেরিয়ে না আসার এক মস্ত কারণ ছিল এ রাজ্যে ধারাবাহিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঐতিহ্য। তার মধ্যে বাঙালিয়ানা অনেক বেশি থাকলেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের উপাদানের অভাব ছিল না। শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন এবং বামপন্থী মতাদর্শের প্রভাবও উগ্র সঙ্ঘী জাতীয়তাবাদকে মাথা তুলতে দেয়নি। এই জায়গাটাকেই আঘাত করতে চাইছে বিজেপি। হাওড়া, হুগলি, ব্যারাকপুর, খড়্গপুর, শিল্পাঞ্চল তারই রসায়নাগার হয়ে উঠল। ২০১৬ সালে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ দেখেছে এই শিল্পাঞ্চল। ২০১৭-তে আসানসোল। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। মোদির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি’র যত বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সমানুপাতিক ভাবে বেড়েছে ঘৃণার রাজনীতি, মেরুকরণের রাজনীতি, ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ। প্রধান বলি মুসলমান ও দলিত শ্রেণিভুক্ত মানুষ। ফ্যাসিস্ত সাম্রাজ্য গড়তে হলে একটি অপর চাই। হিটলারের ছিল ইহুদি। আরএসএস-এর প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন তত্ত্বের আলোকে মোদির লক্ষ্য মুসলমান। এ রাজ্যেও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ১৯৮টি ছোট, বড়ো সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১১ থেকে ২০১৩’র মধ্যে ৬৪টি এবং ২০১৪ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে ১৩৩টি। এর পাশাপাশি বাংলার ধর্মীয় এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিসরে ভিন্ন এবং ভিনদেশি বয়ানের প্রচার ও প্রসার ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে। পয়লা বৈশাখের পরিবর্তে বিক্রমাব্দ পালন থেকে গঙ্গার তীরে প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যা আরতি, শহরের ফুটপাতে শনি-শিতলা-শিব মন্দিরগুলি থেকে আদিবাসী জাহের থানে বজরঙ্গবলী বা হনুমানে মূর্তি স্থাপন এবং চালিশা পাঠ, রামনবমীর নামে উগ্র ধর্মীয় প্রচার, সমাজ মাধ্যমে পুজো সংখ্যার প্রচ্ছদ কিংবা দুর্গা পুজোয় আমিষ খাওয়া নিয়ে নিয়মিত ট্রোল করে যাওয়া, খোদ কলকাতায় অবাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে বাঙালি উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্তের গো-সেবা, ভজন-পূজন-যাগযজ্ঞে মতি, ধর্মীয় সংগঠনের গুরু বা মন্দিরগুলির ট্রাস্টিদের অর্থ দিয়ে বশ করা, জেলায় জেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা একল, সরস্বতী বিদ্যালয় এবং সাম্প্রতিক কালে সাম্প্রদায়িক রণধ্বনি জয় শ্রীরাম স্লোগান তুলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিরোধীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা, সর্বোপরি বাংলার, বাঙালির সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আইকনদের সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার তার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এ সবই কেন্দ্রীয় সঙ্ঘ পরিবারের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং সঙ্ঘী নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত। মনে রাখতে হবে, এই নেতৃত্বের প্রায় সকলেই আরএসএস-এর গোয়াল থেকে আসা প্রচারক। যেমন, এ রাজ্যের যাবতীয় রাজনৈতিক দায়িত্বে থাকা কৈলাশ বিজয়বর্গী, বুথ স্তরে আরএসএস বিস্তারকদের দায়িত্বে থাকা শিবকুমার কিংবা জনৈক ডক্টর মুকুল তাদের অন্যতম গুটিকয়।
ফল, মালদার একটি আসন সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ, সমগ্র জঙ্গলমহল, হলদিয়া ছাড়া সবকটি শিল্পাঞ্চল এখন বিজেপি’র দখলে। অর্থাৎ, গোর্খা জনজাতি, চা-বাগানের আদিবাসী শ্রমিক এবং উত্তরের বনবাসী থেকে দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসী ও মাহাত সম্প্রদায়, রাজবংশী থেকে মতুয়া সম্প্রদায়ের এক বড়ো অংশের মধ্যে বিজেপি তার রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে সফল। শুধুতো গ্রামাঞ্চল নয় রাজ্যের ১২৭টি পুরসভা ও পুরনিগমের মধ্যে লোকসভার ভোটের বিচারে এখন ১০১টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি। এই সাফল্যে রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো আচরণ শুরু করেছে বিজেপি। জেলায় জেলায় আক্রান্ত তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সদস্য থেকে জেলা নেতৃত্ব। সিতাইয়ের তৃণমূল বিধায়ক ঘরছাড়া। দখল হয়ে গিয়েছে বহু দলীয় দপ্তর। ভাটপাড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে কিংবা বোমার আঘাতে মারা গিয়েছেন অন্তত চার জন নিরীহ মানুষ। রাজনৈতিক সংঘর্ষে খুন হয়েছেন যুযুধান বিজেপি ও তৃণমূলের অন্তত এক ডজন কর্মী, সমর্থক। খুন হয়েছেন বামকর্মী। ভাটপাড়া কিংবা সন্দেশখালিতে এলাকা দখলের লড়াইয়ে কখনো হিন্দু-মুসলমান কখনো-বা বাঙালি-বিহারি অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক কিংবা জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির ইন্ধন যোগান হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ ছড়িয়েছে নাগরিক সমাজেও। একই দিনে মহানগরে বিদ্বজ্জনদের দু-দু’টি সভা তা প্রমাণ করে। ঘুম বোধহয় বড়ো দেরিতে ভাঙল। এই দীর্ঘ শীতঘুমে তৃণমূলের সর্বগ্রাসী আধিপত্য, স্বৈরতান্ত্রিক ঝোঁক, অস্বাভাবিক অহংমন্যতার বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের সহিষ্ণু নীরবতা যত কর্ণবিদারী হয়ে উঠেছে, তত বেশি বেশি করে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে আম রাজনৈতিক সমাজ। বিভাজনের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত বিজেপি ও সঙ্ঘী ফ্যাসিস্তরা কোথাও সন্ত্রাস ও গণতন্ত্রহীনতা, কোথাও মুসলমানভীতি, তোষণ কিংবা উদ্বাস্ত সমীকরণের সাতকাহন মিথ্যা, এনআরসি ও নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, কোথাও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের রাজনৈতিক বয়ান, যুদ্ধজিগির, অমূলক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে অঞ্চল থেকে অঞ্চল ভেদে বিস্তার করতে পেরেছে। এবং অবশ্যই দূরদর্শন থেকে কর্পোরেট প্রচার মাধ্যম, কর্পোরেটের টাকার জোর, মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন এই বিস্তারে সহায়তা করেছে। খেলা-মেলা-তোলায় হাত পাকানো তৃণমূলের কাছে বিগত সাড়ে তিন বছর ধরে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়া সাড়ে ১৭ হাজার আরএসএস বিস্তারকদের হিন্দুত্ববাদী প্রচারের পালটা কোনও তত্ত্ব হাজির করা সম্ভব ছিল না। তারা কোথাও কোথাও অক্ষম রাগে বিস্তারকদের হাত-পা ভেঙেছে, বিজেপি কর্মীকে হত্যা করে বিদ্যুতের টাওয়ারে ঝুলিয়েছে, সারা নির্বাচন পর্বে প্রশাসনের সাহায্যে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সভা বানচাল করতে সম্ভাব্য সমস্ত পথ নিয়েছে। কখনো হেলিকপ্টার নামার, কখনো সভার স্থানের অনুমতি না দিয়ে কিংবা নানা টালবাহানা চালিয়ে, ডেকরেটর-মাইক ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে সভা বানচালের ভুল ও অন্যায় পথ নিয়েছে। তারা বোধহয় ভুলে বসেছিল নির্বাচনটি লোকসভার, পঞ্চায়েত কিংবা পুরসভার নয়। এই ‘রাফ আন্ড টাফ’ ইমেজের প্রশংসাও শোনা গিয়েছে লিবারল কিংবা একশ্রেণির বামেদের মুখেও। ভাবটা এমন যেন সঙ্ঘী ফ্যাসিস্তদের মুখের মতো জবাব দিচ্ছেন মমতা।
এই হার থেকে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষা নিয়েছেন? মেডিক্যাল আন্দোলন পর্বের নবান্ন-সভার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত এ প্রশ্নের কোনও ইতিবাচক উত্তর মেলেনি। ফলাফল প্রকাশের অবব্যহিত পরে মনে হয়েছে, ১৮টি আসন নয় যেন ১৮টি গোলার বিস্ফোরণে তিনি শোকস্তব্ধ। সাময়িক নীরবতার পর মুখ খুললেন যখন তখন গভীর অভিমানী। অনতিবিলম্বে ক্রোধে ফেটে পড়লেন ভাটপাড়ার রাজপথে। এই আচরণে নিশ্চয়ই তিনি একান্তে লজ্জিত হয়েছেন। এ কথাতো মনে রাখতে হবে দেশভাগের ফলে বাঙালির জীবনে যেমন তেমনই এই পাটশিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছিল। এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় পাঁচটি চটকল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাঁচা পাট আসা যেমন ব্যাপক হারে কমে যায়, তেমনই তার দাম বাড়ে অস্বাভাবিক হারে। এক দশকের মধ্যে পাটশিল্প বেহাল হয়ে পড়ে। কোনও সাহায্যে এগিয়ে আসেনি কেন্দ্রীয় সরকার। দিল্লি পাট ও চায়ের মতো বাংলার সাবেকি রপ্তানিযোগ্য শিল্পের জন্য কোনও সহায়ক নীতি যেমন তখন গ্রহণ করেনি তেমনই চটের বিকল্প বাজারে আসায় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে। পাশাপাশি লাইসেন্স রাজ এবং মাশুল সমীকরণ নীতি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের পথে দীর্ঘকাল ধরে বাধা সৃষ্টি করে গিয়েছে। শিল্পপতি এবং সংবাদমাধ্যম বাংলার শিল্প-অবনতির জন্য শুধুই ট্রেড ইউনিয়নের জঙ্গিপনার গল্প গিলিয়ে গিয়েছে। তারা শ্রমিক ধর্মঘটের হিসেব করেছে, কথায় কথায় নানা ছুতোয় লকআউট-ক্লোজারের হিসেব কষতে ভুলে গিয়েছে। ভুলেছে এ কথা বলতে শিল্পপতি নয় পাট, চা-শিল্পে মালিক হয়ে বসেছে এক শ্রেণির ফড়ে ও দালাল। এই ভয়াবহ সময়ে বাংলার এই মুমূর্ষু শিল্পাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষকে কোনও সরকার খাওয়ায়-পড়ায়নি। খাওয়া-পড়া তাঁরা তাঁদের রক্ত-ঘামে নিজেরাই জুটিয়েছেন। আজ তাঁদের একাংশ কোন রামরাজত্বের টানে জয় শ্রীরাম রণহুংকার গলায় তুলে নিল তার অন্বেষণ জরুরি। বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদ তার প্রত্যুত্তর হতে পারে না।
এই খোঁজ তখনই সম্ভব যখন পরাজয়কে বিনয়নম্রতায় গ্রহণ করার মানসিক স্থিতি অর্জন করা যায়। যা আত্মমূল্যায়নের নৈতিক সামর্থ্য তৈরি করবে। এখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। প্রতি ১০০ জন ভারতীয়র মধ্যে ৬৬ জন মোদিকে সমর্থন করেননি। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ভাষায় বলা যায়, এ জয় ক্ষমতার নিরিখে কিন্তু মতাদর্শের যুদ্ধে নয়। সে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। বাম দলগুলি ও কংগ্রেসকেও ফিরে যেতে হবে পরাজয়ের উৎস সন্ধানে শ্রমিক মহল্লা, চা-বাগিচায়, খেতখামার থেকে আদিবাসী-বনবাসীদের সমস্যাসঙ্কুল জীবনের দোরগোড়ায়। ক্ষতস্থান চাটতে বসা এখন বিলাসিতার নামান্তর।
লেখক দেবাশিস আইচ সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।
Cover Image Courtesy: dnaindia