বামেদের শূন্যতত্ত্ব


  • May 29, 2019
  • (0 Comments)
  • 3386 Views

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস ও বামদলের বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে এগিয়ে থাকার হিসেব থেকেই স্পষ্ট, ১৯৪৭ সাল থেকে যে বাম আন্দোলন কখনো প্রধান বিরোধী, কখনো ক্ষমতাপ্রাপ্ত দল তারা এই প্রথম নির্বাচনের নিরিখে আর এক, দুই, তিনের মধ্যে নেই। কেন নেই? নেই মানে কি আর নেই না অন্যকিছু? প্রাবন্ধিক অর্ক সেন-এর প্রতিবেদন।

 

 

যে বামশক্তি বাংলার ২৫% ভোটের নিচে গত পঞ্চাশ বছর পায়নি, যার সাথে বাংলার একটা আইডেন্টিটি গড়ে উঠেছিল তারা ৭% মাত্র ভোট পেল! একটা থিওরি উঠে আসছে যে এটা সাময়িক। পরিকল্পনা মাফিক বা অপরিকল্পিত ভাবে, যেমন গেম থিওরিতে হয়, বাম সমর্থকরা একটা ‘ট্রিক’ নিয়েছে, এবং এই ট্রিকের একটা ‘ডায়ালেক্টিক্স’ রয়েছে কেউ কেউ বলছে। আমরা সেদিকে আপাতত যাচ্ছি না। কেননা আমরা অন্য একটা দিক দেখব।

 

পশ্চিমবঙ্গে যারা সরকারী বাম তারা কিন্তু কোনভাবেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নেই, কোনদিন ছিলও না। তেভাগা তেলেঙ্গানা পেরিয়ে আজকের সরকারী বাম, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কখনো পরিস্থিতি পেকে উঠলে তাঁরা কী করবেন তাঁরাই জানেন। ভূভারতে তাঁদের কাজ নির্বাচনে লড়া, গণতান্ত্রিক সরকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

 

বিপ্লবী রাজনীতি ত্যাগ করে সংসদীয় রাজনীতি করতে গিয়ে বামেদের বেশ কয়েকটি মার্ক্সীয় অ্যাজেন্ডাও ত্যাগ করতে হয়েছে। প্রথমতঃ বাজার ব্যবস্থা সংক্রান্ত মার্ক্সবাদী সমালোচনা।সত্তরের দশকে মূল্যব্যবস্থা নিয়ে অধ্যাপক অশোক মিত্র বা অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক কিছু কাজ করলেও ভারতীয় বাজারে মূল্যের বিকৃতি আছে কিনা তা নিয়ে মার্ক্সবাদীদের কোন কাজ বিগত এক দেড় দশকে সাধারণ মানুষের কাছে আসেনি, যদিও নূন্যতম মজুরী নিয়ে দাবী করেছে সরকারী বামেরা। সমাজতন্ত্র বামেদের অ্যাজেন্ডায় দীর্ঘদিন ধরেই নেই, তাই বাজার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে অন্য কিছু করার কথাও একেবারেই এঁদের মুখে শোনা যায়নি। কাজেই ধরে নেওয়াই যায় বাজার নিয়ে এঁরা আর মার্ক্সের রাস্তায় হাঁটেন না। হয়ত মার্কেট সোস্যালিজমকে এঁরা মেনে নিয়েছেন বা কোনো সিদ্ধান্ত এখন মুলতুবী রেখেছেন।

 

বাজার ব্যবস্থার সাথেই চলে আসে মূলধনের কথা। নিজেদের পত্রপত্রিকায় ভারতে দারিদ্র বেড়ে যাওয়া নিয়ে প্রায় স্লোগানধর্মী কিছু নিয়মিত লিখলেও সাধারণ মানুষের কাছে এ মূহুর্তে মূলধন বা পুঁজির কী চরিত্র বামেরা তা বলেন না, পুঁজির চরিত্র পরিবর্তন শ্রমিকদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা দুএকজন বাম গবেষকের বিচার্য হলেও রাজনৈতিক প্রচারের মধ্যে নেই। কেন নেই তার আলোচনায় পরে আসছি।

 

মার্ক্সের কাছে কোনো সমাজের রাজনৈতিক চরিত্র পুঁজি, মূল্যব্যবস্থা আর এর সাথে জড়িত সামাজিক অর্থনৈতিক শ্রেণীগুলির সম্পর্কের মাধ্যমে নির্ধারিত। ভারতের সরকারী বামদলগুলি এক সময় বিপ্লবের স্তর নিয়ে নানা কথা বললেও অধুনা তাদের আলোচনার মধ্যে দেশের শ্রেণী পর্যালোচনা নেই বা থাকলেও ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের কথার চর্বিতচর্বণ, কোন নতুন বিশ্লেষণ তাতে নেই।

 

আসলে বামদলগুলির এই তাত্ত্বিক পশ্চাদপসরণ তাদের চরিত্র বদলের ইঙ্গিত। মূল্য, বাজার, পুঁজি, শ্রেণী নিয়ে কচকচানি শ্রমিকশ্রেণী পছন্দ করে না বলে সেসব বাদ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উচ্চারণে ‘র’ য়ের অনুপস্থিতি নিয়ে ব্যঙ্গ করে  কথাবার্তা বলছে বামনেতারা। এটা মানি যে মার্ক্সবাদী জার্গন এত চর্চিত যে খুবই বিরক্তিকর সীমায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু বামেদের এই তাত্ত্বিক আলোচনা ত্যাগের কারণ তাদের নিজেদের চারিত্রিক পরিবর্তন।

 

আমাদের দেশের বামপন্থার জন্ম শ্রমিক বা কৃষকসমাজের মধ্যে নয়। প্রথমে বুদ্ধিজীবী ও উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষিতমহলে বৌদ্ধিকচর্চা হিসেবে মার্ক্সবাদের বীজ রোপন হয়েছিল, স্বাধীনতার আগে পরে কিছু নেতার অক্লান্ত পরিশ্রম তাকে নিয়ে যায় ক্ষেতমজুর আর সংগঠিত শ্রমিকের কাছে। শোনা যায় স্বয়ং হো চি মিন কলকাতায় এসে সিপিআই দলের এক প্রতিনিধি দলকে বকে ছিলেন, ভোরের কলকাতায় কর্পোরেশনের শ্রমিকদের সাথে কিছু কথা বলার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর।

 

দেশবিভাগের পর একের পর এক নানান অর্থনৈতিক সমস্যা বামেদের ত্রিশ বছর ধরে একটু একটু করে তুলে ধরে সাধারণ মানুষের দল হিসেবে।পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যদিও দ্রুত জমি হারিয়ে যাচ্ছিল।ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সির ফলে যখন সারা ভারত জয়প্রকাশ নারায়ণের বেতাজ নেতৃত্বে আস্থাশীল হল, পশ্চিমবঙ্গে মানুষ বামেদের বেছে নিল, মূলত সিপিআইএম যে বামেদের কাণ্ডারী।

 

একটা গণদলে রামধনুর মতো নানান শ্রেণীর লোক। সামাজিকভাবে অগ্রগণ্য উচ্চবর্ণের আদর্শবাদী শিক্ষিত মানুষ তার নেতৃত্বে।পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতিতে অন্য মুখ্য দল বা মুখ ছিলই না।কাজেই নানান স্রোতে জনস্রোতে যাঁরা ক্ষমতা পেলেন রাজ্যের, সংস্কৃতির, সমাজের তাঁরা আসলে সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু মানুষ।

 

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে এক অবশিল্পায়ন চলছিলই। আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা কমে পাট-শিল্পের দুর্দশা ডেকে নিয়ে আসে। কলকাতা বন্দরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেশে আর পূর্ব এশিয়ায় একাধিক বন্দর গড়ে ওঠে। বম্বে আর বিশাখাপত্তনমের সুবিধা পেতে ভারী শিল্প সেদিকে চলে যায়। মাশুল সমীকরণ নীতিও পশ্চিমবঙ্গকে পেছনে ঠেলে দেয়। বাম আমলে এমন কিছু করা হয়নি যাতে একে উল্টো দিকে চালানো যায়। যারা শিল্প বা অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা তাদের বিদ্যে পুঁথিগত জ্ঞানের বাইরে এতটুকু ছিল না। ইতিমধ্যে আংশিক ভূমিসংস্কারে, শিক্ষকদের অর্থনৈতিক স্থায়ীত্বে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থায়, সরকারী কর্মচারী সংখ্যা স্ফীত হয়ে বাজারকে বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। বাংলার ক্ষমতা ছিল না নিজেই এই স্ফীতিকে ধারণ করবে। দ্রুত এরাজ্য উপভোক্তার রাজ্যে পরিণত হল, উৎপাদক রাজ্য হয়ে উঠল না। আংশিক ভূমিসংস্কারের ফলে যারা জমি পেল তারা আগের চেয়ে খানিক নিরাপত্তা পেল, আর্থিক অবস্থাও একটু ভাল হল, কিন্তু কৃষি ঋণের সুবিধা হল না আইনের জটিলতায়। বীজ, যন্ত্রপাতি কেনার সুবিধা হল না সমবায় ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার না পাওয়ায়। বাংলার কৃষিব্যবস্থার যে রোগ — নিম্নপুঁজি, নিম্নউৎপাদনশীলতা, উচ্চ আংশিক বেকারত্ব — সে সবই রয়ে গেল। কৃষি ও শিল্পের এই পশ্চাৎপদতা কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রেও বিপদ। শ্রমজীবীদের মধ্যে শ্রেণীচেতনা আনতে পারল না সে, শিল্পের প্রলেতারিয়েতদের পেল না পতাকা বইবার জন্য। মধ্যবিত্ত কর্মী, মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব, শিক্ষিত সমাজের কাল্পনিক সংস্কৃতির মধ্যেই মার্ক্সবাদী চিন্তাভাবনা আটকে রইল। বাংলার মার্ক্সবাদী চিন্তা একান্তই একটি সাবজেক্টিভ আন্দোলন। তাতে মার্ক্সের প্রদত্ত ধারা, অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই।

 

একদিকে শিল্প ও কৃষির বিকাশ যেমন থেমে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির বিকাশকে থামিয়ে দিল, অন্যদিকে গ্রামে, শহরে, মফস্বলে অসংগঠিত শ্রমিক, স্বনিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে লাগল। শ্রেণীগত ভাবে এরা যতটা পুঁজিবাদের প্রতি ঘৃণা বহন করেন তারচেয়ে অনেক বেশী ঘৃণা করেন সরকারী আধাসরকারী ক্ষেত্রের নিরাপদ ঘেরাটোপে বসে থাকা কর্মচারীদের, ব্যাংক কর্মী, শিক্ষকদের। এদের ঘৃণা মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির প্রতি যার প্রতীক বাম আন্দোলন। ১৯৭৭ থেকে যত দিন গেছে সমাজের নিচের দিকের নিরাপত্তাহীন এই অংশ ততই কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সমর্থকদের ঘৃণা করেছে। তৃণমূল নেত্রী এদের কাছে এক মেসায়া হিসেবে দেখা দিয়েছেন। অন্যদিকে বামেরা অর্থনীতির এই হিসেব বুঝতে না পেরে বঞ্চিত শ্রেণীটিকে বারবার ‘লুম্পেন’ বলে চিহ্নিত করেছে। আর নিজেরা বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

 

২০১১ সালে যখন বাম সরকারের পতন হল তখন আর বামদল কোন শ্রেণীরই প্রতিনিধি নয়। একদিকে মধ্যবিত্তের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সে ব্যর্থ, আধুনিক শিক্ষা, শিল্প, চিকিৎসা কিছুই সে আনেনি, অন্যদিকে শ্রমিক কৃষকের প্রতি তার কর্তব্য নিতান্ত লিপ সার্ভিসে (ফাঁকা আওয়াজে) পরিণত হয়েছে। আবার আরেক দিকে যে আদর্শের কথা সে বলে এসেছে তার সাথেও বাস্তবে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই একদিকে ‘উন্নয়নই’ শ্রেণীসংগ্রাম এমন বাগাড়ম্বরপূর্ণ অন্তসারশূন্য ‘থিওরি’ দিয়েছে, আবার ‘বিশ্বায়নের’ বিরোধিতা করেছে।

 

১৯৭৭ থেকে ২০১১ বামসরকার কোন এফিশিয়েন্সিও দেখাতে পারেনি, ইকুইটির নীতিকেও বারবার ভেঙেগেছে। এর কারণতার নীতিগত অচলাবস্থা। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কেন্দ্রে বারবার কংগ্রেসের কাছে আসা, আবার কংগ্রেসের চেয়ে দক্ষিণে থাকা দলগুলোকে সমর্থন করা। যার মধ্যে দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির জন্ম। নিজেদের গঠনগত কারণে বামেরা একই সঙ্গ কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতির সমালোচক এবং সমর্থক, এবং এরা কংগ্রেস বিরোধী দক্ষিণপন্থীদের সমর্থক ও সমালোচক। ২০১৯ এর সাধারণ নির্বাচন দেখিয়ে দিল দীর্ঘদিনের বাম ভোটার হিন্দু জাতীয়তাবাদেরও সমর্থক।

 

অতঃ কিম? কী করিতে হইবে?

 

বামেদের এখন সামনে যাওয়ার বা পেছনে আসার কোন পথই আর খোলা নেই। উগ্র মার্ক্সবাদী পথ গ্রহণ করবে? তাহলে প্রশ্ন আসবে এত বছর সে পথ ত্যাগ করেছিল কেন। আর পৃথিবী জুড়ে লেনিনবাদ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। আর্থিক সামাজিক প্রশ্নে লেনিনবাদ আর আধুনিক পৃথিবীতে কোন সমাধান নয়, কেননা রাশিয়াতেই তা ছিল না কখনো। সামান্য কিছু বিপ্লবী ভ্যানগার্ড নিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর স্বঘোষিত নেতা হয়ে সশস্ত্র পথে ক্ষমতা দখল যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব ভারতের মত এত বড় ও জটিল দেশে স্রেফ রেশনিং ব্যবস্থা নির্ভর যুদ্ধকালীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। শান্তিকালীন দেশে উৎপাদন, বন্টন, মূলধন সৃজন কিভাবে হবে তা লেনিনের রচনায় নেই। শ্রমিক শ্রেণীর হাতে উৎপাদন তুলে দেওয়ার কোন কার্যকরী নীতিও নেই। রাজনৈতিক সমাজতন্ত্র থেকে অর্থনীতির সমাজতন্ত্রে বিবর্তিত করার পন্থাও জানা নেই। তাহলে কি পিছিয়ে আসবে? ঘোষণা করবে লেনিনবাদ নয়, বরং ইউরোপের অনেক কমিউনিস্ট পার্টির মতো মার্ক্স, লেনিনকে ছেঁটে ফেলে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক ভাবনাই তার পথ? তাহলে পার্টির হার্ডকোর অংশ হয়ত ছেড়ে চলে যাবে। আর ৩৪ বছরের অকর্মণ্যতা, ভ্রান্তি আর ঔদ্ধত্যের ইতিহাস সামনে রেখে নীতিগত পরিবর্তন করলে কজন তাদের বিশ্বাস করবে? শ্রমিক কৃষিজীবীর মধ্যে আর লাল পতাকা কোনো আবেগের জন্ম দেয় না। তাছাড়াও গত আটবছরে, বিশেষত গত দুই বছরে বাম সমর্থকদের এক নবজন্ম হয়েছে। তারা হাতুড়ি ছেড়ে এরা ত্রিশূল পদ্মফুলে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। হিন্দু বামেদের কেউ পূর্ববঙ্গীয় হিসেবে জেনেরিক্যালি ইসলাম বিদ্বেষী, আরেকদল এদেশীয়রা ‘হিন্দু খতরে মে’র শ্লোগানে ভীত। ‘বর্ন এগেন’ এই হিন্দুদের মধ্যে মার্ক্সকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে? কে আনবে? গ্রামে, বস্তিতে, অভাবী মানুষের ঘরে গিয়ে কাজ করার মত মানুষ কোথায় সরকারী বামদলে?

 

 

লেখক অর্ক সেন প্রাবন্ধিক, প্রকাশিত বই স্তালিনের গুলাগ । 

 

 

 

Share this
Leave a Comment