ভারতে সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের আন্দোলন ক্রমেই সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, বিভিন্ন অধিকার ছিনিয়ে এনেছে ও তথাকথিত মূলস্রোত বাধ্য হয়েছে সমাজের নানা ক্ষেত্রে তাঁদের স্বীকৃতি দিতে। দেশের নাগরিক হিসাবে নির্বাচন প্রসঙ্গে এই মানুষদের ভাষ্যগুলি জানা প্রয়োজন হয়ে পড়ে –লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
দেশের সমকামী, রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের দীর্ঘ কয়েক দশকের আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা, অধিকাংশ প্রান্তিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতো এই সম্প্রদায়ের মানুষদের লড়াইতেও বিভিন্ন পর্যায়ের কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকারদের (কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া) ভূমিকা মোটেই চোখে পড়ার মতো নয়। তবে তা সত্ত্বেও বিগত এক দশকে ভারতে সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের আন্দোলন ক্রমেই সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, বিভিন্ন অধিকার ছিনিয়ে এনেছে ও তথাকথিত মূলস্রোত বাধ্য হয়েছে সমাজের নানা ক্ষেত্রে তাঁদের স্বীকৃতি দিতে। এই আন্দোলনেরই ফলস্বরূপ পাওয়া গেছে নালসা রায়, এসেছে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি, রদ হয়েছে ৩৭৭ ধারা।
কিন্তু পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের মধ্যেই এখনও সমকামী ও রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি অস্বাভাবিক ট্যাবু রয়েছে, রয়েছে তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকার মতো যাবতীয় প্রাথমিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস। এখনও সামাজিক লজ্জা, পারিবারিক চাপ, আইনি জটিলতার কারণে বহু রূপান্তরকামী মানুষ নিজেদের সঠিক পরিচয়ে ভোট দিতে পারেন না বা বাড়ির বাইরে এসে ভোটের লাইনেও দাঁড়াতে পারেন না। তাছাড়াও রয়েছে আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বিভাজন, গ্রাম-শহর বিভাজনের মতো বাস্তব সমস্যা। তাই দেশের নাগরিক হিসাবে নির্বাচন প্রসঙ্গে এই সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের ভাষ্যগুলি জানা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
সত্যিই গণতন্ত্র?
চলতি লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু উদ্যোগ নিশ্চয়ই চোখে পড়ছে যেখানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, পিছিয়ে পড়া মানুষদের নির্বাচনে অর্ন্তভুক্তিকরণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই উদ্যোগের ফলে বাস্তবে তাঁরা ভোটদানে কতটা সক্ষম হবেন সেই পরিসংখ্যান স্পষ্ট নয়। কথা হচ্ছিল রূপান্তরকামী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট-এর অনিন্দ্য হাজরার সঙ্গে। জানালেন নালসা রায়ের পর রূপান্তরকামী মানুষেরা লিঙ্গ স্বনির্ধারণের অধিকার পেয়েছেন, কিন্তু তাও নানা বাস্তব সমস্যায় তাঁদের ভোটার পরিচিতি পত্রে সমস্যা রয়ে যায়। বহু মানুষ তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে আজও ভোট দিতে পারেন না। অথচ সেই সংখ্যাটা কত, সমস্যা কোথায়,তা নিয়ে কেন্দ্র, রাজ্য কারওর কোনও মাথাব্যথা নেই। অনিন্দ্য সরাসরি প্রশ্ন করলেন – “এই গণতন্ত্র কি সত্যিই গণতন্ত্র? যেখানে আমি নিজের পরিচয়ে যোগ দিতে পারছি না? অথচ এই সম্প্রদায়ের ভোটগুলি পরিগণিত হবে। সেক্ষেত্রে আধা-নাগরিক হিসাবে রূপান্তরকামী মানুষদের ভোট কতটা গুরুত্বপূর্ণ?” অনিন্দ্য মনে করছেন এভাবেই জনপরিসরে রূপান্তরকামী মানুষদের অংশগ্রহণে বাধা তৈরি হচ্ছে আর রাষ্ট্রেরও সেক্ষেত্রে ভূমিকা রয়ে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জানালেন, উত্তরবঙ্গে প্রশাসনিক স্তর থেকে বলা হয়েছে এই নির্বাচন কেটে গেলে রূপান্তরকামীদের সচিত্র পরিচয়পত্রের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে!
ইস্তেহারে অর্ন্তভুক্তি
গণতন্ত্রের প্রতিনিধি তৈরিতে প্রত্যেকটি রূপান্তরকামী ভোটেরও একইরকম গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক পরিসরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার লড়াই ও বর্তমানে দেশজুড়ে চলা ফ্যাসিজম-এর বিরূদ্ধে সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের স্পষ্ট অবস্থান – এই দুই মিলে রাজনৈতিক দলগুলিকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। তাই বেশ কয়েক’টি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তেহারে জায়গা করে নিয়েছে রূপান্তরকামী মানুষদের বিষয়। অনিন্দ্য মনে করছেন, “এই প্রথম ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইস্তেহারে এই বিষয়টি আসছে। আজ থেকে ১০, ১৫ বছর আগে এটা ভাবাই যেত না। আমি এটাকে রাজনৈতিক চমক বলে উড়িয়ে দিতে রাজি নই। রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের অবস্থান বিচার করে এই যে অর্ন্তভুক্তি, এর রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে হবে। পরিচয়ের রাজনীতির খারাপ, ভালো দুই দিকই আছে। অধিকারের লড়াই দীর্ঘমেয়াদীভাবে চালিয়ে যেতে গেলে পরিচয়ের রাজনীতিরও প্রয়োজন আছে।”
লড়াই-এর মাধ্যমে স্বীকৃতি
অন্যদিকে এই আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত, সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের কলকাতাস্থিত ক্যাফে ‘আমরা অদ্ভুত’-এর রায়না রায়ের মনে প্রশ্ন, নির্বাচনী ইস্তেহারে উল্লেখ করার পেছনেও কোনও রাজনীতির মারপ্যাঁচ নেই তো? ভোটের পরে কী হবে? অত্যন্ত নেতিবাচক ট্রান্সজেন্ডার বিল-এর বিরূদ্ধে দেশজুড়ে রূপান্তরকামী মানুষদের বিক্ষোভের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন – “টিজি বিল নিয়ে আমাদের আন্দোলনের দৃঢ় অবস্থান সরকার জানে। এই মুহূর্তে বিলটি কোল্যাপ্স করেছে। আমরা চাই যে সরকারই আসুক তারা যেন রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উন্নতির কথা চিন্তা করে। এই সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যের কথা ভাবে। এমন যেন না হয় কিছু তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত, সুবিধাযুক্ত মানুষই উন্নতির শরিক হলেন আর বাকিরা সেই বঞ্চিতই রয়ে গেলেন।”
দেশ চালাচ্ছে শিল্পপতিরা
মাসিক ১৮০০০ টাকা ন্যূনতম উপার্জন বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে রায়না বললেন,“তাহলে কি সরকার রূপান্তরকামী মানুষদেরও এই রোজগারের জন্য কোনও সমান্তরাল অর্থনীতির কথা ভাববে? চাকরির ব্যবস্থা করবে? সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারিতে সাহায্য করবে?” তাঁর বক্তব্য, বর্তমানে পরিবেশ নষ্ট করে যে কর্পোরেটাইজেশন চলছে বা যে ঘৃণার রাজনীতি চলছে তাতে প্রচুর সংখ্যায় শোষণের শিকার হন সংখ্যালঘু রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষেরা অথচ তার কোনও তথ্য, পরিসংখ্যান থাকে না। এ কথা মানলেন যে এই সম্প্রদায়ের মধ্যেও কিছু সংখ্যক মানুষ হয়তো দারিদ্র্য, অচেতনতার জন্য ফ্যাসিস্ত শক্তির আগ্রাসন বুঝতে না পেরে তার সমর্থক রাজনৈতিক দলে যোগ দিচ্ছেন, “কিন্তু তার জন্য যে শিক্ষা বা সচেতনতা তৈরির পরিসর প্রয়োজন তা এই মানুষগুলির কাছে পৌঁছচ্ছে না,” স্পষ্ট বক্তব্য তাঁর। কথা শেষ করলেন এই বলে – “শিল্পপতিরা যখন দেশ চালাচ্ছে তখন আর কী-ই বা আশা করা যায়!”
কলকাতা বা রাজ্যের অন্য যে কোনও প্রান্তের বড় শহরের তুলনায় জেলা ও গ্রামের সমকামী মানুষেরা এখনও নিজেদের যৌন পরিচয় নিয়ে বাঁচার জন্য প্রতিনিয়ত অসম্ভব লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্বনির্ধারিত লিঙ্গপরিচয়ে ভোটদানের জটিলতা
রূপান্তরকামী আন্দোলনের পরিচিত মুখ সম্প্রতি হুগলি জেলার লোক আদালতে বিচারকের সম্মান পাওয়া ঐ জেলারই শেওড়াফুলির বাসিন্দা সিন্টু বাগুই। কাজের সূত্রে কলকাতায় তাঁর নিত্য যাতায়াত। নাচ, অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত তিনি। পরিষ্কারই বললেন, ভোটের কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলি রূপান্তরকামী মানুষদের সাথে কোনওরকম বৈষম্য করবে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানালেন সব দলই ভালো ব্যবহার করেছে। তাঁর শেওড়াফুলির অঞ্চলে তিনি আরও ছ’-সাত জন রূপান্তরকামী পরিচিত জনের সঙ্গে ভোট দিতে গেছিলেন ও সুষ্ঠুভাবে ভোট দিয়েছেন। তবে এ কথা একবাক্যে মানলেন যে রূপান্তরকামী মানুষদের বেরিয়ে এসে স্বনির্ধারিত লিঙ্গ পরিচয়ে ভোট দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সিন্টু – “আমার কিন্তু এখনও পুরুষ পরিচয়ের ভোটার কার্ড। খুব তাড়াতাড়ি আমি সেটা বদলে তৃতীয় লিঙ্গ করব। কিন্তু আমি মহিলার পোশাকেই ভোট দিতে যাচ্ছি এত বছর ধরে। সমস্যা হল তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেরই এখনও পুরুষ/নারী পরিচয়ের ভোটার কার্ড। আন্দোলনের একজন কর্মী হিসাবে আমি অনেক জায়গাতেই সেগুলো বদলে তৃতীয় লিঙ্গ করতে সাহায্য করছি। এই না বদলানোর কারণ হল অনেকের আসল বাড়ি হয়তো অন্য জেলা বা ভিন্রাজ্যে। সেখানে পুরোপুরি পরিচয় বদলে ফেললে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রশ্ন এসে যায়। তাই শাড়ি, চুড়ি পরে ভোট দিতে গেলেও কার্ড’টা বদলান না অনেকে।” বর্তমান নির্বাচনে সিপিআইএম-এর ইস্তেহারে রূপান্তকামী সম্প্রদায়ের জন্য উল্লিখিত দাবীগুলি তাঁর ‘স্পষ্ট ও স্বচ্ছ’ বলে মনে হয়েছে। তিনি মনে করেন এখনকার সচেতন তরুণ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বোধের উপর আস্থা রাখা যায়। শেষে বললেন, “আসলে আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষদের আশাবাদী না হয়ে উপায় নেই। প্রতিটি সরকারের কাছেই আমরা আশা রাখি। তবে নালসা রায়ের পর দেশের বেশ কিছু রাজ্যে আমাদের উন্নয়নে যা কাজ হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তার দশ শতাংশও হয়নি। ভবিষ্যতে এই অবস্থা বদলাবে আমি আশাবাদী।”
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার অভাব ভোট দিতে দেয় না
কোচবিহার জেলার মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি এক দশকেরও বেশি কাজ করছে রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবিকা ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে। মৈত্রী সংযোগের সুমি দাশ যদিও ভোটের রাজনীতিতে তেমন আস্থা রাখছেন না। তাঁর মতে প্রতি পাঁচ বছরে কেন্দ্রে, রাজ্যে সরকার বদলালেও আদপে কোনও সরকারের আমলেই কোনও উন্নতি হয় না। “তবে নির্বাচনী ইস্তেহারে উল্লেখ থাকাটা ভালো। প্রার্থীরা যে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলছেন সেটাও জরুরি। আর ভালো লাগছে শুধু রূপান্তকামী নয়, বৃহত্তর এলজিবিটিকিউ ছাতাটিকেই ধরা হচ্ছে,” বক্তব্য তাঁর। কিন্তু তা সত্ত্বেও চলতি লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে রূপান্তরকামী মানুষদের ভোটে অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। কেন? সুমির উত্তর “এই সাহসটা একজন মানুষ কখন পায়? যখন তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকে, তখন সে সমাজকে তোয়াক্কা করে না। রূপান্তরকামীদের জীবিকার উন্নতি নিয়ে আমাদের রাজ্যে কোনও কাজই হয়নি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত গিয়ে নিজের ভোট দেওয়াটা একটা বড় বিষয়। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা না আসলে তা হবে না।”
চাই বৈষম্যহীন সমাজ
ভারতে সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের আন্দোলনের ফলস্বরূপ বেশ কিছু তরুণ মুখ উঠে আসছেন, যারা নিজেদের পরিচয়ে বাঁচার জন্য পরিবার, সমাজের সাথে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা, লড়াই এইসবই করছেন, ও পেশাগত জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠার লড়াইতেও পিছপা হচ্ছেন না। তেমনই একজন নৃত্যশিল্পী তমোঘ্ন তপোসিধ্যা, যিনি এখন কর্পোরেট চাকরির জগতেও পা দিয়েছেন। সমাজে এখনও সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি ‘ফোবিয়া’ থাকা ও রাজনৈতিক দলগুলির তা দূর করতে কোনওরকম উদ্যোগ না নেওয়া – এর জন্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোকেই দায়ী করলেন তিনি। এই সম্প্রদায়ের মানুষদের বিষয়গুলি যেন সর্বদাই সমাজের আর সমস্ত ইস্যুর মধ্যে পিছনের সারিতে রয়ে যায়। বিশেষত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে তিনি এধরনের ‘ফোবিয়া’ বেশি মাত্রায় লক্ষ্য করছেন বলেও জানালেন। তমোঘ্ন বললেন, “যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাঁদের বলব সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি কোনও অন্যায় হলে এখনও তাঁদের অভিযোগ জানাতে সমস্যা হয়, বহু ক্ষেত্রে আইন পাশে থাকে না। এই অবস্থা যেন বদলায়। আমার মতো অ্যান্ড্রোজিনিয়াস মানুষেরা যেন কোনওরকম বৈষম্যের শিকার না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারি। আর আমাদের কাছে জীবিকা একটা বড় বিষয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই ভালো অভিনয় করেন। আমি চাই ক্রমশ বড় হতে থাকা ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরকামী মানুষদের কাজের পরিসর বড় হোক।”
রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক দাবী
নবীন প্রজন্মের আরেক মুখ অচিন্ত্য প্রান্তর। তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চোখ রাখলেই বোঝা যায় রাজনীতির বিশ্লেষণে এই প্রজন্ম নিজেদের যৌন ও লিঙ্গ পরিচিতি নিয়ে সচেতনভাবেই উপস্থিত। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন অপর লিঙ্গভুক্ত ও যৌন সংখ্যালঘু মানুষদের কী কী সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি লিখছেন – (১) রাস্তায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হাসপাতালে, সরকারি দপ্তরে কোথাও অপর লিঙ্গভুক্ত মানুষদের জন্য কোনও টয়লেট নেই। (২) প্রশাসনিক স্তরে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে, সরকারি কার্য্যালয়গুলিতে যাঁরা পরিষেবা দেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই অপর লিঙ্গভুক্ত মানুষদের সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতা আছে। (৩) পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তায় -ঘাটে সর্বত্র প্রতিটি সময়ে আমাদের যে শ্লেষ, ঘৃণা, যৌন হেনস্থা এবং ‘ট্রান্স-টিজিং’-এর শিকার হতে হয় তার থেকে কোনও সামাজিক সুরক্ষা নেই। অপর লিঙ্গভুক্ত মানুষদের জন্য এমন কোনও আইন নেই যার ভিত্তিতে থানায় অভিযোগ করা যেতে পারে। তাই আমাদের ক্ষেত্রে ধর্ষণ, যৌন হেনস্থার কোনও অভিযোগ গৃহীত হয় না। (৪) …অপর লিঙ্গভুক্ত মানুষদের জন্য নিজের অস্তিত্বের সংগ্রামটাই এতটা বড় হয়ে ওঠে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জীবিকার জন্য যোগ্যতা অর্জনের সুযোগটাই তাঁরা পান না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর রিপোর্ট অনুযায়ী সরাকারি হিসেবে ভারতবর্ষে ছয় লক্ষ ট্রান্সজেন্ডার মানুষের (বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী সংখ্যাটা কুড়ি লক্ষের উপর) ৯৮%-ই কিশোরাবস্থার পর বাড়িতে থাকার সুযোগ পান না। ট্রান্সজেন্ডার শিশুদের জন্য আলাদা কোনও সরকারি ব্যবস্থা নেই, এবং জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট-এও অপর লিঙ্গভুক্ত শিশুদের জন্য বিশেষ কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা নেই। … ট্রান্সজেন্ডার ছাড়া যাঁরা অন্য যৌন সংখ্যালঘু মানুষ তাঁরাও অধিকাংশই জীবিকার ক্ষেত্রে নিজের যৌন পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হন। … ভারতবর্ষে অপর লিঙ্গভুক্ত এবং যৌন সংখ্যালঘু মানুষদের জন্য এমন কোনও ‘অ্যান্টি ডিসক্রিমিনেটরি আইন’ নেই। … (৫) এছাড়া বিবাহের অধিকার এবং বিবাহিত দম্পতি হিসাবে অন্যান্য সামাজিক অধিকার-এর কোনটিই অপর লিঙ্গভুক্ত বা অন্যান্য যৌন সংখ্যালঘু মানুষদের নেই। … অচিন্ত্য তাঁর পোস্ট’টি শেষ করছেন এভাবে – “…এটা ধরে নিতে অসুবিধা হয় না যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এগুলির বাস্তবায়ন না হওয়ার একটি বড় কারণ। সংসদীয় গণতন্ত্রে যেহেতু সংখ্যার পাটিগণিতই শেষ কথা বলে, সেদিক থেকে ভাবলেও কিন্তু এই কয়েক কোটি মানুষ যেকোনও সরকারের পাশা পাল্টাতে সক্ষম। রাজনীতিকরা এই বিষয়টি মাথায় রাখবেন!”
প্রার্থী হয়েও প্রার্থী নন
গত বিধানসভা নির্বাচনে লোক জনশক্তি পার্টি-র পক্ষ থেকে যে দু’জন রূপান্তরকামী প্রার্থীর নাম ঘোষনা করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে একজন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ববি হালদার। শাসক দলের ভীতিপ্রদর্শনে তিনি ও অপর জনও প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। সে সময়ের আলাপের সূত্রে ফোন-এ ধরা গেল ববি-কে। জানালেন সেই ঘটনার পর থেকে লোক জনশক্তি পার্টি বা অন্য কোনও রাজনৈতিক দলই আর যোগাযোগ করেনি। এবারের লোকসভা নির্বাচন ঘিরেও আলাদা কোনও উত্তেজনা ধরা পড়ল না তার গলায়। কী মনে হচ্ছে রাজনীতিকদের দেখে? “ আলাদা করে ভালো, মন্দ কিছুই মনে হয় না। আমাদের কথা কেউ ভাবেও না, আমাদের কথা কোথাও থাকবেও না। ভোট চাইতে তো সব দলই আসে। ভোটে জিতলে সুযোগ-সুবিধা দেবে বলে, কেউ কেউ তো বলে আপনি দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু আমি জানি কেউ কোনও সুবিধা দেবে না। আমাদের বক্তব্য কেউ শোনে না। খালি নিজের মনে হয় কিছু করা উচিৎ। যদি আবার সুযোগ পাই মানুষের সেবা করব, মানুষের পাশে দাঁড়াব।”
কলকাতায় রাজনৈতিক দলের কথোপকথন
১) এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিপিআইএম-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রের চার জন প্রার্থী সমকামী, রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রায় ৪-৫টি আলোচনাসভা করেন। দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের সেরকমই এক সভায় কথা হল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শঙ্খদীপ, শুভঙ্কর, সৌম্য, শঙ্করের সঙ্গে যারা নিজেদের সমকামী পুরুষ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের কাছে এ ধরনের আলোচনা একটা শুরু বলা যেতে পারে। তবে সকলেই মনে করছেন শহরের থেকেও বেশি মফস্বলে, গ্রামে, পঞ্চায়েত এলাকায় এধরনের সভা করে সচেতনতা তৈরি করা বেশি দরকার। বিশেষত স্কুলে, শিক্ষকদের মধ্যে সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করলে শিক্ষাক্ষেত্রের পরিসর সহজ হবে বলে তাঁরা মনে করছেন। দেশের সরকার তৈরিতে এমন একটি দল প্রয়োজন যাঁরা বৈষম্য, বিভাজনহীন ‘ইনক্লুসিভ সোসাইটি’ তৈরিতে বিশ্বাসী। আর এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে তাঁদের বক্তব্য – শুধু নিজেদের সম্প্রদায়ের কথা নয়, সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের ফ্যাসিজম-এর বিরূদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, কারণ ফ্যাসিজম-এর প্রথম আঘাতটা প্রান্তিক মানুষদের উপরেই আসে। তাদের সাফ কথা – “দেশকে ভালবাসা মানে রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে কথা না বলা নয়।”
২ ) এধরনের সভার প্রভাব কতটা হতে পারে জানতে চাইলাম অভিনব-র কাছে,যিনি এই অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বললেন, “যদিও এই সম্প্রদায়ের বৃহত্তর মানুষের মধ্যে সকলের মধ্যেই স্বাভাবিক অ্যাপ্রিহেনশন থাকতে পারে, যেহেতু ঠিক ভোটের আগেই সভাগুলি হচ্ছে।তবুও এধরনের আলোচনা জরুরি। কারণ কথাবার্তাটা কোথাও গিয়ে শুরু হচ্ছে। তৃণমূলের ইস্তেহারে তো এই সম্প্রদায়ের নামোল্লেখও নেই।”
৩) অন্যদিকে বার্তা ট্রাস্ট-এর পবন ঢাল-কে সভা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ায় বললেন, “এটি একটি বহুদিন ধরে আটকে থাকা প্রচেষ্টা যা এই সভাগুলির মধ্যে দিয়ে সামনে আসছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে। যদিও আমি যা খুঁজছিলাম তা পুরোপুরি পেলাম না, এঁরা স্বীকার করলেন যে সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের উপরে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা হিংসাত্মক আচরণ করেছেন, কিন্তু তার জন্য কোনও ক্ষমাপ্রার্থণা দেখলাম না। আমি ২০০৬-৭ সালে বারাসাতে আমার ঘনিষ্ঠ একাধিক বন্ধুদের দেখেছি তাঁদের যৌন, লিঙ্গ পরিচিতির জন্য ক্ষমতাশীলদের কাছে হেনস্থা হতে। আমি আগ্রহী এই কথোপকথন কোন্ পথে এগোয় তা দেখতে।” যদিও দলের তরফ থেকে বলা হচ্ছে এই কথাবার্তা নির্বাচনের পরেও চলবে, তবু কি কিছু প্রশ্ন জাগে? পবন বললেন, “হ্যাঁ, একটু তো জাগেই। কারণ আগের নির্বাচনেই আম আদমি পার্টি-র তরফ থেকে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তাও ঠিক নির্বাচনের আগে। এবারেও তাই। দেখা যাক কী হয়।” পশ্চিমবঙ্গে কোনও দল থেকেই রূপান্তরকামী কোনও প্রার্থী নেই কেন? “আমার মনে হয় কোথাও একটা অবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে যে দু’জনের দাঁড়ানোর কথা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করা হয়েছিল।”
যে যে দাবী উঠল
সেদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্যও। সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের তরফ থেকে বিভিন্ন যে বিষয়গুলি উঠে এসেছিল, তা হল –
(১) বামফ্রন্টের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের অ্যাজেন্ডায় শ্রমজীবী রূপান্তরকামী মানুষদের বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রের ইস্যুগুলির অর্ন্তভুক্তি যাতে তাদের জীবিকার অধিকার, সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার মত বিষয়গুলি গুরুত্ব পায়।
(২) এধরনের আলোচনা, প্রচার যেন শুধু কলকাতার মতো বড় শহর নয়, জেলায়, মফস্বলে, গ্রামেও করা হয়।
(৩) এই কথোপকথন যেন শুধু নির্বাচনকেন্দ্রীক না হয়, যেন দাবী ওঠে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর, জেন্ডার ক্লিনিক করার, প্রার্থী যদি সাংসদ না-ও হন তবু যেন আলোচনা চলে।
(৪) নির্বাচনী ইস্তেহারে পুলিশ রিফর্ম নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই। মানবাধিকার কর্মীরা বারেবারেই পুলিশি অসহযোগিতার সম্মুখীন হন। এলজিবিটিআইকিউ সম্প্রদায় এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়।
(৫) বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির বিভিন্ন গণসংগঠনকে এলজিবিটিআইকিউ ইস্যুর বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করতে হবে।
(৬) সমকামী যুগল দীর্ঘ কয়েক দশকের সম্পর্কের পরেও কেন বিসমকামী যুগলদের মতো সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন? এধরনের আইনি বৈষম্য দূর করা দরকার।
(৭) বামপন্থী বিভিন্ন যে ছাত্র সংগঠন, তাদের মধ্যে হোমোফোবিয়া, ট্রান্সফোবিয়া দূর করার জন্য বিশেষভাবে সচেতনতা প্রসার করা দরকার।
(৮) দলের সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে দেখতে হবে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের যেন কোনও সমস্যা না হয়।
(৯) যৌন হেনস্থা সংক্রান্ত আইনের ক্ষেত্রে সমকামী, রূপান্তরকামী, ক্যুইয়ার মানুষেরা যাতে আইনি সহায়তা পান তারজন্য আইনে বদল আনতে হবে।
(১০) কৃষিজীবী, খেতমজুর যে রূপান্তরকামী মানুষেরা রয়েছেন তাঁদের অধিকারের প্রশ্নে নজর দিতে হবে।
(১১) ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোট তৈরির সময়ে যেন এলজিবিটিআইকিউ মানুষদের শুধু গোষ্ঠী পরিচিতি নয়,তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ দেখেই সঙ্গে নেওয়া হয়।
অধিকার আন্দোলন আসলে মানুষের বাঁচার লড়াই। নির্বাচন আসবে, যাবে। কিন্তু ফ্যাসিজম-এর বিরূদ্ধে, পিতৃতান্ত্রিকতার বিরূদ্ধে, ফোবিয়ার বিরূদ্ধে, ট্যাবু-র বিরূদ্ধে, বঞ্চনা আর শোষণের বিরূদ্ধে, অত্যাচারের বিরূদ্ধে সমকামী, রূপান্তরকামী, ক্যুইয়ার মানুষদের লড়াই দীর্ঘ পথ হাঁটবে।
সুদর্শনা চক্রবর্তী ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক।