‘নগরে’ থেকে, শ্রম দিয়েও যাঁরা সরকারের চোখে এখনো ‘নাগরিক’ হয়ে উঠলেন না


  • May 7, 2019
  • (0 Comments)
  • 3064 Views

 

দিল্লির রাজ সিংহাসনে কে বসবে? বহেনজি নাকি দিদি নাকি আবার সেই মোদী? ভোট যুদ্ধ কে জিতবে – আলি নাকি বজরংবলী? এই নিয়ে যখন গোটা দেশ তথা রাজ্য তর্কে-আলোচনায় মশগুল, তারই মধ্যে গত ৫ মে ২০১৯, যাদবপুরের সূর্য সেন হলে, সল্টলেকের বস্তিবাসী মানুষের উদ্যোগে তৈরি শ্রমজীবী-বস্তিবাসী অধিকার রক্ষা কমিটি, সল্টলেক বস্তিবাসীদের নাগরিক অধিকার রক্ষার দাবি নিয়ে প্রথম সম্মেলনটি করল। একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।

 

 

সল্টলেক ও বস্তিবাসী

পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি হয়েছিল আজকের সল্টলেক। ঝাঁ-চকচকে সুন্দর বাড়িঘর, অফিস, স্কুল, নার্সিংহোম, রেস্তোরাঁ, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফুটপাথ, পার্ক দিয়ে ঘেরা সল্টলেক। ঘিঞ্জি কলকাতার পূর্বদিকে গড়ে ওঠা এই শহরে ঢুকলেই মনে হবে অন্য কোথাও এসে পড়েছি। কিন্তু এটাই সল্টলেকের সম্পূর্ণ ছবি নয়। ছবির মত সাজানো সল্টলেকের বিভিন্ন ব্লকের এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলো বস্তি অঞ্চল। যেখানে দরমার বেড়া আর প্লাস্টিকের চালের নীচে অসংখ্য মানুষের বাস। সল্টলেক বলতে যে চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার সাথে একেবারেই বেমানান। ঘিঞ্জি, জল, আলো, শৌচালয়হীন লবণহ্রদের মধ্যে মধ্যে গজিয়ে ওঠা কিছু বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এই দ্বীপের বাসিন্দাদের ভালো-খারাপ, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। একটু ভুল বললাম। ঝাঁ-চকচকে শহরের মাঝে এই বস্তিগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে সবার বড্ডঅস্বস্তি। তাই কীভাবে এগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, তার পরিকল্পনা চলতে থাকে অবিরাম।

 

গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বসে পড়তে শুরু করলে জীবিকার সন্ধানে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বসিরহাট, বনগাঁও, সুন্দরবনসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, এমনকি বিহার থেকেও মানুষ কলকাতামুখী হয়। সল্টলেকের বস্তিগুলোতে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটিয়ে থেকে যায় এইসব গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে আসা মানুষদের একাংশ। সল্টলেক ১২ নম্বর ট্যাঙ্ক, ৯ নম্বর ট্যাঙ্ক, ৫ নম্বর ট্যাঙ্ক, এফএফ ব্লক, এফই ব্লক, সিটি সেন্টারের আশাপাশের বস্তি, সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০০ মানুষের বাস।

 

এই বস্তিতে থাকা মানুষদের রক্তঘামেই সচল থাকে এই সল্টলেক। এই শহরটা যাঁরা পরিষ্কার রাখেন, শহরের বাড়িগুলোকে যাঁরা ঝকঝকে তকতকে করে রাখেন রোজ, রিক্সা চালান, পথঘাট, বড়-বড় চোখ ধাঁধানো বাড়ি বানান, ফুটের ধারে ছোট্ট দোকানে রান্না ক’রে দূর থেকে চাকরি করতে আসা মানুষগুলোর অহেতুক খরচ বাঁচিয়ে অল্প টাকার খাবার জোগান দেন – তাঁরা সবাই এই বস্তিগুলোর বাসিন্দা। অধিকাংশের জন্ম, বড় হয়ে ওঠা এখানেই। গড়ে ৩০-৩৫ বছরের বাসিন্দা। তবুও এঁরাই বহিরাগত। অনিশ্চিত জীবন।

 

এত বছর এখানকার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের এই ঠিকানায় ভোটার করার চেষ্টা কোনও আমলেই হয়নি। কারণ ভোটার হয়ে গেলেই ভোটবাক্সের দায়ে বস্তিবাসীদের ভালোমন্দের দেখভাল সামান্য হলেও করতে হবে। আগামী ১৯ মে বিধাননগরে (বারাসাত লোকসভার অন্তর্গত) ভোট, বিভিন্ন দলীয় মিটিং-মিছিল ভরাট করতে এখান থেকে লোকজনকে নরমে গরমে নিয়ে যাবার তাগিদ সাংসদীয় দলগুলোর থাকলেও এদের কথা ভাবার ফুরসত তাদের নেই। ভোটার না হওয়ায় বেআইনিভাবে বসবাস করছে, এই কারণ দেখিয়ে এই সমস্ত বস্তিগুলোতে প্রায় নিয়ম করে পুলিশি জোরজুলুম চলতে থাকে। বস্তিবাসীরা শহরটাকে নোংরা করছে, এই দাবি তুলে পুলিশ প্রায়ই এসে ‘এবার তুলে দেবো’ বলে হুমকি দেয়। রীতিমত তোলা তোলে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর থেকে। অথচ এই মানুষগুলো জল, আলো, পর্যাপ্ত শৌচালয়ের ব্যবস্থা ছাড়া কীভাবে সুস্থভাবে বাস করতে পারবে, তা নিয়ে বিধাননগর প্রশাসনের কোনও মাথাব্যথা নেই।  বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্লক স্কুলগুলো থাকলেও, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য যে যত্ন ও মনোযোগ প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত।

 

কমিটি কীভাবে শুরু হল

বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটির পথ চলা শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। ২০১৭ সালে দুর্গাপূজোর আগে সল্টলেক জুড়ে ফিফা অনুর্ধ্ব-১৭ যুব বিশ্বকাপের মোট ১০টি ম্যাচ আয়োজিত হয়েছিল জাঁকজমক করে। বিদেশী অতিথিদের কাছে শহরটাকে সুন্দর করে তুলে ধরতে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের চত্বরসহ আশেপাশের এলাকার বিপুল সৌন্দর্যায়ন করা হয়েছিল। বিশ্বকাপের আয়োজনে শহরকে সুন্দর করে সাজানোর অজুহাতে, সল্টলেক এবং বাইপাস সংলগ্ন এলাকার গরীব, খেটে খাওয়া মানুষদের পিটিয়ে, বস্তি উচ্ছেদ করে তাদের আশ্রয়হীন, গৃহহীন করে দিয়েছিল তৃণমূল সরকার। বিধাননগর পৌরসভার শাসকদল তথা প্রশাসনের ইশারায় সুপরিকল্পিতভাবে বস্তিবাসী মানুষের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছিল। বিনা নোটিশে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল শেষ সম্বলগুলো। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে উচ্ছেদ অভিযানকে রুখে দিতে, বস্তিবাসী-ঝুপড়িবাসীদের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে, বস্তিবাসী এবং তাঁদের পাশে দাঁড়ানো গণআন্দোলনের মানুষদের নিয়ে তৈরি হয় বস্তিবাসী-শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটির প্রাথমিক উদ্যোগ। সংগঠিত ভাবে কমিটির লড়াইয়ের ফলে বেশ কিছু জায়গায় উচ্ছেদ রুখে দেওয়াও সম্ভবপর হয়েছিল।

 

দীর্ঘদিনের বাসিন্দা হবার কারণে এবং কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প অনুযায়ী এই মানুষদের জীবন ও জীবিকার অধিকার সুরক্ষিত করতে সরকারের ঠিক উল্টো পদক্ষেপ নেওয়ারই কথা ছিল। বাস্তবে হল অন্যকিছু। তাই বস্তিবাসীরা ঠিক করেছেন, লড়াই করেই তাঁরা তাঁদের জীবন ও জীবিকা সংক্রান্ত ন্যায্য দাবি আদায় করে নেবেন। এইভাবেই শুরু হয় সল্টলেক বিধাননগর অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বস্তিবাসী মানুষ, যাঁরা এখনো কমিটির অন্তর্ভুক্ত নয়, তাঁদের সংগঠিত করবার কাজও।

 

কমিটির প্রথম সম্মেলন

প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে, দুপুর দেড়টা নাগাদ যখন যাদবপুরের সূর্য সেন হলে গিয়ে পৌঁছই, তখন সম্মেলনের কাজ শুরু হয়নি। তবে প্রথমেই চোখে পড়ল – হল ভর্তি বস্তিবাসী মানুষ, অধিকাংশই মহিলা। এটা যেকোনো উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনেরই বৈশিষ্ট্য – ব্যাপক হারে মহিলাদের উপস্থিতি। বস্তিবাসীদের সম্মেলন সফল করতে উপস্থিত ছিল এক ঝাঁক তরুণ ছেলেমেয়ের দল। অধিকাংশই সবে ছাত্রজীবন শেষ করেছেন, কেউ আবার এখনো ছাত্র – সক্রিয় ভাবে ছাত্র রাজনীতি করেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে কিম্বা ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি তাঁরা শহরের শ্রমজীবী এবং বস্তিবাসী মানুষদের সংগঠিত করার কাজও করছেন। পশ্চিমবাংলার সম্প্রতি বাম রাজনীতিতে এই ধরনের প্রচেষ্ঠার বড়ই অভাব।

 

খাওয়াদাওয়া শেষের পর ৩টে নাগাদ ছাত্রযুবদের গানের মধ্যে দিয়ে শুরু হল সম্মেলন। একটা প্রশ্নে বেশ খটকা লাগছিল – কেন সল্টলেকের বস্তিবাসীদের যাদবপুরে এসে সভা করতে হচ্ছে! তার উত্তর পেলাম বস্তিবাসীদের বক্তব্যে, জানতে পারলাম শাসক দলের নির্দেশে সল্টলেকের কোনো প্রেক্ষাগৃহই তাঁদের ভাড়া দেওয়া হয়নি। সব হল থেকে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অগত্যা বাস ভাড়া করে ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে যাদবপুরে এসে সম্মেলন করতে হয়েছে। এসব এখন দিদির বাংলায় স্বাভাবিক ব্যাপার। মিছিল-মিটিং-সভা করতে গিয়ে খালি শাসক দলের চোখ রাঙ্গানি নয়, পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সেগুলোকে পুরোপুরি আটকে অব্দি দেওয়া হয়।

 

প্রায় ৩০০-র কাছাকাছি বস্তিবাসী উপস্থিত ছিলেন। সিটি সেন্টারের পিছনের বস্তির রিক্সাচালক সুভাষ দেবনাথ, ১২ নং বস্তির নাপিত রাজু ঠাকুর, এফএফ ব্লক বস্তির পুষ্প মন্ডল,  ৫ নম্বর ট্যাঙ্ক সংলগ্ন বস্তির মনোয়ারাদি সহ বক্তব্য রাখলেন অনেকেই। মনোয়ারাদি বলছিলেন কীভাবে মুর্শিদাবাদ থেকে কাজের খোঁজে এখানে আসেন এবং ন্যূনতম প্রয়োজনীয় আলো, জল, শৌচালয় ছাড়া এখানে বছরের পর বছর, অল্প রোজগারে সংসার চালাতে বাধ্য হন। দুই ছেলেকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন কষ্ট করে। কিন্তু এই চাকরির বাজারে তাদেরকেও পড়াশুনো ছেড়ে জোগাড়ের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। সুভাষ দেবনাথ জানালেন, সল্টলেকের বস্তিবাসী ঝুপড়িবাসী মানুষদের উচ্ছেদের ঘটনা এই প্রথম নয়, এর ইতিহাস সুদীর্ঘ। অতীতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পাঁচ-ছ বার এবং তৃণমূল সরকার আসার পরও এক-দু’বার উচ্ছেদের মুখে পড়েছিলেন তাঁরা। প্রায় ৩০-৪০ বছর ধরে সল্টলেকের বুকে থাকা সত্ত্বেও কোনো আইনিঅধিকার পাননি। জানা গেল, শুধু শাসক-বিরোধী দলই নয়, চিট ফান্ড থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তরফ থেকেও আর্থিক ভাবে ক্রমাগত প্রতারিত হয়েছেন এই মানুষজন। ভাগীরথী নওটিয়াতে হাউস কিপিংয়ের কাজ করেন এফএফ ব্লক বস্তির পুষ্প মন্ডল। তিনী বললেন কীভাবে ১০-১২ ঘন্তা কাজ করিয়ে তাদের ২০০-২৫০ টাকা দৈনিক বেতন দেওয়া হয়। তাঁর বক্তব্যে উঠে এলো সম কাজের জন্য সম বেতনের দাবী।

 

হলে বিলি লিফলেট থেকে জানা গেল সম্মেলনের উদ্দেশ্য :

 

– দলমত নির্বিশেষে সল্টলেকের সমস্ত শ্রমজীবী বস্তিবাসী মানুষের অধিকারের দাবি নিয়ে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে লড়াই গড়ে তোলার অঙ্গীকার করছে শ্রমজীবী-বস্তিবাসী অধিকার রক্ষা কমিটি, সল্টলেক।

 

– বিধাননগর শহরের যে দৈনন্দিন সামাজিকতা, তাতে বস্তিবাসীদের প্রকৃত সামাজিক স্বীকৃতি তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দীর্ঘকালীন ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কমিটি।

 

– অমানবিক (Dehumanised) পরিস্থিতিতে জীবন কাটানো বস্তির মানুষদের জীবনের প্রকৃত উন্নতি ও ক্ষমতায়নের জন্য লাগাতার ভাবে কর্মসূচী নেওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে কমিটি।

 

– দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে যেভাবে জাতি বর্ণ এবং সর্বোপরি ধর্মীয় বিভাজনের বাতাবরণ ছড়িয়ে পড়ছে, তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী-বস্তিবাসী মানুষের মধ্যে সাহচর্য্য ও সংহতির পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে শপথ নিচ্ছে শ্রমজীবী-বস্তিবাসী অধিকার রক্ষা কমিটি।

 

– বিধাননগর-কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যেকোনো বস্তিবাসীদের অধিকার সংগ্রামে পাশে থাকার ব্যাপারে দায়বদ্ধতা প্রকাশ করছে কমিটি

 

২০১১ সালের জনশুনানি অনুসারে দেশের ৬.৫ কোটি লোক বস্তিতে থাকেন। বিভিন্ন সূত্র অনুসারে সেই সংখ্যাটা বর্তমানে ১২ কোটির বেশী, অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। তার মধ্যে পশিমবঙ্গে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। এই মানুষরা কিন্তু সাধ করে ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে আসছেন না। বিশ্বায়নের অভিঘাতে আমাদের দেশে গ্রামীণ অর্থনীতি যেভাবে ভেঙ্গে পড়ছে, নানাভাবে শহর বাড়ছে, তারই সূত্র ধরে কাজের আশায় শহরে আসছেন বস্তিবাসী মানুষেরা। সার্বিক ভাবে দেশের, বিশেষত শহরের অর্থনীতিতে, সামাজিক চলাচলে এই জনসংখ্যার অংশীদারিত্ব উল্লেখযোগ্য। কাগজে-কলমে এই বিপুল জনসংখ্যার উন্নতি সাধনে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে দেশের প্রশাসন।

 

বাসস্থান ও সামগ্রিক শহর উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালে তৈরি হওয়া রাষ্ট্র সংঘের HABITAT III সনদের অন্যতম সাক্ষরকারী ভারত। এই সনদে শহরে শ্রম দেওয়া শ্রমজীবীদের শহরের অধিকারের (Right to the city) প্রশ্নটি গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত। সাম্প্রতিক কালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছু রায়ে বস্তিবাসীদের জীবন ও জীবিকার অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার বলে চিহ্নিত করেছে। জানিয়েছে, উপযুক্ত কারণ বা পুনর্বাসন ছাড়া সরকারি জমি থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করা চলবে না। ২০২২ সালের মধ্যে সামগ্রিক ভাবে বস্তিবাসী সহ শহর উন্নয়নের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ভাবে নীতি আয়োগের পলিসি তৈরি হয়েছে। অথচ বাস্তবে আমরা দেখছি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, শহরে উন্নয়নের নামে শপিং মল, হোটেল, হাই রাইজ তৈরির অজুহাতে লাগাতার উচ্ছেদ চলছে। উচ্ছেদ ছাড়াও নানা অজুহাতে নিয়মিত ভাবে পুলিশ-প্রশাসনের হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে বস্তি- ঝুপড়ির বাসিন্দাদের।

 

এই প্রশ্নে আমাদের রাজ্যের হাল আরও দুর্বিষহ। এব্যাপারে আগের এবং বর্তমান সরকার একই পথের পথিক। কলকাতা পৌরসভার কিছু ন্যূনতম আইন থাকলেও ২০১৫ সালে গঠিত বিধাননগর পৌরসভার এই বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট আইন বা পলিসি কিছুই নেই।

 

‘নগরে’ থেকে, শ্রম দিয়েও যাঁরা সরকারের চোখে এখনো ‘নাগরিক’ হয়ে উঠছেন না, বাস্তবত অদৃশ্য হয়ে থাকা সেই বস্তিবাসীদের দৃশ্যমান করে তোলার লড়াইয়ের ইতিহাসে, প্রশাসনিক-সামাজিক মানচিত্রে, শ্রমজীবী-বস্তিবাসী অধিকার রক্ষা কমিটি-র এই সম্মেলন হয়তো বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

 

আগামী দিনে, আরও মানুষকে সংগঠিত করে সল্টলেকের বুকেই সম্মেলন করার অঙ্গীকার নিয়ে ৫ মে-র সম্মেলন শেষ হল সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ। অনেকের মুখে শোনা গেল, ফেরার পর আবার নতুন করে শাসক দলের হুমকি, আরও পুলিশ ও প্রশাসনিক হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কার কথা।

 

সম্মেলনের দাবিসনদ :

১) বস্তিবাসীরা এখন যেখানে বসবাস করছেন, সেখানেই তাঁদের আইনি স্বীকৃতিসহ উপযুক্ত স্থায়ী বাসস্থান করে দিতে হবে।

 

২) সকল বস্তি অঞ্চলে পানীয় জলের সঠিক পরিষেবা দিতে হবে। এলাকার মধ্যেই নলকূপ এবং টাইম কলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

 

৩) প্রত্যেক বস্তিবাসীর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পরিষেবা পৌঁছে দিতে হবে।

 

৪) প্রত্যেকটি বস্তি অঞ্চলে শৌচালয়, স্নানাগার, পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ চাই।

 

৫) অযথা পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে হবে। হকারদের ওপর এবং বস্তির ঘরে ঘরে ঢুকে পুলিশের জুলুমবাজি, বস্তিবাসীর ওপর প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

 

৬) বস্তি অঞ্চলের যে সকল মহিলারা আশেপাশের বিল্ডিং, শপিং মলে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন, তাঁদের কাজ অনুযায়ী সঠিক পারিশ্রমিক, নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় ছুটিগুলো দিতে হবে।

 

৭) নির্মাণ শ্রমিক এবং সকল অসংগঠিত শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। কোনো শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত হলে বা অঙ্গহানি ঘটলে, সংশ্লিষ্ট মালিক বা কর্তৃপক্ষকে সেই শ্রমিকের চিকিৎসার খরচা দিতে হবে, তার পরিবারকে আপৎকালীন প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে হবে। এব্যাপারে প্রশাসন আইনমাফিক উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবে।

 

৮) ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালকদের বিধাননগর পৌরনিগমের লাইসেন্স দিতে হবে, যাতে পুলিশের হয়রানি বন্ধ হয়, যাতে রিক্সাচালকরা ব্যাটারি চালিত গাড়ি চালাবার আইনি বৈধতা পায়।

 

৯) স্ট্রীট ভেন্ডার আইন ২০১৪ অনুসারে নাগরিক হকারদের নিয়ে টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি করতে হবে।

 

১০) পুরসভার সাফাই কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি লাগু করতে হবে এবং স্থায়ী কাজ দিতে হবে। সাফাই কর্মের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে হবে।

 

১০) শহরে শ্রমদানকারী সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের এবং বস্তিবাসীদের শহরের প্রতি অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজ্যে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে।

 

 

All Images courtesy: শ্রমজীবী-বস্তিবাসী অধিকার রক্ষা কমিটি

 

 

Share this
Leave a Comment