অযোধ্যা পুরাভূমি ধ্বংস-প্রকল্পের বিরুদ্ধে কলকাতায় নাগরিক কনভেনশন


  • April 22, 2019
  • (0 Comments)
  • 3276 Views

 

‘অযোদিয়া বুরু রক্ষা আন্দোলন সংহতি মঞ্চে’-র ডাকে আগামী ২৪ এপ্রিল কোলকাতার ভারতসভা হল-এ একটি কনভেনশনের আয়োজন করা হয়েছে। উপস্থিত থাকবেন অযোধ্যা পাহাড়ে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা মানুষেরা। একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।

 

সমূহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে অযোধিয়া বুরু। বিপদের মুখে নেই নেই করেও টিকে থাকা আদিম বনাঞ্চল, আদিবাসী-মূলবাসীদের জীবিকা-উপজীবিকা, সংস্কৃতি। অযোধ্যা নিছক একটি পাহাড় নয়, আমাদের আদিমতম ইতিহাসের প্রাকৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ। এ অরণ্য আড়াই কোটি বছর পূর্বের পরম্পরা ধারণ করছে। এই অরণ্য মহাকাব্যের প্রাচ্যবন৷ মহানগর আলোয় ভাসবে বলে এই পুরাভূমি ধ্বংস করা, ধ্বংস করে দেওয়া পাহাড়-নদী-বন প্রভাবিত জীবনবোধ, লোকসংস্কৃতি, পূজা-পার্বন, খাদ্যসংস্কৃতি — সে কোনও উন্নয়ন তো নয়ই, সভ্যতাও নয়। অথচ, সেই বর্বর, লোভী, অসভ্য উন্নয়নের নীল নকশা অনুযায়ী শুরু হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ। আপাতত আদালত সে কাজে স্থগিতাদেশ দিয়েছে।

 

উন্নয়নের অছিলায় বাঘমুন্ডি অযোধ্যা ধ্বংসের শুরু ২০০২ সালে। পাঁচ বছরের মধ্যে বামনি প্রপাত আর জলধারাকে টানেল বন্দি করে তৈরি হল প্রথম পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল বিস্তীর্ণ পাহাড়, বাঁধের জলে ডুবে গেল অন্তত তিন লক্ষ গাছ, এক বিপুল জীববৈচিত্র্য। কত যে পাখি ঘর হারাল, কত যে সরীসৃপ, ছোট প্রাণী, কীটের সলিল সমাধি ঘটল তার লেখাজোখা নেই। চিরতরের জন্য হারিয়ে গেল কত বিশেষ ঔষধি, লতা, গুল্ম। বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হল কত লক্ষ কোটি বছরের জীবাশ্ম, পুরাতাত্বিক নিদর্শন। যা ছিল আবিষ্কারের অপেক্ষায়। শত শত মানুষ হারাল রুখাশুখা পাহাড়ের প্রধান জলধারা, বন নির্ভর জীবিকা।

 

সেই ধারা বেয়ে সমগ্র অযোধ্যা জুড়ে পরিকল্পিত হয়েছে আরও তিনটি প্রকল্প। ঠুরগা, বান্দু, কাঠালজোল জলধারাকে কেন্দ্র করে। ঠুরগা প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শেষ। ‘অযোধিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন সংহতি মঞ্চ’ ও ‘প্রকৃতি বাঁচাও, আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’ এর সমীক্ষা অনুযায়ী ঠুরগা প্রকল্পের ফলে ধ্বংসের মুখে মারাংবুরু বা বড় পাহাড়। সমস্ত অরণ্যবাসীর কাছে এই পাহাড় সর্বগ্রাহ্য দেবতা। সাঁওতালদের কাছে শুভ অশুভ সকল ক্ষমতার অধিকারী। মুন্ডারা এই পাহাড়কে বুরু বঙ্গা ও পাট-সরনা বলেও ডাকেন। বাউরি ও বাগদিদের কাছে বড় পাহাড়ি। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প সম্পূর্ণ হলে ২৯৪ হেক্টর এলাকায় হয় কাটা পড়বে কিংবা বাঁধের জলে ডুববে লক্ষ লক্ষ গাছ, অজস্র ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম ও বন্যপ্রাণী।

 

দেওয়াল লিখনে পরিবেশ সংরক্ষণের ডাক

 

অথচ, এই অরণ্যভূমি ও পাহাড়ে যাঁদের অধিকার সবচেয়ে বেশি এই প্রকল্প রূপায়ণে তাঁদের মতামতের কোনও মূল্য নেই সরকারের কাছে। বনাধিকার আইন ২০০৬ অনুযায়ী এই জাতীয় প্রকল্প রূপায়িত করার আগে বনের উপর নির্ভরশীল বনগ্রামগুলির অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষের সম্মতি প্রয়োজন। অথচ প্রশাসন জনশুনানির নামে মাত্র ২৪ জনের স্বাক্ষর করা অনুমতি পত্র তৈরি করে। অভিযোগ, তার পিছনেও রয়েছে এক ধরনের প্রতারণা। সংহতি মঞ্চের সমীক্ষার দাবি শুধুমাত্র অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতেই বাস করেন ১৮০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। অক্টোবর ২০১৮’য় ‘অযোধ্যা পাহাড়ের অধীবাসীবৃন্দ’ একটি ইস্তাহারে জানান, “২০০৬ এর বনাধিকার আইন-এর ৩ ও ৫ নং ধারা অনুযায়ী আমাদের ব্যবহারের যে বন আমাদের গ্রামসভাভুক্ত সর্বসাধারণের গোষ্ঠীসম্পত্তি। এবং যে বন আমরা বহু প্রজন্ম ধরে বাঁচিয়ে রেখেছি, সেই বনের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনও কাজ আমরা সম্মতি দিইনি।”

 

পাওয়ার প্রোজেক্ট-এর বিরুদ্ধে দেওয়াল লিখন

 

অযোধ্যা পাহাড়ে প্রকৃতি পরিবেশ এবং মানবাধিকার রক্ষার এই লড়াই শুরু হয়েছিল ২০১৮’র জুন-জুলাই মাস থেকে। সেই বছর দুর্গাপুজোর নবমীতে পাহাড় চুড়োর এক মেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় ‘ঐতিহ্যমণ্ডিত পবিত্র সুতানতান্ডির অযোধ্যা রক্ষার্থে আদিবাসীদের চাই জঙ্গলের অধিকার’ শীর্ষক এক প্রচারপত্র। সেপ্টেম্বরে অযোধ্যার বারেলহর গ্রামের রবি বেসরা, মুনিরাম টুডু, সুশীল মুর্মু কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। হাইকোর্ট ৩১ মার্চ অবধি প্রকল্প এলাকায় গাছ কাটার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ জারি করে। এবার টনক নড়ে শাসক গোষ্ঠীর। অভিযোগ, লেলিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ-প্রশাসনকে। শুরু হয় চোখরাঙানি,মাওবাদী তকমা লাগিয়ে দেওয়ার হুমকি। উৎকোচ এবং চাকরির লোভ। ভবি ভোলেনি। তিরিশ-চল্লিশ জনে ঘরোয়া সভা উপচে তিনশো-চারশো ছাড়িয়েছে। ‘প্রকৃতিবাদী’ অধ্যাপক, ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে আদিবাসী সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল’ এই আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ১৭ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্ট আগামী ৩১ অগস্ট পর্যন্ত প্রকল্প এলাকায় সমস্ত কাজে অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ জারি করেছে। মোদ্দা কারণ, বনাধিকার আইন অনুযায়ী বনবাসীদের সমস্ত অধিকার ও দাবি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে যে দাবি করে জেলাশাসক কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশমন্ত্রকে প্রকল্প শুরুর ছাড়পত্রের জন্য পাঠিয়েছিলেন তা ‘রঙচড়ানো ও মিথ্যে’ বলে প্রমাণিত হয়েছে আদালতে।

 

আন্তর্জাতিক মানে ভারত পরিবেশগত কৃতিত্বের নিরিখে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৭ তম। সেই প্রেক্ষাপটে আগামী ২৪ এপ্রিল কলকাতায় ভারতসভা হলে এক নাগরিক কনভেনশনের আয়োজন করেছে সংহতি মঞ্চ ও প্রকৃতি ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ।

 

 

 

Share this
Leave a Comment