যুদ্ধে উন্মত্ত পৃথিবীতে মাটির সুরের সন্ধান


  • February 28, 2019
  • (0 Comments)
  • 1966 Views

“লরি থেকে বালির বস্তা নামিয়েছেন কোনোদিন? আমরা প্রতিদিন নামাই, ২০০-২৮০ টাকা মজুরি। কিন্তু আমরা রেশনটাও পাই কারুর দয়াতে। আমাদের সেই অধিকার আছে কি ? রেশনের অধিকার, ন্যায্য মজুরির অধিকারই চাইতে পারি না। চাইলে পৌঁছয়ও না। সে দেশে যুদ্ধ চাই এই দাবী কাকে, কেন, কাদের জন্য জানাবো?” – প্রেমশূন্য, নিঃস্ব, হিংসায় উন্মত্ত, বাজারের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে এখনও এমন কথা বলার মানুষ আছেন। যুদ্ধের দোরগোড়ায় থমকে থাকা দেশের করিমপুর নামের একটি গ্রামের থেকে ঘুরে এসে জানালেন লাবনী জঙ্গী

 

 

প্রেমশূন্য নিঃস্ব পৃথিবীর বুকে একটি নির্দিষ্ট দিন প্রেমের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় আজকাল। সেই বরাদ্দ দিনটির নিরানব্বই ভাগ দখল করে নিয়ে বাজার এই প্রেমশূন্য নিঃস্ব পৃথিবীর সভ্যতাকে শেখায়, কিভাবে বাজারি প্রেম প্রদর্শন করতে হয়। যাক, এইসব বিতর্ক ক্লিশে, বহু বছর ধরে হয়ে আসছে। মৃত পৃথিবী থেকে পালিয়ে যাওয়া বসন্ত ঋতু ক্যালেন্ডারে ফেলে রেখে গেছে ফাল্গুন মাসটিকে। এই মাসই সেই সময়, যখন পলাশ-শিমুলের গাছগুলো লাল হয়ে ওঠে, ঘন নীল আকাশের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তাদের। যদিও মৃত পৃথিবীর আকাশ আর কখনো ঘন নীল হবে না; দূষণের কালো ধোঁয়ার পরতে আকাশ এখন ধোঁয়াশায় ভরা, কালচে, চিটচিটে। তবু পলাশ-শিমুল ফুলগুলো এই সময়ে জোর করেই ফোটে আর অতীতের কথা শোনাতে চায়। আমরা শুনতে পাই না, অনেক আওয়াজ এখানে; এতো দাবীর চিৎকার। তবুও আমরা এখনো অনেকে যারা পুরনো সময়ে বাঁচার কথা, প্রেমের কথা পড়েছি, শুনেছি, আঁতিপাঁতি করে খুঁজে চলি সেই প্রাচীন কথোপকথনগুলি।

 

এবছরও নিয়ম করে এই মৃত পৃথিবীতে সমারোহে একটি বাজারি প্রেমের দিন উদযাপিত হয়েছিল। সেদিন এক বৃদ্ধ, যাকে খুব ঘেন্না করা যায়, একই সাথে খুব ভালোবাসাও যায়, এমন একটি বুড়ো লোক সন্ধ্যে থেকে রাত অবধি গান শুনিয়েছিল, একটি মৃত শহরের সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত মঞ্চে। মঞ্চ ভরা মানুষেরা ওই লোকটির সাথে সমবেত সুরে বসন্তের গানও গেয়েছিল,

“দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি–
বরষ ফুরায়ে যাবে, ভুলে যাবে জানি॥
তবু তো ফাল্গুনরাতে এ গানের বেদনাতে
আঁখি তব ছলোছলো, এই বহু মানি..”

 

বৃদ্ধ গায়ক প্রবল বিশ্বাসে বলেছিল ‘আমাদের এই সুরের মাটি হিংসার দখলে যেতে দেবো না। কথা দিন আমরা আটকে দেবো হিংসাকে, আমাদের মাটি এখনো বসন্তের সুরে গান গাইতে জানে, এই মাটিকে রক্তাক্ত হাতে তুলে দেবো না’।

 

লোকটির প্রতিটা কথা সত্যি, প্রতিটা মিথ্যে। প্রেমের সুর, প্রতিবাদের সুর, মাটির সুর – এসবও তো এই মৃত পৃথিবীতে বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের মতই। বাজারসভ্যতা এসব প্রোডাক্ট বানিয়ে নানা মোড়কে সাজিয়ে রেখেছে। বাজারের শব্দ-প্রতিরোধী, বুলেট-প্রতিরোধী কাঁচের দোকানের দেয়াল ভেদ করে সুরগুলো আজ মাটির আর্তনাদ কতটা শুনতে পাচ্ছে? সুরগুলো আজকাল দোকানে সাজানো থাকে, আর নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধ সেদিন মঞ্চে বলেছিল, আগামীর হিংসাকে যদি হারিয়ে দিতে পারি, আমরা সারারাত গান গাইবো, এমন গান যে গান কোনোদিন গাইনি, এমন গান যে গান কোনোদিন শোনেনি কেউ…

 

আর সেদিনই, হ্যাঁ সেদিনই আমরা রাতে যখন ফিরছিলাম, রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা, আর সেই জটলা থেকে গর্জন ‘এই ঘটনাটা বড়’, ‘এটাকে ছেড়ে দিলে চলবে না’, ‘আমাদের প্রতিশোধ নিতে হবে’, ’৪০টা লাশ ভাই চোখে দেখা যাচ্ছে না’, ‘কী বীভৎস’, ‘এবার দেখা যাক সরকার কী করে’।
পরদিন সকালের বাজারে এই কথাগুলোর সাথে এক-এক করে যুক্ত হতে থাকে ‘ওদের তো হোমল্যান্ড স্বাধীনতার সময়ে দেওয়া হয়েছিল। ওখানে না থেকে আমাদের দেশে থাকবে, আর আমাদেরই সর্বনাশ করবে’, ‘এবার সময় হয়েছে জবাব দেবার, ওদের এবার খেদানো দরকার’, ‘দেশের খেয়ে দেশের ক্ষতিতে অন্য দেশের সাহায্য করে, ওদের বোঝানো হোক রামধোলাই কাকে বলে’।

 

১৫-১৬ তারিখ জুড়ে এই মৃত শহরের চারিদিক মোমবাতি মিছিলে ‘বদলা চাই’ স্লোগান-ব্যানারে ছেয়ে গেল। এগুলো আমাকে অস্থির করছিলো, বুঝতে পারছিলাম অধিকাংশ আলোচনার একটা পর্বে এসে ‘একজন-দুজন’ আলোচনাটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নিজস্ব নির্মিত যুক্তি সাজিয়ে কাশ্মীরের সেনামৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক করে তুলবার একটি ধারাবাহিক স্ক্রিপ্টেরই পুনঃপুনঃ পাঠ আওড়ানো হচ্ছিলো। এই উঠতি দিশাহীন কর্মহীন তথাকথিত শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের নব্য সংস্কৃতি দেখে অসহায় লাগছিল।

 

তবে আরও বীভৎস হয়ে উঠলো ১৬ তারিখ বিকেল, যাদবপুরের একটি অটোতে ফুটফুটে তিন বছরের সন্তান কোলে এক মা যখন একটানা বলে চললেন ‘মোদীজি পারবে এদের নিকেশ করতে, আগেই উচিত ছিল এদের দেশ থেকে খেদানোর’। সেদিন পাঁজর ভেঙে কান্না পেয়েছিল। আমার মায়ের মুখ মনে পড়ছিল। নিজের গ্রামের মাটি আঁকড়ে নাছোড় প্রেমিকার মতো শুধু এটুকু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ‘এই মায়ের সন্তানের ভবিষ্যৎ ভালো হোক’। মনের গভীর শূন্যতা থেকে আশীর্বাদের মতো যেন উঠে আসছিল, ‘এই মায়ের সন্তান যেন আমাদের সময়ের থেকে ভালো থাকে, প্রেমে থাকে….’। ওই ফুটফুটে শিশুটি বড় হতে হতে যেন ততদিনে আমরা হিংসাকে প্রেম দিয়ে হারিয়ে দিতে পারি।

 

১৫ তারিখ থেকেই রাজ্যে হল এক নতুন হিংসার সূচনা। চারিপাশের সদ্য ফোঁটা পলাশ-শিমুলেরা নির্বাক, আকাশে গুমোট ধোঁয়াশা। চারিদিকে কেবল সীমান্তের মৃত্যু ঘিরে একদল উন্মত্ত লোক প্রবল উল্লাসে নতুন দেশের রচনা করছে, যার নাম ‘পেট্রিয়টিক লিঞ্চিস্তান’ দেওয়া যেতে পারে। সেই দেশে প্রতি ঘণ্টায় একটা করে মবলিঞ্চিং-এর ভিডিও বানানো হচ্ছে এবং উল্লাসের সাথে সেটা বাজারি মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে এক নতুন ঘরানার ত্রাস তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ১৫-১৬ জন যুবক যুবতী মিলে নিজেদের এলাকা বা পার্শ্ববর্তী এলাকার কোন একজনকে টার্গেট করে তার বাড়িতে গিয়ে তার বক্তব্যের বিকৃত অর্থ বানিয়ে তাকে পাকিস্তানপন্থী বানিয়ে সমবেত ভাবে লিঞ্চ করে উল্লাস করছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই টার্গেট করে লিঞ্চিং চলছে যখন, সেই উল্লাস মুহূর্ত ‘লাইভ’ করে রাজ্যের প্রতিটা প্রান্তে সগর্বে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল যখন, রাজ্য প্রশাসন তখন নীরব দর্শক। রাজ্যের সাধারণ মুসলমান ও শাল বিক্রি করতে আসা কাশ্মীরীদের নিরাপত্তাহীনতা ক্রমে বাড়ছিল। একই সাথে এই লিঞ্চকারী উন্মত্ত ১৫-১৬ জনের আঞ্চলিক দলগুলো নিজেদেরকে ‘দেশের সাধারণ জনগণের’ নাম দিয়ে যখন ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করে চলছিল, প্রশাসনের কাছে এই ছেলেমেয়েগুলোর ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্বেও প্রশাসন নীরব। এই নীরবতা সামান্য কিছু হিংস্র লোককে আরও আরও হিংসা বিস্তারে, ধর্ষণের হুমকি দিতে, লিঞ্চ করতে, আরও সাহায্য করে চলল। এই হিংসার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটি আমরা দেখলাম ১৮ তারিখ নবদ্বীপে। শিক্ষকের বাড়ির সামনে তার ছাত্ররা এক সাথে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে বলল আমাদের মাস্টারমশাইকে আমরা চিনি, ‘তোরা কে? কার কথাতে এখানে এসেছিস? খুব দেশভক্তি হয়েছে, মানুষকে মেরে দেশভক্তি দেখাবি তোরা? এই সব কটাকে ধরে রাখ তো!’

 

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখেছি আমরা বেশ কতগুলো কমন স্ট্র্যাটেজি – নিজেদের ‘সাধারণ মব’ বলে দাবী করা। হুংকার, চিৎকার, ও উস্কানি দিয়ে আশেপাশের জনগণকেও নিজেদের উন্মত্ত কার্যকলাপে যোগদান করতে উৎসাহিত করা। ও ভারত মায়ের নামে, সেনার নামে স্লোগান দিয়ে মারধোর, ভাঙচুর করে একটা ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করা। ও সেই উন্মত্ততা সোশ্যাল মিডিয়াতে দিয়ে এই ভয়ের বাজারটাকে আরও উষ্ণ-গরম রেখে দেওয়া।
১৪ তারিখ রাত থেকে এক ফোঁটা ঘুম না আসা শরীর ক্রমে ভাঙছিল, আর প্রতিটা হিংসার ভিডিও দেখলেই মনে এক অসম্ভব অনিশ্চয়তা অন্ধকার তৈরি করছিল। ১৮ তারিখ শহর থেকে পালিয়ে এসেও কোন লাভ হল না। কারণ আমার মফঃস্বলের পড়শি বন্ধুদের একাংশ একইভাবে যেন মৃত পৃথিবীর পচনশীল দেহে হিংসা-পোকা হয়ে উঠেছে।

 

১৯ তারিখ আজহার ফকিরের বার্ষিক অনুষ্ঠানে শিক্ষকসম এক বৃদ্ধ আসবার জন্য জানালেন। দুইবার ভাববার সময় নিইনি। সকালে উঠেই বাস ধরলাম করিমপুরের। দুপুরে পৌঁছলাম যখন, দেখি মনসুর ফকির গান ধরেছেন “এখনো সে বৃন্দাবনে বাঁশি বাজেরে ; হরে কৃষ্ণ; কৃষ্ণ কৃষ্ণ রে হরে রাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম রে”। আজহার ফকিরের বার্ষিকী অনুষ্ঠান। চারিদিক থেকে বাউল, ফকির, সাধুরা এসেছেন। মানুষেরা আসবেন, চার দিন গান হবে, সাধুসেবা হবে। হতেই পারতো মৃত পৃথিবী থেকে পালানোর জন্য এটা একটা আস্তানা। কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে পচনশীল দেহের প্রতিটা অঙ্গই যে আক্রান্ত হয় – একথা সত্য।

 

গ্রামে এতো আয়োজন, তবে কোথাও যেন মাটির থেকে সুরের একটা দূরত্ব। মানুষেরা, সুরেরা সরে সরে যাচ্ছে মাটি থেকে। আইডিয়ালাইজ না করেই জানাচ্ছি, এটা সেই গ্রাম নয়, যেখানে প্রেমের আবাদ হয়। একটি নতুন গ্রাম, যে গ্রামে মানুষেরা নিয়ন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণে সুর বাঁধেন আজকাল। দেখলাম সাধুদের জন্য নির্দিষ্ট রাখা প্যান্ডেলের গায়ে একটি বড় বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স ঝোলানো। আর মঞ্চের সামনে চারটি বিশাল আকৃতির শব্দ-যন্ত্র; সেটিতে গান চালানো হলে বুক ও মাটি কেঁপে উঠছে। এবং অস্বস্তি বাড়ছে ক্রমাগত।

 

বৃদ্ধ দেখা হতেই বললেন “মন ভালো নেই কেন? এতো অস্থির কেন? কয়েকটি মাত্র লোক, আর তাদের তৈরি করা হিংসা তোমার মনকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে! তুমি দশটি ভিডিও দেখেছ আর ভাবছো এটাই সমগ্র সমাজ। তোমার সামনে যে নির্মিত দেশটাকে দেখানো হচ্ছে সেটাই কিন্তু তোমার দেশ নয়; তোমার দেশে মনসুর হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে বুঁদ হয়ে যায়, তোমার দেশে আরও কতো কিছু আছে। সে সব ছেড়ে ওরা তোমার চোখে যে দেশের চিত্রায়ন করছে সেটাকে বিশ্বাস করে নিয়ে তুমি অযথা কষ্ট পাচ্ছ, দুর্বল হয়ে পড়ছ”।

 

“একটা কাজ করো এই মেলাতে আসা মানুষজন ও গ্রামের মানুষের সাথে গিয়ে কথা বল; তাঁদের প্রশ্ন করো, জানার-বোঝার চেষ্টা করো, তুমি যে যুদ্ধ উন্মাদনা, হিংসাবাদকে দেখছ, তাঁরাও কি একই কথা বলছেন। দেশের একটা বড় অংশের মানুষের কথা তো তুমি না শুনেই নির্ণয়ে পৌঁছে যাচ্ছ, যে মানুষ যুদ্ধ চাইছে, হিংসাতে বাঁচতে ভালবাসছে। একটু বেরিয়ে দেখো তো। নতুন কিছু খুঁজে পেলে আমাকে এসে জানাবে।”

 

আমি বিকেল থেকে শুরু করলাম; গৌরভাঙার আজিজুল খান ফকির। বয়স ৫৫ মতো হবে। আমাকে সাহায্য করলেন তাঁর গ্রামের মানুষের বাড়ি নিয়ে যেতে। রাস্তায় বললেন, পাশের গ্রাম ফোলিয়া থেকে যে দিদিরা এসেছেন, তাঁরা হিন্দুবাড়ির বৌ, প্রতিবছর আজহার ফকিরের বার্ষিকীতে ওনারাই রান্না করতে আসেন; এবারও এসেছেন; আমাদের মধ্যে কোনোদিন সম্পর্ক খারাপ হয়নি।

 

লালচাঁদ ফকিরের চল্লিশের কোঠায় বয়স; তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখলাম, বাড়িতে টিভি নেই; তবে উনি কাশ্মীরের সেনামৃত্যুর ঘটনাটি জানেন। উনি বলে চললেন, আমি মূর্খ মানুষ, গান জানি শুধু; আমি মানুষের মৃত্যুতে কষ্ট পাই, সব্বাই পাই; মানুষকে খুন করা হলে আরও কষ্ট হয়, মনে হয় আমরা যে প্রেমের পৃথিবীটার কথা বলি সেটাই আসলে একটু একটু করে খুন হচ্ছে। তুমি কাশ্মীর নিয়ে আমার কাছে কী জানতে চাও আর আমি কী বলতে পারি? আমার মনে হয় আমরা বলবার জন্য অনেক ক্ষুদ্র, আমাদের বলা, মনে হওয়াতে পৃথিবী চলে না”।

 

নাজেম খান, বললেন চাষ আবাদের সারাদিন খাটনি করে; সন্ধ্যে বেলা একটু গান নিয়ে বসি; তারপর দেখি সকাল হয়ে গেছে। আর আমাদের এখন সরকার ভাতা দিচ্ছে, গান করাতে নিয়ে যাচ্ছে, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, পঞ্চায়েত, শৌচাগার নিয়ে নতুন নতুন গান বাঁধতে হয়। তাই অল্প কিছু রাজনীতির খবর রাখার দরকার হয় এখন। ডিস টিভির চ্যানেলগুলা এখন আলাদা করে টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে; টাকা দেওয়া হয়নি বলে টিভিতে কোনো চ্যানেল আসছে না, কয়েক সপ্তাহ। তবে মুখে-মুখে শুনেছি কাশ্মীরের ঘটনাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সরকার নিশ্চয় এর প্রতিকার ভাবছে।”

 

কোলকাতা

রেজিনা বিবি, বয়স পঞ্চাশ, জানালেন, “আমার ভাইয়ের ছেলেও সেনাতে আছে; ফোন করে যখন এগুলো নিয়ে বলছিল, ভয়ে জানটা শুকিয়ে গেল, কতোগুলো তরতাজা জান গো। তাঁদের মায়েদের কী অবস্থা বলো। কী করে সহ্য করে এক মা, তার তাজা সন্তান বুক থেকে চলে গেলে।” একই সাথে জাহানারা বিবি জানালেন, এসব যুদ্ধের অসুস্থতা তাঁদের গ্রামে ঢোকেনি। গ্রামের পাশেই হিন্দু, দাস, মাহিষ্য, পরামাণিক সম্প্রদায় আছেন, “বডারে মৃত্যু নিয়ে আমাদের এই গ্রামে এখনো পর্যন্ত কোন রাজনীতি হয় না। এমনিতে আমাদের গ্রাম্য লড়াই আছে, জমির আল নিয়ে, মুরগী, ছাগল নিয়ে মাঝে মাঝে মারামারি হয়; কিন্তু হিন্দু মুসলমান নিয়ে এসব এখনো আমাদের গ্রামে হয় না।”

 

আজিজুল কাকা তাঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন, তাঁর বৌমা আঙ্গুরার সাথে আলাপ করাবেন বলে। বছর কুড়ির এক যুবতী আঙ্গুরা টিভিতে স্টার জলসা দেখতে ভালোবাসেন। স্টার জলসার প্রতিটা সিরিয়াল দেখেন। খবর দেখেন অল্প-বিস্তর। কাশ্মীরের সেনা মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান এটা খুব ভয়ংকর ঘটনা, কিন্তু এ সম্পর্কে তিনি বলতে পারবেন না, কারণ তাঁর কোনদিনও মনে হয়নি এই ঘটনা নিয়ে তাঁকে কেউ প্রশ্ন করতে পারে। “আমার মনে হওয়ার আর কী গুরুত্ব আছে এই সমাজে?”

 

মোমিনুল শেখ ২৬-২৭-এর যুবক থানারপাড়াতে থাকেন, মূল জীবিকা ডে-লেবার; তবে বিভিন্ন জায়গাতে মেলায় ঘুরতে যাওয়া তার শখ, সেই শখ থেকেই তিনি পার্শ্ববর্তী মেলাতে ফুচকা, বাদাম এসবের ফেরি করেন। সারাদিন এতো পরিশ্রম করেন যে দিনদুনিয়ার খবরের অবকাশ নেই তাঁর জীবনে। তবে কাশ্মীরের ঘটনাটির বিষয়ে চায়ের দোকান থেকে শুনেছেন। আমাদের দেশের জন্য একটি বড় দুর্ঘটনা বলে মনে করেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম চারিদিকে মানুষেরা যুদ্ধ-যুদ্ধ করে চিৎকার করছেন আপনি কি যুদ্ধের পক্ষে? “হ্যাঁ যুদ্ধ হলে যদি আমার লাভ হয় তবে অবশ্যই যুদ্ধের পক্ষে, কিন্তু আমার পক্ষ বিপক্ষতে আদৌ কি দেশের সরকারের কিছু যায় আসে? সরকার চাইলে যুদ্ধ হবে, না চাইলে হবে না, তাই আমাদের মতো লোকেরা অযথা চেঁচামেচি করে, এতো কিছু ভেবে কী লাভ।”

 

২৪-২৫ বছরের যুবক বনমালী দাসের সাথে কথা বলতে গিয়ে যে শিক্ষাটা পেলাম, বহুদিন সঞ্চয়ে রাখবো। বনমালীর দাদার বাড়িও থানারপাড়াতে। মেলাতে বাদাম বেচছিলেন। লরি থেকে বালি পাথর খালি করেন। আর সন্ধ্যে হলে গ্রামের পার্শ্ববর্তী মেলাগুলোতে ফেরি করেন। কাশ্মীর নিয়ে শুনেছেন, বন্ধুদের মুখে। আমি তাকে প্রশ্ন করি ঘটনার প্রতিক্রিয়া কি ? উনি জানান খুব খারাপ ঘটনা। আপনি কি যুদ্ধ চান? হাসলেন খুব, তারপর বলতে শুরু করলেন, “লরি থেকে বালির বস্তা নামিয়েছেন কোনোদিন? আমরা প্রতিদিন নামাই, ২০০-২৮০ টাকা মজুরি। কিন্তু আমরা রেশনটাও পাই কারুর দয়াতে। আমাদের সেই অধিকার আছে কি? রেশনের অধিকার, ন্যায্য মজুরির অধিকারই চাইতে পারি না। চাইলে পৌঁছয়ও না। সে দেশে যুদ্ধ চাই এই দাবী কাকে, কেন, কাদের জন্য জানাবো?

 

লাহোর

এরপর নির্মল কর্মকার, ভরত কর্মকার-এর সাথে কথা হল, ওনারা মেলাতে লোহার অস্ত্র বিক্রি করেন। নির্মলদা হোয়াটসআপে খবর পেয়েছেন। জিতপুরের মেলাতে ছিলেন তখন। কাশ্মীরের ঘটনাটির পর মনে হয় পাকিস্তানকে যোগ্য শাস্তি দেওয়া দরকার। তুলনামূলকভাবে বাকিদের মধ্যে নির্মলদার রাগ ও প্রতিক্রিয়া একটু বেশী। “আমরা আগেও এই মুসলমান প্রধান গ্রামের মেলাতে এসেছি নিরাপদ ভাবে নিজেদের লোহার জিনিস বিক্রি করে গেছি, আজও এসছি, সামনের দিনগুলোতেও আসবো। আমরা তো মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাই না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাই; আমার অনেক মুসলমান বন্ধুও আছে যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চায়।”

 

পাশে নির্মল কর্মকারের বাবা বসেছিলেন। উনি বললেন এতো যুদ্ধ যুদ্ধ করছ, যুদ্ধ হলে হাঁড়িতে টান পড়ে। আমরা যুদ্ধ দেখেছি তো তাই জানি। নির্মল প্রত্যুত্তরে জানালেন, অত কিছু বুঝি না, বদলা চাই।

 

ফেরার পথে একজন সিভিক পুলিশ আসলাম খানের সাথে দেখা হল। উনি জানালেন পাড়ার কিছু উঠতি যুবক দু-একদিন একটু বাড়াবাড়ি করেছিল, অশান্তি তৈরি করার চেষ্টা করেছিল, আমরা পুলিশ থেকে হোয়াটসআপের ওই মেসেজ ধরে ওদেরকে সাবধান করে দিই। এখন সব ঠিক আছে দিদি।

 

যখন আজহার ফকিরের মাজারে ফিরলাম, সন্ধ্যে নেমে গেছে; দেখি বৃদ্ধ মানুষটির সাথে গ্রামের মানুষেরা এসে দেখা করে যাচ্ছেন। তিনি সকলের নাম জানেন, তাঁদের পরিবারের কথা জানেন। এই গবেষক মানুষটিকে যেন একটা বড় গাছের ছায়ার মতো। একজন এসে বলেই গেলেন, বাবা আর আপনি এইখানে একসাথে বসে থাকতেন, বাবা মারা গেছেন, আপনি আছেন।

 

সালিমা হাশমি, বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কন্যা।

তিনি বললেন “এই যে লাবনী এদিকে এসো, কথা হল ‘দেশের মানুষের’ সাথে?” আমি প্রবল উৎসাহে লাফাতে লাফাতে বলতে শুরু করলাম। উনি হাত দেখিয়ে বললেন “আমি এগুলো জানি। তুমি কী শুনেছ আমি বুঝতে পারছি। তোমাকে এগুলো আমি বললে এই কথাগুলোতে এতটা বিশ্বাস তুমি অর্জন করতে পারতে না। তাই তোমাকে এই কাজ করতে বললাম। যখন ভাবছ দেশ মানে তোমার দেখা কয়েকটি হিংসার ভিডিওতে উঠে আসা কয়েকজন মানুষজন, তখন তুমি একটা বড় অংশের পৃথিবীকে অস্বীকার করছ, যা ঠিক নয়। আজ হয়তো তুমি ১০ জন মানুষের সাথে কথা বলে তাঁদেরকে জেনে খুশী হলে। এই মানুষকে জানার পরিধিটা বিস্তৃত করো। দেখবে, সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা উপর থেকে ছড়ায়। তবে সাম্প্রদায়িকতার মেয়াদ বেশীদিনের নয় কারণ তোমার সমাজের মধ্যেই এতো এতো স্তর, সেই স্তরের মানুষেরা এমন ভাবে বাঁচে, যে চাইলেই তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে হিংসার সাথে সহবাস করতে পারে না। ভালো থাকতে হলে এই সমাজের বহু-স্তরকে অন্বেষণ করো বোঝো, আর তাকে খুঁজে পেলে সংরক্ষিত রাখার চেষ্টা করো। এ বেশী গভীর কথা হয়ে গেলো। একটা গল্প শোনো।”

 

“অনেক বছর আগে বহরমপুরে একজন এস.আই. আসেন। আসবার আগেই তাঁর নাম নিয়ে হইচই পড়ে যায়। সুলতান সিং মানে ত্রাস। যেখানেই উনি যান সেখানেই সন্ত্রাস তৈরি করেন, চোর ডাকাতেরা সাইজ হয়ে যায়। অসংখ্য গল্প চারিদিক থেকে সুলতান সিং অমুক করেছিলেন একবার, সুলতান সিং তমুক করেছিলেন একবার… মানুষের মুখে-মুখে তখন কেবল সুলতান সিং। উনি যেদিন থানাতে এলেন, বাইরে অসংখ্য জনগণের ভিড় একবার তাকে দেখার জন্য; তখন তিনি বারান্দাতে এসে হাত নাড়লেন। ছোটখাটো রোগাপাতলা একজন মানুষকে দেখে জনগণ বলল, ‘সুলতান সিং কোথায়? তাকে দেখার জন্য এতো মানুষ জড়ো হয়েছে, তাকে একবার সামনে আনা হোক!’ সুলতান সিং মুচকি হেসে বারান্দা থেকে অফিসের ভিতরে গিয়ে তার দেহরক্ষীকে বাইরে বেরিয়ে হাত নাড়তে বললেন। জনগণ খুশি হয়ে ফিরে গেল। তুমি বাড়ি গিয়ে ওরাল ট্রান্সমিটার নিয়ে একটু পড়াশুনো করবে। সময়ের সাথে এটা ঠিক বুঝবে কিভাবে হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা রচিত হয়, ও সেই রচনা কিভাবে ক্ষমতাবানেরা নিজেদের স্বার্থে সমাজের নানা কোণে বিস্তারে সাহায্য করে।”

 

উনি বলে চলেন আরও অনেক কথা, আমি একজন ছাত্রের মতো শুনে চলি, আমার প্রবীণ শিক্ষকের কথা। আজকাল এই প্রবীণ শিক্ষকদের প্রাচীন বটগাছের মতো মনে হয়; তারা বিগত অনেকগুলো ঝড় দেখেছেন, আগামী ঝড়ের আগাম বার্তা পাচ্ছেন তবু তারা শক্তভাবে মাটি আঁকড়ে বাঁচার কথা শেখান, মাটিকে গভীরভাবে জানেন; আর জানতে সাহায্য করেন। আমি এই কয়েকদিনের অসংলগ্নতা ও দুর্বলতার পরও যেটুকু শিখেছি সেটা হল আমাদের চারিপাশের নির্মিত পৃথিবী, সমাজ, জীবনের বাইরেও একটা আস্ত জগত আছে। সেই জগতে একটা বড় অংশের মানুষ প্রেমে বাঁচতে জানে, ফসল ফলাতে জানে, আর শ্রমকে ইবাদত হিসাবে ভাবে।

 

আপনি যুদ্ধবাদী না শান্তিবাদী এই প্রশ্ন অবান্তর, হাস্যকর। বরং এই মুহূর্তে এটা জানা বেশী জরুরী, যে মাটির গানকে প্রোডাক্ট বানিয়ে মাটি থেকে বিচ্যুত করছেন যারা, তারা কাদের প্রতিনিধি। ছোট-ছোট করে এগুলো খুঁজতে বেরোলেই আপনি-আমি-আমরা খুঁজে পাবো, শহর যত বাড়ছে বসন্ত ততই হারিয়ে যাচ্ছে কেন।

 

 

 

লেখক সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স কলিকাতা-র শিক্ষার্থী ও গবেষক।

 

ছবির সূত্র: পীপলস মিডিয়া। ফিচার ছবি: কোলকাতায় এপিডিআর-র মিছিলের একটি পোস্টার।

Share this
Leave a Comment