একুশে ফেব্রুয়ারী এবং বাধ্যতামূলক ভাষাশিক্ষা


  • February 21, 2019
  • (0 Comments)
  • 2376 Views

ভাষা দিবসে অসম-বাংলা ডামাডোলের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে লিখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

মায়ের ভাষা না বাপের ধর্ম কোনটার গুরুত্ব বেশী? দুটোরই সমান গুরুত্ব বলতে পারলে ঝামেলা থাকতো না। কিন্তু তা তো নয়। বুড়ো যকের মত এ ওর কাঁধে চাপছে অথবা ও এর কাঁধে। আমি একজন আসামবাসী বাঙালী। আমার মাতৃভাষা বাংলা এবং আমার পিতামহধর্ম হিন্দু। এ দুটোই জন্মসূত্রে প্রাপ্ত, কর্মসূত্রে নয়। যেহেতু আসামে বেড়ে ওঠা, তাই এই দুই পরিচয়ের কখন কোনটা সারফেসে উঠে আসে তা বাইরের কারও পক্ষে বোঝাটা একটু সমস্যার। দ্বিঘাত, ত্রিঘাত সমীকরণের অংক। হিন্দু বাঙালী, মুসলিম বাঙালী, হিন্দু অসমীয়া, মুসলিম অসমীয়া সম্পর্কের ওঠা নামা রাজনীতির জটিলতম অধ্যায়। দশকে দশকে সমীকরণ বদলে বদলে যায়।

 

১৯৬১ সালে বরাক উপত্যকার মুসলমানদের একটা অংশ ছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হিন্দু অসমীয়াদের সঙ্গে। যার ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল প্রথমে ১৯শে মে ১৯৬১-র বাংলাভাষা আন্দোলনে ১১ জনের শহীদ হওয়া। তার ঠিক একমাস বাদে ১৯শে জুনের হাইলাকান্দি ফায়ারিং এবং ১১ জনের মৃত্যু। ৫১ সালের আগুপিছুতে চর এলাকার ময়মনসিংহ মুসলিমরা নিজেদের অসমীয়াভাষী হিসাবে ঘোষণা করে সেন্সাসে। ১৯৩১ সালে অসমীয়াভাষির সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ৩১.৪ শতাংশ মাত্র কুড়ি বছরে ১৯৫১ সালের আদমসুমারিতে তা বেড়ে দাঁড়ালো ৫৬.৭ শতাংশ। অসমীয়া ভাষা সংখ্যাগুরুর ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় আসামে।

 

১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গে ঘটে যায় ২১শে ফেব্রুয়ারী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত  নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ইতিমধ্যে উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু বাংলার (ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশ) মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে।

 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক  সালাম, বরকত ও আব্দুল জব্বার সহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং এক কিশোর।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বিশ্ব পর্যায়ে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, তখন ২১শে ফেব্রুয়ারীর গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণ বিবর্ধিত হয় এবং প্রতিবছর মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়।

 

এই পর্যায়ে ২১শে ফেব্রুয়ারীর সঙ্গে আসামের বরাক-উপত্যকার প্রভূত মিল। বিবদমান দুটি ভাষা গোষ্ঠির মধ্যে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংঘর্ষ। ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রবিরোধি এই আন্দোলনে মোট সাতজন শহীদ হন। আর ১৯৬১ সালের ১৯শে মে রাষ্ট্রবিরোধী সেই আন্দোলনে এগারোজন শহীদ হন। তফাৎটা হয় পরবর্তী পর্যায়ে। ২১শের কৌলিন্য বাড়তে থাকে আর ১৯ ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে ১১ জন শহীদ শুধু নয়, তারপরেও ১৭ই অগাষ্ট, ১৯৭২ সালে বিজন চক্রবর্তী, ২১শে জুলাই ১৯৮৬ সালে আরও যীশু আর জগন, বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। মার্চ ১৬, ১৯৯৬ শহীদ হয়েছেন সুদেষ্ণা সিংহ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে। সবই অসমীয়া রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন গোষ্ঠির ভাষিক আগ্রাসনের ফলশ্রুতি।

 

১৯শে মে, ১৯৬১, শিলচর, আসাম।

 

সমস্যা তীব্র হয় ১৯৭১ সাল থেকে। যে বৎসর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো সেই বৎসরেই শুরু হলো আসুর বিদেশী বিতাড়ণ আন্দোলন। বাংলাদেশ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারীরা আসামের কৃষ্টি সংস্কৃতি অর্থনীতি সব ধ্বংস করে দিচ্ছে। ৮১ সালে সেন্সাস হয়নি। কিন্তু ৯১ সাল থেকে অসমীয়াভাষীর সংখ্যা শতাংশ হিসেবে কমতে শুরু করে। এই সময় থেকেই অলক্ষ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হিন্দুত্ববাদের উত্থানপর্বের সূচনা। এবারে প্যরাডাইম শিফট হতে থাকে। আসু-র বঙালখেদা সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত হতে থাকে মুসলিম খেদা অভিযানে। ইলেকশান পলিটিক্সে উথালপাথাল হতে থাকে। এর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে যুক্ত এবং বিযুক্ত হতে থাকে বোডো, ডিমাসা, চুতিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া, মার, নাগা, মিজো সর্বোপরি হিন্দী এবং ইংরেজী। সঙ্গে খৃষ্টান, আদিবাসী এবং উপজাতি ধর্ম।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলিতে বাংলা ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার একটি প্রস্তাবনা হয়েছে সরকারের তরফে। এ প্রসঙ্গে আমি সবাই কে একটাই অনুরোধ করবো, কষ্ট করে আসামের কুখ্যাত “সেবা (সেকেণ্ডারী এডুকেশন বোর্ড অব আসাম) সার্কুলার ১৯৮৬” একটু পড়ে নেবেন। সেদিনও সারা আসাম জ্বলে গেছিলো প্রতিবাদে। বরাকভ্যালির করিমগঞ্জে জগন্ময় আর যীশু পুলিশের গুলিতে রাস্তায় শহীদ মৃত্যুবরণ করেন। জনরোষ চারজন পুলিশকে পিটিয়ে মারে। তারপর বরাক উপত্যকায়, বিশেষতঃ করিমগঞ্জে নেমে আসে শ্বেত সন্ত্রাস। সে ইতিহাস হয়তো না জানলেও চলে। কিন্তু সেবা সার্কুলার (The Secondary Education Board of Assam (SEBA) Circular No. SEBA/AB/Syll.11/85-86/1, Dtd.28th February, 1986, according to “Clause Four‟of which Assamese was to be introduced as a compulsory “Third Language‟) কি ১৯৮৬-র রেপ্লিকা?  এই বঙ্গীয় অধ্যাদেশ কি প্রফুল্ল মহান্ত অনুপ্রাণিত? অসমীয়া প্রাদেশিকতার তুতো বোন?

 

অথচ ভারতীয় সংবিধান কোনও ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করেনি। হিন্দী এবং ইংরেজি সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রাহ্য। রাজ্যগুলির হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে সংসদীয় বিধি পালন করে নিজের নিজের সরকারী ভাষা চিহ্নিত করার। এই পদ্ধতিতে ভারতবর্ষে ২২টি রাজ্য সরকারি ভাষা রয়েছে যার মধ্যে সবচাইচে বেশী ব্যবহৃত ভাষা হলো হিন্দী। ভারতীয় জনসংখ্যার ২৫% হিন্দী ভাষা ব্যবহারকারী। মনে রাখতে হবে ভারতীয় সংবিধান ১৯৫০ সালে দেবনাগরি স্ক্রীপ্টে হিন্দীকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করে। সংসদ অন্য সিদ্ধান্ত না নিলে ২৬ জানুয়ারী ১৯৬৫ সংবিধান বলবৎ হওয়ার পর ১৫ বছরের জন্য ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত মুলতুবি রাখা হয়। কিন্তু এই পরিবর্তন অ-হিন্দিভাষাভাষীদের মনে বিপদঘন্টা বাজিয়ে দেয়। বিশেষ করে দ্রাবিড়িয়ান ভাষা গোষ্ঠির মনে যাদের ভাষার সঙ্গে হিন্দির কোন মিলই নেই। এই প্রেক্ষিতে সংসদ সরকারি ভাষা আইন ১৯৬৩ চালু করে বলা হয়, ১৯৬৫ সালের পরেও সরকারি কাজে ইংরেজির ব্যবহার পূর্ববৎ চালু থাকবে। ১৯৬৪ সালের শেষদিকে আরও একবার চেষ্টা হয় সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজির ব্যবহার বন্ধ করার। কিন্তু মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক, পুদুচ্চেরি, অন্ধ্রপ্রদেশের মত রাজ্যগুলি এর প্রবল বিরোধিতায় নামে। কিছু প্রতিবাদ হিংসার দিকে মোড় ঘোরায়। ফলস্বরূপ প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়।

 

কিন্তু ইতিমধ্যে আসাম তো বটেই,  বোডো,  ডিমাসা,  চুতিয়া এমন কি মনিপুর, মেঘালয়ে শহুরে উপজাতিরা নিজ নিজ ভাষার থেকেও ভাঙা হিন্দীতে বেশী স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছেন। পূর্বোত্তর সীমান্তে হিন্দী আগ্রাসন ঠেকাতে জোর করে হিন্দী সিনেমা দেখা বন্ধ করতে হচ্ছে (ভ্যালু জাজমেন্টে না গিয়েই বলছি)। হিন্দী ভাষার আগ্রাসনকে ঠেকাতে গেলে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করাই একমাত্র পথ বলে যারা উদ্বাহু নৃত্য করছেন তাঁরা ভাষিক আগ্রাসনও বোঝেন না তার সমাধানও বোঝেন না। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান এর হোমোজেনিয়াস প্রক্রিয়ায় আমিও আহত এবং একে প্রতিহত করার যে কোনও প্রয়াসে আমি সামিল থাকবো। কিন্তু সে প্রক্রিয়ার শুরু হবে কোন বিন্দু থেকে? কাদের নিয়ে? অজস্র উপভাষা (!), অন্য ভাষা, অসংখ্য বিরোধিতার চোরাস্রোত, আগ্রাসী রাজনীতি, প্রতিরোধের রাজনীতি, ভাষায় বিদেশী শব্দের অনুপ্রবেশ ঠেকানো এসব বিতর্কের সমাপ্তি কোথায়? এক-জাতি-এক-প্রাণ-এক ধর্ম-এক ভাষা-এক রাষ্ট্র-এক নেতা-র যে জিগির তুলেছে হিন্দুত্ববাদীরা, বলা হয় সেটা আমদানী করা জিগির। কেন বলা হয় কে জানে। যুগে যুগে এটাই তো সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রের নীতি।

 

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। বাংলাদেশের মহিলারাই প্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙে পথে নামেন। ঢাকা বিশবিদ্যালয়ে জমায়েত করে তাঁরা প্রতিবাদে যোগ দেন। আজও তাঁদের আন্দোলনের যথাযথ তথ্যায়ন হয়নি।

 

আর রাষ্ট্রই বা বলছি কেন? সাহিত্য সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে এর উজ্বল উপস্থিতি। সেদিন রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতা আবার পড়তে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ‘এক’ ‘এক’ করে একাকার করে ফেলেছেন। বলেছেন “তপস্যাবলে একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া / বিভেদ ভুলিল জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া”। আমি ভাষা রক্ষণশীল নই। শব্দের অনুপ্রবেশে আমার কাতরতা নেই। মোবাইলে বাংলা টাইপ করার অসুবিধা হয় জানি বলে মাঝে মাঝে রোমান হরফে লিখতে বা পড়তে ভ্রূ কুঁচকে ফেলিনা। কোনও কোনও সময় ইংরেজী পোস্ট বা কমেন্টের প্রত্যুত্তরে ইংরেজীতেও লিখে ফেলি। কিন্তু এমনটাও মনে হয় যে যদি এগুলো করতে না হতো তাহলে তো আরও স্বচ্ছন্দ হতাম। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে হিন্দীর চাইতে ইংরেজীকে আমার বেশী আগ্রাসী মনে হয়।
আসলে অসমীয়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মতই বাঙালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন এটাই তো ফলে আশা করাই যায় এই ১৯শে মে এতদিন যা হয়নি তাই হবে। এতদিন ভারতবর্ষের বাঙালীরা বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারী উদযাপনে এত উৎসাহ দেখালেও পাশের রাজ্য আসামের ১৯ শে মে উদযাপনে নিরুৎসাহ ছিল। কেন? শুধুমাত্র বিনোদন এবং ঝুঁকিমুক্ত প্রগতিশীলতা বলে? অসমীয়া ভাষিক রাজ্য আসামে যদি বাংলাভাষা, বোডো ভাষা বা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার সমমর্যাদার দাবীকে যদি লেজিটিমেট বলতে হয় তবে সত্যিই তো পশ্চিমবঙ্গে নেপালী, কামতাপুরী, রাজবংশী, হিন্দী এই ভাষাগুলির সমমর্যাদার দাবীকেও তো লেজিটিমেট বলতে হয়। এনারসিগত কারণে চল্লিশ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন ঘোষিত হওয়ায় বাঙালী অকস্মাৎ জেগে উঠেছে। তাই এতদিন ১৯শের কথা কেউ জানতো না, এখন হঠাৎ জেনেছে। তাও অন্যান্য ভাষার ওপর বাংলা ভাষার বাধ্যতামূলক আরোপনের পর। ভাষা রাজনৈতিক আগ্রাসনের একটি টুল হতে পারে, কিন্তু শিক্ষা এবং ভাববিনিময়ের জন্য ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা অন্যায়। একথা আসামের ক্ষেত্রে সত্য, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সত্য এমনকি ২১শে ফেব্রুয়ারীর ক্ষেত্রেও সত্য। আমি সত্যিই এখনও মনে করি যে স্কুলে যে ভাষা মাধ্যম,  শুধু সেই ভাষাটি বাধ্যতামূলক থাকুক। বাকী সব ভাষা ঐচ্ছিক হোক। এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।

 

পাশাপাশি বাধ্যতামূলক বাংলার বালখিল্যতা বন্ধ করার আয়োজন প্রয়োজন। এখানে বাধ্যতামূলক বাংলাপাঠের সমর্থক হয়ে, আসামের মূল বাঙালী বিরোধিতার প্রতিপক্ষ হওয়া যায় না। হিন্দী ভাষার আগ্রাসন ঠেকাতে অন্য উপায় ভাবতে হবে। এটাই সত্য। এটাই জিগির। বাংলা বলে,  বাংলা লিখেই এর বিরোধিতা করতে হয়। পেশীশক্তির আস্ফালন দিয়ে নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এসব আলোচনায় যাদের অংশ নেওয়া উচিৎ সেই সব নিম্নবর্গীয় মানুষ চিরকাল এসব বৌদ্ধিক আলোচনায় উপেক্ষিত থাকে। এঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশপাশি ভাষাতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমাজের প্রতিটি স্তরের বিশেষজ্ঞকে নিয়ে দীর্ঘকালীন মেয়াদে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে এ সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে।

 

কবি এবং প্রবন্ধকার পার্থ প্রতিম মৈত্রর জন্ম শিলচরে। চাকরিসূত্রে কলকাতাবাসী। ফীচার ছবিটি  ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিহত শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত  শহীদ মিনারের। 

Share this
Leave a Comment