২৫ ডিসেম্বর “মনুস্মৃতি দহন দিন”: ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের মাইলফলক


  • December 25, 2018
  • (0 Comments)
  • 2690 Views

২৫ ডিসেম্বর “মনুস্মৃতি দহন দিন”। ১৯২৭ সালে এই দিন ডঃ আম্বেদকারের নেতৃত্বে মনুস্মৃতি পুড়িয়ে ডাক দেওয়া হয় চতুর্বর্ণ ব্যবস্থাকে নির্মূল করার। এত বছর বাদে আজও এই দেশে জাতিবিরোধী আন্দোলন অসম্পূর্ণ, এবং বহুক্ষেত্রে তথাকথিত নিম্নবর্ণ সমাজের উপর বর্তমান সময়ের ব্রাহ্মন্যবাদী শাসকশ্রেণীর সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ নতুন আকার ও বিদ্বেষের মাত্রা নিয়ে হাজির। আজকের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষিতে ডঃ কে যমনাদাস-এর লেখা মনুস্মৃতি দহন দিন সম্পর্কিত একটি লেখা বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হল। মূল ইংরাজি লেখাটি পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন

 

 

আজ বড়দিন, ২৫ ডিসেম্বর। গোটা খ্রিষ্টীয় দুনিয়াজুড়ে আজ যিশুর জন্মদিন পালিত হচ্ছে। কিন্তু দলিত দুনিয়ার কাছে ২৫ ডিসেম্বর ‘মনুস্মৃতি পোড়ানো’র দিন। ১৯২৭ সালে ড. আম্বেদকর প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি পোড়ান। তখন মাহার সত্যাগ্রহের ‘মহাসংগ্রাম’ চলছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে দলিতদের কাছে এই দিনটি একটি মাইলফলক, একটি গর্বের দিন।

 

১৯২৭-এ এইদিন সাধারণ সভা করার জন্য যখন আম্বেদকরকে জায়গা দিতে অস্বীকার করে মনুবাদী শক্তিরা, তখন ফত্তেখান নামে এক মুসলমান ভদ্রলোক তাঁর ব্যক্তিগত জমিতে সভা করার অনুমতি দেন। স্থানীয় বাজার সভায় আসা মানুষদের খাবার, পানীয় জল বিক্রি করতে অস্বীকার করায় সমস্ত রসদ বাইরে থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল সভাকারীদের।*

 

সভার দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবীদের ৫ টি বিষয়ে শপথ নিতে হয়েছিল:
১. জন্মনির্ধারিত চতুর্বর্ণ প্রথায় আমি বিশ্বাস করি না।
২. আমি জাতিভেদে বিশ্বাস করি না।
৩. অস্পৃশ্যতাকে আমি হিন্দুত্বের এক ঘৃণ্য অঙ্গ বলে মনে করি এবং একে নির্মূল করার জন্য আমি সৎভাবে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করব।
৪. কোনো অসাম্যে আমার বিশ্বাস নেই, আর তাই খাদ্য-পানীয়ের ব্যাপারে আমি সমস্ত হিন্দুদের মধ্যে অন্তত কোনো ভেদাভেদ করব না।
৫. মন্দির, জলের উৎস, স্কুল ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা পাবার অধিকার অস্পৃশ্যদের আছে বলে আমি মনে করি।

 

ড. আম্বেদকর ‘পদ্মাবতী’ নামের একটি নৌকোয় চড়ে বম্বে থেকে দাসগাঁও বন্দর হয়ে এসেছিলেন। যদিও ধরমতার হয়ে এলে তাঁকে কম পথ পেরোতে হত, কিন্তু বাসমালিকরা বয়কট করলে এই পথে ৫ মাইল হেঁটে হলেও মাহার পর্যন্ত পৌঁছন সম্ভব হত। কেউ কেউ বলেন যে চাভাদর জলাশয় থেকে জল খাওয়ার কার্যক্রম আদালতের হুকুমে এবং কালেক্টরের জোরাজোরিতে বাতিল করতে হওয়ার কারণে আম্বেদকর একেবারে শেষ মুহূর্তে মনুস্মৃতি পোড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। কথাটা সর্বৈব মিথ্যে। সভামণ্ডপের সামনেই মনুস্মৃতি পোড়ানোর অনুষ্ঠানের জন্য বেদি গাঁথা হয়েছিল আগের থেকেই। ছ’জন মানুষ টানা দুদিন খেটে এই বেদি তৈরি করেন। ছ ইঞ্চি গভীর, দেড় ফুট দৈর্ঘের একটা বর্গাকার গর্ত খুঁড়ে চন্দন কাঠের টুকরো দিয়ে সেটা ভরা হয় এবং তার চার কোণে চারটে খুঁটি পুঁতে তার তিনদিকে ব্যানার লাগানো হয়, যাতে লেখা ছিল:
১. মনুস্মৃতি দহনভূমি
২. অস্পৃশ্যতা ধ্বংস হোক
৩. ব্রাহ্মণ্যবাদ নিপাত যাক

 

১৯২৭ এর ২৫ ডিসেম্বর রাত ৯টায় এই বেদিতে মনুস্মৃতি রেখে বাপুসাহেব সহস্ত্রবুদ্ধে ও আরো পাঁচ ছয়জন দলিত সাধুর হাত দিয়ে তাকে পোড়ানো হয়। গোটা মণ্ডপে একটাই ছবি ছিল, সেটা মহাত্মা গান্ধীর। যা দেখে মনে হয় আম্বেদকরসহ অন্যান্য দলিত নের্তৃবৃন্দ তখনো গান্ধীর প্রতি আশা হারান নি। সভায় বাবাসাহেব তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্যটি রাখেন, যার প্রধান অংশগুলো ছিল এইরকম:

 

এই জলাশয়ের জল খাওয়া আমাদের বারণ কেন তা আমাদের বুঝতে হবে। চতুর্বর্ণের বিষয়ে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন যে চতুর্বর্ণের শেকল থেকে মুক্তির জন্য আমাদের লড়াই এবং সাম্যের জন্য সংগ্রামের আজ এখান থেকেই শুরু। ১৭৮৯ এর ২৪ জানুয়ারি ফ্রান্সে ষোড়শ লুই-এর ডাকা সভার সঙ্গে এই সভার তুলনা টানেন তিনি। ফরাসি জনপ্রতিনিধিদের সেই জমায়েতে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল রাজা-রাণীর, উচ্চ শ্রেণির মানুষেরা বিধ্বস্ত হয়েছিল আর বাকিরা নির্বাসিত হয়েছিল। বড়লোকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল এবং ১৫ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের গোড়াপত্তন হয়েছিল। মানুষ এখনো এই বিদ্রোহের গুরুত্ব বোঝেনি। এ বিদ্রোহ শুধু ফ্রান্সেরই নয় গোটা ইউরোপের সমৃদ্ধির সূত্রপাত করে এবং সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিপ্লব আনে। ফরাসী বিপ্লবকে তিনি খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তারপর বলেন যে আমাদের লক্ষ্য শুধু অস্পৃশ্যতা নির্মূল করা নয়, বরং চতুর্বর্ণকেই নিশ্চিহ্ন করা। কারণ আসল অশুভের বীজ সেখানেই নিহিত। তিনি উল্লেখ করেন কীভাবে প্যাট্রেসিয়ানরা ধর্মের নাম করে প্লেবেসিয়ানদের ঠকিয়েছিল। অস্পৃশ্যতার মূল লুকিয়ে আছে অসবর্ণ বিবাহের বিধি-নিষেধের মধ্যে আর সেটাই আমাদের ভাঙতে হবে। উচ্চবর্ণদের কাছে তিনি আবেদন রাখেন যে তারা যেন এই সামাজিক বিপ্লবকে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হতে দেয়। শাস্ত্রের কথা ভুলে যেন ন্যায়ের পথকেই মান্যতা দেয়। তিনি কথা দেন যে তাহলে এপক্ষ থেকে শান্তি বজায় থাকবে। এখানে চারটি সঙ্কল্প নেওয়া হয় ও একটি “সাম্যের ঘোষণা” জারি করা হয়। এরপর মনুস্মৃতি পোড়ানো হয়।

 

ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রেসগুলোতে জোরালো প্রতিক্রিয়া হয়। কাগজে আম্বেদকরকে ‘ভীমাসুর’ আখ্যা ডেওয় হয়। তিনি নিজে বিভিন্ন লেখায় মনুস্মৃতি পোড়ানোর সপক্ষে সওয়াল করেন। যারা মনুস্মৃতি না পড়েই এটি বর্জন করার নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন। অনেকে বলেন সেকেলে হয়ে যাওয়া এক শাস্ত্রগ্রন্থকে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের উদ্দেশ্যে আম্বেদকর বলেন দলিতদের ওপর ঘটে চলা আক্রমণগুলোর ওপর নজর রাখতে এবং একমাত্র তাহলেই তারা বুঝবে যে এই নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচারের কারণ হিন্দুদের মধ্যে এই শাস্ত্রগ্রন্থের গ্রাহ্যতা। তারপর তিনি যোগ করেন যে এই নেহাত সেকেলে হয়ে যাওয়া পুস্তিকা (যদি তাই হয়) পোড়ালে কারো কিছু আসছে যাচ্ছেই বা কেন? অনেকে প্রশ্ন তোলেন মনুস্মৃতি পুড়িয়ে দলিতরা কী পেয়েছে? তাঁদের জবাবে তিনি প্রতিপ্রশ্ন করেন যে বিলিতি কাপড় পুড়িয়ে গান্ধী কী পেয়েছিলেন? খান-মালিনীর বিয়ে নিয়ে লিখিত ‘দ্যান প্রকাশ’ পুড়িয়ে কী পাওয়া গিয়েছিল? নিউ ইয়র্কে মিস মেয়োর ‘মাদার ইন্ডিয়া’ পুড়িয়ে কারা কী পেয়েছিল? এমনকি রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য গঠিত সাইমন কমিশন বয়কট করেই বা কী পাওয়া গিয়েছিল সেদিন? এসবই প্রতিবাদকে চোখের সামনে তুলে ধরার একেকটা ধরন, আমাদেরটাও তাই।
তিনি আরো বলেন যে দুর্ভাগ্যের কথা হল মনুস্মৃতি পোড়ানোতেই ব্রাহ্মণ্যবাদ শেষ হয়ে যাবে না। হয় আমাদের ব্রাহ্মণ্যবাদ-গ্রস্ত মানুষদেরই পুড়িয়ে ফেলতে হবে, আর নইলে হিন্দুত্বকে একেবারে গোড়া থেকে বর্জন করতে হবে।

 

আসুন আমরা সকলে মিলে এই মহান দিনটিকে শ্রদ্ধা জানাই।

 

 

*উল্লেখনীয়, গত বছর ভীমা-কোরেগাওতে জাতিবাদবিরোধী বিপুল জমায়েতের ক্ষেত্রেও এই এক-ই অভিযোগ করেন সভায় যোগ দিতে যাওয়া মানুষ: স্থানীয় দোকান বাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সভার একদিন আগে থেকেই যাতে সভায় আসা মানুষ খাওয়ার বা পানীয় জল বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী না কিনতে পারেন। এছাড়া মিটিং হল বা মাঠ এই ধরনের সভার জন্য ব্যবহার করতে না দেওয়া প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে – এই শাসননীতি আজও সারা দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

 

অনুবাদ: গ্রাউন্ডজিরো

Share this
Leave a Comment