আরএসএস কি বদলে যাচ্ছে?


  • November 22, 2018
  • (0 Comments)
  • 2767 Views

সরসংঘচালকের নজরে, ‘আরবান নকশাল’ হল এমন এক ধরনের কমিউনিস্ট, যাদের “জগৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী” একেবারেই আলাদা। প্লেটোর রাষ্ট্রে কবিদের রাখলে যেমন তারা রাষ্ট্রটাকেই ভেতর থেকে ক্ষইয়ে দিতে পারে বলে ভয় ছিল, তেমনি তাঁর সাধের রাষ্ট্রে আর যারাই থাকুক না কেন, ‘আরবান নকশাল’রা থাকলে তারা তার কাঠামোটাই ধসিয়ে দিতে পারে। তাই তিনি ‘আরবান নকশাল’ এই ঝোঁকটাকেই একেবারে ‘এলিমিনেট’ করবার নিদান দিয়েছেন। লিখেছেন নীলাঞ্জন দত্ত। 

 

নবমী নিশি না পোহাতেই দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধানের বাৎসরিক ‘বিজয়াদশমী ভাষণের’ গম্ভীর বার্তা। বাংলায় হয়ত তেমন করে সেটা প্রচারিত হয়নি। একে তো এখানে লোকজন পুজোর আনন্দে মেতে ছিল, তার ওপর খবরের কাগজ ছিল বন্ধ। আর বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো কবে আবার এইসব দেখায়?

 

১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার নাগপুরে যেদিন সংঘের স্থাপনা ঘোষিত হয়েছিল, সেদিনটা ছিল বিজয়াদশমী। সেকথা মনে রেখেই প্রতি বছর এই তিথিতে সরসং ঘচালক একটি ভাষণ দেন, যাকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।

 

এবারের বিজয়াদশমী ভাষণ নিয়ে একটা আগ্রহ আগেই তৈরি হয়েছিল। আগ্রহের উদ্রেক হয়েছিল এক মাস আগে, যখন ডঃ মোহনরাও ভাগবত দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের (এবং শেষ দিনে সাংবাদিকদের) সামনে সেপ্টেম্বরের ১৭ থেকে ১৯ টানা তিন দিন ধরে লেকচার দিয়ে সংঘের বর্তমান ভাবনাচিন্তা ব্যাখ্যা করেন। এই অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল, ‘ভারত অফ ফিউচার: অ্যান আরএসএস পার্স্পেক্টিভ’। অর্থাৎ, ভবিষ্যতের ভারত: আরএসএস-এর চোখে।

 

প্রথম দিন তিনি বলেন, “আমরা সংঘের আধিপত্য চাই না। সংঘ উল্টোটাই মনে করে। সংঘের আধিপত্যের কারণে এই দেশে ভাল কোনও কিছু হয়েছে, এমনটাই যদি ইতিহাসে লেখা থাকে, তবে তা সংঘের কাছে একটা বিরাট পরাজয় হবে। কারণ আমরা চাই যে দেশের ইতিহাস দেশের ইতিহাস, দেশের বর্তমান, দেশের জনগণই তৈরি করবেন।”

 

তিনি আরও বলেন, “একম সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি। তাই বৈচিত্রকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। বৈচিত্রকে মেনে নিন। সব বৈচিত্রই সত্য। বৈচিত্রের উৎসব হোক (এ তো একেবারে let a hundred flowers bloom!)।” তারপর — “নিজের নিজের বৈচিত্র বজায় রাখুন, বিশিষ্টতায় অটল থাকুন। সকলের বৈচিত্রকে সম্মান দিন। মিলেমিশে থাকুন।”

 

দ্বিতীয় দিন তিনি বলেন, “হিন্দু রাষ্ট্রের মানে এই নয় যে সেখানে মুসলিমদের জন্য কোনও জায়গা থাকবে না। যেদিন তা বলা হবে, সেদিন থেকে আর হিন্দুত্বই থাকবে না।”

 

তৃতীয় দিন তিনি বলেন, “হিন্দুত্ব মানে হিন্দুনেস। হিন্দুইজম কথাটা ভুল। কারণ, ইজম একটা বদ্ধ জিনিস। এটা কোনও ইজম নয়, এটা হল একটা প্রক্রিয়া যা চলতেই থাকে।”

 

এসব শুনে অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন, আরএসএস কি পালটে যাচ্ছে? যেমন, ইতিহাসবিদ ও নৃতাত্বিক এবং ‘ফ্যাসিনেটিং হিন্দুত্ব: স্যাফ্রন পলিটিক্স অ্যান্ড দলিত মোবিলাইজেশন’ বইটির লেখক বদ্রী নারায়ণ বলেছিলেন, “আজকে আরএসএস সমাজের সবাইকে গ্রহণ করার এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে বেশি করে মন দিয়েছে।” তাঁর মতে, সংঘ সাংগঠনিকভাবেই বদলে যাচ্ছে আর নমনীয় হওয়ার চেষ্টা করছে। সে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সত্ত্বাকে এক করতে চাইছে। ভাগবতের কথা তারই প্রতিফলন। কেন এই পরিবর্তন? তিনি বলেন, “আরএসএস আজ যেরকম সাফল্য পাচ্ছে, তা ইতিহাসে কখনও পায়নি। আর সে তার ভিত্তিকে আরও বাড়াতে চায়।” তাহলে এতদিন যারা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে এসেছে, তারা কী করবে? বদ্রী নারায়ণের বক্তব্য, “আরএসএস-এর নবজন্ম হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকেও নতুন করে জন্মাতে হবে, একমাত্র তাহলেই সে ছড়াতে পারবে। যতদিন না ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি একটা নতুন ভাষা না শিখে পুরনো ভাষাতেই কথা বলে যাবে ততদিন তারা বিপদের মধ্যে থাকবে।”

 

আমেরিকার জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া চর্চার অধ্যাপক ওয়াল্টার অ্যান্ডারসন, যাঁর শ্রীধর দামলের সঙ্গে যৌথভাবে তিন দশক আগে লেখা ‘দা ব্রাদারহুড অভ স্যাফ্রন’ বইটা আজও আরএসএস-এর ওপরে একটা ‘অথরিটেটিভ টেক্সট’ বলে গণ্য হয়, বলছেন যে সংঘের “একটা বড় বিবর্তন” হয়ে গেছে। “এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বহু (এমনকি হয়ত বেশিরভাগ) স্বয়ংসেবকই এখনও মুসলিমদের সম্পর্কে কট্টর মনোভাব পোষণ করেন, কিন্তু ওপর থেকে এই বার্তা তাকে নাকচ করে দিচ্ছে। এখন, অধিকতর সহিষ্ণুতার পক্ষে এই সওয়ালকে ভেতর থেকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা দিয়েই আমাদের এর আন্তরিকতাকে বিচার করতে হবে।”

 

শেষদিনের সাংবাদিক বৈঠকে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। ‘গুরু’ মাধব সদাশিব গোলওয়ালকারের ‘আ বাঞ্চ অভ থটস’-এর চিন্তাভাবনা থেকে কি বেরোতে পারবে আরএসএস? ভাগবত নিজেই ব্যাখ্যা করে বললেন, “বাঞ্চ অভ থটস যে পরিস্থতিতে লেখা হয়েছিল, তা চিরকাল থাকেনি…। সংঘ কোনও বদ্ধ সংগঠন নয়। সময় বদলে যায়, আমাদের চিন্তাভাবনাও বদলায়, বদলানোর অনুমতি ডঃ হেডগেওয়ারের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।”

 

আরএসএস কি বদলে যাচ্ছে? নাকি, আসলে সে হিন্দুত্বের শিকড়ে ফিরে যাচ্ছে? হিন্দু ধর্মের বিকাশই তো এইভাবে হয়েছে। যাদের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের বিবাদ-বিসংবাদ চলেছে, সেরকম বহু লোকসমাজ, লোকধর্মকে শেষপর্যন্ত আত্মসাৎ করে নিয়েই সে বিস্তৃত হয়েছে। এমনকি, বিদ্রোহী বুদ্ধের অনুগামীদের সঙ্গে অনেক হানাহানি চালিয়েও তাঁকে অবতার বানিয়ে দিতে অসুবিধা হয়নি। তাই তার দেবলোক বা প্যান্থিয়নে এত বিভিন্ন প্রকৃতির দেবদেবীর সহাবস্থান। হিন্দুত্বের উদ্গাতা চন্দ্রনাথ বসু (সাভারকর নন) তাঁর ১৮৯২ সালে প্রকাশিত ‘হিন্দুত্ব’ বইতে লেখেন:

 

“…হিন্দুর মনের ন্যায় সমগ্রগ্রাহী, সমগ্রব্যাপী মন পৃথিবীতে আর নাই। জগতে যাহা কিছু আছে, ছোট বড় সজীব নির্জীব পুং স্ত্রী ভূত বর্ত্তমান ভবিষ্যৎ প্রকৃতি পুরুষ — হিন্দুর মনে সকলই আছে। জগতে যেমন অভিন্ন অবিচ্ছিন্ন ভাবে একে অপর সকলের সহিত এবং সকলে একের সহিত গ্রথিত আছে, হিন্দুর মনে তেমনই গ্রথিত আছে। হিন্দুর মন জগতের ছাঁচে ঢালা (Cosmically constituted) মন। এমন বিরাট মন কি আর আছে? (চন্দ্রনাথ বসু, হিন্দুত্ব, ঢাকা, রিডার্স ওয়েজ, ২০১৭ (প্রথম প্রকাশ ১৮৯২), পৃঃ ৮)

 

নৃতাত্বিক নির্মলকুমার বসু তাঁর দিশারী গ্রন্থে দেখিয়েছেন, শোষণ আর সংশ্লেষ, এই দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র কীভাবে এতদিন তার শাসন চালিয়েছে — একটু ঘুরিয়ে বললে, সংশ্লেষের মধ্যে শোষণ চালিয়েছে। (নির্মলকুমার বসু, ‘হিন্দুসমাজের গড়ন’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ, দেখুন বিশেষত: উপসংহার)

 

নির্মলবাবুর বইটি প্রকাশের পাঁচ বছর আগে, সনৎকুমার রায়চৌধুরী আমাদের প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন:

 

যদি মনে হয়, হিন্দু বলিতে কোন বিশেষ দেবতা বা দেবতাগণের পূজককে বুঝায়, তাহা হইলে হয়ত ভুল করা হইবে।

হিন্দুত্ব, প্রকৃতপক্ষে জগৎকে কিভাবে গ্রহণ করিতে হইবে, কিভাবে বুঝিতে হইবে, তাহার উদ্দেশ্য কি, জগৎ সম্বন্ধে এবং আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে ব্যবহার কিরূপ হওয়া উচিত, এই সকল বিষয়ের একটি সুনির্দিষ্ট ভাবধারা; প্রকৃতপক্ষে ইহা সর্ব্বসাধারণের ধর্ম্ম এবং সনাতন অর্থাৎ সৃষ্টির প্রাক্কাল হইতে বর্ত্তমান। হিন্দুত্ব বলিতে যে ভাবধারা বুঝায়, তাহা গ্রহণ করিলে — ঐ ভাবধারা গ্রহণ সম্বন্ধে কাহারও কোনও বাধা নাই — কোন বিশেষ দেবতা পূজা করার কোন বাধা নাই। হিন্দুধর্ম্মে সকলেই স্ব স্ব ধর্ম্ম প্রতিপালন করিতে পারেন, কেবল জগৎ সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গী হিন্দুধর্ম্মানুযায়ী হওয়া প্রয়োজন। (সনৎকুমার রায়চৌধুরী, ‘হিন্দুধর্ম্ম পরিচয়’, কলকাতা, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, ৪র্থ সংস্করণ ১৯৯২ (প্রথম প্রকাশ ১৩৫১ বঙ্গাব্দ), পৃঃ ১০৪-১০৫)

 

তাই আজ সরসংঘচালক যখন বলেন, “হিন্দু রাষ্ট্রের মানে এই নয় যে সেখানে মুসলিমদের জন্য কোনও জায়গা থাকবে না”, তখন তার জন্যে আরএসএস-এর বদলানোর কোনও দরকারই নেই। এবং সেপ্টেম্বর মাসে এসব কথা বলেও তিনি তাঁর বিজয়াদশমী ভাষণে রামমন্দিরের কথা তুলে অনায়াসেই বলতে পারেন, “জমির মালিকানার বিষয়ে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর সরকারকে উপযুক্ত এবং প্রয়োজনীয় আইনের মাধ্যমে এই মহান মন্দির নির্মাণের পথ পরিষ্কার করতে হবে।” একবার যদি “জগৎ সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গী” আমাদের মত করে ফেলতে পারো, আমাদের রাষ্ট্রে কাউকেই জায়গা দিতে কোনও অসুবিধা নেই, কারণ, “জগতে যাহা কিছু আছে” আমাদের মনে তা সকলই তো আছে।

 

 

কিন্তু সত্যিই কি সবাইকে জায়গা দেওয়া যায়? অমন যে মহান গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, যিনি আজ থেকে ২,৩০০ বছর আগেই প্রজাতন্ত্রের কথা ভেবে ফেলেছিনেন, তিনিও তো তাঁর ‘রিপাবলিক’-এ কবিদের স্থান দিতে চাননি, তারা বিপজ্জনক বলে। ভাগবত কবিদের কথা বলেননি, বলেছেন ‘আরবান নকশাল’দের কথা। তারা কারা? যারা নাকি সমাজের দুর্বলতর অংশগুলির প্রতি বঞ্চনা, অবিচার ও উদাসীনতা থেকে তাদের মনে জন্ম নেওয়া ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে বিচ্ছিন্নতা, হিংসা, ঘৃণা আর দেশবিরোধী আবেগ জাগিয়ে তোলে।

 

এই গোষ্ঠীর সামনের সারিতে যে মুখগুলো দেখা যায়, যাদের থেকে ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’ ধরনের স্লোগান শোনা যায়, তারা কিছু কিছু জায়গায় ঘটনা ঘটার সময় হাজির হয়ে গরম গরম বক্তৃতা দেয়। গভীর জঙ্গলে হিংসাত্মক কাজকর্মকে যখন শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে, তখন শহুরে নকশালবাদের প্রবক্তাদের দেখা গেছে এই সমস্ত আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে এবং হিংসায় উস্কানি দিতে।… এই আরবান নকশালদের ‘নিও-লেফট’ নীতি হল এক নতুন, অপরিচিত, বেলাগাম, একচোখা নকশাল নেতৃত্ব এবং তাদের কিছু অন্ধ অনুগগামী তৈরি করা, যারা কেবল তাদের প্রতিই দায়বদ্ধ থাকবে। এদের চেলারা, যারা ইতিমধ্যেই সোশাল ও অন্যান্য মিডিয়ায়, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, এইসব কাজকর্মের সঙ্গে আগাগোড়া যুক্ত। এরা ইন্টেলেকচুয়্যাল এবং অন্যান্য পদ্ধতিতে, আন্দোলন সম্পর্কে মোহ সৃষ্টিকারী প্রচারের মাধ্যমে এই সমস্ত কাজকর্মের পক্ষে সওয়াল করে, আবার অন্যদিকে এসবের থেকে একটা নিরাপদ দূরত্ব এবং তাদের তথাকথিত মানমর্যাদা বজায় রেখে চলে। এরা যথেচ্ছ চাতুরী এবং বিষাক্ত, উত্তেজনাকর ভাষা ব্যবহার করে তাদের ঘৃণার প্রচারকে আরও তীব্র করে তুলতে ওস্তাদ। দেশের শত্রুদের সাহায্য নিয়ে বিশ্বাসঘাতী কাজকর্ম করতে পারাটা এদের একটা বাড়তি দক্ষতা হিসেবে দেখা হয়। এদের সোশাল মিডিয়ার প্রচারের বিষয়বস্তু এবং বলার ধরন খুঁটিয়ে দেখলে এটা বুঝতে ভুল হবে না। এসবের মধ্যে কোনও না কোনও ভাবে জেহাদি আর সন্ত্রাসবাদীদের উপস্থিত থাকা একটা সাধারণ ব্যাপার। সুতরাং, যে সিদ্ধান্তটা উঠে আসছে তা হল, এটা দেশের ভেতরের ও বাইরের শক্তিদের সাহায্য নিয়ে এক বৃহত্তর, চতুর ষড়যন্ত্র। এখন আর তা বিরোধী দলগুলোর ক্ষমতার রাজনীতির ব্যাপার নয়, রাজনৈতিক উচ্চাশাসম্পন্ন কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী — বুঝে বা না বুঝে — এবং বঞ্চিত, অবহেলিত, দুর্বলতর অংশের মানুষেরা চান বা না চান এর রসদ হয়ে উঠছেন। দেশের আভ্য়‌ন্তরীণ নিরাপত্তার ভিত্তি যে সামাজিক সংহতি, তাকে দুর্বল করে দিয়ে ধ্বংস করার লক্ষ্যে একটা বিষাক্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ আবহাওয়া তৈরি করে এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। আমাদের প্রাচীন রাজনীতি শাস্ত্রে একে ‘মন্ত্রযুদ্ধ’ বলা হয়েছে।

 

মন্ত্রযুদ্ধের কথা ভাগবত তাঁর বিজয়াদশমী বক্তৃতায় এমন প্রাঞ্জলভাবে বলেছেন, যে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে হয়। কিন্তু, একটু আগে যে বলছিলাম, আরএসএস মোটেও বদলায়নি, বদলানোর দরকারও নেই, তা নিয়ে এবার প্রশ্ন জাগে। ‘আরবান নকশাল’-এর মত একটা কুলগোত্রহীন ক্যাটেগরি নিয়ে এত কথা আগে কখনও তো শোনা যায়নি। যে অর্বাচীন চলচ্চিত্রকারের মাথা থেকে এটা বেরিয়েছিল — যিনি বর্তমানে ‘মি টু’র ধাক্কায় কোটরগত — তিনিও বোধহয় কোনওদিন ভাবেননি সরসংঘচালকের বিজয়াদশমী ভাষণে তা এমন গুরুত্বের জায়গা পাবে। আরএসএস কি সত্যিই বদলে যাচ্ছে?

 

অনেক দিন আগে, ‘টাইপরাইটার গেরিলা’ হওয়ার চেষ্টায় যখন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম, কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের কর্মীসভাতেও মাঝে মাঝে ঢুকে পড়তাম। ১৯৮০র দশকের শেষদিকে, যখন রামমন্দিরের হাওয়া উঠতে লেগেছে, এমনি এক সভায় বাইরে থেকে আসা এক হাই-প্রোফাইল প্রচারকের কথা শুনতে শুনতে বেশ অবাক হচ্ছিলাম। ধর্মকর্ম, মন্দির-টন্দির নিয়ে কিছুই বলছেন না তো! বলছেন, মার্ক্সবাদ কেন এক সর্বনাশী মতাদর্শ, সারা পৃথিবীতে কেন তা বর্জিত হচ্ছে, এখানেও তা কেন ছুঁড়ে ফেলা দরকার, এইসব। রামের প্রসঙ্গের সঙ্গে যোগসূত্র একটাই। বার বার বলছেন, কমিউনিস্টরা হল ‘রাবণকে অওলাদ’ — রাবণের বাচ্চা। ভাল গালি বটে!

 

সরসংচালকের মুখে এরকম গালাগালি সাজে না। তাঁর নজরে, ‘আরবান নকশাল’ হল এমন এক ধরনের কমিউনিস্ট, যাদের “জগৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী” একেবারেই আলাদা। প্লেটোর রাষ্ট্রে কবিদের রাখলে যেমন যেমন রাষ্ট্রটাকেই ভেতর থেকে তারা ক্ষইয়ে দিতে পারে বলে ভয় ছিল, তেমনি তাঁর সাধের রাষ্ট্রে আর যারাই থাকুক না কেন, ‘আরবান নকশাল’রা থাকলে তারা তার কাঠামোটাই ধসিয়ে দিতে পারে। তাই তিনি ‘আরবান নকশাল’ এই ঝোঁকটাকেই একেবারে ‘এলিমিনেট’ করবার নিদান দিয়েছেন। ‘এলিমিনেট’ — মানে নিকেশ করা। আমরা যেমন আজকাল টিভিতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি — অমুক জায়গায় “দুজন মাওবাদী নিকেশ”। তার জন্যে কী করতে হবে, তারও তিনি স্পষ্ট পথনির্দেশ দিয়েছেন।

 

এই ধরনের ঝোঁকগুলোকে নিকেশ করতে হলে, সরকারকে সতর্কভাবে এটা নিশ্চিত করতে হবে উপদ্রবকারীরা যার সুযোগ নিতে পারে এমন কোনও ঘটনাই যাতে না ঘটতে পারে। সেই সঙ্গে বিপজ্জনক ব্যক্তি ও শক্তিদের ওপর সর্বদা নজর রাখতে হবে যাতে তারা কোনও উৎপাত করতে না পারে। ধীরে ধীরে, সমাজের থেকে কোনও সমর্থন না পেয়ে এইসব বিপজ্জনক লোকেরা একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে। প্রশাসনকে তার গোয়েন্দাগিরির ব্যবস্থা আরও ব্যপক ও সজাগ করে তুলতে হবে। জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিকে দ্রুত রূপায়নের মাধ্যমে সমাজের শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে করতে হবে। কিন্তু এই অবস্থা একেবারে কাটিয়ে ওঠা তখনই সম্ভব হবে, যখন সমাজের সব অংশ ভ্রাতৃত্ব ও সৌজন্যের সঙ্গে একে অপরের সঙ্গে চিন্তা ও মনের আদানপ্রদান করবে। সম্প্রদায়, ধর্ম, জাতপাত, ভাষা ও প্রদেশের বিভিন্নতাকে আমাদের ঐক্যের প্রকাশ হিসেবেই দেখতে হবে। সমাজের যে কোনও অংশের বিশেষ পরিস্থিতি ও সমস্যাকে সমগ্র সমাজ যদি নিজের বলে দেখতে পারে, তবেই ভদ্রভাবে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে তার একটা ন্যায্য এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসবে।

 

তাহলে খেলাটা কীরকম হবে? ‘আরবান নকশালস ভার্সেস দা রেস্ট’? এটা একটা নতুন কথা বটে।

 

লেখক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Share this
Leave a Comment