ফাদার স্ট্যান স্বামী : এক ‘দেশদ্রোহী’ পাদরি ও রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী অভিযান


  • September 3, 2018
  • (1 Comments)
  • 3305 Views

আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘুর হয়ে গলা চড়ানোর অপরাধে সমাজকর্মী থেকে সুপণ্ডিত, আইনজীবী থেকে মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক থেকে পাদরি — রাষ্ট্রের রোষ থেকে মুক্তি নেই কারও। কেউ জেলে, কেউ-বা গৃহবন্দি। এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের প্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী-বন্ধু ফাদার স্ট্যান স্বামীর দীর্ঘ সংগ্রামের কথা মেলে ধরলেন দেবাশিস আইচ

 

আপনি এ মুহুর্তে একজন দেশদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলছেন। সরকার আমাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু, আমি সরকারের ভুল নীতির বিরুদ্ধে চলমান জনসংঘর্ষে সামিল। মানুষকে জাগিয়ে তুলছি। আমাকে অপরাধী বলে দেওয়া হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। এখন আপনি ( সংবাদমাধ্যম) আর আমি (সিভিল সোসাইটি) যদি চুপ করে থাকি, তবে দেশ আরও ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে। আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। আমাদের আরও জোরের সঙ্গে কথা বলা জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে গণতন্ত্র বাঁঁচবে না।

– স্ট্যান স্বামী, বিবিসি (হিন্দি)-কে দেওয়া সাক্ষাৎকার, ৩১ আগস্ট ২০১৮।

চায়ের কাপটা দু’হাতে তুলে ধরলেন ফাদার স্ট্যান স্বামী। থরথর করে হাত দুটো কাঁপছিল প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধের। না, কারও সাহায্য নেননি। কাপ হাতে এসে বসলেন টেবিলে। বাগাইচা খ্রিষ্টীয় মিশনারি আশ্রমে এটাই নিয়ম। নির্দিষ্ট সময়ে সকাল-দুপুর-রাতের খাবার। অতি সামান্য আয়োজন। থালা-বাটি-গ্লাস সাজানো রয়েছে। এসো থালা হাতে কাউন্টারে দাঁড়াও, খাবার নাও, খাও। খেয়েদেয়ে থালা-বাটি ফের সাবান দিয়ে ধুয়েমুছে জায়গারটা জায়গায় সাজিয়ে রাখো। সেদিন সকালে হঠাৎই ফাদারের সঙ্গে দেখা। মুখোমুখি হতেই সুপ্রভাত জানালাম। পালটা সুপ্রভাত জানিয়ে নিজের টেবিলে ডেকে নিলেন। এই তো বছর তিনেক আগের কথা।

স্ট্যান সম্পর্কে নানা কথা শুনে মুগ্ধতা ছিলই। পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হতেই অভ্যাসবশত ঝাড়খণ্ড, আদিবাসীদের সমস্যা ইত্যাকার নানা প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। বিশেষ করে ‘বিস্থাপন বিরোধী জনবিকাশ আন্দোলন’-এর কথা। খানিক সময় ধৈর্য ধরে শুনে জানালেন, এ বিষয়ে কিছু রিপোর্ট, বইপত্তর আশ্রমের সেলস কাউন্টারে আছে। সেগুলো যেন একটু দেখে নিই। এর পর কথা হল সাধারণ।

২৮শে অগাস্ট রাঁচির নামকুমে বাগাইচাতেও মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ড পুলিশ তল্লাশি চালায়। আরও পাঁচজন সমাজকর্মী, আইনজীবীর ক্ষেত্রে যা হয়েছে সেই মতোই ভোর ছটায় হানা। সেই মারাঠি ভাষায় লেখা এফআইআর। যে ভাষা জানেনই না স্ট্যান। ঘর তছনছ করে আরও পাঁচজনের মতোই বাজেয়াপ্ত করা হল ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল এমনকি মিউজিকের ক্যাসেটও এবং পাথালগড়ি আন্দোলন বিষয়ক একটি প্রেস রিলিজ। কিন্তু, কেন চলল এই তল্লাশি? প্রাথমিক ভাবে তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারেননি তিনি। পুণে তিনি কখনোই যাননি। এলগার পরিষদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া তো দূরের কথা। ধীরে ধীরে গ্রেফতারির তালিকা দেখে কিছুটা বোধগম্য হল। এঁদের সকলের সঙ্গেই তিনি অল্পবিস্তর পরিচিত। সুধা ভরদ্বাজের সঙ্গে একটু বেশি। দু’জনেই মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএল-এর সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়াও আরও একটি সংগঠন সুধা ও স্ট্যান গড়ে তুলেছেন। সেটি হল, ‘পারসিকিউটেড প্রিজনারস সলিডারিটি কমিটি’। যে সংগঠনের প্রধান কাজ বছরের পর বছর মিথ্যা মামলায় জেলে আটক থাকা আদিবাসীদের হয়ে আইনি লড়াই করা।

অপরাধ বটে, গুরুতর অপরাধ। এক, জল-জঙ্গল-জমি থেকে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন দুই, বিনা বিচারে আটক আদিবাসীদের জন্য আইনি লড়াই। যাঁরা ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়ের খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছেন তাঁর বা সুধা ভরদ্বাজদের অপরাধের গুরুত্ব। শুধু সুধা বা স্ট্যান কেন? ভীমা কোরেগাঁও-কাণ্ডে প্রথম দফায় যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় দফায় যে পাঁচজন দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশে আপাতত গৃহবন্দি, তাঁদের পরিচয় খতিয়ে দেখুন — দেশের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী — সকলেই আদিবাসী ও দলিত আন্দোলনের সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত। হয় বৌদ্ধিক স্তরে তত্ত্বগত লেখালেখি বা প্রচারে, সাংবাদিকতার মাধ্যমে, আইনি সহায়তার সাহায্যে, মানবিক ও নাগরিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কিংবা আদিবাসী ও দলিত আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে।

তামিল বংশোদ্ভূত ফাদার স্ট্যান লারডুস্বামী তাঁদেরই একজন। বহুকালই পাদরির আধ্যাত্মিকতা ভুলে কেবলই স্ট্যান স্বামী। সে প্রায় তিন দশক হল ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে চলেছেন স্ট্যান। ১৯৯৬ সালে ঝাড়খণ্ড অর্গানাইজেশন এগেইনস্ট ইউরেনিয়াম রেডিয়েশন বা জোয়ার আন্দোলনে যোগ দেন। চাইবাসায় রেডিও অ্যাক্টিভ আকরিক বর্জ্য ফেলার একটি ড্যাম তৈরির বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম চলছিল। সেই আন্দোলনে জয়ী হয় জোয়ার। ড্যাম হলে যদুগোড়ার চাটিকোছা এলাকায় বহু আদিবাসী মানুষ জমি-ঘরবাড়ি হারাতেন। এর পর বোকারো, সাঁওতাল পরগনা, কোডারমা যেখানেই আদিবাসীরা আক্রান্ত হয়েছেন সেখানেই ছুটে গিয়েছেন। ২০০১ সালে রাঁচি চলে আসেন। বাগাইচায় জেসুইট চার্চের ক্যাম্পাসে তৈরি করেন ট্রেনিং সেন্টার। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের হাতেকলমে শিক্ষার কেন্দ্র গঠিত হয়। পাশাপাশি চলতে থাকে কীভাবে আইনি উপায়ে আদিবাসী ও দলিত বিরোধী নানা অন্যায়, অত্যাচার, উচ্ছেদের বিরোধীতা করা যায় তার জন্য শিক্ষিত যুব নেতৃত্বকে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাদান। স্বাভাবিক ভাবেই বাগাইচাকে চিরকালই নেকনজরে রেখেছে সরকারি গোয়েন্দা বাহিনী।

এইখানে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও বলি, রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা তার চতুর্থ স্তম্ভ যতই ‘আরবান নকশাল’বলে ভয়, ঘৃণা ছড়িয়ে দিক, এ কথা মনে রাখা ভালো ভারতের দলিত-আদিবাসীদের সামান্য অংশই নগরবাসী। যে উন্নয়ন- উদ্বাস্তু, পরিবেশ-উদ্বাস্ত, বিপর্যস্ত গ্রামীণ অর্থনীতির কোপে পড়া উদ্বাস্তু, নগর- মহানগরে বাস করেন, তাঁদের অধিকাংশই থাকেন নগরীর অন্ধকারময় অঞ্চলে। খুবই রক্ষণশীল একটি হিসেব হল, বিগত ৫০ বছরে খনি, বাঁধ, শিল্প, অভয়ারণ্য জাতীয় প্রকল্পের জন্য প্রায় ২ কোটি ১৩ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৮৫ লক্ষ আদিবাসী। সমস্ত উদ্বাস্ত আদিবাসীদের এক চতুর্থাংশের মোটামুটি একটা পুনর্বাসন মিলেছে। বাকিদের প্রশাসন মর্জিমাফিক কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি তথ্য মনে রাখা দরকার আদিবাসীরা দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ। অন্য একটি সমীক্ষা বলছে, ১৯৯০ -এর মাঝামাঝি সময়ে ১৫ লক্ষ মানুষ ভূমিচ্যুত হয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। প্রায় ১৫ লক্ষ একর জমি থেকে — মূলত আদিবাসীরা — বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। গ্রাম ও জমি থেকে এই বিচ্ছিন্নতা ২০০০ সালের পর থেকে আরও ব্যাপক আকার নিয়েছে। (হোয়ার অ্যান্ট ড্রোভস আউট এলিফ্যান্টস, স্টোরি অভ পিপলস রেসিস্ট্যান্স টু ডিসপ্লেসমেন্ট ইন ঝাড়খণ্ড, স্ট্যান স্বামী, প্র‍্যাক্সিস রিভিউ, ২০১৩)। ফলত, একদিকে যেমন বেড়েছে প্রতিরোধ — কোনও কোনও অঞ্চল জুড়ে মাওবাদী বা নকশালপন্থীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ — অন্যদিকে লাগামহীন বর্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। রাগ ও আবেগে ‘#মিটুআরবাননকশাল’ বলে ঘোষণার মাধ্যমে আক্রান্ত সমাজকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী পাদরিদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করার ঐকান্তিক ইচ্ছে প্রকাশের আগে তাঁদের কর্মজগৎটি বিবেচনায় আনা বোধহয় প্রয়োজন ছিল। আর কিছু না হলে অন্তত নগরাঞ্চলের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তু খেটে খাওয়া মানুষগুলির সঙ্গে ‘#মিটুআরবাননকশাল’-এর মতো সোশাল মিডিয়া ক্যাম্পেনের একাত্মতার গভীরতা বিবেচনা করা উচিত ছিল। সঙ্ঘী দালালের প্ররোচনায় পা না-দিয়ে হয়তো ঘোষণা করা যেত — মি টু সুধা ভরদ্বাজ বা ভারভারা রাও কিংবা অন্য কোনও আক্রান্তের নাম।

ভিলাই, ছত্তিশগড়

যাই হোক, স্ট্যানের কথায় ফিরে আসি। ব্যাঙ্গালুরুর ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের দিনগুলি থেকেই আদিবাসী মানুষদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহ জন্মায় স্ট্যানের। কিন্তু, আকাদেমিক পরিসরে সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। একদিন চলেই এলেন তৎকালীন বিহার বর্তমান ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। মিশে গেলেন আদিবাসীদের সঙ্গে। শিখলেন হো ভাষা। আর প্রতি সাপ্তাহিক হাটের বেচাকেনা তাঁকে শেখাল অর্থনৈতিক, সামাজিক বঞ্চনা, শোষণ কাকে বলে। আর ফেরা হল না। নভেম্বর ২০০০, ঝাড়খণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠা হল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আরও হাজারো ঝাড়খণ্ডীদের মতো তাঁরও স্বপ্নভঙ্গ হল। গভীর উপলব্ধিতে বুঝতে পারলেন, ঝাড়খণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ আসলে ততটা আদিবাসী মানুষদের দীর্ঘকালের লালিত আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে

নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী স্বশাসন প্রতিষ্ঠা নয়। প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিটাই ছিল বিপুল খনি সম্পদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। সরকার ও খনি কোম্পানিগুলির মধ্যে শুরু হল একের পর এক মউ (MoU) স্বাক্ষর। স্ট্যান বলছেন, কোনও আলাপ-আলোচনা নয়। আদিবাসী জমি যাতে বেহাত না হয়, তার জন্য যে সমস্ত আইনি রক্ষাকবচ রয়েছে যেমন, ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট (১৯০৮), সাঁওতাল পরগনা টেন্যান্সি অ্যাক্ট (১৯৪৯), সংবিধানের পঞ্চম তফশিল, প্রভিশনস (এক্সটেনশন টু শিডিউলড এরিয়াজ) অ্যাক্ট (১৯৯৬), সুপ্রিম কোর্টের সমতা রায়, ১৯৯৭’র মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ রায় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে চলল। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একশোরও বেশি মউ স্বাক্ষরিত হল। একটা মোটামুটি হিসেব হচ্ছে ওই সময় সীমার মধ্যে ১.৪ লক্ষ হেক্টর জমি সই-সাবুদ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হল। জমি-জঙ্গল-পাহাড় তো আদিবাসী মানুষদের কাছে স্রেফ একটি অর্থনৈতিক পণ্যদ্রব্য নয়, তা হল আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক জীবনরসের উৎস। (সূত্র : পূর্বোল্লিখিত রচনা)। ঝাড়খণ্ডের ৩৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করেন। দেশের ‘বিদ্যুৎ রাজধানী’-তে সাধারণ মানুষের কাছে অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ আজও অধরা। পাঁচ বছরের নীচে ১৯.০৬ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। অর্থাৎ, তথাকথিত উন্নয়নের কোনও ফলই সাধারণের কাছে পৌঁছায়নি। এবার এল আরও উচ্ছেদের হুমকি।

মোটামুটি ২০০৪ সাল থেকেই শুরু হয় উচ্ছেদ বিরোধী, বিস্থাপন বিরোধী সংগ্রাম। ২০১০ সালে যা গণআন্দোলনের রূপ নেয়। আন্দোলনের জেরে শ’খানেক কোম্পানির মধ্যে মাত্র তিন-চারটে সংস্থা কিছু জমি দখল করতে পেরেছিল। এর পর কর্পোরেট সংস্থাগুলি চাপ বাড়াল সরকারের উপর। ‘দেশদ্রোহী’, ‘উন্নয়ন বিরোধী’দের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সওয়াল শুরু হল। ইতিমধ্যেই ২০০৫ সাল থেকে ছত্তিশগড়ে একদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, অন্যদিকে রাষ্ট্রপোষিত সালওয়া জুড়ুম বাহিনীর অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছে। ঝাড়খণ্ডের মতো দু’হাজার সালেই ছত্তিসগড় রাজ্যের জন্ম এবং একই ভাবে সেখানেও খনিজ সম্পদের লোভে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল করপোরেট বাহিনী। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হল দেশজুড়ে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। এই সময়ই তো, ১৮ জুন ২০০৯, সংসদে শোনা যাবে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সেই অমোঘ উক্তি, “If left-wing extremism continues to flourish in parts which have natural resources of minerals, the climate for investment would certainly be affected (খনিজ সম্পদ বহুল অঞ্চলগুলিতে যদি উগ্র বামপন্থা চলতে থাকে, তাহলে পুঁজি বিনিয়োগের আবহাওয়া নষ্ট হবে।)” (‘The Trickledown Revolution’, Outlook, 20 September 2010) ১০ মার্চ ২০১১ ঝাড়খণ্ডে শুরু হল ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। (ঝাড়খণ্ডে এই অভিযানের অবশ্য আরও একটি নাম ছিল অপারেশন আনাকোন্ডা।) আসলে ‘অপারেশন মিনারেল হান্ট’। ছত্তিশগড়ের বস্তারে যে রাষ্ট্রীয় অভিযান আগেই হয়েছিল। এভাবেই দেশের ন’টি রাজ্যে, আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে, নিজের দেশবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ভারত। এর দু’বছর আগেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ফের দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেবেন, “Naxalism remains the biggest internal security threat to India (নকশালবাদ ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রধানতম শত্রু।)” (The Times of India, 24 October 2009) চার বছর আগে ২০০৫ সালে এপ্রিল মাসে একই কথা শুনিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা-ছত্তিশগড় জুড়ে এই রেড করিডোর তো আসলে মিনারেল করিডোর। ঝাড়খণ্ডে অপারেশন গ্রিনহান্ট তো আর কিছুই নয় এই খনিজ সম্পদকে কবজায় আনা। স্ট্যানের ভাষায়, এর মানে হল মানুষ শিকার। তাদের খেদিয়ে তাদেরই সবুজ জমি আর জঙ্গল খনি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া। এর জন্য এক নয়া দর্শনের জন্ম দেওয়া হল: মধ্যভারত জুড়ে নকশালদের জন্যই উন্নয়ন হচ্ছে না। নকশাল/মাওবাদীদের নি:শেষ করে দিতে পারলে, সরকার সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে। আদিবাসীরাও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো উন্নয়নের অংশীদার হয়ে উঠবে।

মনমোহন সিংহ, পি চিদাম্বরম, মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়ারা যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী, অরুণ জেটলি, অমিত শাহ’রা তো সেই যুদ্ধই আরও নিপুণ কুশলতায় চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরও তো একই বক্তব্য। ৯ মে ২০১৫, ছত্তিশগড়ের বস্তারে ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বললেন, উন্নয়নই নকশালপন্থার উত্তর। মানবাধিকার কর্মী, লেখক গ্ল্যাডসন ডুংডুং-এর কথায়, “ভারতের গৃহযুদ্ধ সিপিআই (মাওবাদী)-দের নিকেশ করে দেবার বিষয় নয়, যার ফলে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শান্তি ও সুশাসন ফিরে আসবে। এটি হল খনিজ সম্পদের জন্য আদিবাসীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সুপরিকল্পিত যুদ্ধ। ঝাড়খণ্ডের সারান্ডা বনাঞ্চল এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।” (মিশন সারান্ডা, আ ওয়ার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স ইন ইন্ডিয়া, গ্ল্যাডসন ডুংডুং, ২০১৫)। ঝাড়খণ্ডের উদাহরণ দিয়ে বলা হলেও ন’টি রাজ্যের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। কিন্তু কারা এই মাওবাদী? ঝাড়খণ্ডের উদাহরণ দিয়ে স্ট্যান জানাচ্ছেন, “ঝাড়খণ্ডে তথাকথিত ‘মাওবাদী’দের অধিকাংশ স্থানীয় আদিবাসী। এটা একটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয়। কয়েকজন প্রধান নেতা বাইরে থেকে আসতে পারেন কিন্তু ক্যাডাররা প্রায় সকলেই আদিবাসী ও মূলবাসী। নীচের তথ্য থেকে তা প্রমাণ করা যায়। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন ২০১৪, এই ছ’মাসে, মাওবাদী সন্দেহে ২৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে ১৮৬ জন (৭৭ শতাংশ) স্থানীয় আদিবাসী। এই সময় তথাকথিত সংঘর্ষে ১০ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে ৭ জন (৭০ শতাংশ) আদিবাসী। … সুতরাং, ‘মাওবাদী বিরোধী অভিযান’-এর নামে আদিবাসীদের উপর নিষ্পেষণ চলে আসছে।” (আদিবাসীজ টু ফাইট/কিল আদিবাসীজ, স্ট্যান স্বামী, প্র‍্যাক্সিস রিভিউ, ২০১৪।)

আদিবাসী অধিকারের ফলক

লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। কর্পোরেট, রাষ্ট্র মরণকামড় দেওয়ার শেষ তোড়জোড় করে ফেলেছে। এই ২০১৭ সালেই ঝাড়খণ্ডে স্বাক্ষরিত হয়েছে তিন লক্ষ কোটি টাকার ২০৯টি মউ। উল্টোদিকে, পাথালগড়ি আন্দোলন ছড়িয়েছে ঝাড়খণ্ড থেকে ছত্তিশগড়।

এই তো গত জুলাই মাসে সামাজিক মাধ্যমে পাথালগড়ি নিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য ঝাড়খণ্ড পুলিশ স্ট্যান ও আরও কুড়িজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দায়ের করেছে। অকুতোভয় স্ট্যান আবারও এই অভিযোগ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লেখেন, “আমি আদিবাসীদের হয়ে গলা খুলেছি। আমি কি জাতিদ্রোহী?

স্ট্যানরাই এমন বলতে পারেন। তাই তাঁদের জন্য এত মিথ্যা মামলা, জেল-হাজতের তোড়জোড়। ২৮ আগস্টের ঘটনাকে ভালো চোখে দেখেনি ঝাড়খণ্ডের নাগরিক সমাজ। স্ট্যানের পাশে দাঁড়াতে তারা কালক্ষেপ করেনি।

পুনঃ ওহো বলতে ভুলেছি। বাগাইচা চার্চ ক্যাম্পাসের যে কোনটিতে ফাদার স্ট্যান স্বামীর বসবাস ও ইংরেজি ‘এল’আকারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সেখানে দেওয়াল জোড়া শুধু উচ্ছেদ বিরোধী নানা আন্দোলনের কোলাজ। আইন-কানুনের পোস্টারে ভরা। ঈশ্বরের বাণী কিংবা চিত্র দেখিনি। আর আঙ্গিনার একপাশে রয়েছে নানা আদিবাসী আন্দোলনের শহিদদের নাম লেখা একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ঠিক উল্টোদিকে তিন-চার ফুট পেডেস্টালের উপর উলগুলানের নায়কের পূর্ণাবয়ব পাথরের মূর্তি। ঠিক ধরেছেন, তিনি বিরসা মুন্ডা।

লেখক একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক ও সামাজিক কর্মী।

Share this
Recent Comments
1
  • রাষ্ট্রের এই যুদ্ধ ঘোষণার বিরুদ্ধে লড়াই-এ সামিল হোন। শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড, এসো মোরা মিলি একসাথ…

Leave a Comment