প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সঙ্ঘী ঘৃণা ছাপিয়ে কেরালায় সহমর্মিতার বান


  • August 22, 2018
  • (0 Comments)
  • 3435 Views

রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তার পাশাপাশি রয়েছে কদর্য সঙ্ঘী প্রচার তবু অদম্য কেরালা। প্রতিবেশী তো বটেই দেশ-বিদেশের মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এই ছোট্ট রাজ্যটির দিকে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ত্রাণ শিবিরে তবু ‘নয়া কেরালা’ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। একটি রাজ্য কতদূর সক্ষম হয়ে উঠতে পারলে, সে রাজ্যের মানুষ কতটা স্বক্ষমতা অর্জন করতে পারলে গলা জলে ডুবেও স্বপ্ন দেখা যায়, তার উদাহরণ হয়ে থাকবে কেরালা। লিখছেন দেবাশিস আইচ

অসহায় বিপর্যস্ত মানুষের বিরুদ্ধে এমন তীব্র ঘৃণ্য প্রচার এ দেশ কখনও দেখেনি। পৃথিবীর ইতিহাসেও এমন কোনও নিদর্শন রয়েছে বলে জানা নাই। বন্যা বিধ্বস্ত কেরালার মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যম জুড়ে সঙ্ঘ পরিবারের এই ধর্মান্ধ ও কদর্য প্রচার আবারও প্রমাণ করল হিন্দুত্ববাদীরা কতটা নীচ হতে পারে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বহু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে ভারত। অসম (১৯৫০), লাতুর (১৯৯৩), ভুজের (২০০১) ভূমিকম্প; অসম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড, জম্মু-কাশ্মীর, চেন্নাই, তামিলনাড়ুতে বিগত চার দশকে একের পর এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এ রাজ্যে আয়লা কিংবা ওড়িশার (১৯৯৯) উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণি ঝড়ের স্মৃতি আজও মুছে যায়নি। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় সংগঠনের সদস্য-সমর্থকরা বিপর্যস্ত রাজ্যের মানুষের বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা উপচে দেয়নি। এর পিছনে সার সত্যটা বোধহয় উঠে এসেছে সামাজিক মাধ্যমের একটি পোস্টে। যার মূল কথা হল, ‘বিজেপি’ই এদেশে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।’ যে বিপর্যয় অবশ্যই সম্পূর্ণ ভাবেই মনুষ্যসৃষ্ট। এ শুধু রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক নয়, দেশ জুড়ে মানবিকতা-নীতি-আদর্শের এমন চরম স্খলন আগে কখনও দেখা যায়নি।

সূত্রঃ ইন্টারনেট

একথা যখন লিখছি, আশার আলোও দেখছি তার পাশাপাশি। দেখতে পাচ্ছি ক্রমে হার মেনে নিচ্ছে বিচিত্র সব সঙ্ঘী বাহিনী। এই দু’দিন আগে যারা নানা কুৎসা ছড়িয়ে কেরালায় ত্রাণ পাঠানোর বিরুদ্ধতা করছিল, তারা কেন হঠাৎ ভুয়ো ছবি ছড়িয়ে প্রচার করতে যাবে — স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উদ্ধার কাজে নেমেছেন। কেন সঙ্ঘীপন্থী ‘সেবাভারতী’ প্রমাণ করার চেষ্টা করবে তারাই সবচেয়ে বেশি দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছেছে। কারণ তারা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান ভুলে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের নাগরিক ও সরকার যত সময় এগিয়েছে, মানুষের মতোই মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়িয়েছে। সঙ্ঘীরা যতই প্রশ্ন করুক, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’ বা হিন্দু না ওরা খ্রিস্টান’? কে দাঁড়ায়নি পাশে? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা যখন ঘোষণা করছেন তাঁরা প্রত্যেকে ২৫ হাজার টাকা দেবেন ত্রাণ তহবিলে তখন কেরালার জেলবন্দিরা রোজ হাজার হাজার রুটি আর গামল-গামলা সবজি বানিয়ে চলেছেন উদ্ধারকারী দলের খিদে মেটাতে। দেশের মানুষ, দেশের সেনা ও নৌবাহিনী, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, কেরালার অজস্র নানা পেশার সাধারণ মানুষ, মাঝি-মাল্লা-মৎস্যজীবী মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে যেন নি:শব্দে বলে চলেছে — ‘ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’। উদ্ধার কাজ এখনও চলেছে। ত্রাণের কাজও। ১২ লক্ষ মানুষ ত্রাণ শিবিরে। মৃতের সংখ্যা রোজই বাড়ছে। ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। যা আরও বৃদ্ধি পাবে।

ঠিক কী কী জাতীয় সঙ্ঘী প্রতিক্রিয়া প্রাথমিক পর্বে দেখা গিয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই পাঠক জানেন। শুধুমাত্র, তথ্যের খাতিরে তা ফের বলা। আরএসএস-এর গোয়াল জাত আরবিআই-এর ডিরেক্টর গুরুমূর্তি ট্যুইট করে বলে বসলেন, আয়াপ্পা মন্দিরে ঋতুমতী নারীদের প্রবেশের অধিকার দেওয়ায় দেবতা ক্রুদ্ধ। সরাসরি বললেন না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ‘দেবতার অভিশাপ’ এ কথা যদি দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কের কর্তা বলতে পারেন, জানি না হয়তো তিনি কাল বলে বসবেন, ব্যাঙ্ক লুঠেরা মোদী-মহুল’রা ‘মা লক্ষীর বরপুত্র’। কারও আবার দাবি, মন্দিরে দলিত পুরোহিত নিয়োগ করাই কাল হয়েছে।

বিষ তো নানা প্রকার হয়, তাই আমরা দেখতে পাব আরও একদল সামাজিক মাধ্যম ভরিয়ে ফেলেছে স্রেফ এ কথা বলে যে, ‘গরু খাওয়ার জন্য ভগবান শাস্তি দিয়েছে।’ নানা ভাবেই নানা জন এই গরু-বিষ ছড়িয়ে গিয়েছে। নানা বয়ানে। (Rakhi Bose, News 18.com, August 19, 2018). একদল সারমেয়প্রেমী আবার এই বন্যায় প্রতিহিংসাও খুঁজে পেয়েছে। এই কিছু কাল আগে সরকারি নির্দেশে কেরালায় শয়ে শয়ে পথ কুকুর হত্যা করা হয়েছে , তাই কেরালাবাসীদের এভাবে বিপর্যস্ত হওয়ায় তারা বেশ খুশি। গণহারে পথ-কুকুর হত্যা নিন্দা যোগ্য। কিন্তু, যে সারমেয়প্রেমীরা এই বিপর্যয়ে উল্লসিত হয়, তারা আর যাই হোক, জন্তুর মন ও মগজেরও যোগ্য নয়।

সেবাভারতীর কথা বলছিলাম। একটি পোস্টে দেখা যাচ্ছে, বিদেশে বসবাসরত ভারতীয় ও অমালয়ালিদের কাছে অনুরোধ করা হচ্ছে, কেরালার মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে যেন টাকা না পাঠানো হয়। কেননা যারা বন্যার্ত তারা বিত্তশালী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। সেই সেবাভারতী আবার ত্রাণ সামগ্রী, অর্থ যেন তাদের কাছে পাঠানো হয় তার জন্য আবেদন জানাচ্ছে। একজন ফেসবুক পোস্টদাতা বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়ার জনৈক কো-অর্ডিনেটর সুরেশ কোচ্চাত্তিল। অন্যজন, আমেরিকা প্রবাসী সঙ্ঘী রাজীব মালহোত্রা। মালহোত্রা তো সরাসরি বলেইছেন, হিন্দুদের সাহায্য করার জন্য সেবাভারতীতে দান করতে। ঘুঘু বার বার ধান খেয়ে যাবে এমন তো হতে পারে না। অতএব, শুধু নিন্দার ঝড় বইল না, পাশাপাশি ২০০৪ সালে টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট তুলে ধরেছেন এক পালটা মন্তব্যকারী। যেখানে দাবি করা হয়েছে, সেবাভারতী বা আরএসএস শাখাগুলি ব্রিটেনবাসীদের কাছ থেকে, ওড়িশার সাইক্লোন (১৯৯৯) কিংবা গুজরাট ভূমিকম্পে (২০০১) আক্রান্তদের সেবার নাম করে যে টাকা তুলেছে, তা আসলে আত্মসেবায় ব্যয় হয়েছে।

একদিকে রাজ্যের ইতিহাসে ভয়ালতম প্রাকৃতিক বিপর্যয় অন্যদিকে এই সংকীর্ণমনা, অসহিষ্ণুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কেরালাবাসী। জেলে নৌকা ও ক্যাটামেরন নিয়ে মৎস্যজীবীদের উদ্ধারকাজের কাহিনি যেন রূপকথা। নৌকাতে উঠতে সুবিধা হবে বলে এক হাঁটু জলে যিনি পিঠ পেতে দিলেন, শরীর হয়ে উঠল সিঁড়ি, সে ছবি আরও বহু বহুকাল মানসিক, শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত মানুষকেও শুশ্রূষা দেবে। যা মনোবিদ বা ট্রমা সেন্টারের চিকিৎসকদের কাছে আরোগ্যদানের উপকরণ বা হিলিং টুল হয়ে উঠতে পারে। সেই মৎসজীবী মালয়ালি যুবকের নাম জয়সাল কে পি। তেমনই হয়তো লোককাহিনিতে স্থান করে নেবে এক বিমান চালকের অসীম সাহস ও দক্ষতার কাহিনি। নারকেল গাছের ঘনবদ্ধ সারির ফাঁক দিয়ে যিনি হেলিকপ্টার নিয়ে নেমে পড়েছিলেন বাড়ির ছাদে। শুধু তো মানুষ নয়, কত গৃহপালিত ও বন্যপ্রাণী যে এই বিপর্যয়ে প্রাণ হারিয়েছে তার হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। তবু, মানুষ নিজের বিপদ ভুলে, বাঁধের গেট বন্ধ করে বিপন্ন একাকী দাঁতালকে নিরাপদ স্থানে ফিরিয়ে দিয়েছে। ভেসে আসা চিতল শিশুকে দিয়েছে নিরাপত্তা। চরম বিপদ হবে জেনেও ডজন দুয়েক পথের কুকুরকে ছেড়ে উদ্ধার হতে চাননি পালিতা মানুষ-মাতা। এই রাজ্যের মানুষ শুধু তাঁদের কথা ভাবেননি। ভেবেছেন ভিন রাজ্য থেকে আসা লক্ষ লক্ষ ‘অতিথি শ্রমিক’দের কথাও। কীভাবে তাদের স্ব স্ব রাজ্যে নিরাপদে ফেরানো যায়। নানা স্তরে লাগাতার চেষ্টা চালিয়েছেন সে রাজ্যের মন্ত্রী, আধিকারিক ও শ্রমিক নেতারা। কেরালার বন্যা তাই শুধু মাত্র ধর্মান্ধতা, মৃত্যু ও ধ্বংসের কাহিনি নয়। মনুষ্যত্বের কাহিনিও।

কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটির ন্যক্কারজনক বিরোধীতার পরও কেরলবাসী সারা দেশ এবং বহির্বিশ্বকে কাছে পেয়েছে। এক প্রাক্তন প্রশাসকের মতে এর কারণ কেরালার, কেরালাবাসীর ‘সক্ষমতা ও স্বক্ষমতা’। এই ছোট্ট রাজ্যটি নানা গুণমানেই একটি সক্ষম ও শিক্ষিত রাজ্য। মালয়ালিরা স্বক্ষম জাতি। না হলে গলা জলে ডুবেও কেউ ‘নয়া কেরালা’ গড়ার কথা বলতে পারে? কেরালা পারে। সারা বিশ্বে বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছেন অজস্র প্রবাসী মালয়ালি। সাধারণ শ্রমিক, উচ্চপদস্থ কর্মচারী থেকে কোটি, কোটিপতি ব্যবসায়ী সর্বস্তরেই। এই বিপর্যয়ে তারা দু’হাত ভরে সাহায্য করে চলেছেন। ভবিষ্যতেও পাঠাবেন। সে অর্থ সাহায্যেই ‘নয়া কেরালা’ গড়ে উঠবে এমনই আশা মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের। তবে, এ দেশের যে কোনও রাজ্যের মতোই একটি শিক্ষায় তার বড়সড় ফাঁকি পড়ে গিয়েছে। সে পরিবেশ শিক্ষা। এ বিপর্যয় কেরালা অতি দ্রুত সামলে উঠবে। আশা করা যায়, কেরালা সহ আমরা সকল রাজ্যের মানুষ এ বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেব। বিশেষ ভাবে পরিবেশ পাঠের শিক্ষা।

সূত্রঃ ফেসবুক

লেখক একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক ও সামাজিক কর্মী।

Share this
Leave a Comment