ধর্ম-লিঙ্গ ভুলে পড়শির জন্য দরজা খোলার ডাক : শহরে পথসভা


  • July 4, 2018
  • (0 Comments)
  • 7698 Views

গ্রাউন্ডজিরো, কলকাতা: গ্রাম, মফস্বল থেকে আসা একের পর এক বক্তা বলছিলেন, “ভেবেছিলাম কলকাতা অনেক উদার।” পর মুহূর্তে  তাঁদের ভুল ভাঙার কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। তখন যাদবপুর এইট-বি’র মোড়ে উপস্থিত শ্রোতাদের ক’জন বার বার লজ্জায় অধোবদন হচ্ছিলেন, সে সমীক্ষা করা হয়নি। তবে, ‘সংহতি অভিযান’ আয়োজিত, সোমবার ২ জুলাইয়ে এই পথসভা জানিয়ে দিল নগর কলকাতায় মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা ভাড়াটে হিসাবে স্বাগত নয়।

হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক নিয়ে যাঁরা ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন, এ কোনও নতুন খবর নয়। এ বিষয়ে ফিসফাস  আলোচনা চলেই কিংবা কদাচিৎ ছোট্ট খবর হয়। কিছু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ছাড়া, এই পরিবেশটিকে বদলে ফেলার জন্য সমস্যাটিকে মুখোমুখি সম্বোধন করা জরুরি, সে কথা তেমন করে কেউ ভাবেননি। সদ্য গড়ে ওঠা সংগঠন ‘সংহতি অভিযান’ এই প্রশ্নটিকেই গণপরিসরে তুলে আনার, আলাপ-আলোচনার পরিবেশ তৈরির এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিল। পথসভায় তাই অধিকাংশ বক্তাই ছিলেন বৈষম্যের শিকার ভুক্তভোগীরা।

সোমবার ‘ওপেন আ ডোর, ধর্ম পরিচয়ে নয়, মানুষ হিসেবে মানুষকে বাড়ি ভাড়া দিন’ শীর্ষক সভায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিউর রহমান যখন বলেন, দরজা খোলার আগে মনটাকে খোলা রাখতে হবে, এখানেই সভার সুরটি বাঁধা হয়ে যায়। মেদিনীপুরের মফস্বল শহর থেকে পড়তে আসা শফিউর বলছিলেন, পড়তে আসার আগে এ শহর সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল, ‘কলকাতা অনেক উদার।’ হস্টেলে থাকতে গিয়ে কিংবা বাড়ি ভাড়া চাইতে গিয়ে ভারতের এই ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ বলে কথিত শহর সম্পর্কে ভুল ভাঙে। শুনতে হয় “আমরা মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দিই না।” হিন্দু মা মুসলমান পিতার সন্তান অনিন্দ্য রায় আহমেদের অভিজ্ঞতাও এক। তাঁর আক্ষেপ, কলকাতার মতো এক আধুনিক শহর কীভাবে বলে “মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দেব না”! একটি ক্ষেত্রে অনিন্দ্যর সঙ্গে বাড়িওয়ালার প্রায় পাকা কথা হয়ে যায়। বাড়িওয়ালার শর্ত ছিল ঘরে বিফ আনা যাবে না, কোনও ধর্মীয় আচরণ করা যাবে না জাতীয় নানা কিছু। একদিন বাদেই অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানিয়ে দেন, মূল গৃহকর্তার মুসলমানদের পছন্দ নয়। তাই ঘর ভাড়া দেওয়া যাবে না।

ঘর না দেওয়ার পিছনে প্রধান কারণ ‘তুমি মুসলমান’। আর মুসলমান মানেই গরু খাবে, নোংরা, কিংবা ‘বোমা ফাটাতে পারে’ অর্থাৎ, আতঙ্কবাদী।  সেই ছকে ফেলা ভাবনাগুলোই কাজ করে। পেয়িং গেস্ট রাখেন সায়ন্তনী খাঁ। তাঁদের গেস্ট হাউসে অবশ্য ধর্মীয় বা অন্যান্য কোনো জাতীয় বৈষম্য নেই। তবে, কোনো কোনো ভাড়াটেও মুসলিম গেস্ট রাখা হয় কি না, আমিষ-নিরামিষ ছোঁয়াছুঁয়ি মান্য করা হয় কি না, এমন খোঁজ নিতে পিছপা হন না। এসব আবদারে অবশ্য পাত্তা দেওয়া হয় না বলেই জানিয়ে দেন সায়ন্তনী। এই ছেলে-মেয়েদের ভাষা-পোশাক বা চেহারা দেখে না, নাম শুনে বাড়িওয়ালারা বুঝতে পারেন ভাড়া চাইতে আসা ব্যক্তিটি হিন্দু না মুসলমান। এর পর কেউ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসাও করে বসেন, “ও তুমি মুসলমান, তোমাকে দেখে তো বোঝা যায় না?” তার পরই নাকচ করার পালা। এখানেও সেই মুসলিম চিহ্নিতকরণের ছকে ফেলা দাড়ি-টুপি-হিজাবের ছবি। এমন ঘটনা ঘটেছে মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত সালার থেকে আসা ছাত্রী তনভি সুলতানার ক্ষেত্রে। সংহতির ফেসবুক পেজে তনভি লিখেছিলেন, “যাই হোক খুব খারাপ লাগলো। ধর্মের কাছে মনুষ্যত্বকে হারতে দেখে। সত্যিই কি মুসলিম হওয়াটা দোষের ছিল?”

ফেসবুক পোস্ট, স্থানীয় ‘ব্রোকার’-এর চেষ্টায় ফিরিয়ে দেওয়া এক বাড়ির প্রবীণ কর্তা অবশেষে তনভিকে ঠাঁই দিয়েছেন। দুঃখ প্রকাশ করছেন তিনি। সভায় তনভির আবেদন, “পড়াশোনার জন্য এসেছি। সেটাই প্রায়োরিটি হোক। ধর্ম বা লিঙ্গ যেন প্রায়োরিটি না হয়।” শাফিউর যেমন জানিয়েছেন, তাঁর এক সময়ের বাড়িওয়ালা ডাক্তারবাবু আজও দেখা হলে বলেন, “তোমার মতো ভাড়াটে আর পেলাম না।” তিনি আশাবাদী। ‘বাংলা সাংস্কৃতিক মঞ্চ’র তন্ময় ঘোষের কাছে এ হল এক সামাজিক রোগ। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ সচেতনতাও উন্নয়নের লক্ষ্য। তন্ময়ও মনে করেন, “সমাজ এখনো অতটা খারাপ হয়নি।” তিনি হতাশ নন। এ সবই রূপালি আলোর রেখা।

ফেসবুকে ‘ওপেন আ ডোর’ ক্যাম্পেন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে বাড়িওয়ালা, মেস কিংবা পেয়িং গেস্টের মালিকদের। দমদম থেকে বেহালা তার বিস্তার শহর জোড়া। সংগঠনের ঘোষিত লক্ষ্য, সঙ্ঘ পরিবারের ঘৃণার রাজনীতির বিপরীতে এক জবরদস্ত সামাজিক প্রতিরোধ ও নতুন সমাজের নির্মাণের বাহিনী গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যে নিজের ঘরটিকেও ধুয়ে-পুঁছে পরিচ্ছন্ন করে তোলা যে জরুরি, সংগঠনের তরুণ নেতৃত্ব কস্তুরী, সামরুল, দ্বৈপায়ন, দেবর্ষি, জাহাঙ্গীররা যে সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল, পড়শির জন্য দরজা খোলার ডাক দিয়ে পথে নামার মধ্যে তা প্রমাণিত।

Share this
Leave a Comment