উনিশে মে উদযাপন আসলে দেশকালব্যাপী যে ধর্ম ও ভাষা সংকট, তার সমাধানের লক্ষ্যে এগোনো। অমীমাংসিত, অবাঞ্ছিত কিছু প্রশ্নের উত্থাপন। রাষ্ট্রশক্তি আর তার বাহন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়। লিখেছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র।
আবার সেই যুদ্ধজিগির উঠেছে আসাম জুড়ে। “আহ আহ ঐ উলাই আহ। বিদেশি বঙালি খেদাব লাগে, খেদাব লাগে। হিন্দু বাংলাদেশি না খেদাল জুই জ্বলিব, জুই জ্বলিব।“ মায়ের ভাষা না বাপের ধর্ম কোনটার গুরুত্ব বেশি? দুটোরই সমান গুরুত্ব বলতে পারলে ঝামেলা থাকত না। কিন্তু তা তো নয়। বুড়ো যখের মতো এ ওর কাঁধে চাপছে, অথবা ও এর কাঁধে।
আমার মাতৃভাষা বাংলা এবং আমার পিতামহ-ধর্ম হিন্দু। এ দুটোই জন্মসূত্রে প্রাপ্ত, কর্মসূত্রে নয়। যেহেতু আসামে বেড়ে ওঠা, তাই এই দুই পরিচয়ের কখন কোনটা সারফেসে উঠে আসে, তা বাইরের কারও পক্ষে বোঝাটা একটু সমস্যার। দ্বিঘাত, ত্রিঘাত সমীকরণের অঙ্ক। হিন্দু বাঙালি, মুসলিম বাঙালি, হিন্দু অসমিয়া, মুসলিম অসমিয়া সম্পর্কের ওঠানামা রাজনীতির জটিলতম অধ্যায়। দশকে দশকে সমীকরণ বদলে বদলে যায়। ১৯ মে সংক্রান্ত কোনও আলোচনাই এই সমীকরণকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব নয়।
১৯ মে‘র সংক্ষিপ্ত পশ্চাদপট
একটি অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘকাল ধরে একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের মাটির সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা, সেই মানুষদের আকাঙ্খা, আর স্বকীয় পরিচিতির তোয়াক্কা না করে, ১৮৭৪ সালে বাংলার থেকে শ্রীহট্টকে ও গোয়ালপাড়া জেলাকে উত্তরবঙ্গ থেকে কেটে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। কেননা রেভিনিউ স্টেট হিসেবে আসাম স্বনির্ভরতা পাবে। অর্থাৎ কাল পর্যন্ত যারা বাংলার অধিবাসী ছিল নেহাত-ই প্রশাসনিক কারণে তারা হয়ে গেল আসামের বাসিন্দা। গোয়ালপাড়া ও শ্রীহট্ট জেলার অধিবাসী বলতে প্রায় সবাই তখন বাংলা ভাষাভাষী। আপার আসামের মটক ও মরান নামে দুটো ক্ষুদ্র রাজ্যও ইংরেজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে শ্রীহট্ট কাছাড় আর গোয়ালপাড়া সহ গোটা ব্রহ্মপুত্র এলাকাই বৃটিশ সাম্রাজ্যের আওতাভুক্ত হয়ে যায়। ১৮৩৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া রাজ্যও ইংরেজের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ১৮৫৪ সালের কোনও এক সময়ে লর্ড ডালহৌসি স্বাধীন নাগারাজ্যকেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তগুলি ওপর থেকে চাপানো। সামাজিক বিরোধের বীজ উত্তপ্ত হল এখানেই। বাঙালিরা কোনওদিন অসমিয়া ভাষাকে নিজের ভাষা হিসাবে মেনে নিতে পারল না, অসমিয়াভাষীরাও কোনওদিন বাঙালিকে ভ্রাতৃপ্রতিম বলে মন থেকে স্বীকার করতে পারেনি। বহুভাষিক জনসংখ্যার চাপে নিজেদের বিপদাপন্ন বোধ করল অসমিয়া জনগোষ্ঠী।
বৃটিশ সাম্রাজ্যের কুক্ষি থেকে অধীনতামুক্তির সময়ে সমস্যা দেখা দেয় শ্রীহট্ট জেলাকে নিয়ে। ১৯৪৬ সালের বৃটিশ ক্যাবিনেটের এক প্রতিনিধি দল ভারতে আসে। এবং ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা, অনেক ঘটনার ঘনঘটার পর দেশভাগের সিদ্ধান্ত হয়। মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শ্রীহট্টকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে কোনও দাবি তোলেননি। কিন্তু সিলেটের মুসলিম লিগের নেতারা শ্রীহট্টকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির দাবি তোলে। কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের এ নিয়ে কোনও মাথা ব্যাথা ছিল না।
আসামের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী চায়নি সিলেট আসামে থাক। ১৯৩৩ সালের ১৬ এপ্রিল আসাম অ্যাসোসিয়েশন-এর এক বিশেষ রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, কুলধর চালিহার সভাপতিত্বে। সম্মেলনে শ্রীহট্টকে আসাম থেকে পৃথক করার দাবি করা হয়।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাইয়ের গণভোটে শ্রীহট্ট ভাগ হয়ে যায়। গণভোটের আগেই যে বিরাট মিছিল বের হয় সে মিছিলে স্লোগান ছিল, ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই, সোনার সিলেট ভাঙব না।’ স্থানীয় নয় বলে চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার ছিল না। তা না হলে ভারতবর্ষের অন্য ইতিহাস লেখা হত, মানচিত্রও। দেশভাগের পর সীমান্ত নির্ধারণের জন্য যে রেডক্লিফ রোয়েদাদ নামের কমিশন বসে তাতেও কংগ্রেস কিছু দায়সারা মামুলি বক্তব্য রেখেছিল মাত্র।
করিমগঞ্জ মহকুমা শহরের তিন থানা, বেশ কিছু চা-বাগান, বর্তমান বরাক উপত্যকা ভারতে থেকে যায়।
কিন্তু উল্লাসে ফেটে পড়েছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারা। দেশভাগ ও সীমানা নির্ধারণের প্রাক মুহূর্তে আসাম জাতীয় মহাসভার প্রায় মুখপত্র, তখনকার একমাত্র ইংরেজি দৈনিক ‘আসাম ট্রিবিউন’ লিখল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিলেট পাকিস্তান চলে যাক।” সেই সঙ্গে মন্তব্য ছিল, “দ্য অ্যাসামিজ পাবলিক সিম টু ফিল রিলিভড অব আ বার্ডেন।” এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু চাপ। নির্মিত হতে থাকে আজকের আসামের অস্থিরতার প্রেক্ষাপট। প্রাক স্বাধীনতাপর্বে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর ঘোষণা, “আসাম শুধুমাত্র অসমিয়াদেরই।”
![](http://www.groundxero.in/wp-content/uploads/2018/05/CFVSqi3UgAAQY_h.jpg)
ভাষা শহিদ
আসামের সকল সাইন বোর্ডেই অসমিয়া ভাষায় লেখা বাধ্যতামূলক – এই দাবির ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালেই শুরু হয় আসামের জাতিদাঙ্গা। ১৯৫০ সালে দাবি ওঠে, দেশভাগের পর আসামে আগে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আসাম থেকে তাড়াতে হবে। ১৯৫৫ সালে গোয়ালপাড়া জেলা, যা ১৮৭৪ সালে বৃটিশ উত্তরবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, তা আসামে রাখার দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা। ভাষা দাঙ্গার নৃশংসতা চরমে পৌঁছায় প্রায় গোটা রাজ্য জুড়ে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে আশ্রয় নেয় পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে। আরও প্রায় ৯০,০০০ আশ্রয় নেন বরাক উপত্যকায় ও সন্নিহিত এলাকায়। ১৯৬০ সালে ঘোষণা করা হল আসামের রাজ্যিক ভাষা হবে অসমিয়া এবং ক্ষোভে ফেটে পড়ে সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালি অঞ্চল। বরাক উপত্যকায় তারই প্রতিবাদে গড়ে ওঠে ১৯-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। ১৯ মে, ১৯৬১, শিলচরে গুলি এবং এগারো জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে অধ্যায়ের আপাত সমাপ্তি।
হিন্দু বাঙালি ও মুসলিম বাঙালি
সে সময়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে চাষযোগ্য ভূমি ও বনভূমি ছিল। যখন ব্রিটিশরা ১৮২৬ সালে অঞ্চলটির দখল নেয় তখন পূর্ববাংলা থকে জমির আকাঙখায় বহু কৃষক আসামে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের উৎসাহ দেয় স্থানীয় জমিদার ও মৌজাদারেরা। উপত্যকায় আবাদ করে তারা। সমৃদ্ধ করে তোলে আসামের অর্থনীতি।
প্রাথমিকভাবে, এই অভিবাসনকে অসমিয়া জনসাধারণ ইতিবাচক হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়। তবে, ১৯২০ সাল থেকেই অসমিয়া জনগণের একাংশ সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে যে, অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন জনবিন্যাসকে পরিবর্তন করতে পারে। প্রদেশের গঠন, তাদের স্বদেশে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া জাতিগত ভাবে অসমিয়া জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এর পর থেকে আসামের প্রধান সমস্যার দুটি অভিমুখ:
(১) মুসলিম অভিবাসনের ক্রমবর্ধমান প্রবাহ থেকে আসামকে রক্ষা করা
(২) সিলেটের আলাদা বাংলা ভাষাভাষী জেলা এবং আসামের প্রশাসনকে বাঙালিমুক্ত করার জন্য বাঙালি হিন্দু কর্মীদের বরাক উপত্যকায় লড়িয়ে দেওয়া। জওহরলাল নেহেরু যখন ১৯৩৭ সালের নভেম্বরে আসামে আসেন, তখন তাঁর কাছে দুটি সংগঠন স্মারকলিপি জমা দেয়, এক অসমিয়া সংরক্ষণী সভা, অন্যটি অসমিয়া ডেকা দল।
প্রথম স্মারকলিপি তে বলা হয়, ‘অসমিয়া জাতিকে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার একটি পদক্ষেপ হিসেবে, অসমীয়া বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, ভারত থেকেও আসামের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছে।’
দ্বিতীয় স্মারকলিপিটিতে অসমিয়া জাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য একটি বিস্তারিত রূপরেখা আঁকা হয়। প্রস্তাব আকারে তা হল (১) সিলেটকে বাংলার অর্ন্তভুক্ত করা (২) অন্তত কুড়ি বছরের জন্য ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালিদের অভিবাসনের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা (৩) আসাম প্রদেশের বাসিন্দা বাঙ্গালি অভিবাসীদের জন্য কঠোর ন্যায্যকরণ আইন।
১৯৪৮ সালের ৪ মে আসাম মন্ত্রিসভার উদ্যাগে নীচের নিম্নলিখিত সরকারি বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়:
‘পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চল থেকে প্রদেশে শরণার্থীদের প্রবাহের ফলে সৃষ্ট অবস্থা এবং শহরে ও গ্রামগুলিতে শান্তি, শৃঙখলা ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করার লক্ষ্যে সরকার তার নীতি পুনর্ব্যক্ত করছে যে, অ-আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে কোনও পরিস্থিতিতেই জমি হস্তান্তর বা কোনও সেটেলমেন্ট করা যাবে না। বর্তমান আপৎকালীন অবস্থায় যারা এই প্রদেশের আদিবাসী নয় সেইসব ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হবে, যারা অ-আদিবাসী বাসিন্দা কিন্তু এই প্রদেশেই ইতিমধ্যে নিজেদের জমি ও ঘর তৈরি করেছে এবং আসামকে নিজস্ব ভূমি হিসাবে বিবেচনা করছে।’ (রাজস্ব বিভাগ সংখ্যা ১৯৫/৪৭/১৮৮ তারিখ ৪.৫.৪৮)।
লব্ধ জমি, জীবিকা, এবং নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে দলে দলে বাঙালি নিজেদের অসমিয়া হিসাবে পরিচয় দিতে শুরু করে। ’৫১ সালের আগুপিছুতে চর এলাকার ময়মনসিংহ থেকে আসা মুসলিমরা নিজেদের অসমিয়াভাষী হিসাবে ঘোষণা করে সেন্সাসে। ১৯৩১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যায় অসমিয়া ভাষাভাষীদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৩১.৪% ছিল। কিন্তু ১৯৫১ সালের প্রথম স্বাধীনতা-উত্তর আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে যে, অসমিয়া ভাষাভাষী মানুষদের সংখ্যা ১৯,৭৩,২৫০ থেকে বেড়ে ৪,৯১,৩২,৯২৯ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বিশ বছরে প্রায় ১৫০% বৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে। এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে কারণ ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী অভিবাসী বাঙালি মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা হিসাবে নিজেদের অসমিয়াভাষী হিসাবে ঘোষণা করেছিল।
অসমিয়া ভাষা সংখ্যাগুরুর ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় আসামে।
১৯৬১ সালে বরাক উপত্যকার মুসলমানদের একটা অংশ ছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হিন্দু অসমিয়াদের সঙ্গে। যার ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল ১৯ জুনের হাইলাকান্দি ফায়ারিং এবং ১১ জনের মৃত্যু।
একুশ ও উনিশ : কে কোথায় দাঁড়িয়ে।
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি দুই-ই ভাষাযুদ্ধ। ভাষাসেনানীদের রক্ত সাক্ষর। হিংস্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে আত্মবলিদানের কথকতা। যতই আমরা হারমোনিয়াম আর ডুগি তবলা সহযোগে তাকে সুরেলা করার চেষ্টা করি না কেন, ইতিহাসের রক্তগন্ধ কি ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব ? বাস্তব? নানা রকমের বাহারি সব পাঞ্জাবি আর কোটা তাঁতসিল্ক শাড়িতে ক্ষণে ক্ষণে বডি স্প্রে ছড়িয়েও কি চাপা দেওয়া সম্ভব চারপাশের রক্তমাখা স্মৃতি?
আমাদের মত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির কাছে ‘একুশে’, ‘উনিশে’ সব একাকার। সবই পাপক্ষালন আর সবই বিনোদন। বরাক উপত্যকার বাইরে ‘১৯ মে’ প্রায় অচ্ছুত কেননা এ প্রসঙ্গে যে কোনও আলোচনাই উদ্যোক্তাদের, সংশ্লিষ্টদের কিছু অবাঞ্ছিত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সমস্যাটা ভাষার নয়, সমস্যাটা সেই ভাষায় কথা বলা মানুষের। ক্ষমতার সংস্কৃতিতে মানুষ আসলে প্রভুত্বকামী। অন্যকে নীচে রাখার, অবজ্ঞা করার, অবহেলা করার, শাসন করার, ভৃত্যে পর্যবসিত করার প্রবৃত্তি তার মজ্জাগত। নিজেকে একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু করার, কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার প্রবণতা তার। সবাইকে ছাপিয়ে, সবাইকে দাবিয়ে, নিজে নিজে একা উন্নত হতে চায় সে। একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে ওঠা। উনিশে মে নিয়ে যে কোনও আলোচনা, অনেকগুলি প্যাণ্ডোরার বাক্স খুলে দিতে পারে। তাই তাকে ‘বরাক-পাড়ে’ই দাফন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যত্নসহকারে।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ছিল উর্দু ভাষার সম্প্রসারণ বাদের বিরুদ্ধে। পাঁচজন শহিদ হয়েছিলেন। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল অসমিয়া ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। শহিদ হয়েছিলেন এগারো জন। তার মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষা শহিদ। এখানে শেষ নয়। হিন্দি ভাষার সম্প্রসারণবাদ আজ শুরু হয়নি। আসাম তো বটেই, বড়ো, ডিমাসা, চুতিয়া এমন কি মণিপুর, মেঘালয়ে শহুরে উপজাতিরা নিজ নিজ ভাষার থেকেও ভাঙা হিন্দিতে বেশি স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছেন। আমাদের আধুনিক প্রজন্ম যখন ফরফর করে ইংরেজি শব্দ আর সিনটাক্সে ভরপুর বাংলিশ বলে, বিরক্ত হই। সত্যি কথা বলতে কী, বহুভাষিক চরিত্রের সাম্য অবস্থান রীতিমতো অভ্যাস করতে হয়, যা আমাদের দেশে অন্তত এখনও শুরু হয়নি। তারপর নতুন নতুন শব্দ ও বাগবিধিতে ভাষা তার রূপ পরিবর্তন করে। তখন বলা হয় সিলেটের ভাষা আসলে বাংলা নয়, নাগরি। বরাকের বাংলা সিলেটি নয়, বরাকি। অদূর ভবিষ্যতে এমনটা বলা হতেই পারে, যে বাংলা আসলে বাংলা নয়, হিন্দি/সংস্কৃতের উপভাষা।
১৯ মে’র আলোয় ধর্ম ও ভাষাযুদ্ধের সাম্প্রতিক ধারাবাহিকতা
১৯৮১ সালে জনসংখ্যা গণনা হয়নি। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে অসমিয়াভাষীর সংখ্যা শতাংশ হিসেবে কমতে শুরু করে। এই সময় থেকেই অলক্ষ্যে হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানপর্বের সূচনা। এবারে উলটপুরাণের শুরু। আসু’র বঙালখেদা সূক্ষ্ণভাবে রূপান্তরিত হতে থাকে মুসলিম খেদা অভিযানে। কেন? উত্তর লুকিয়ে আছে মাত্রই কিছুদিন আগে প্রকাশিত ধর্মভিত্তিক সেন্সাস রিপোর্টে। দেখা গেল আসামের মুসলমান হচ্ছে জনসংখ্যার ৩৪.২% যেখানে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ২৭%। হাইলাকান্দি, বরপেটা, নগাঁও, ধুবরি, বঙ্গাইগাঁও, গোয়ালপাড়া, করিমগঞ্জ, দরং, মোরিগাঁও জেলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য। অতএব মূল কোপটা নেমে আসছে আসামের মুসলিমদের ওপর। অবশ্য বাঙ্গালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের সমস্যা যে তাতে কিছুমাত্র লাঘব হল তা কিন্তু নয়।
বর্তমানে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। কে এই সর্বানন্দ সোনোয়াল? এক কালের প্রবল পরাক্রমশালী বাঙালি বিদ্বেষী আসু’র সভাপতি, অগপ’র শীর্ষনেতা এবং বঙালখেদা আন্দোলনের তাত্ত্বিক স্থপতি হিসাবে ‘আসামের জাতীয় নায়ক’ হিসাবে খ্যাত। তবু তার দল ভোট পেল বরাক উপত্যকা থেকেও। কেন? আর শুধু তিনি কি একাই দায়ী? বরাক উপত্যকার প্রায় সবকটি প্রধান রাজনৈতিক দলই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে, নেতাদের সঙ্গে জোট বেঁধে, গা ঘষাঘষি করে গেছে। তার পরেও এই উপত্যকায় তাদের সগর্ব উপস্থিতি শিহরণ জাগায়। রহস্যের শিহরণ।
এই রহস্য উদ্ঘাটনেই পরিষ্কার হয়ে যাবে ‘হাইব্রিড’ বাঙ্গালিরা কেন নটবর সেজে ভাষা শহিদ দিবস পালন করতে বেরোয়! কেন ১৯ মে’র মতো একটি রাজনৈতিক ইস্যু, আজ শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক উৎসবে পর্যবসিত? পরিষ্কার হবে যে বাংলা ভাষা নিয়ে যা কিছু উদ্বেগ তা আসলে স্বার্থান্বেষী রাজনীতির। শিলচরের বুকে দাঁড়িয়ে ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় সগর্বে ঘোষণা করেন, উনিশ এখন অতীত। এখন অতীত ভুলে হিন্দু বাঙালি আর হিন্দু অসমিয়ার ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, যাতে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করা যায়।
এই আলোচনায় যাদের অংশ নেওয়া উচিত সেই সব নিম্নবর্গীয় মানুষের অংশগ্রহণ চিরকাল এসব বৌদ্ধিক আলোচনায় উপেক্ষিত থাকে। এঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশপাশি ভাষাতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমাজের প্রতিটি স্তরের বিশেষজ্ঞকে নিয়ে দীর্ঘকালীন মেয়াদে পুঙখানুপুঙখ বিশ্লেষণে এ সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে। শুধু মনে রাখতে হবে, যে কোনও বর্ণ বা আকৃতির দলীয় রাজনীতিকের প্রবেশাধিকার সচেতন ভাবেই নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আমার অভিজ্ঞতায়, যে কোনও সমস্যা-সমাধানের আলোচনায় এঁরাই হচ্ছেন সবচেয়ে অজ্ঞ, অপদার্থ, বদ্ধমনস্ক ও ষড়যন্ত্রকুশলী। আর আপাতত শেষ কথাটা হচ্ছে, ভাষিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রে সেই মূহুর্তে-ই প্রতিরোধ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হয়। তা সে হিন্দি হোক, অসমিয়া হোক বা বাংলা। প্যাণ্ডোরার বাক্স খুলে গেছে।
তবু উনিশে মে উদযাপিত হয়, হবে। এবং ভাষা যুদ্ধ কিন্তু ১৯ মে ১৯৬১ সালে শেষ হয়ে যায়নি। উনিশের এগারো শহিদের সঙ্গে তালিকায় নাম লিখিয়েছে বিজন চক্রবর্তী (১৭ আগস্ট ১৯৭২), জগন্ময় দেব আর দিব্যেন্দু দাস ( ২১ জুলাই ১৯৯৮)। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে প্রাণ দেন সুদেষ্ণা সিংহ (১৬ মার্চ ১৯৯৬)।
উপসংহার
আজ আসামে একদিকে ‘নাগরিকপঞ্জী নবায়ন’ ভাষিক বিভাজনের আশঙ্কায় দিন গুনছে লক্ষ লক্ষ বাঙালি। অন্যদিকে অকস্মাৎ নাগরিকত্ব বিল (সংশোধনী) ২০১৬-কে কেন্দ্র করে আসাম জুড়ে হিন্দু বাঙালি খেদানোর নতুন ধর্মজিগির। আসলে দীর্ঘ-দীর্ঘকাল জুড়ে অসমিয়া ও বাঙালির মধ্যে সম্পর্কের ফাটল এত বড় হয়ে গেছে যে বিজেপি’র ধর্মমিলনের ডাক দুপক্ষের কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। অতএব দুটো ক্লায়েন্টকেই খুশি রাখার জন্য বিজেপি সরকার (কেন্দ্র ও রাজ্য) দুটি গাজর ঝুলিয়েছে। হিন্দু অসমিয়াদের জন্য এনআরসি গাজর আর হিন্দু বাঙালির জন্য নাগরিকত্বের গাজর। বিজেপি’র নয়া খুড়োর কল।
ফলে উনিশে মে’র যা কিছু তাৎপর্য তা একে ঘিরে আবর্তিত হওয়া রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই সীমায়িত। উনিশে মে উদযাপন আসলে দেশকালব্যাপী যে ধর্ম ভাষা সংকট, তার সমাধানের লক্ষ্যে এক পা এগোনো। অমীমাংসিত, অবাঞ্ছিত কিছু প্রশ্নের উত্থাপন। রাষ্ট্রশক্তি আর তার বাহন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণশীলতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান। ধর্ম প্রসঙ্গে, ভাষা প্রসঙ্গে সারাক্ষণ ঢাকঢাক গুড়গুড় করার ফল এখন আমরা হাতেনাতে পাচ্ছি। হিন্দুত্বের ফ্যাসিবাদী বিপদকে, ইসলামের জঙ্গি বিপদকে বাঙালিপনার প্রতিষেধক টিকা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা মূর্খামি।
লেখক কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার।