কলকাতা মেডিকাল কলেজে হোস্টেলের দাবিতে আন্দোলন, ঘেরাও প্রিন্সিপাল, ক্যাম্পাসে ঢুকল পুলিশ


  • July 7, 2018
  • (0 Comments)
  • 2146 Views

১৮৪ বছরের পুরনো কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চলছে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদী অবস্থান, স্বচ্ছ অরাজনৈতিক হোস্টেল কাউন্সেলিংয়ের দাবিতে। এর মধ্যেই তাঁদের উপর নেমে এসেছে রাজনৈতিক ধামাধারী প্রিন্সিপাল ও পুলিশবাহিনীর অত্যাচার। এই আন্দোলন নিয়ে তাঁদেরই লেখা রিপোর্ট প্রকাশিত হল গ্রাউন্ড‌জিরোতে।

রুমেলিকা কুমার

ফের শিক্ষাক্ষেত্রে তৃণমূলী সন্ত্রাসের জোয়ার আছড়ে পড়ল কলেজ ক্যাম্পাসে। তাও আবার ডাক্তারি পড়ুয়াদের ওপর। গত ৬ জুলাই এই নির্লজ্জ বর্বর ঘটনার সাক্ষী রয়ে গেল মেডিক্যাল কলেজের শতাব্দীপ্রাচীন ক্যাম্পাস।

গত তিনবছর ধরে বারংবার আবেদনের পরেও কলেজের কোনোরকম হোস্টেল কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া নেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে দেখছি দেখব বললেও আখেরে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি কিছুই। ফলত হোস্টেল পায়নি কলেজের বর্তমান দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররা। জলপাইগুড়ি, মালদা, রায়গঞ্জ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দিনাজপুর প্রভৃতি দূর দূর জেলা থেকে আসা ছাত্ররা বারবার আবেদনেও হোস্টেল না পেয়ে বাধ্য হন মেসে বা পিজিতে চড়া মূল্যে থাকতে। আবেদনে টনক নড়েনি প্রাক্তন প্রিন্সিপাল কিংবা কর্তৃপক্ষের।

আর যারা হোস্টেল পেয়েছিল? শেষ যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হোস্টেল পেয়েছিল ফাইনাল ইয়ার এবং ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রদের একাংশ। মেইন বয়েজ হোস্টেল। সেই মেইন বয়েজ হোস্টেলের পাঁচতলায় সাময়িকভাবে বানানো ফলস সিলিং গত কয়েক মাসে চার-পাঁচবার ভেঙে পড়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে অনেকে। ছয়মাস মতো খারাপ ছিল বাথরুমের আলো। অনুরোধ সত্ত্বেও ছাত্রদের অবস্থা, হোস্টেলের সমস্যা দেখতেও যাননি হোস্টেলের সুপার কিংবা কর্তৃপক্ষের কেউই। PWD সাফ জানিয়ে দিয়েছে সাময়িক মেরামত আর সম্ভব নয়। কর্ণপাত করেনি কেউ। বাকি হোস্টেল গুলিরও অবস্থা তথৈবচ।

মেডিক্যাল কলেজে বর্তমানে বর্ষপ্রতি পড়ুয়া সংখ্যা ২৫০। যেখানে এমসিআই রেগুলেশন অনুযায়ী অন্তত ৭৫ শতাংশ পড়ুয়ার হোস্টেল পরিষেবা পাওয়ার কথা, সেখানে সব মিলিয়ে ২৫০ জনের ১০০ জন ও হোস্টেল পান কিনা সন্দেহ থেকে যায়। ছাত্রীদের ক্ষেত্রে অবস্থা আরোই শোচনীয়। প্রথম বর্ষের কোনো ছাত্রী হোস্টেল পান না। পুরুলিয়া, শিলিগুড়ি, উত্তর দিনাজপুরের ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হন তাই এলাকা সংলগ্ন মেস বা পিজিতে চড়া দামে থাকতে।

এমতাবস্থায় কিছুদিন আগে প্রিন্সিপাল উচ্ছল কুমার ভদ্র একটি নোটিশের মাধ্যমে জানান, নতুন যে ১১ তলা হোস্টেল বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, সেই হোস্টেলে কেবলমাত্র নতুন ভর্তি হতে আসা ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্ররাই জায়গা পাবে— অন্য কেউ নয়। আর সেই হোস্টেলের সুপার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে পার্থপ্রতিম মণ্ডলকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে কিছু কথা, কিছু ইতিহাস, কিছু ঘটনা জেনে নেওয়া প্রাসঙ্গিক, নইলে সমস্যাটা বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। পার্থ প্রতিম মণ্ডল— এনার একমাত্র পরিচয় ডাক্তার নয়। তিনি মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী, ছাত্রজীবনের ইতি ঘটেছে বেশ কয়েক বছর আগে। যোগ্যতা অনু্যায়ী তিনি এমবিবিএস পাশ— অথচ উচ্ছ্বল ভদ্রের সাক্ষর করা নোটিশ অনুযায়ী তিনি মেডিক্যাল কলেজ সি সি ইউ(ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট)-এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ন বিভাগের ডেপুটি ইন চার্জ। কার্যত সিসিইউ তাঁর সব পেয়েছির দেশ। কুকুরের ডায়ালিসিস কাণ্ডে খ্যাত নির্মল মাঝির ডানহাত, ছাত্রাবস্থায় কলেজ প্রাঙ্গণে তৃণমুলী গুণ্ডারাজের নেতা— মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এবং নির্মল মাঝির আশীর্বাদে স্বনামধন্য পার্থ প্রতিম মণ্ডল হতে চলেছেন আগামীর নিউ বয়েজ হোস্টেলের সুপার, যেখানে কিনা এমসিআইইয়ের নির্দেশ অনু্যায়ী সুপার হবেন বিভাগীয় প্রধান অথবা প্রফেসর। এ বাদ দিয়েও তিনি বর্তমানে সরকারী চাকরির পাশাপাশি অ্যাপোলোর সাথেও যুক্ত। নির্দেশিকা অনুযায়ী সরকারী পদে নিযুক্ত কোনও ডাক্তার বেসরকারী হাসপাতালে যুক্ত হতে পারেন না। কিন্তু ইনি পার্থ প্রতিম মণ্ডল— কলেজে প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে হুমকি ছাড়তে পারেন— স্যার এবারে কিন্তু ভোটটা হবে না। আইন-কানুন-নিয়মের উর্দ্ধে তিনি।

ঠিক এর উল্টোদিকে, প্রশ্ন করা হলে দেখানো হচ্ছে এমসিআইয়ের নির্দেশিকা। সেই দোহাই দেখিয়ে যেখানে এখনো বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী হোস্টেল না পেয়ে অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন, সেখানে ১১ তলার হোস্টেলে রাখা হচ্ছে কেবল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের। তাও পার্থর মত একটি শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধির দায়িত্বে। আর সুপার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্নে প্রিন্সিপালের উত্তর— I will have to find out. তিনি নাকি নোটিশটার অস্তিত্বই জানতেন না।

আসলে বুঝে নিতে হবে, এমসিআইয়ের নির্দেশিকা মেনে চলা শ্রেষ্ঠ মেডিক্যাল কলেজ বানানোর এই যুক্তি-ভাঁওতা। সেই লক্ষ্যপূরণ করতে হলে আরো অনেক সহজ এবং দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো বাকি রয়েছে, যা আসলে সহজেই সম্ভবপর (উদাহরণ— লাইব্রেরী ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা, ই লাইব্রেরীর ব্যবস্থা করা)। বরং এই নিয়ম আকস্মিক চালু করার পিছনে অন্য একটি উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার ভাবে হাজির হচ্ছে। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের প্রথম দিন কলেজে প্রবেশ করা মাত্র অচলায়তনে একা দরজা বন্ধ করে শাসকদলের মন্ত্রে দীক্ষিত করে ‘আমরা কিছু দেখিনি, আমরা কিছু জানি না, আমরা কিছু শুনিনি’ র বাহিনী বানানোই আসল উদ্দেশ্য।

এমতাবস্থায় কোনো উত্তর না পেয়ে ছাত্ররা বাধ্য হন অবস্থান করতে। দীর্ঘদিন ধরে হোস্টেল না পাওয়া ছাত্ররা ব্যাগ বিছানা বালিশ নিয়ে চলে আসেন জেনারেল কমন রুমে গত ২ জুলাই। সেখানেই চলতে থাকে তাঁদের পড়াশোনা, জীবন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্ররা পরীক্ষা দেন সেখান থেকেই। আগামী মাসে পরীক্ষা প্রথম বর্ষেরও। ৫ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৮০ ঘন্টা অবস্থানের পরও প্রিন্সিপাল উদাসীন থাকেন ছাত্রদের দুর্দশার প্রতি। বলেন— “u people don’t bother me”। কখনো বলেন “আমি তোমাদের কোনো দায়িত্ব নেব না”, আবার বলেন “তোমাদের ফার্স্ট ইয়ারের ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষতে দেব না”! সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কের ১৮৪ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী মেডিক্যাল কলেজে এরকম কথা রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া বলা যায় না— এ কথা পরিষ্কার।

এই অবস্থায় ছাত্ররা বাধ্য হয়েই ৫ জুলাই দুপুর তিনটে থেকে প্রিন্সিপালের রুমের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান শুরু করেন। প্রিন্সিপালকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবি তিনি এভাবে অগ্রাহ্য করতে পারেন না কোনোভাবেই। এরপরেই মেডিক্যাল কলেজ তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময় দেখে।

রাত ৮টার সময় প্রিন্সিপালের নির্দেশে প্রায় ৯০-১০০ জন উর্দিছাড়া পুলিশ ও গুন্ডা কলেজ ক্যাম্পাসে এসে মেডিক্যাল কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্লকের ভেতরে ঢোকে এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থানরত ছাত্রদের ওপর শুরু করে নির্মম অত্যাচার। একের পর এক চড়-ঘুঁষি-লাথি মারতে থাকে ছাত্রদের, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় প্রতিবন্ধী ছাত্রদের, উপস্থিত দুজন ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করতেও ছাড়েনি এই চটি-পুলিশের দল। টেনে হিঁচড়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয় ছাত্রদের, ছুঁড়ে ফেলা হয় তাঁদের কলেজ বিল্ডিংয়ের বাইরে। প্রায় ৪০ জন মেডিক্যাল পড়ুয়া আহত হন, যাঁদের মধ্যে ২ জন গুরুতর আহত। জখম হন প্রত্যেকেই। এরপর পুলিশ তৃণমূলের দালাল প্রিন্সিপালকে গাড়িতে নিয়ে চলে যায়।

মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এখনো হোস্টেলের ন্যায্য দাবিতে কমন রুমে অবস্থানে রয়েছে। অবস্থান আজ ১১০ ঘণ্টা পেরিয়েছে।

এই ধিক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে মেডিক্যাল কলেজে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মোমবাতি মিছিল করা হয় কলেজের মধ্যেই। অ্যাপ্রন পরে মিছিলে পা মেলান ডাক্তারী ছাত্রছাত্রীরা। সেই মিছিল দেখিয়ে দেয়, অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটলেও আমরা সবাই যদি নিজেদের আলো মিলিয়ে দিই, তাহলে সেই আলোই আমাদের পথ দেখায়। পথ দেখায় একসাথে থেকে নিজেদের দাবি লড়ে নেবার, পথ দেখায় সংগ্রামের, পথ দেখায় আগামীর।

আন্দোলনের বর্তমান দাবি হলো—

১) মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সমেত যেসকল ছাত্রেরা হোস্টেল পাননি তিনবছর ধরে, এবং যাঁরা পুরোনো হোস্টেলে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন, তাঁদের স্বচ্ছ ও অরাজনৈতিক হোস্টেল কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিনিয়রিটি ও দূরত্বের ক্রমানুসারে কলেজের প্রত্যেকটি হোস্টেল বিল্ডিংয়ে (উক্ত New Boys’ Hostel সহ) হোস্টেল অ্যাকোমোডেশন দিতে হবে।

২) উক্ত New Boys’ Hostel এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট কোনো তৃণমূলের এমবিবিএস পাস ছাত্রনেতাকে করা যাবে না। অন্যান্য হোস্টেলের মত এমসিআই রেগুলেশন অনুযায়ী কোনো অ্যাসোসিয়েট/অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর/হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টকে ওই হোস্টেলের সুপারের পদ দিতে হবে।

৩) ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকিয়ে মার খাওয়ানো প্রিন্সিপালকে অবিলম্বে জবাবদিহি করতে হবে এবং পদত্যাগ করতে হবে।

৪) অবিলম্বে কলেজ কাউন্সিল এর মিটিং ডেকে ছাত্র প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সমস্ত দাবিদাওয়া নিয়ে সুস্থ আলোচনা করতে হবে।

আগামী সোমবার ৯ জুলাই মহামিছিলের ডাক দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আহ্বান জানিয়েছেন ডাক্তার শিক্ষক ছাত্র ছাত্রী যুব বুদ্ধিজীবী গণতন্ত্রপ্রিয় সমস্ত মানুষকে।

ছবি – অবস্থানে থাকা ছাত্রছাত্রীদের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া

লেখক মেডিকাল কলেজের ইন্টার্ন এবং ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত।
Share this
Leave a Comment