প্রসঙ্গ: ভারতবর্ষে পরকীয়া বিষয়ক আইন


  • October 22, 2018
  • (1 Comments)
  • 2884 Views

গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট ‘পরকীয়া সম্পর্ক’ বিষয় রায় দিয়েছিল। পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ কর্তৃক ঘোষিত এই রায়ে  ইতিবাচকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। লিখেছেন উর্বা চৌধুরী

 

গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট ‘পরকীয়া সম্পর্ক’ বিষয়চরম রায়টি দিয়েছে, যার মূলগত ভিত্তি হল সংবিধানের তিনটি ধারা। ধারা ১৪, ধারা ১৫, ধারা ২১। গোটা রায়টিতে বারবার এই তিন ধারার উল্লেখ রয়েছে।

 

ধারা ১৪ অনুযায়ী, প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিক রাষ্ট্রর চোখে সমান এবং রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে সমানভাবে সুরক্ষিত রাখবে।

 

ধারা ১৫ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের কাছে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিক প্রতি সমান অর্থাৎ কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না।

 

ধারা ২১ অনুযায়ী, কোনো ভারতীয় নাগরিক তার জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। আইন প্রত্যেক নাগরিকের এই দুই অধিকারকে সুনিশ্চিত করবে।

 

সুপ্রিমকোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ কর্তৃক ঘোষিত এই রায়ে উপরোক্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অধিকারের উল্লেখ ইতিবাচকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই উল্লেখ দেখে মনে হয়, নাগরিকের অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম ও প্রেমজনিত প্রয়োজনকে একপ্রকার মৌলিক প্রয়োজন হিসাবে মান্যতা দিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট।

 

এই রায়টি কার্যত নারীপুরুষের যৌথ সম্পর্ককেন্দ্রিক। সে সম্পর্ক বৈবাহিক সম্পর্ক বা অবৈবাহিক সহবাস সম্পর্ক বা ‘পরকীয়া সম্পর্ক’ যাই হোক। কারণ এই তিনধরণের সম্পর্ক পরস্পরের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে। একটি ধরণের সম্পর্ককে কেন্দ্রে রেখে আলোচনা হলে তা অন্য দুটিকে টেনে আনবেই। তবে তা কেবল ‘কেন্দ্রিক’ই। এই যৌথ সম্পর্ক প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে আলোচনায় উঠে এসেছে নানা ধরণের সাংবিধানিক অধিকারের কথা, নাগরিকের মর্যাদার কথা, রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক দায়িত্বের কথা।

 

রায়টি খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, তার প্রতিটি বাক্য লিঙ্গ সমতা বিষয়টিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে, নাগরিকের জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরের বোঝাপড়ার প্রতি যেন তুলনায় যত্নশীল হয়েছে, নাগরিকের ব্যক্তিগত মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে আধুনিক মন নিয়ে ভাবতে পেরেছে। এমনকি প্রেম, যৌনতা, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ সর্বোপরি প্রেমঘটিত ‘সম্পর্ক’কে ভিন্ন সামাজিক চোখে দেখার কথা বলেছে।

 

পরকীয়া সম্পর্ককে কেবল এই রায়ে নয়, গোড়া থেকেই ‘যৌন সম্পর্ক’ দ্বারা আইনত সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। পরকীয়া সম্পর্ককে ‘প্রেম বিষয়ক’ এমনটা বোঝাতেই সম্ভবত প্রামাণ্য সূত্র হিসাবে ‘যৌন সম্পর্ক’ শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে।

 

রায়টি ‘পরকীয়া’ প্রসঙ্গ উথ্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে যা উল্লেখ করেছে, তা হল, নারী পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কে নারীটি তার পুরুষসঙ্গীর ‘সম্পত্তি’ নয়। সম্পর্কে অধঃস্তন অবস্থান কোনো সঙ্গীরই নয়, উভয়ই সমান। আগের আইনে পরকীয়া প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে যে, কোনো পুরুষ যদি কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে তার ‘স্বামী’-র সহমতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন তবে সেই যৌন সম্পর্ক ‘অপরাধ’ হিসাবে পরিগণিত হবে। পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় পরকীয়া সম্পর্কে লিপ্ত নারীটির ‘স্বামী’র অভিযোগের ভিত্তিতে, বিচার সাপেক্ষে পরকীয়ায় লিপ্ত পুরুষটির পাঁচবছর কারাবাস ও জরিমানাও হতে পারে। নতুন রায়ে পরকীয়া সম্পর্কে ‘স্বামী’-র সহমতিদানের বা তার অভিযোগের কোনো সুযোগই থাকছে না, কারণ, নতুন রায় অনুযায়ী পুরুষসঙ্গীটি আর নারীসঙ্গীটির ‘কর্তা’ নয়।

 

অপরদিকে, আগের আইনানুসারে ‘পরকীয়া’ নামক ‘অপরাধ’-এ জড়িত ‘নারী’টি কোনোভাবেই আইনের চোখে অপরাধী হত না। মনে করা হত যে, সে অপরাধী তো নয়ই, পরকীয়াঘটিত যৌনসম্পর্কের যে ‘অপরাধ’, তাতে স্বেচ্ছায় যোগদান করেও সে অপরাধে ‘যোগদানকারী’ বা ‘সাহায্যকারী’ বা ‘উৎসাহপ্রদানকারী’ও নয়। আপাত স্বস্তিকর এই ব্যবস্থাপনা নারীকে ‘অপরাধ’-এর শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করত বটে, তবে একই সঙ্গে অস্বীকার করত তার স্বাতন্ত্র্যকে, সামর্থ্যকে, বৌদ্ধিক যোগ্যতাকে, আত্মবিশ্বাসকে, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতাকে, এমন কি নাগরিক মর্যাদাকেও। সম্ভবত, মনে করা হত, যৌনসম্পর্কে প্ররোচনা দেওয়ার মতো উচ্চ বৌদ্ধিক স্তরের কাজ করতে পারে কেবল মস্তিষ্কধারী পুরুষ, নারী সেসবের যোগ্য নয়, নারী কেবল চালিত হতে পারে। অতঃপর সে শিশুর মতোই নির্বোধ, তাকে শাস্তি দেওয়া চলে না।

 

পুরানো আইনটি দর্শনগতভাবে সংবিধানের ধারা ১৪ ও ধারা ১৫-এর বক্তব্যের বিরোধী ছিল। একই ‘অপরাধ’-এ স্বেচ্ছায় অংশ নেওয়া নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে আইন সমান ছিল না, আইন একপ্রকার লিঙ্গবৈষম্য ঘটিয়ে একই পরিস্থিতিতে দুই নাগরিকের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করত। আবার পরকীয়ায় জড়িত বিবাহিত পুরুষটির স্ত্রীর অভিযোগ করার বা বিচার চাওয়ার যেহেতু কোনো উপায় থাকত না, তাই তার সুরক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করতে আইন ব্যর্থ হত।

 

২৭ শে সেপ্টেম্বরের রায় অনুযায়ী ‘স্বামী-র সহমতি’ বিষয়টির কোনো প্রাসঙ্গিকতা রইল না, কারণ নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কে পুরুষটি নারীর আইনসম্মত জীবনসঙ্গী হলেও দর্শনগতভাবে আর তার ‘স্বামী’ রইল না। তাহলে কি ‘স্বামী’-র সহমতি থাক বা না থাক ‘পরকীয়া’ সততই ‘অপরাধ’ হয়ে দাঁড়ালো? না! বরং উল্টো। এই রায় কেবল ‘নারী’-কে ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে দেখার মূলেই কুঠারাঘাত করল না, ‘পরকীয়া’-কে সার্বিকভাবেই আর ‘অপরাধ’ হিসাবে দেখতে রাজি হল না। বলা যেতে পারে, সম্পর্কের জটিল চলন গমনকে কোনোক্রমে সরলীকৃত করে ‘বিবাহ’ বন্দোবস্তে তার পরিণতি দেওয়ার গোঁজামিলের আইনিব্যবস্থায় ‘পরকীয়া’কে আইনের চোখে ‘অপরাধ’ হিসাব না দেখা একটি আশার ও দায়িত্বশীল দেখা।

 

রায়টিতে উল্লেখ আছে, সঙ্গীর সহমতিনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ‘পরকীয়া’ বিবাহকেন্দ্রিক একটি বিষয় যদিও তা দুটি মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এমতবস্থায় আইনের এ হেন ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রতিবিধানের উদযোগ করা বা অপরাধ হিসাবে দেখে তার বিচার করা একপ্রকারে সংবিধানের ধারা ২১ বিরোধী। নতুন রায় অনুযায়ী নাগরিকের জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার (ধারা ২১) সুনিশ্চিত করতে পরকীয়া প্রসঙ্গে আইন নাগরিকের জীবনের সঙ্গে যুক্তিযুক্ত দূরত্ব বজায় রাখবে এবং বিষয়টিকে কেবল বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্র হিসাবে গ্রাহ্য করবে। এক্ষেত্রে ‘যুক্তিযুক্ত’ বলতে সংবিধানের ধারা ১৪,১৫ ও ২১-কে মেনে যে দূরত্ব রাখা জরুরি তাকে বোঝানো হয়েছে। রায়ে এমন বাক্যের ব্যবহারও রয়েছে, যেখানে পুরানো আইনটিকে ‘সংবিধানের ধারা লঙ্ঘনকারী’ মায় ‘অসাংবিধানিক’ও বলা হয়েছে।

 

রায়ে নির্দিষ্টভাবে বলা আছে যে, যদি কোনো একজন সঙ্গী অপরজনের পরকীয়া সম্পর্কের জেরে আত্মঘাতী হন, তবে ‘পরকীয়া’ সম্পর্কটিকে আইনি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তবে সেক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রমাণ অাইনের সামনে রাখতে হবে যাতে আত্মঘাতীর মানসিক বা শারীরিক বিপর্যস্ত অবস্থার কারণ হিসাবে সঙ্গীর পরকীয়াকে দায়ী করা যায়, আত্মহত্যায় প্ররোচনা হিসাবে পরকীয়া সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত করা যায়। কেবল এক সঙ্গীর ‘পরকীয়া’ সম্পর্কের জেরে অপরজনের আত্মঘাতী হয়েছেন, এমন সরলরেখায় বিষয়টিকে দেখা হবে না। এক্ষেত্রে ‘পরকীয়া’ নয়, পরকীয়াজনিত কোনো ‘অপরাধ’ ঘটে থাকলে, সেটি ‘অপরাধ’ হিসাবে গ্রাহ্য হচ্ছে। যেমন, গৃহহিংসা বা অন্য যেকোনো স্বীকৃত ‘অপরাধ’।

 

মোটের উপর সুপ্রিমকোর্টের ২৭শে সেপ্টেম্বরের রায় আশাব্যঞ্জক। যদিও রায়টি বারকয়েক পড়লে একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন মনে আসে-

সংবিধানের ধারা ২১-কে মাথায় রেখে যদি পরকীয়া সম্পর্কে রাষ্ট্রের প্রবেশ অন্যায্য হয়, অনধিকার চর্চা হয়, তবে তো তা নাগরিকের জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের কারণেই, ফলত একাধিক পরকীয়ায় রাষ্ট্রের আপত্তি থাকছে না। অথচ বেশিরভাগ ধর্মেই একাধিক বিবাহে কিন্তু রাষ্ট্রের ঘোর আপত্তি। তাহলে ‘বিবাহ’ নামক বন্দোবস্তটি কি রাষ্ট্রের বিধিরীতির চারণভূমি? বিবাহ কি তবে এতটাই সামাজিক যে সেই চারণভূমিতে রাষ্ট্র চাইলেই যেকোনো অনুশাসনের স্তম্ভ পুঁতে দিতে পারে! স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আর কিছু তুচ্ছ বস্তুগত সুযোগ সুবিধার লেনদেন ছাড়া বিবাহে কি ব্যক্তিগত কিছুই নাই তেমন! বিবাহ কি তবে নিখাদ আইনি ‘চুক্তি’?

 

পুরানো আইনটির পক্ষসমর্থনে যা ছিল তা হল, ‘পরকীয়া অপরাধ’, কারণ তা বিবাহ প্রতিষ্ঠানটির পবিত্রতাকে ধাক্কা দেয়, প্রথাসিদ্ধ সমাজকাঠামোর স্থিতাবস্থাকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে পারে। বিস্ময়ের হলেও ইতিবাচক কথা হল, এই সব সম্ভাবনার কথা বারবার রায়ে উল্লেখ করা হলেও শেষতক সেগুলিকে একপ্রকার খারিজ করে কেবল তিনটি সাংবিধানিক ধারা মানার তাগিদেই এই রায় দেওয়া হয়েছে।

 

শুরুতেই লিখেছি, আলোচ্য রায়টি পড়ে মনে হয়েছে যে, প্রেম ও প্রেমজনিত প্রয়োজনকে একপ্রকার মৌলিক প্রয়োজন হিসাবে মান্যতা দিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট। ‘পরকীয়া’ সম্পর্ক প্রেম প্রসঙ্গে সাংবিধানিকভাবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার যেভাবে বুঝে পেল, তা অভিনন্দনযোগ্য! কিন্তু ‘বিবাহ’ কি পারবে কোনোদিন রাষ্ট্রের শ্যেন চোখ উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার বুঝে নিতে? সম্ভবত না। সাংবিধানিকভাবে সম্পত্তির অধিকার বিবাহ নিশ্চিত বুঝে নিয়েছে, নেয়, নেবেও। তবে সম্পত্তির অধিকার ‘সম্পর্ক’কে কতটা স্বস্তি দেয়, তা খুব সহজবোধ্য নয়! সম্ভবত সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তির প্রকৃত স্বাধীনতা সমানুপাতিক হারে এগোয় না!

 

সংবিধানের ৪৯৭ ধারাটি আংশিকভাবে নয় সামগ্রিকভাবে এই রায়ে আলোচিত। ফলে সংসদে নতুন আইন প্রস্তুত না হওয়া অবধি এই রায়ের ভিত্তিতেই পরকীয়া বিষয়ক আগামী মামলাগুলি বিবেচিত হবে। আবার সংসদ নতুন আইন নাও করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই রায়ই হবে ভবিষ্যতের বিচারেরর সময় প্রয়োজনীয় উপাদান। অর্থাৎ, ধারা ৪৯৭ আর এদেশে প্রযোজ্য নয়। ‘পরকীয়া’ আর অপরাধ নয়।

 

লেখিকা সর্বশিক্ষা মিশনে কর্মরত এবং সামাজিক কর্মী।

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Souvik Roy on January 8, 2022

    কোথায় আছেন অনেকজনই সার্থক দেখতে গিয়ে একজনের সার্থক তুচ্ছ করা যেতে পারে তাহলে এক স্বার্থ দেখতে গিয়ে অনেক জনস্বার্থ নষ্ট হচ্ছে কেন

Leave a Comment