চা গাছের প্রতিটি পাতায় লুকিয়ে আছে শ্রমিকের কান্না


  • July 16, 2018
  • (0 Comments)
  • 4465 Views

চা বাগানগুলিতে ২৩-২৫ জুলাই ধর্মঘট ডেকেছে কর্মী ইউনিয়নগুলির জয়েন্ট ফোরাম। ফোরামের অন্যতম প্রধান দাবি শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি কাঠামো চালু করা। ২০১৩ সালের ১৫ মে দেশে বাগিচা শিল্পে নূন্যতম মজুরি চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেরল, কর্নাটক, তামিলনাডুতে তা চালু হলেও এ রাজ্য ও আসামে তা হয়নি। এ ছাড়াও ২০১৪ সালের মার্চ মাসে মজুরি সংশোধনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিন বছরের জন্য মজুরি সংশোধন চুক্তি হয়ে থাকে। এবার শ্রমিকরা নূন্যতম মজুরি কাঠামোর দাবিতে অটল। শুক্রবার ১৩ জুলাই কলককাতায় নূন্যতম মজুরি সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি’র বৈঠকে শ্রমিক ও মালিক পক্ষ নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছে। ১৭ জুলাই শিলিগুড়িতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে বলে রাজ্যের শ্রম কমিশনার জানিয়েছেন। তবে না আঁচিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে রাজি নয় জয়েন্ট ফোরাম। এই প্রেক্ষিতেই দেখে নেওয়া যাক চা বাগান শ্রমিকদের বর্তমান হাল হকিকত। লেখক রুপম দেব

ভারতে রেলের পর সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান ঘটে চা শিল্পে। আর সংগঠিত এই চা শিল্পে শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। বিশেষত আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে চা শ্রমিকদের সমস্যা অত্যাধিক। ত্রিপাক্ষিক চুক্তির (মালিক,সরকার ও শ্রমিক সংগঠন) মাধ্যমেই চা বাগানে মজুরি স্থির হয়। ২০১৪ সাল থেকেই উত্তরবঙ্গে শ্রমিক সংগঠনগুলো জয়েন্ট ফোরামের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরির দাবি জানায়। এই লড়াইয়ে নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মত ছিল। তবে এক বছর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ একটি অন্তর্বতীকালীন হাজিরা চুক্তি মেনে নেয় শ্রমিক সংগঠনগুলি। চুক্তিতে ছিল তৃতীয় বছরে ১৩২.৫০ টা. হাজিরা পাবে উত্তরের চা শ্রমিকরা। একটি মিনিমাম ওয়েজ অ্যাডভাইসারি কমিটিও তৈরি হয়। ২০১৭ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে সরকার এককভাবে অন্তর্বর্তী কালীন ১৭ টাকা বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে শাসক দলের সংগঠন ও পাহাড়ের মোর্চার সংগঠন ছাড়া চা বাগানের সমস্ত শ্রমিক সংগঠন নূন্যতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন জারি রেখেছে। তবুও প্রশ্ন হল স্বাধীনতার ৭০ বছর পর চা বাগানের শ্রমিকরা বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপাদান থেকে কেন বঞ্চিত ? ১৯৪৮ সালে ন্যূনতম মজুরি আইন পাশ হলেও আজও যদি শ্রমিকদের ১৫৯ (সম্প্রতি রেশনের ৯ টাকা যুক্ত হয়েছে) টাকা হাজিরা পেতে হয় তাহলে এই কৃষিশিল্পে রাষ্ট্র, মালিক ও শ্রমিকের ভুমিকাকে নতুন করে বোঝার প্রয়োজন আছে।

চা শিল্প হল উপনিবেশবাদের ফলাফল। একে বরাবরই টি এস্টেট বলা হয়েছে। আর এই জমিদারি সম্পত্তিতে দুটো বিষয় খুব দরকার তা হল (ক) প্রচুর শ্রমিক ও (খ) বৃহৎ পরিমাণ জমি। এই শিল্পে যন্ত্রের ব্যবহার কম থাকায় একে শ্রমনিবিড় শিল্প বলা হয়। কাজেই স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী উভয় সময়েই মালিকপক্ষ রাষ্ট্রের প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ্য মদতে চা শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম রাখার প্রচেষ্টা করেই চলেছে। চা বাগিচা ঔপনিবেশিক অর্থনীতির উপাদান হওয়ায় আর পাঁচটা অর্থনীতির চেয়ে সে ভিন্ন এবং ঐতিহাসিক ভাবেই মালিকপক্ষ রাষ্ট্রের সাথে অনেক নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ফলত চা মালিকরা শুরু থেকেই চা বাগানে এমন পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে যা হল সভ্যতার একেবারে বাইরে এক অন্ধকারময় দ্বীপ। যেখানে দেশের আইনকানুন খুবই কম লাগু হয়।

চা বাগান পার্শ্ববর্তী উন্নয়ন:

কোথাও বৃহৎ শিল্প গড়ে উঠলে আশপাশের এলাকার উন্নয়ন ঘটবে তা পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়ম। শ্রমিকরা যে টাকা উপার্জন করবে তা দিয়ে তারা প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনবে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের বাইরে বাজার গড়ে উঠবে। তাকে ঘিরে তৈরি হবে জনবসতি। শিল্পকারখানা ও এলাকার সুবিধার্থে রাস্তাঘাট, রেলব্যবস্থা ইত্যাদি গড়ে উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক । তবে ডুয়ার্সের চা শিল্পে অনেক কিছুই উল্টোটা ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে ১৮৯১ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়কাল অব্দি অনিয়মিত ভাবে হলেও ধাপে ধাপে পুরুষ শ্রমিকের মাত্র ৪ থেকে ৬ আনা ও মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ আনা মজুরি বেড়েছে। ফলত শ্রমিকদের হাতে পয়সা এতই কম ছিল যে আশপাশে চা বাগানকে কেন্দ্র করে বাজার গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া বাগান মালিকরা পতিত জমি শ্রমিকদের চাষ করতে দিত বলে তাদের শুধু বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়নি। একটা সময়ের পর মালিক শ্রমিকদের খাদ্যদ্রব্য যেমন তেল, ডাল, ওষুধ দিত যা পার্শ্ববর্তী বাজার থেকে আসত না, আসত বড় বড় ট্রেডারদের কাছ থেকে যা আজকের উত্তরবাংলার বাইরে অবস্থিত ছিল। ১৮৭৫-এ ডুয়ার্সে চা বাগানের পত্তন ঘটে। ১৮৯৩ বেঙ্গল ডুয়ার্সে রেলওয়ে ভিত্তিপ্রস্তর হয়( ডামডিম-ওদলাবাড়ি-বাগড়াকোট ১৯০১-০২, মালবাজার-চালসা-মাদারিহাট ১৯০১-০৩)। তৎকালীন ডেপুটি কমিশনারের বক্তব্য ছিল রেললাইনগুলো লোকাল বাজারকে কেন্দ্র করে বসুক যার ফলে এলাকার উন্নয়ন ঘটবে। কিন্ত বাধ সাধে চা মালিকরা। তাদের বক্তব্য ছিল রেললাইন বসবে বাগানকে কেন্দ্র করে। যাতে উৎপাদিত চা সোজা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যায়। এলাকার রাস্তা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় জলপাইগুড়ির জেলা দপ্তরকে যার বেশিরভাগ সদস্য ছিল ইউরোপের বাগিচা মালিকরা। ফলত এর বেশিরভাগ বরাদ্দ টাকাই ব্যবহার হত চা বাগিচার রাস্তা তৈরিতে। এক্ষেত্রে “ডুয়ার্স উন্নয়ন” লক্ষ্য ছিল না। চায়ের অকশন সেন্টারও ছিল কলকাতায়। মালিকের লাভের ছিটেফোঁটাও এই অঞ্চলে পড়ত না। আশপাশের এলাকার উন্নয়ন না ঘটায় শ্রমিকরা কম পয়সায় কাজ করতে বাধ্য হত।

সূত্রঃ ইন্টারনেট।

বদ্ধ শ্রমিক:

আগেই বলেছি ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ফসল হল চা শিল্প। যেখানে সামন্ত অর্থনীতি হাতে হাত মিলিয়ে চলে। যেহেতু এই বাগিচা ব্যবস্থা জনবসতি থেকে অনেক দূরে ও বসবাসের অনুপযুক্ত জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে গড়ে ওঠে তাই শ্রমিকদের চলাচল আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। উত্তরবঙ্গ বা আসামে যেসব শ্রমিকদের আনা হয়েছিল তারা অনেকেই ছোটনাগপুর বা আজকের নেপাল থেকে আসা। স্বাভাবিকভাবেই একবার এসে গেলে ফিরে যাওয়ার অনেক অসুবিধা ছিল। আর এর সুযোগ নিত চা বাগিচার মালিকরা অমানবিক শোষণ করে। সেই সময় চা বাগিচার নিজস্ব আইন বলে বাগান ম্যানেজার অবাধ্য শ্রমিককে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করতে পারত। আইন মালিককে সেই ক্ষমতা দিয়েছিল। মালিকরা সম্মিলিত ভাবে বানিয়েছিল বেসামরিক বাহিনী। যার নাম ছিল “নর্থবেঙ্গল মাউন্টেড রাইফেলস”। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এরা সীমাহীন অত্যাচার চালিয়ে গিয়েছে। বাগিচামালিকদের ক্ষমতা এতটাই ছিল যে বন ও রেল দপ্তর চা শ্রমিকদের কাজে লাগাতে চাইলে চা মালিকরা তা প্রতিরোধ করে। মালিকদের অভিযোগ ছিল বন বা রেল দপ্তর বেশি মজুরি দিলে তাদের শিল্পে ক্ষতি হবে। স্বাভাবিকভাবেই সরকার তা মেনে নেয়। শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ করার আরো নানান উপায় মালিকরা বের করেছিল যেমন বিভিন্ন বাগানে শ্রমিকদের মধ্যে যোগাযোগ যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে জন্য প্রত্যেক বাগানের জন্য পৃথক পৃথক হাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল । এছাড়া সমস্ত অঞ্চলে রবিবার ছাড়া অন্যদিন যাতে হাট না বসে তার জন্য বাগিচা মালিকরা প্রশাসনের ওপর চাপ দিত। পতিত জমিতে শ্রমিকদের চাষ করতে দেওয়াও মালিকদের পক্ষে লাভজনক ছিল। কারণ এতে মজুরি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা কমেছিল। তা ছাড়া মজুত শ্রমিকদের জমি দিয়ে বাগানে রেখে দেওয়ার ফলে বাগানে শ্রমিকের অভাব থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল বাগান মালিকরা। আইন করে চা বাগানে চা ছাড়া বিকল্প অর্থনীতি গড়ে উঠতে না দেওয়াতে শ্রমিকরা বাধ্য হয়েই এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে এবং আছে। ফলত ২০০২ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর ডুয়ার্সে একের পর এক বাগান যখন বন্ধ হচ্ছিল তখন শ্রমিকদের যে মৃত্যু মিছিল আমরা দেখেছিলাম তার প্রধান কারণ ছিল যুগ যুগ ধরে তাদের অন্য কাজ শিখতেই দেওয়া হয়নি।

স্বাধীনতার পর চাবাগানের মানুষেরা যা পেল:

১৯৫১ সালে লেবার প্ল্যান্টেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে শ্রমিকদের ঘর, জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মালিকদের প্রদান করার আইন চালু হল। কিন্তু শ্রমিকরা তা পাচ্ছে কিনা বা না পেলে মালিকরা কি শাস্তি পাবে? তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই গেল। আপাতদৃষ্টিতে সরকারের তৈরি করা আইন উল্লেখযোগ্য মনে হলেও সরকারের তদারকির অভাবে বাগানের ম্যানেজার ও বাবুরা শ্রমিকদের কাছে মা-বাপ হয়ে ওঠে। সরকার চা বাগিচার জন্য ১৯৬০ সালে ওয়েজ বোর্ড তৈরি করে। এই বোর্ডের সুপারিশ জমা করতে ৫ বছর ৬ মাস লেগে যায়। বোর্ড মজুরি মাপদণ্ডের ক্ষেত্রে ৩ একক (শ্রমিক+স্ত্রী+ দুজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান) খরচের কথা বলে। মালিকপক্ষ প্রতিবাদ ক’রে বলে- যেহেতু বাগানে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই কাজ করে কাজেই তা ১.৫ একক হওয়া উচিত। সবচেয়ে লজ্জাজনক বিষয় হল সরকার ও ট্রেড ইউনিয়ন তা মেনে নেয়। ওই সময় পুরুষ শ্রমিকের মুজুরি ছিল ১.৯৮ পয়সা ও স্ত্রী শ্রমিকের ১.৮৪ পয়সা আর শিশুর ১.০৭ পয়সা কিন্তু চুক্তির ফলে ১৯৬৬ জানুয়ারি মাসে পুরুষ, স্ত্রী জন্য বাড়ে ১৩ পয়সা ও শিশুর জন্য বাড়ে ৭ পয়সা আর ৬ মাস পর পুরুষ ও স্ত্রী শ্রমিকের জন্য বাড়ে ২ পয়সা এবং শিশুর জন্য ১ পয়সা। স্বামী ও স্ত্রী কাজ করার মানে কি তারা দুজনে আধা আধা কাজ করে ? তা তো নয় ! পুরুষ বা স্ত্রী যদি একই ব্যাংকে বা স্কুলে কাজ করে তাহলে ১.৫ একক অনুসারে তারা আধা টাকা পাবে ? আমাদের তা মানতে কষ্ট হলেও চা বাগানের শ্রমিকরা এর প্রতিবাদ করতে পারেনি। কারণ স্বাধীনতার পর সরকার শ্রমিকের পাশে তো দাঁড়ায়ইনি বরং যে শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল তারাও কোনদিনও শ্রমিকদের হয়ে ওঠেনি।

চা শ্রমিকের ‘পানীয় জল’। ছবিঃ লেখক।

চা বাগান বানিয়াদের নিয়ন্ত্রণে:

দার্জিলিং চা বাগান প্রতিষ্ঠার মূখ্য ভূমিকা নেয় ব্রিটিশরা। ডুয়ার্সে ইংরেজ ও বাঙালি উভয়েরই ভূমিকা ছিল। তবে ব্রিটিশদের দ্বারা বাতিল করা জমিতে ভারতীয়রা চা বাগানের পত্তন করে। ঐ জমিগুলিকে বলা হত ওয়েস্ট ল্যান্ড। প্রথম দিকে এতে খাজনা দিতে হত না। দেশের প্রচলিত আইনকানুন ওয়েস্ট ল্যান্ডে প্রযোজ্য হত না। ফলত মালিক ও ম্যানেজারের রাজই চালু ছিল। যাই হোক ভারতীয়দের মধ্যে দুজনের নাম প্রথমে আসে। একজন বিহারীলাল গাঙ্গুলি। তিনি ছিলেন কাঠের ব্যবসাদার আর অন্যজনের নাম ছিল রহিম বক্স। ইনি ছিলেন জলপাইগুড়ি কোর্টের উকিল। এরা দুজন ১৮৯০ সালে তৈরি করেন আঞ্জুমান টি কোম্পানি। সেই সময় জলপাইগুড়ি উকিল, প্রোমোটার ও জোতদারদের মধ্যে চা বাগানের মালিক হওয়ার এক বিশেষ প্রবণতা দেখা দেয়। এর এক বিশেষ কারণ ছিল সস্তায় বৃহৎ জমি। পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বাবুরা মূলত এসেছিল আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি থেকেই। প্রাথমিক ক্ষেত্রে চায়ের অর্থনীতি কৃষিকাজ বৈশিষ্ট্য যুক্ত। মেশিনের ব্যবহার অল্প। সস্তা জমি ও সস্তা শ্রমিকের কারণে আরও আকর্ষণমূলক। চা এক নিরাপত্তামূলক বিনিয়োগ হওয়ায় ধীরে ধীরে মারোয়াড়িদের আগমন ঘটতে থাকে। তবে বাগান পত্তনের ৬০ ও ৮০ বছর পর নতুন গাছের রিপ্ল্যান্টেশন করা, বছরে ৮ মাস পাতা তোলার পর ৪ মাস গাছের পরিচর্যা করা এবং তারপর লাভের মুখ দেখার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন আছে। তবে চটজলদি মুনাফা ঘরে তোলার প্রবণতার কারণে উত্তরবঙ্গের চা শিল্প গভীর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। নানান ফাটকাবাজ ও বানিয়ারাই চা শিল্পের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বায়ন পরবর্তী এই ফাটকাবাজদের সংখ্যা আরো বেড়েছে।

যে ডানকানস গোয়েঙ্কা কোম্পানির চা বাগান নিয়ে বহু আলোচনা। তার ইতিহাস দেখলেই আমাদের অনেক কিছু পরিষ্কার হবে। স্বাধীনতার পর ১৯৫৯ সালে গোয়েঙ্কা পরিবারের প্রাণপুরুষ কেশব প্রসাদ গোয়েঙ্কা ডানকানস-এর মালিকানা কেনেন। এর পরেই নাম হয় ডানকান- গোয়েঙ্কা। কেশবের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ধনী মহাজন। কলকাতায় হিন্দু ব্যাংক চালাতেন। এদের চা বাগিচা চালানোর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে ঋণ দেওয়া ও টাকা মেটানোর মধ্য দিয়ে চটজলদি মুনাফা অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৯ সালে গোয়েঙ্কা পরিবারের ফাটল ধরে। ডানকানের মালিকানা আসে কেশরী প্রসাদের কনিষ্ঠ পুত্র জি. পি গোয়েঙ্কার হাতে। কর্পোরেট জগতে গোয়েঙ্কা পরিবারের বিশেষত্ব হল অন্য কোম্পানি কিনে নিয়ে নিজেদের ব্যবসার পরিধি বানানো। বিআইএফআর (বোর্ড অভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড ফাইনান্সিয়াল রিকন্সট্রাকশন ) স্পষ্ট জানিয়েছে ডানকানসের চা ক্ষেত্রে সংকটের কারণ চায়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় বরং ক্রমাগত লোকসানে চলা তাদের সার কারখানার কারণেই এই সংকট। সার কারখানার সমস্যা মেটাতে কোম্পানির প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। যা চা শিল্প থেকে পুঁজি সরিয়ে সার কারখানায় ঢালা হয়। আর এর ফলেই ডানকানসের ১৫ টি বাগান বন্ধ হয়ে যায়। শয়ে শয়ে মানুষ মারা যায়। বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা কাজের তাগিদে ছুটতে থাকে দেশের নানান প্রান্তে। মেয়েরা ঠাঁই পায় শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের ‘ঝি’ হিসেবে। শিশুদের দেখা যায় নদীতে পাথর তুলে বিক্রি করতে। কোর্টের অর্ডার সত্যেও আজও ৬ টা বাগান বন্ধ। আর বাকি গুলো ধুঁকছে ফলে ছবিগুলো আজও বদলায় নি।

বন্ধ ডানকান-এর বীরপাড়া চা কারখানা। ছবিঃ নিউজমিনিট

২০১৪ সালে ২২ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত সোনালি বাগানের মালিক রাজেশ ঝুনঝুনওয়ালা দীর্ঘদিন বেতন না দেওয়ার কারণে শ্রমিকের হাতে খুন হন বলে অভিযোগ। এরপর রাজেশ ঝুনঝুনওয়ালার সম্বন্ধে পত্রিকায় বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়। জানা যায়, ২০০৮ –এর ডিসেম্বরে বেনিয়াপুকুর থানার এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন দুঃ সময়ে পড়া চা বাগানের মালিক পরিচয় দিয়ে তার কাছে চাকরি নিয়েছিল রাজেশ। ঐ ব্যবসায়ীর ‘মিনারেল ওয়াটার’ সংস্থায় চাকরি পাওয়ার পরেই তার নাম জড়ায় তহবিল তছরপের ঘটনায়। পরে ঐ সংস্থার একটি গাড়ি কেনার সময়ে চেক বাউন্স করায় রাজেশের বিরুদ্ধে কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এছাড়া গ্যাংটকে একটি সরকারি অ্যামিউজমেন্ট পার্ক চালানোর দায়িত্ব নিয়ে সিকিম সরকারকে রাজেশ যে ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার চেক দিয়েছিল, সেটিও বাউন্স করেছিল বলে অভিযোগ। তালিকায় রয়েছে কলকাতার একটি সোনার দোকানে প্রতারণার অভিযোগ। পুলিশের দাবি, সব মিলিয়ে রাজেশের বিরুদ্ধে অন্তত ৩০ কোটি টাকার প্রতারণার অভিযোগ ছিল। ২০১০ সালের আগস্টে রাজেশ শ্রমিক সেজে পালাতে গিয়ে সিকিম- পশ্চিমবঙ্গে সীমান্তের রংপোয় গ্রেপ্তার হয়।

এসবই হল আজ বাগানের মালিকদের চেনা ছবি। চাল ব্যবসায়ী থেকে ক্রিমিনালরা সরকারের মদতে আজ চা- বাগান মালিক, এমন অভিযোগ রয়েছে। কালচিনির মধুবাগান থেকে শুরু করে বাগরাকোটের সোনালি বাগান এরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। ২০১৪ সালে চা বাগানের পরিস্থিতি নিয়ে বের হওয়া শ্রম দপ্তরের রিপোর্টেও বলা হয়েছে যে বেশ কিছু বাগান প্রোমোটারের দখলে, যাদের বাগান চালানোর দীর্ঘমিয়াদী কোনও পরিকল্পনা নেই।বাগানের সম্পদ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে মোটা টাকা নেওয়া ও তা না মিটিয়ে পালিয়ে যাওয়া। পুনরায় বিনিয়োগ না করা। পি.এফ, গ্র‍্যাচুয়িটু ও জমি রাজস্ব না দেওয়াই তাদের অধিকার বলে মনে করা। বোনাসের সময় বা গাছ পরিচর্যার সময়ে শ্রমিক অসন্তোষ দেখিয়ে বাগান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া তারপর সরকার ও শ্রমিক সংগঠনের সহযোগিতায় শ্রমিকদের পাওনাগন্ডা না মিটিয়ে ছয় দিনের কাজ করিয়ে তিন্ দিনের টাকা দেওয়ার শর্তে বাগান খোলা আর মালিক সংগঠনগুলো এর গালভরা নাম দেবে শিল্পসংকট। যেখানে ভারতের আভ্যন্তরীণ চাহিদা বর্তমান যোগানের চেয়ে বেশি। আর এই কারণেই চা পর্ষদ ৮০ দশকে চায়ের রপ্তানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দেয় এবং চা রপ্তানিতে ঊর্ধ্বসীমা ২০০ থেকে ২১৫ মিলিয়ন কেজিতে বেঁধে দেয়। এরপরেও আমাদের শুনতে হবে চা শিল্পে সংকট !! কারণ বানিয়ারা আমাদের তাই শিখিয়েছে ।

ট্রেড ইউনিয়ন:

একাংশ রেল কর্মচারীর চেষ্টায় প্রথম সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে চা বাগানে। স্বাধীনতার আগেও তেভাগা আন্দোলনে কৃষক ও চা বাগানে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৫৫ সালে মার্গারেটস হোপ চা বাগানে বোনাস, মাতৃত্বকালীন ছুটি চালু ও হাট্টাবাহার প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও ৬ জন শ্রমিকের শহিদ হওয়া আমাদের শ্রমিক সংগঠনের ইতিবাচক ভূমিকাকেও মনে করিয়ে দেয়। তবে ৮০ দশক থেকেই শ্রমিক সংগঠনগুলিতে ঘুণ ধরতে থাকে। আজ লোকমুখে খুব প্রচলিত যে চা বাগানের সমস্যার দুটি কারণ এক মালিক, দ্বিতীয় এক শ্রেণির শ্রমিক সংগঠন। চা বাগানে যে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা ওড়ে তার স্বাদ যে শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের এক বড় অংশ ভালোভাবেই পেয়ে থাকে তা অনেকেরেই জানা। মালিকপক্ষ বাগানে উৎপাদিত চায়ের যে বৃহৎ অংশ খোলা বাজারে বিক্রি করে তার দামের হিসেব আমরা কোথাও পাই না। অকশনে খারাপ গুণেরর চা পাঠিয়ে ভালোটা খোলা বাজারে পাঠিয়ে দেয়। অথচ এর সঠিক দাম জানার দাবি শ্রমিক সংগঠন কোনোদিন করেনি। বাগানে শ্রমিকরা আন্দোলন করলে ম্যানেজাররা খাতা খুলিয়ে দেখিয়ে দেয় বাগান সংকটে চলছে। শ্রমিক সংগঠনগুলি শ্রমিকদের তা মানতে বাধ্য করায়। অথচ গল্পটা বিপরীত। অকশন বাজারেও কারচুপি অত্যাধিক। ক্রেতা ও বিক্রেতা অনেকসময় একই। সুতরাং অকশনে চায়ের দাম ওঠেই না পরে দালালের মাধ্যমে তা চড়া দামে বিক্রি হয় । জনসমক্ষে প্রচার হয় চা শিল্প সংকটে। ‘ন্যায্য দাবি করলেই বাগান বন্ধ করে দেব’ এই ভয় থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করার চেষ্টা বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন কোনওদিন করেনি। উল্টো শ্রমিকদের উদ্যোগে ১৯৭৪ সালে জলপাইগুড়ি স্থিত সোনালি বাগানে সমবায় গড়া হলে বাম নামধারী শ্রমিক সংগঠনের নেতারা একে ভেঙ্গে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। ১৯৭৭ বাম সরকার আসার পর ১৯৭৮ সালে পুলিশি অত্যাচার ও সরকারের নেতিবাচক ভূমিকায় শ্রমিকরা তাদের সোনালি স্বপ্ন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। অথচ বিনা ব্যাংক বা সরকারি সাহায্য ছাড়াই সোনালি সমবায় ২০% বোনাস দিয়েছিল। যেখানে সেই সময় শ্রমিকদের সমস্ত বাগান শ্রমিকদের ৮% করে বোনাস প্রদান করে। শুধু তাই নয় সমবায় ব্যাংকে ৮ লক্ষ টাকা জমা করেছিল সোনালির শ্রমিকরা। সঠিক আন্দোলনের কৌশল সাজাতে না পারায় শ্রমিক সংগঠনগুলো আজ বাগানে শ্রমিকদের বিশ্বাস অর্জন করতে ব্যার্থ হয়েছে। শ্রমিকদের সামাজিক চেতনার মান উন্নয়নে শ্রমিক সংগঠনগুলো কোনদিন নিবিড় ভূমিকা গ্রহন করেনি। মদ্যপান ও জুয়াখেলার বিরুদ্ধে, কুসংস্কার ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে, ঝাড়ফুঁক মন্ত্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের বিরুদ্ধে এ যাবৎ কোনও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। এছাড়া চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলা হলেও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে মহিলাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। চা বাগানের প্রধান নেতৃত্ব এমন সব মানুষের হাতে যাদের সাথে চা বাগানের কোনও সম্পর্ক নেই।

রাষ্ট্রের ভূমিকা:

আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্গত বন্ধ বান্দাপানির শ্রমিকরা ভুটান থেকে আসা জল পান করে। নির্দিষ্ট করদানের মাধ্যমে যা ভুটান সরকারকে দিতে হয়। এমন ঘটনা আমাদের দেশে আর কোথায় আছে আমার জানা নেই, তবে এ থেকে পরিষ্কার রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ চা বাগানের শ্রমিকদের পূর্ণ মানুষের মর্যাদা বা তাদের অধিকার কোনওদিন দেয়নি। এখানে রাষ্ট্র যেমন নাগরিককে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে তেমনি চা বাগানের মালিকরা রাষ্ট্রের মধ্যে যেন আর একটা রাষ্ট্র তৈরি করেছে। বাগান বন্ধ হলে শ্রমদপ্তর ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকে তবু মালিক আসেন না। আবার ডাকেন। আবারও আসেন না। এমনও উদাহারণ আছে, বাগান খোলার মিটিং শ্রম দপ্তরে নয় মালিক সংগঠনের অফিসে হচ্ছে। কারণ মালিকপক্ষ শ্রম দপ্তরে আসতে চান না। পি. এফ দপ্তরে পি. এফ মেটানোর কথা বললে মালিকপক্ষ এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। মালিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই অবজ্ঞা করছে। শ্রম দপ্তরের নিজস্ব রিপোর্টেই প্রকাশ ৮৭ টি বাগানের কোন রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট নেই। তবুও বাগান চলছে।

পানীয় জলের পাইপ। ছবিঃ লেখক।

১৯৫১ সালের প্লান্টেশন অ্যাক্ট থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের অধিকার ও পঞ্চায়েতের দেওয়া প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট না হওয়ায় অধিকাংশ সময় লাভের গুড় মালিকরা খেয়ে নেয় অর্থাৎ জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্লান্টেশন অ্যাক্ট অনুসারে মালিকের প্রদান করা উচিত। অথচ পঞ্চায়েত বাগানে একই কাজ করায় মালিক এই অধিকারগুলো দেয় না।এর পরিবর্তে কোনও টাকাও দেয় না। অতীতে বাগান এফসিআই থেকে খাদ্যশস্য কিনে ৪০ পয়সা দরে পরিবারে কতজন শ্রমিক রয়েছে বা পুরুষ, মহিলা শ্রমিকের ভিত্তিতে খাদ্যশস্য দিত । খাদ্য দপ্তরের হিসেব অনুসারে এতে পরিবার পিছু বাগানের খরচ হত ৬৬০ টাকা অর্থাৎ ২৬ দিনের হিসেবে ২৫ টাকা। খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুসারে সরকার বাগানে রেশন দেওয়ার ফলে বাগান মালিকরা শ্রমিকদের যে রেশন দিত তা থেকে বঞ্চিত করতে থাকে। বাগানে ১০০০ শ্রমিক ধরলে এক বাগান থেকেই বছরে ৮০ লক্ষ টাকা লাভ করছে বাগান মালিক ।সম্প্রতি শ্রমমন্ত্রী ঘোষণা করেন, রেশনের পাওনা মালিকদের ১ মে থেকে মজুরির সঙ্গে দিতে হবে(আগের টাকার হিসেব আর রইল না) । তবে দিনে ২৫ টাকা নয় মাত্র ৯ টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিনের ১৬ টাকা কেড়ে নেওয়া হল আইনসিদ্ধ ভাবে। ফলত, আর এরই মাঝে ড: বিনায়ক সেন গবেষণা করে দেখিয়েছেন উত্তরের চা বাগানগুলোর ৪০ শতাংশ মানুষের বি এম আই (বডি মাস ইন্ডেক্স) ১৮.৫ এর নীচে (ওজন নেওয়া হবে কেজিতে এবং তাকে ভাগ করতে হয় উচ্চতায় (মিটার) বর্গ দিয়ে। ১৮.৫ কম হলে মানুষটি অবশ্যই অপুষ্টির শিকার) অর্থাৎ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী সেই স্থানগুলি দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চল। তাই চা পাতার রঙ সবুজ হলেও এদের জীবন রঙহীন- সাদাকালো। আমরা তাদের হাতে ১৫ আগস্ট জাতীয় পতাকা শুধু তুলে দিয়েছি তা ছাড়া যেন আর সবকিছুই কেড়ে নিয়েছি !

লেখক উত্তরবঙ্গে কর্মরত সামাজিক কর্মী।

Share this
Leave a Comment