আক্রান্ত শ্রমিক আন্দোলন : ঝাড়খণ্ড সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করল মজদুর সংগঠন সমিতি, গ্রেপ্তার সংগঠনের নেতারা


  • June 16, 2018
  • (0 Comments)
  • 3421 Views

আইনি ভাবে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নিষিদ্ধকরণ ও সংগঠকদের গ্রেপ্তারি এক বৃহত্তর প্রশাসনিক পরিকল্পনা সূচিত করে তা হ’ল যেকোনো নিপীড়িত জনতার প্রতিবাদের প্রচেষ্টাকে মাওবাদী আখ্যা দেওয়া এবং তার উপর পুলিসি ও আইনি অত্যাচার চালানো শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই একই পদ্ধতি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। টি.এন. লেবার-এ প্রকাশিত দুটি রিপোর্ট (http://tnlabour.in/news/6291http://tnlabour.in/news/6893) থেকে সংগৃহীত।

প্রথম পর্ব: এম.এস.এস.-এর নিষিদ্ধকরণ

২০১৭-র ২৭ ডিসেম্বর ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার মজদুর সংগঠন সমিতি (এম.এস.এস.)-কে ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সি.এল.এ.এ.)-এর আওতায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং এম.এস.এস.-এর ১০ জন পদাধিকারী সদস্যের নামে ঐ আইন ব্যবহার করে ভুয়ো মামলা দাখিল করে। রাশিয়ার বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এম.এস.এস.-আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত তেলুগু কবি ভরভারা রাও-কে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই ঘটনাকেই এই নিষিদ্ধকরণের পিছনে মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়। এই আমন্ত্রণই নাকি এটা প্রমাণ করে, যে এম.এস.এস. মাওবাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত! অভিযোগে এটাও বলা হয়, যে এম.এস.এস. এই অনুষ্ঠানের জন্য “বেআইনি ভাবে টাকা তুলেছে”। অথচ না ভরভারা রাও-এর নামের সাথে বেআইনি কিছু জড়িয়ে আছে, না জনতার সামনে তাঁর বক্তব্য রাখা নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে, না সংগঠনের সদস্যদের থেকে টাকা তুলে অনুষ্ঠান করার মধ্যে কোনো আইনি সমস্যা আছে। অতএব এই নিষিদ্ধকরণটিই আসলে এক বেআইনি পদক্ষেপ। নিষিদ্ধকরণের দু’মাস আগে থাকতে সংগঠনকে নিয়মানুযায়ী নোটিস দেওয়া হয়নি। তাছাড়া নিষিদ্ধকরণের অধিকার রয়েছে শুধুমাত্র রেজিস্ট্রার অফ ইউনিয়ন (সাধারণত লেবার ডিপার্টমেন্ট-এর ডেপুটি কমিশনার)-এর। এই নিয়মও মানা হয়নি। এই নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, সংগঠন নির্মাণ ও বাক্‌-স্বাধীনতা বিষয়ে সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার পথে আরও এক পা এগিয়ে গেল।

মজদুর সংগঠন সমিতি বা এম.এস.এস. ৩০ বছর ধরে ঝাড়খণ্ডে অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করে চলেছে একটি রেজিস্টার্ড সংগঠন হিসেবে। ১৯৮৫ সালে অ্যাডভোকেট সত্য নারায়ণ ভট্টাচার্যের প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটির রেজিস্ট্রেশন হয় করা হয় ১৯৮৯ সালে। এই সংগঠনে এই মুহূর্তে ২২,০০০ সদস্য আছেন, যাঁরা সকলেই অসংগঠিত শ্রমিক। ধানবাদের কয়লাখনি ও থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের শ্রমিক, কৃষি-শ্রমিক এবং শিখরজির তীর্থস্থানের কর্মচারীদের মধ্যে এম.এস.এস. সংগঠন গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। শ্রমিক, কৃষক ও আদিবাসীদের নানান প্রতিবাদ ও সংগ্রামে সহযোগিতা করার সাথে সাথে শ্রমিক ও আদিবাসীদের জন্য বিনা পয়সার হাসপাতাল তৈরি এবং একটি মাসিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে এম.এস.এস.।

৩০ বছর ধরে সম্পূর্ণ আইনি পথে শ্রমিক আন্দোলন চালিয়ে আসা এই সংগঠনটির নামে কোনোদিনই হিংসাত্মক ঘটনা বা এফ.আই.আর.-এর কোনো নজির নেই। তবে কেন হঠাৎ আজ এই সরকারি নিষেধাজ্ঞা? এর পিছনে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, এক, বিজেপি সরকারের শ্রম আইন সংস্কারের নামে শ্রমিকবিরোধী আইন চালু করার পরিকল্পনা ও তাতে বাধা দিতে পারে এইজাতীয় কট্টর শ্রমিক সংগঠনগুলিকে উপড়ে ফেলা; দুই, আদিবাসীদের জমি ও জীবিকা থেকে উচ্ছেদকারী ‘মোমেন্টাম ঝাড়খণ্ড প্রোগ্রাম’-কে ঠেকাবার যে আন্দোলন, তাতে এম.এস.এস.-এর অগ্রণী ভূমিকা। গত বছর যখন মতিলাল বাস্কে নামক এক শ্রমিক ঝাড়খণ্ড পুলিসের ‘ফেক এনকাউন্টার’-এ মারা যান, এবং তাঁর নামে মাওবাদী হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়, তখন এম.এস.এস. সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ও আইনি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়। ফলে দেশের নয়া-উদারনৈতিক ফ্যাশিবাদী সরকারের কাছ থেকে তার প্রতিক্রিয়ায় এর চেয়ে বেশি আর কি আশা করা যেতে পারে! নাৎসি জার্মানিতে একইভাবে শ্রমিক সংগঠনগুলিকে দমন করার চেষ্টা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে ইতিমধ্যেই একাধিক এইজাতীয় ঘটনা ঘটেছে। নব্বইয়ের দশকে অন্ধ্রের সিঙ্গারেনি কয়লাখনির শ্রমিকদের জঙ্গী ইউনিয়ন ‘সিকাসা’(SIKASA) যখন খনি শ্রমিকদের সাধারণ অধিকারের দাবিতে কর্মবিরতির ডাক দেয়, তখন (১৯৯২) তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও একটি সম্পূর্ণ আইনি ভাবে রেজিস্টার্ড সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা এই প্রথম। অথচ সমবেত ভাবে মুখর হওয়া তো দূরের কথা, বামপন্থী কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি (সি.আই.টি.ইউ, এ.আই.টি.ইউ.সি., ইত্যাদি) এর প্রতিবাদে একটি শব্দও উচ্চারণ করছে না।

এম.এস.এস.

দ্বিতীয় পর্ব: এম.এস.এস.-এর উপর নিপীড়ন, পদাধিকারী সদস্যদের গ্রেপ্তার

সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরেও এম.এস.এস.-এর প্রতি শ্রমিকদের সহানুভূতি ও সহযোগিতা কমেনি। হয়তো সেই কারণেই ২০১৮-র ৩১ মে এম.এস.এস.-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বাচ্চা সিং ও অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে অক্লান্ত ভাবে কাজ করে যাওয়া কেন্দ্রীয় সচিব দীপক কুমার-কে ঝাড়খণ্ড পুলিস গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বেআইনি ভাবে ৫৮ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়, এবং শুধুমাত্র নানান জায়গা থেকে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করার পরেই ৩ জুন তাঁদের কোর্টে নিয়ে আসা হয়। বাচ্চা সিং-এর নামে অন্তত ৫টি এফ.আই.আর. করা হয়েছে; তাঁর বিরুদ্ধে মুখ্য অভিযোগ মাওবাদীদের সহযোগিতা করার।

শ্রমিক-আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে যে দলগুলি, তাদের উপর ঝাড়খণ্ড সরকারের নিপীড়নের বহু উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ঝাড়খণ্ড বিস্থাপন বিরোধী জন বিকাশ আন্দোলন (জে.ভি.ভি.জে.ভি.এ), যার ছত্রছায়ায় ৩০টি উচ্ছেদ-বিরোধী সংগঠন কাজ করে, তার কনভেনর দামোদর তুরি-কে এম.এস.এস.-এর সংগঠক হবার সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেপ্তার করে, বেআইনি ভাবে ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট‘-এ আটকে রাখা, যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে। আসলে বিজেপি সরকারের তুরুপের তাস ‘মোমেন্টাম ঝাড়খণ্ড প্রোগ্রাম’, যা মাইনিং কোম্পানিগুলিকে এবং বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার অবাধ সুযোগ করে দেবার জন্য লাগু করা হয়েছে, জে.ভি.ভি.জে.ভি.এ. আর এম.এস.এস.-এর ভূমিকার কারণে তা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে – তাই এই লাগাতার নিপীড়ন। ঝাড়খণ্ড পুলিস খোলাখুলি ভাবে জানিয়েছে যে তারা সি.এল.এ.এ.-এর আওতায় ১৩টি “মাওবাদী সংগঠন”-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মাওবাদী আন্দোলনকে নির্মূল করতে চলেছে। কিন্তু আসলে যাদের নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তারা হল নাগরিক অধিকারবাদী সংস্থা ও শ্রমিক সংগঠনগুলি, যারা নয়া-উদারনৈতিকতাবাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে।

বাচ্চা সিং, দীপক কুমার, দামোদর তুরি প্রমুখ বহু সংগঠকের গ্রেপ্তারি, এম.এস.এস. ও এইজাতীয় অন্যান্য আইনি ভাবে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি এক বৃহত্তর পরিকল্পনা সূচিত করে। তা হল যেকোনো নিপীড়িত জনতার প্রতিবাদের প্রচেষ্টাকে মাওবাদী আখ্যা দেওয়া এবং তার উপর পুলিসি ও আইনি অত্যাচার চালানো। পুনেতে জাতিবিরোধী আন্দোলন এলগার পরিষদ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে দলিত ও অন্যান্য নিপীড়িত জনজাতির ন্যায্য অধিকার পেতে চাইলে তাঁদের এই প্রয়াসকে হিন্দুত্ববাদী বয়ানে মাওবাদী ষড়যন্ত্র বলে দাবি করার পাশাপাশি ৫জন মানবাধিকার কর্মীকে ইউ.এ.পি.এ. আইনে গ্রেপ্তার করা হয় – যাঁদের মধ্যে ৪ জন কিনা এলগার পরিষদের সাথে সম্পর্কিতই নন। বাচ্চা সিং-দীপক কুমারদের সাথে যা ঘটেছে, গড়চিরোলির মাইনিং কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে আদিবাসী আন্দোলনের সংগঠক মহেশ রাউত বা রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য আন্দোলনকারী রোনা উইলসন-এর সাথেও তা-ই ঘটেছে।

গত কয়েক দশক ধরে ভারত রাষ্ট্র তার নাগরিক অধিকার কর্মীদের মাওবাদী নাম দিয়ে বন্দী করার এই পদ্ধতি চালু করেছে। এটা বহুবার প্রমাণিত যে এই পদ্ধতি জাতীয় সন্ত্রাসের ছুতোয় জনমতকে ভুল পথে চালিত করার কাজ করছে। শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই একই পদ্ধতি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কোনো সূত্র ছাড়াই সংগঠনের নিষিদ্ধকরণ, সংগঠকদের অবাধ গ্রেপ্তার ও জামিন দিতে অস্বীকার করার ভিতর দিয়ে আসলে ইউনিয়ন ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনগুলিকে শাসানো হচ্ছে, যে নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থার সাথে টক্কর দিতে গেলে তাদের সাথেও এটা ঘটতে পারে – সহজেই। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস কোর্টরুমের বাইরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিতর দিয়ে সংগঠিত হবার ইতিহাস। আজ সেই কর্মপদ্ধতির সুযোগ ক্রমশ কমছে, যা শুধু শ্রমিক আন্দোলনকে নয়, গণতান্ত্রিক মতবাদকেই সমূহ বিপদের দিকে দ্রুত ঠেলে দিচ্ছে।

ফটো – TNLabour, Janjwar Newspaper

Share this
Leave a Comment