কবির ধর্ম


  • May 22, 2018
  • (0 Comments)
  • 5822 Views

কবির ধর্ম কি শুধু সৌন্দর্যের সাধনা? মানুষের জীবনমৃত্যু-সুখদুঃখ ভুলে গেলে সে কেমন সৌন্দর্য? মানুষ ও মানবিকতা যখন আক্রান্ত, তখন কবির ধর্ম প্রতিবাদে কলম ধরা। প্রয়োজনে পথে নামাও।

ঋত্বিক দাশ

ঠিক কী করা উচিত একজন কবির, যখন তার চারপাশে আক্রান্ত হয় মানবতা, সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ঢেকে ফেলতে থাকে পরিচিত প্রতিবেশ, আর ক্রমশ পালটে যেতে থাকে চেনা মুখগুলি? যখন সে দ্যাখে স্বাভাবিক, সহজ সম্পর্কগুলির বাঁধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে আর সেই ফাটলে মাথা তুলছে অবিশ্বাস, সন্দেহ আর শত্রুতার চারাগাছ, তখন, সেই অসহায় মুহূর্তে, কী করতে পারে সে? এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তার কি উচিৎ কবিতায় যে সুন্দরের, মহতের সাধনা সে এতদিন করে এসেছে তাতেই মগ্ন থাকা? নাকি প্রতিবাদে কলম ধরা উচিৎ, অংশ নেওয়া উচিত রাজনীতিতে, প্রয়োজনে পথে নামাও দরকার?

১৮২১ সালে লেখা একটি প্রবন্ধ ‘আ ডিফেন্স অফ পোয়েট্রি’-তে শেলি বলেছিলেন: “poets are the unacknowledged legislators of the world”। রোম্যান্টিক কাব্যদর্শন সঞ্জাত শেলির এই উক্তি কিছুটা অতিকথন নিশ্চই। সাহিত্যের যে অসীম ক্ষমতা তাকে সমাজ গঠনে বা তার কল্যাণসাধনের দিকনির্দেশনায় ব্যবহার করা যেতে পারে – এমনটাই বলতে চেয়েছিলেন তিনি। কবিতা, তাঁর মতে “The most unfailing herald, companion, or follower of the awakening of a great people to work a beneficial change in opinion or institution …” আর কবিরা হলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এবং ভবিষ্যতের রূপকার: “Poets are… the mirrors of the gigantic shadows which futurity casts upon the present”। ইংরাজিতে Poet শব্দটি এসেছে গ্রীক Poiein থেকে। যার অর্থ সৃষ্টি করা। অর্থাৎ, কবি (Poet) শব্দের আদি অর্থ সৃষ্টিকর্তা।শেলি কবিদের মূল্যায়নে এই আদি অর্থের ওপর জোর দিচ্ছেন। কবিমাত্রেই কল্পলোকের বাসিন্দা – এই বহুল প্রচলিত মিথটির মূলে আঘাত করছেন। তিনি কবিদের সমাজ গঠনের ও সংস্কারের সক্রিয় কারিগর হিসাবে দেখছেন। উল্লেখ্য, এই প্রবন্ধ রচনার দু বছর আগেই, ১৮১৯ সালে, শাসকের মদতে সংঘটিত পিটারলু হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে, অহিংস প্রতিবাদের ডাক দিয়ে শেলি লিখেছেন ‘দ্য মাস্ক অফ অ্যানার্কি’ নামক একটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কবিতা। অনেক সমালোচকের মতে যা ইংরাজি ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কবিতা:

Rise like Lions after slumber
In unvanquishable number—
Shake your chains to earth like dew
Which in sleep had fallen on you—
Ye are many—they are few.

ইংরাজি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি যিনি, সেই ইয়েটস সম্মুখীন হয়েছিলেন এই সমস্যার, এই দ্বন্দ্বের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে ইউরোপ তখন বিপর্যস্ত। মিস্টিসিজম, অকাল্টিজম আর মিথোলজির ছায়া-আবছায়া, মায়ালু পৃথিবী থেকে বাস্তবে ছিটকে পড়লেন ইয়েটস। বিহ্বল কবি ১৯১৫ সালে লিখলেন:

I think it better that in times like these
We poets keep our mouths shut, for in truth
We have no gift to set a statesman right

মাত্র একবছরের মধ্যেই অবশ্য ইয়েটস কাটিয়ে উঠবেন তাঁর এই দ্বিধা, সরাসরি কলম ধরবেন আইরিশ বিপ্লবীদের হয়ে, তাঁর বিখ্যাত ‘ ইস্টার, ১৯১৬’ কবিতায়। ‘All changed, changed utterly / A terrible beauty is born’ – এই বিখ্যাত পংক্তিতে তিনি হয়ত শুধুই সামাজিক পট-পরিবর্তনের আভাস দেননি, কবি হিসাবে তাঁর নিজের অবস্থান পরিবর্তনের কথাও বলেছেন।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এর পর থেকে ইয়েটস সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯২২ সালে আইরিশ ফ্রি স্টেটের সেনেটর নির্বাচিত হন।

কবির কলমের সামনে কতটা বিপন্ন হলে তাঁকে খুন করে শাসক মৃতদেহ গুম করে দেয়? না, কবিতা লিখে রাতারাতি যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়া যায়না। ক্ষুধার্ত মানুষের থালায় ভাতও এনে দেয়না কবিতা। কিন্তু জনমত তৈরি করা যায়।

ইয়েটসের সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কলাকৈবল্যবাদ ও বাস্তবমুখী কাব্যসৃজন সংক্রান্ত কোনো দ্বিধা দেখতে পাইনি আমরা। পরাধীন দেশের এক কবি, গীতিকার বা সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর অবস্থান কী হবে তা নিয়ে তাঁকে সংশয়ে ভুগতে হয়নি। চারপাশে ঘটে চলা অন্যায়গুলির বিরুদ্ধে তাঁর কলম সরব থেকেছে বরাবর। স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন: “… আমি যদি মনে করি, জগতের হাত এড়াইতে পারিলেই আমি অনন্ত লাভ করিব, তাহা হয়ত ভ্রম হইতে পারে। অনন্তের উপরে লাফ দেওয়া ত চলে না। আমাদের সমস্ত লম্ফঝম্প এইখানেই। এই জগতের উপরেই লাফাইতেছি, এই জগতের উপরেই পড়িতেছি। আর, এই জগতের হাত হইতে অব্যাহতিই বা পাই কি করিয়া?”

আধুনিক ইংরাজি কবিতার আরেক প্রধান রূপকার – উইস্টান হিউ অডেন ‘সেপ্টেম্বর ১, ১৯৩৯’ কবিতায় রাজনীতিকদের মিথ্যাচারের (‘lie of authority’) কথা বলছেন:

… what dictators do,
The elderly rubbish they talk
To an apathetic grave

তিনি বলছেন পরস্পরকে ভালোবেসে আরো ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকবার কথা: ‘We must love one another or die’। উচ্চারণ করছেন তাঁর সেই অমোঘ পংক্তি – ‘Hunger allows no choice’।

বিশ্ববিখ্যাত Poetry পত্রিকার প্রতিষ্ঠাত্রী-সম্পাদিকা হ্যারিয়েট মনরো, যিনি নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত কবি, ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা একটি সম্পাদকীয়তে যুদ্ধকে romanticize করবার জন্য কবিদের দায়ী করেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। এই ভ্রম সংশোধন করার দায়িত্ব তিনি ন্যস্ত করেছেন কবিদের কাঁধেই:

What is the fundamental, the essential and psychological cause of war? The feeling in men’s hearts that it is beautiful. And who have created this feeling? … poets with their war-songs and epics … the feeling that war is beautiful still lingers in men’s hearts, a feeling founded on world-old savageries—love of power, of torture, of murder, love of big stakes in a big game. This feeling must be destroyed, as it was created, through the imagination. It is work for a poet.

তবে সব কবিই রবীন্দ্রনাথ, শেলি বা মনরোর মত সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে কবিতার বা কবিদের কোনো সদর্থক ভূমিকা আছে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। ব্রিটিশ কবি বেসিল বান্টিং তো মনে করতেন কবিদের রচনা বা ভাবনার ক্ষেত্রটি খুবই সীমিত, কাব্যিক পরিসরের বাইরে তাঁদের কোনো লেখা, কোনো মন্তব্যের বিশেষ মূল্য নেই। ভিয়েতনামে মার্কিনী আগ্রাসনের প্রতিবাদে তাঁর কাছ থেকে কবিতা আহ্বান করা হলে চিঠিতে তিনি তাঁর অপারগতা জানিয়ে লিখেছিলেন:

There’s not a soul who cares twopence what I or any other poet thinks … We are experts on nothing but the arrangements and patterns of vowels and consonants, and every time we shout about something else we increase the contempt the public has for us.

আরেক ব্রিটিশ কবি মাইকেল হ্যামবার্গারও অনুরূপ মত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসাবে কবিতা তেমন যুৎসই নয়। যাদের হয়ে এই প্রতিবাদ আর যারা এই প্রতিবাদের লক্ষ্য – তাদের কারোর কাছেই পৌঁছতে পারে না কবিতা। প্রতিবাদ হতে পারে শুধুমাত্র রাস্তায় নেমে। নিতান্তই লিখে প্রতিবাদ জানাতে হলে গদ্যই উপযুক্ত মাধ্যম। খানিকটা এই দলেই পড়বেন টি. এস. এলিয়ট-ও। আধুনিক ইংরাজি কবিতার অন্যতম স্তম্ভ এলিয়ট ১৯৪৩ সালে একটি বক্তৃতায় বলছেন: “একজন কবির দায়িত্ব আগে ভাষার প্রতি, তারপর মানুষের প্রতি। ভাষার সংরক্ষণ, পরিবর্ধন ও সর্বোপরি ভাষার উন্নতিসাধনই তার প্রাথমিক কর্তব্য।” সমালোচকের মতে কবি হিসাবে ইলিয়ট সর্বদাই “relatively indifferent, or uninterested, observer of the phenomenal world”।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বান্টিং বা হ্যামবার্গারের মত নৈরাশ্যবাদী নই। ইতিহাস আমায় আশাবাদী হতেই ভরসা দেয়। আমাদের দেশে, বিশেষত বাংলায়, রাজনৈতিক কবিতা রচনার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যর নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মর্তব্য। তিনজনেই সক্রিয় বাম রাজনীতি করেছেন। কৃষকের, শ্রমিকের দৈনন্দিন যাপনের, সংগ্রামের শরিক এঁরা। এঁদের কবিতার ভাষা শ্রমজীবী মানুষের মুখের ভাষা – সরল, দ্ব্যর্থহীন অথচ রাজনৈতিক ইডিয়মে পূর্ণ। এঁদের লেখা সমকালের জীবন্ত দলিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় কিছু পংক্তি “রাস্তাই একমাত্র রাস্তা”, “ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে”, “ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত”, “ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে ছেলে গেছে বনে” ইত্যাদি তো বাংলা বাগধারার অন্তর্গত হয়ে গেছে। মানুষের যন্ত্রণা আর সমস্যা তাঁর কাব্যে উঠে এসেছে কোনো ভণিতা ছাড়াই:

বেকার ছেলেগুলো চোখের মাথা খেয়ে
আর কিছু না পেয়ে
কাজে না-লাগা হাতগুলোই
আগুনে পোড়াচ্ছে।

বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের “রাজা আসে, রাজা যায়” কবিতাটি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার তথা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চালচিত্রের ওপর একটি অনন্য কমেন্টারি:

রাজা আসে যায়   রাজা বদলায়
নীল জামা গায়     লাল জামা গায়
এই রাজা আসে    ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের     রং বদলায়
দিন বদলায় না

আশ্চর্যের বিষয়, বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা কোনো বড় পত্রিকায় কখনো ছাপা হয়নি। মানুষের মুখে মুখেই ছড়িয়ে গিয়েছে তাঁর লেখা। অনেক কবিতা সুরারোপিত হয়ে গানের রূপ পেয়েছে।

সুকান্ত ভট্টাচার্যর কলমে উঠে এসেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলির কথা। রয়েছে সর্বহারা, শ্রমজীবী মানুষের উত্থানের কথা। নীচের কবিতাটি লেখা হয়েছিল নৌবিদ্রোহের পটভূমিতে। যদিও গান হিসাবেই এটি বেশি পরিচিত:

বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,
আমি যাই তারি দিন–পঞ্জিকা লিখে,
এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ,
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ ;
স্বপ্ন–চূড়ার থেকে নেমে এসো সব —
শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব?
নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট,
রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদ–পট।
প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত,
দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত…

আর নজরুল, কবি হিসাবে যাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বাটিই বরাবর প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, নিজের মূল্যায়ন করছেন এই বলে: “… আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা কিছু মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।” রবীন্দ্রনাথের মত তাঁর মধ্যেও নিজের অবস্থানঘটিত কোন দ্বন্দ্ব ছিলনা। গানে, কবিতায় অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই আর হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যসাধনের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা – দুই-ই অব্যাহত ছিল তাঁর লেখকজীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

বিশিষ্ট সমালোচক ডেভিড ও’র ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘The Politics of Poetry’ শীর্ষক প্রবন্ধে মতপ্রকাশ করেছেন: ‘আজকের কবিরা রাজনীতি নিয়ে লিখুন বা না লিখুন, তাঁরা অবশ্যই রাজনীতি সচেতন’। কবি-সাহিত্যিকরা সমাজের বাইরে কোন নিরুপদ্রব তপোবনের বাসিন্দা নন। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটগুলি সাধারণ মানুষের মত তাঁদেরও প্রভাবিত করে। সাধারণ মানুষদের মত তাঁদেরও এক অংশ নিজের মত করে প্রতিবাদ করেন, কেউ করেন না। একথাও ভুললে চলবে না, কখনো কখনো রাজনীতির কথা সরাসরি কবিতায় তুলে না আনাই হয়ত সেরা প্রতিবাদ, আবার কখনো হয়ত উল্টোটাই সত্যি। ডেভিড মনে করিয়ে দিচ্ছেন মানুষকে প্রণোদিত এবং প্রভাবিত করবার স্বাভাবিক ক্ষমতা রাজনীতিক এবং কবি এই দু পক্ষেরই রয়েছে: “It’s important to note first that poetry and politics are both matters of verbal persuasion—that is, both have strong connections to the art of rhetoric. Admittedly, poets and politicians are typically trying to persuade us of very different things”। কিন্তু একটু হলেও কি কবিরা এগিয়ে থাকবেন না এই ‘verbal persuasion’-র প্রতিযোগিতায়? তা নাহলে, কিভাবেই বা ব্যাখা করব পাবলো নেরুদা নামের রূপকথাকে বা ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা নামের কিংবদন্তিকে? একজন কবিকে (নেরুদা) কতদূর ভয় পেলে অত্যাচারী শাসক তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাধা দিতে কারফিউ জারি করে আর মানুষ সেই বাধা অগ্রাহ্য করে ভিড় জমায় কবির শেষ যাত্রায়? কবির কলমের সামনে কতটা বিপন্ন হলে তাঁকে (লোরকা) খুন করে শাসক মৃতদেহ গুম করে দেয়? না, কবিতা লিখে রাতারাতি যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়া যায়না। ক্ষুধার্ত মানুষের থালায় ভাতও এনে দেয়না কবিতা। কিন্তু জনমত তৈরি করা যায়। ভালো-মন্দ চিনতে মানুষকে সাহায্য করা যায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস জোগানো যায়। আর এই সবের মাধ্যমেই এই লক্ষ্যগুলো পূরণ করবার একটা রাস্তা তৈরি হতে থাকে। সাম্প্রতিক অতীতেই তো আমরা দেখেছি কিভাবে আমাদের শহরের একটি সফল ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল শ্রীজাতর একটি কবিতা (‘তুমিও মানুষ আমিও মানুষ/তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়’)। দেশে-দেশে, যুগে-যুগে সংগ্রামী মানুষের সহযোদ্ধা হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লোরকা, হোসে মার্তি বা নেরুদার কবিতা; ব্রেশটের আর সফদর হাশমির নাটক; জন লেনন, পিট সিগার, পল রোবসন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস আর সলিল চৌধুরির গান।

জীবনের অন্যান্য নানা বিষয়ের মতই রাজনীতি এবং সাহিত্য – উভয়ের বিকাশের পথই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে। সাদা-কালোর, ভালো-মন্দের, ‘To be’ আর ‘not to be’-র দ্বন্দ্ব। শাসকের প্রলোভন, হুমকি, অত্যাচার আর তার পাশাপাশি সচেতন, সহমর্মী সাহিত্যের প্রচেষ্টার দ্বন্দ্ব। নজরুল ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’-তে লিখছেন: “… আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্তানের পথে তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি।” সত্যের পথ, সুন্দরের পথ, অনন্তের পথ চিরকালই আমাদের সাদামাটা, কেজো পৃথিবীর ধুলোবালিভরা পথের মধ্য দিয়ে। সেখানে “নিবিড় ব্যথার সাথে পদে পদে পরমসুন্দর/পথে পথে মেলে নিরন্তর”। দোষগুণ, দুঃখতাপে ভরা এই জগতের আলেখ্য রচনাই তো কবির কাজ – “এ বিশ্ব তো তারি কাব্য, মন্দাক্রান্তে তারি রচে টীকা/বিরাট দুঃখের পটে আনন্দের সুদূর ভূমিকা”। এই বৈপরীত্যের সাধন ও উদযাপনই কবির দর্শন, কবির ধর্ম।

ছবি – https://www.poetryfoundation.org/ ও অন্যান্য

ঋত্বিক দাশ পেশায় তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, নেশায় সাহিত্যপড়ুয়া।
Share this
Leave a Comment